” ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইআরসিপিএইচ, স্টেশন রোড, টঙ্গী, গাজীপুর কেন্দ্রের অভ্যন্তরে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল প্রেস ও কৃত্রিম অঙ্গ উৎপাদন কেন্দ্র (বিপিএএলসি) স্থাপিত হয় । কৃত্রিম হাত-পা, ক্র্যাচ, ব্রেইস, স্ট্রিক তৈরী করে স্বল্প মূল্য, বিনামূল্য প্রতিবন্ধীদের চাহিদা অনুসারে সার্ভিস ও মেরামত সুবিধা দেয়া হয়।”
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা সম্পর্কে পর্যালোচনা করেছে অঙ্গন৷ একদম গোড়া থেকেই ধারণা নিয়েছে সে। শুরু থেকে প্রণয় যে ডক্টরের চিকিৎসাধীন রয়েছে তার সহায়তায়, বিভিন্ন ডাক্তারদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো, যত টাকাই লাগুক প্রণয়কে সে দু’পায়ে দাঁড় করাবেই। আম্মা, নতুন ভাবি, ভাতিজি “সুখের” কাছে পঙ্গু প্রণয় নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ প্রণয়’কেই হাজির করবে। তাই নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করল।
বর্তমান সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। একজন প্রাক্তন চিকিৎসক হিসেবে এ বিষয়ে অন্যদের তুলনায় অধিক জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ প্রণয়। তার ছোট ভাই তাকে সুস্থ করার জন্য, দু’পায়ে দাঁড় করানোর জন্য এতটাই মরিয়া হয়ে ওঠেছে যে মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেছে সে কত গুণবান একজন ডক্টর ছিল! কৃত্রিম পা’য়ের ব্যাপারে প্রণয় বড়ো উদাসীন। অনেক বুঝিয়েও তাকে রাজি করাতে পারল না অঙ্গন। বেশি জোরাজোরি করাতে প্রণয় বিরক্তি প্রকাশ করল। বলল,
-‘এত বাহানা না করে সরাসরি বলেই ফেল, আমি অসুস্থ! একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী আমি! বড়ো ভাই’কে প্রতিবন্ধী হিসেবে দেখতে তোর সম্মানে লাগছে।’
কণ্ঠে ক্রোধ, বিরক্তিবোধের চেয়ে অভিমানটাই যেন বেশি ছিল। বুঝতে কষ্ট হলো না অঙ্গনের। মুহূর্তেই মাথা নুইয়ে ফেলল অপরাধী সুরে বলল,
-‘আম্মা, নতুন ভাবি তোমার এই অবস্থা সহ্য করতে পারবে না ভাই। আমি তোমাকে একদম সুস্থ করে ওদের সামনে নিয়ে যেতে চাই। নতুন ভাবির জন্য হলেও তুমি রাজি হও প্লিজ।’
চোয়ালজোড়া শক্ত করে প্রণয় জবাব দিলো,
-‘আমি আমার জন্মদাত্রী, প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গিনী, কলিজার টুকরো সন্তানের সামনে কোন কৃত্রিম অঙ্গের সাহায্যে দাঁড়াতে চাই না।’
থামলো প্রণয়। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে পুনরায় বলল,
-‘আমার দু’টো পা নেই এতে আফসোস নেই। আমি আজো মাথা উঁচু করে বসে থাকতে পারি। দাঁড়িয়ে আছি না বসে আছি সেটা বড়ো কথা নয়। মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি এটাই বড়ো কথা। শত্রুপক্ষ কে জানি না৷ শুধু জানি তারা তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পারেনি৷ পারবেও না। কারণ আমি আমার ভালোবাসার জন্য লড়াই করছি। ভালোবাসার লড়াইয়ে বিপক্ষ দল’রা কখনোই জিততে পারে না।’
মাথা তুলল অঙ্গন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সে। তার মুগ্ধতায় ভরা দৃষ্টিজোড়া দেখতে পেয়ে ম্লান হাসলো প্রণয়। বলল,
-‘আমি মরে যাইনি ভাই। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে হালে রেখেছেন এতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি কোন কৃত্রিমতা নিয়ে ওর কাছে ফিরতে চাই না। বরং সৃষ্টিকর্তা আমায় যেটুকু দান করেছেন সেটুকু নিয়েই বীরের মতো মাথা উঁচু করে যেতে চাই। পেছনে শত্রু যেই থাকুক সে আমার মাথা নুয়াতে পারেনি। আমি প্রণয় চৌধুরী, যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, যতকাল এ পৃথিবীতে থাকব ঠিক ততদিন, ততকাল মাথা উঁচু করে বীরের মতো বাঁচব!’
