প্রণয় সিদ্ধান্ত নিলো, অসহায় বুড়ো, বুড়িদের ওপর নির্ভর করবে না৷ একদিন, দু’দিন, তিনদিন। কতদিন আর করবে তারা? বরং তাদের দু’জনের দায়িত্ব এবার নিজ কাঁধে নেবে৷ মানুষ গুলো যতটুকু করেছে এই ঢেড় বেশি। বিনিময়ে এবার কিছু প্রাপ্য তাদের৷ দাদা টুকটাক কাজ করে৷ কিছু সবজি, ফল ফলাদিও সপ্তাহে দু’দিন বাজারে বিক্রি করে৷ বৃদ্ধ বয়সে অভাবের সংসার টানতে বড়ো কষ্ট হয়ে যায় তার। চোখের সামনে সবটা দেখে সহ্য করতে পারেনি প্রণয়। গতকাল যখন দাদা কলা আর পেয়ারা বিক্রি করার জন্য হাঁটে যাচ্ছিলো, সেও সঙ্গে গিয়েছে। হাড়কাঁপানো শীতের মৌসুমে লুঙ্গি, শার্ট গা’য়ে চাপিয়ে মাথা সহ মুখে মাপলার দিয়ে পেঁচিয়ে বাইরে বেরিয়েছে সে। এক নজরে হোক বা চার, পাঁচ নজরে হোক কৃষক ব্যতীত অন্য কিছু ভাবা সম্ভব নয়। প্রণয় যখন এভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো শাহিনুরও টুনটুনি দাদির সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নিলো। তার সরল ভাষ্য এই যে,
-‘ অনেক করেছেন দাদি এবার নাতবউয়ের হাতের রান্না খাবেন, সেবা যত্ন পাবেন আর শুধু আরাম করবেন৷ ‘
যে নির্ভরতা বুড়ো,বুড়ি নিজের ছেলের কাছে চেয়েও পায়নি, সেটুকু প্রণয়, শাহিনুরের কাছে পেয়ে বড়োই শান্তি পেলেন। দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণভরে দোয়াও করলেন ওদের জন্য।
পাহাড়ি টিলার উপর ছোট্ট মাটির ঘরটাতে তিনদিন দিন-রাত কেটে গেল৷ পলাশ, রঙ্গন পরলোক গমন করেছে আজ চল্লিশ দিন। প্রণয়ের বুকের ভিতর যে অস্থিরতা চলছে তা খুব টের পাচ্ছে শাহিনুর। প্রণয় যেমন তার অস্থিরতা লুকোনোর চেষ্টা করছে, শাহিনুরও তার অস্থিরতা গুলো বুঝতে না পারার ভান করছে। কেবল একে অপরকে ভালো রাখার উদ্যমে রয়েছে তারা। চারিদিকে সূর্যের আলো মিলিয়ে গেছে। মাগরিবের আজান ধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রণয় বেরিয়েছে ঘন্টাখানেক আগে। আপনজনদের জন্য বড়ো অস্থির সে। একটা চিঠি পাঠানোর জন্য বড়ো উদ্বিগ্ন হয়ে আছে৷ আজ হয়তো পাঠাইবেই। চিন্তা করতে বারণ করে গেছে শাহিনুরকে। সে চিন্তা করছে না৷ যে বিষয়ে প্রণয়ের মনে স্বস্তি আসবে তাতে সেও শান্তি পাবে। চুলা থেকে তরকারি নামিয়ে ঘরে গিয়ে টুনটুনি দাদিকে বলল,
-‘ দাদি রান্না শেষ ভাত বেড়েছি দাদাকে নিয়ে খেতে বসুন৷ আপনাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে তো ? ‘
টুনটুনি দাদি বলল,
-‘ আইতাছি আইতাছি, আ কুদ্দুসের বাপ আহো দেখি খাইয়া তাড়াতাড়ি যাই। ‘
শাহিনুর মিষ্টি করে হেসে খাবার বেড়ে দাদা, দাদির সামনে দিলো। তারা খেয়ে দেয়ে হারিকেন হাতে রওনা দিলো শেখ বাড়ির পথে। শেখ বাড়িটা বেশ দূরে৷ হেঁটে সাত, আট মিনিট লাগে৷ তবুও রোজ সন্ধ্যার পর খেয়েদেয়ে হারিকেন হাতে বুড়ো, বুড়ি চলে যায় শেখ বাড়িতে। দু’টির মনে এখনও বেশ ফূর্তি। টুনটুনি দাদি খুব টিভি ভক্ত মানুষ। সেই ছোটোবেলায় নাকি সপ্তাহে একদিন তাদের গ্রামে সবাই মিলে টিভি দেখতো। গ্রামের স্কুলের বারান্দায় টিভি সেট করে নাটক, সিনেমা চালু করে দিতো আর এলাকার সকলে মিলে মাঠে বসে টিভি দেখতো। তখন থেকেই টিভির প্রতি নেশা ছিল তার। বাপ, মায়ের হাতে মাইরও কম খায়নি। বিয়ের পরও আশপাশে যাদের বাড়ি টিভি ছিল তাদের বাড়ি গিয়ে টিভি দেখতো। সে যুগের তুলনায় এ যুগের বেশ উন্নতি ঘটেছে। মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরেও এখন টিভি। তাও রঙিন টিভি! শেখ বাড়িতে