__
প্রণয় এবং রমেশের বিশেষ বন্ধু জুবায়ের। তার
বড়ো ভাই এসপি মনজুরুল হক। জুবায়েরের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে রমেশ এবং অঙ্গন। এস আই সারিম প্রণয়ের বিরুদ্ধে করা মামলাটির দায়িত্বে ছিল। তাকে কন্ট্রোল করছিল ওসি কাসেম মির্জা। যিনি রোমানার বাবা মাজহারুলের বিশেষ বন্ধু। ক্ষমতা এবং অর্থ এ দুটোর প্রয়োজনীয়তা এবার হারে হারে টের পাচ্ছে অঙ্গন৷ আজ এ দু’টো আছে বলেই কৌশল খাঁটিয়ে টাকা ছড়িয়ে এসপি’কে হাত করে নিলো সে।
দু’দিনের মধ্যে কাসেম মির্জার থেকে প্রণয়ের বিরুদ্ধে করা মামলার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিলো, এসপি মনজুরুল হক৷ তৃতীয় দিন রঙ্গনের বিষয়টা পুরোপুরি ক্লোজ করে দিলো৷ আদালতে এটাই প্রমাণিত হলো, অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে স্ট্রোক করে মৃত্যু ঘটেছে তার। বাকি রইল পলাশ হত্যা, এ নিয়েও বিশেষ কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হলো৷ এবার যথাযথ স্বাক্ষীর প্রয়োজন।
এ পর্যন্ত সবটাই গোপন রইল৷ কাসেম মির্জার মুখও বন্ধ করা হলো। প্রণয় জীবিত। সে সুস্থ হয়ে ওঠেছে। কিন্তু এ খবর গোপন রইল। আদালতে পেশ করা হলো, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে প্রণয় চৌধুরী। ভয়াবহ এবং সন্দেহজনক এক্সিডেন্টে দু’টো পা হারিয়ে আজ সে পঙ্গু। পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও তার আজ নেই। তাই প্রসাশনকে নিশ্চিন্ত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। তবে মামলা চলবে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রণয় পক্ষের উকিল আদালতে উপস্থিত থাকবে। সব কিছু গোপন করার চেষ্টা করলেও কিছুই গোপন থাকল না৷ পাঁচফোড়ন গৃহের গুটিকয়েক মানুষ’দের কানে ঠিক পৌঁছে গেল। সমস্তটাই জেনে গেল পল্লব, শবনম, অরুণা৷ শুধু প্রেরণা, মুনতাহা, শাহিনুর আর সকল ভৃত্য’রা কিছুই জানতে পারলো না৷ ওদিকে মাজহারুল ইসলাম মুনতাহার সঙ্গে যোগাযোগ করে সবটাই জানিয়ে দিলো। রঙ্গনের কেস ক্লোজ, প্রণয় জীবিত সমস্ত’টা জেনে হিংস্র হয়ে ওঠল তারা। মাজহারুল বার বার মুনতাহাকে স্মরণ করে দিলো, কোন মতে, কোন পরিস্থিতিতে যেন সে পিছিয়ে না যায়৷ এখনো প্রণয় পুরোপুরি নির্দোষ প্রমাণিত হয়নি। মাজহারুলের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বদ্ধ উন্মাদের মতো বাইজি গৃহে ছুটে গেল মুনতাহা। শাহিনুর তখন সুখ’কে ঘুম পাড়িয়ে কাপড় ভাঁজ করছিল। হঠাৎ মুনতাহা দ্বারে করাঘাত করল৷ শাহিনুর জিজ্ঞেস করল,
-‘বড়ো ভাবি?’
-‘আমি।’
চমকে উঠল শাহিনুর। কয়েক পল নীরব থেকে বলল,
-‘অপেক্ষা করুন।’
এক মিনিট পর দরজা খুলল সে। মুনতাহা ভেতরে প্রবেশ করতে করতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-‘এত সময় লাগে?’
শাহিনুর চাপা নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। কিছুই বলল না৷ মুনতাহা পালঙ্কে গিয়ে বসে পা দুলাতে শুরু করল। চোখ,মুখ বেশ বিধ্বস্ত লাগছে। এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলো শাহিনুর৷ মুনতাহা কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল,
-‘কেন এসেছি জানতে চাইছ না কেন?’
কাপড় ভাঁজ করে বিশাল পালঙ্কের একপাশে রেখে ম্লান হাসলো শাহিনুর। মুনতাহার শরীর জ্বলে ওঠল৷ গর্জে ওঠে বলল,
-‘খুব সুখ তাই না?’
এ পর্যায়ে শাহিনুরের চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখা দিলো। প্রণয়ের চিঠি পাওয়ার পর থেকে অনেকটাই নিশ্চিন্ত রয়েছে সে। বুকের ভিতর এখন আর যন্ত্রণা হয় না। তবে অভিমান জমে আছে। তার যে মিথ্যুক স্বামী। ‘এই যাব এই আসব’ বলে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিলো৷ তবুও এলো না৷ কবে আসবে তাও জানে না৷ তবে না ফেরার সংশয় দূর হয়েছে। মেয়ে সুখ’কে নিয়ে ভালোই আছে সে৷ যার মেয়ের নাম সুখ তার আবার দুঃখ কীসের? তার তো খুব সুখই…
মুনতাহা চোখমুখ কুঁচকে ধমকের সুরে বলল,
-‘এই মেয়ে এই ভূতে পেয়েছে নাকি?’
একটু চমকাল শাহিনুর। দূরত্ব বজার রেখে পাশেই বসলো। মুচকি হেসে নিচু কণ্ঠে জবাব দিলো,
-‘সুখে পেয়েছে!’
পরোক্ষণেই একটা কথা ভেবে চুপ হয়ে গেল। এ মূহুর্তে মুনতাহা’কে স্বাভাবিক লাগছে না। অঙ্গনের ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে এই মেয়ে স্বাভাবিক নয়। এর বড়ো ধরনের সমস্যা আছে। কী যেন নাম বলল? হ্যাঁ মনে পড়েছে ‘সাইকো’ এর অর্থ হচ্ছে, যার কোন মন নেই, মাথায় ঘিলু-টিলু নেই। ঠোঁট টিপে হাসি আটকালো শাহিনুর। সত্যিই তার মেজো জা’ এর মাথায় ঘিলু নেই। থাকলে কি আর পলাশ নামক নিকৃষ্ট প্রাণীটির প্রেমে পড়ে! অঙ্গন এও বলেছে, মেজো ভাবি’কে সহজ ভাষায় পাগলও বলা চলে। এসব শুনে শাহিনুরের ধারণা হলো, পলাশও হয়তো সাইকো ছিল। সত্যি উপরওয়ালা দু’টোকে মিলিয়ে ছিলও বটে!
-‘আমি এ বাড়ি থেকে চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছি। তাই দেখা করতে এলাম।’
কথা শুনে বিস্মিত হলো শাহিনুর। মুনতাহা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
-‘খুব বেশি সুখে আছো তাই না৷ তোমার সুখ আমার সহ্য হচ্ছে না৷ তাই ভাবলাম যাওয়ার আগে তোমার সুখ কেড়ে নিয়ে যাব।’
ভ্রু কুঁচকে গেল শাহিনুরের৷ কী আবোলতাবোল বকছে! রাগও হয় হাসিও পায়। যা ইচ্ছে বলুক সে কিছুই বলবে না শুধু শুনবে।
-‘ষড়যন্ত্র বোঝো? ষড়যন্ত্র? নিশ্চয়ই বোঝো না। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। ফুপা দেশে আসার পর তোমাদের খোঁজ করার জন্য দ্বিগুণ লোক লাগানো হলো। এরমধ্যে শুধু আইনের লোক ছিল না, বেআইনের লোকও ছিল। তার আগে বলে নিই, ফুপা কেন লোক লাগালো? কারণ আমার মতোই ফুপা তোমাদের সর্বনাশ চায়। কেন জানো? কারণ তার মেয়ের সবকিছু কেড়ে নিয়েছ তুমি। তার ঘর, তার সংসার এমনকি তার বরটাও। এই তোমার সমস্যা কী বলোতো সবার বর কেড়ে নাও কেন তুমি?’
কয়েক পল সময় নিয়ে আবারও বলতে শুরু করল,
-‘রোমানা আপুর মৃত্যুর কোন কারণ ছিল না এক তুমি ছাড়া৷ রূপ ছাড়া কোন দিকেই তার যোগ্য ছিলে না তুমি৷ এই রূপ দিয়ে কত পুরুষের মাথা ঘুরিয়েছ, কত মেয়ের সর্বনাশ করেছ, তোমার লজ্জা থাকলে নিজের গা’য়ে নিজেই আগুন দিতে। আমি যদি সুযোগ পাই তোমার শরীরে এসিড ছুঁড়ে দেবো।’
আঁতকে উঠল শাহিনুর। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল মুনতাহার পানে। মুনতাহা দম নিলো না বলতেই থাকল,
-‘কেন দেবো জানো? বিবাহিত পুরুষদের মাথা খায় তোমার এই রূপ। বাগদত্তা হয়েও প্রণয় ভাইয়ের মতো সৎচরিত্রবান মানুষ তোমার রূপের কাছে হেরে গেল। নিশ্চয়ই রোমানা আপাকে তোমার জন্যই প্রত্যাখ্যান করেছিল? তাই তো আপা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে!’
নিস্তব্ধ হয়ে ঠায় বসে রইল শাহিনুর। চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠেছে তার। বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে। মুনতাহার কথাগুলো এবার শুধু কর্ণে নয় বক্ষেও আঘাত করছে।
-‘ একমাত্র মেয়ের মৃত্যু সহ্য করতে পারেনি ফুপা। তাই সে তক্কেতক্কে ছিল। যেদিন আমার স্বামী খু’ন হয়, রঙ্গন খু’ন হয় ঠিক সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার প্রতিশোধ নেবে। এটাই সঠিক সুযোগ। আর সেদিন থেকেই দেশে আসার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তিনি দেশে ফেরার পর থেকেই তোমাদের কালোদিন শুরু হয়ে যায়।’
সহসা বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে ওঠল মুনতাহা। কেঁপে ওঠল শাহিনুর৷ তার দৃষ্টিজোড়া রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে। তবুও একফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ল না। সে দৃষ্টিতে নজর পড়তেই পৈশাচিক আনন্দ পেল মুনতাহা। বেশ আয়েশ করে বলতে লাগল,
-‘সেদিন এস আই সারিমের বাড়ি থেকে তোমরা পালিয়ে যাওয়ার পরই আমরা বুঝে ছিলাম। প্রণয় ভাইয়ের মতো চতুর লোক’কে এভাবে ধরা সম্ভব নয়। চতুর লোকের সঙ্গে চতুরতাই প্রয়োজন। তাই শহরের সন্ত্রাসদের হাত করল ফুপা। সারিমের বাড়ির আশপাশে যে কয়েকটা অঞ্চল ছিল সমস্ত জায়গায় লোক লাগানো হলো। তোমাদের সঠিক বাসস্থান খুঁজে পায়নি কেউ। পেলে হয়তো আজ তুমিও এখানে থাকতে না। কোনভাবেই তোমাদের ধরা সম্ভব হচ্ছিল না। তারপর একদিন হুট করেই শুনতে পেলাম, কয়েকজনের নজরে পড়েছিল প্রণয়৷ রাত ছিল বলে ফাঁকি দিয়ে ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে গেছে। কী সাংঘাতিক মানুষ তোমার বরটা! কাপড় ছেড়ে পালিয়ে গেল। শুধু একটা শার্ট নিয়ে ওরা ফিরল!’
সহসা শাহিনুরের মনে পড়ল সেদিন প্রণয় খালি গায়ে ঘরে ফিরেছিল৷ তার মানে সেদিন শত্রুদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ঘরে ফিরেছিল ডাক্তারসাহেব। এরপর কী হয়েছিল? প্রবল উত্তেজনা ঘিরে ধরল তাকে।হৃৎস্পন্দন থমকে রইল। নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হলো। মস্তিষ্ক অসাড়। শরীর ঘামছে। দু’চোখের পাতায় ভেসে ওঠল নিষ্ঠুর এক নারীকে। কর্ণে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করল এক নিষ্ঠুর নারীর ষড়যন্ত্রের বাজনা,
-‘আমাদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল সেই রাতেই। আমিও অসহ্য হয়ে ওঠেছিলাম। সে রাতের ঘটনা পুলিশের কাছ থেকে গোপন করল ফুপা৷ কারণ আমি পরিকল্পনা পরিবর্তন করে দিয়েছিলাম। কী করেছিলাম জানো, বলেছিলাম এর পরের বার যখনই প্রণয় ভাই, নাহ বাইজি কন্যা শাহিনুরের টগবগে স্বামীকে নজরে পড়বে সোজা তুলে নিয়ে আসব। উপহার দেবো মৃত্যু’কে! তারপর বেশ অনেকগুলো দিন তোমার জামাইকে দেখা যায়নি। শেষ যখন দেখা গেল তখন মাঝরাত। আমাদের লোক আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। তাই নিমিষেই হাত, মুখ, পা বেঁধে তুলে আনতে একটুও অসুবিধা হয়নি। ওকে তুলে আনার পর কী করেছিলাম জানো?’
শাহিনুরের সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। চোখ,মুখের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করল। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত শাহিনুর’কে চোখ ভরে দেখল মুনতাহা৷ চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বলল,
-‘নির্জন রাস্তার মাঝখানে ফেলে দু’টো গাড়ি দিয়ে একদম পিষে দিয়েছিলাম!’
দু’হাতে দু’কান চেপে ধরে আর্তনাদ করে ওঠল শাহিনুর। উচ্চশব্দে হাসতে হাসতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল মুনতাহা। লুকিয়ে গেল প্রণয়ের বেঁচে থাকার সুসংবাদটুকু।
[১১৪]
দু’হাতে কান চেপে ধরে থরথর করে কাঁপছিল শাহিনুর৷ হঠাৎ মেয়ে প্রীতির কান্নার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেল সে। বিধ্বস্ত মস্তিষ্কে আচমকাই স্মরণ হলো, সেদিনের পাওয়া চিঠিটার শেষ লাইন দু’টো, ইতি তোমার, “প্রিয় সুখের আব্বু।” নিমিষে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল৷ বারকয়েক ঢোক গিলে শুঁকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে যাওয়া গলা ভিজিয়ে নিলো। রুদ্ধ কণ্ঠে বিরবির করে বলল, ‘ডাক্তারসাহেব একদম ঠিক আছে, কিছু হয়নি তার। আমার সুখের আব্বু একদম ঠিক আছে, ভালো আছে সে।’ বুকটা হুহু করে ওঠল মুখে এসব বললেও অবচেতন মন ফিসফিসিয়ে বলল, ‘একদম ভালো নেই, একটুও ভালো নেই!’
প্রীতি কাঁদছে। তবুও তার দিকে তাকাল না সে। পুনরায় ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সে অবস্থাতেই আঁচলের নিচ থেকে একটি বাটন মোবাইল ফোন বের করল। দু’হাত থরথর করে কাঁপছে তার। একহাতে মুখশ্রীতে লেপটে থাকা স্বেদজল সন্তর্পণে মুছে নিলো। স্মরণ করল মুনতাহা’কে কক্ষের বাইরে এক মিনিট দাঁড় করিয়ে সে ঠিক কী করছিল,
সেদিন হুট করেই অঙ্গন বাইজি গৃহে এলো৷ একটা ছোট্ট বাটন ফোন দিয়ে তাকে তার ব্যবহার শিখিয়ে দিলো। এই মোবাইলের নাম, সিম্ফনি মোবাইল। এটা দিয়ে দূরে থাকা মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়৷ ক্যামরা থাকায় ছবিও তোলা যায়। সুখ যখন কাঁদবে বা হাসবে তখন কীভাবে ভিডিও করবে তাও শিখিয়ে দিয়েছে অঙ্গন। শিখে নিয়ে কয়েকটা ভিডিও করেছেও৷ উদ্দেশ্য ডাক্তারসাহেব যখন ফিরবে তাকে এসব দেখানো। এই ছোট্ট মোবাইলে, ছোট্ট স্ক্রিনে, ছোট্ট সুখকে দেখতে পেয়ে ভারী আশ্চর্য হয়েছিল সে। তার সে আশ্চর্যান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে অঙ্গন বলেছিল,
-‘ভাবি এটা আপনাকে দেওয়ার পেছনে আরো একটি উদ্দেশ্য রয়েছে।’
বোকা চোখে তাকিয়ে শাহিনুর প্রশ্ন করেছিল,
-‘আরো উদ্দেশ্য?’
-‘হ্যাঁ। আমার খুব গভীর একটি সন্দেহ হচ্ছে। সেদিন মেজো ভাবি আপনার সঙ্গে ঠিক কী ধরনের আচরণ করেছিল জানি না। আপনি যতটুকু বলেছেন তা বিশ্বাস করি বলেই কিছু প্রমাণ যোগারের উদ্দেশ্য এটি আপনাকে দিলাম।’
-‘এটা দিয়ে কীভাবে প্রমাণ হবে?’
-‘যেভাবে সুখের স্মৃতি এখানে ধারণ করবেন ঠিক সেভাবে সুযোগ পেলে কারো মুখোশের আড়ালের চেহেরাটাও ধারণ করবেন।’
বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল শাহিনুর৷ অঙ্গন তাকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে তার বিস্মিতা কাটিয়ে দিয়েছিল। আজ যখন দ্বারে করাঘাতের পর শুনতে পেল মুনতাহা এসেছে। তখনি একমিনিট সময় নিয়ে চটজলদি ছোট্ট সিম্ফনি ফোনটি বের করেছে। তাড়াহুড়ো, উত্তেজনা সব মিলিয়ে সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে যথাসম্ভব ঠিক রেখে সেদিনের শিখিয়ে দেওয়া বিষয়গুলো মনে করে, ওয়ান,টু লেখা সংখ্যার বাটনগুলোর টু এর উপরে বড়ো একটি বাটন ছিল সেখানে ক্লিক করল। তারপর কয়েকটি এপের চিত্র ভেসে ওঠল। সেগুলোর মধ্যে মাল্টিমিডিয়াতে একটি গোলাকার বৃত্ত ঘোরপাক খাচ্ছিল। তাড়াহুড়ো করে বড়ো বাটনের বা সাইটে চাপ দিলো মাল্টিমিডিয়া থেকে গোল বৃত্তটি চলে গেল ক্যামেরা এপে, দ্রুত বড়ো বাটনের মাঝবরাবর চাপ দিতেই ক্যামেরা চালু হলো, অঙ্গনের শেখানো অনুযায়ী বাম বাটনের উপরের বাটনে চাপ দিলো ওখানে লেখা ওঠল, সুইচ টু ভিডিও রেকর্ডার। ভুলবশত অডিও না করে ভিডিওতে ক্লিক করল সে। যদিও ভিডিও দেখা যাচ্ছিল না তবুও স্পষ্ট কথাগুলো ধারণ হচ্ছিল রেকর্ডার চালু থাকায়। ঊনচল্লিশ মিনিট ধরে চলছিল রেকর্ডটি৷ শাহিনুর ত্বরিতবেগে ডানপাশের উপরে বাটনে বুড়ো আঙুলের পেট দিয়ে চাপ দিলো অতঃপর রেকর্ডটি স্টপ এবং সেভ দুটোই হয়ে গেল।
লেখকের কথা: ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ১ম এবং ২য় খণ্ডের শেষে সবাই দারুণ দারুণ রিভিউ দিয়েছিল পাঠকমহলে। তাদের সকলের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। তৃতীয় খণ্ডের শেষেও কিন্তু দারুণ রিভিউ চাই৷ এবার পাঠকমহলে নয় পেইজের রিভিউ অপশনে গিয়ে সবাই রিভিও দেবেন৷ দীর্ঘ এই উপন্যাসটির শেষে লেখিকার এই চাওয়াটি অবশ্যই পূরণ করবেন। মনে রাখবেন এতে আপনাদের লেখিকা অনুপ্রাণিত হয়ে/ উৎসাহ পেয়ে ভিন্ন ধরনের লেখা উপহার দেবে ইনশাআল্লাহ। সকল পাঠককে এক আকাশসম ভালোবাসা জানাই।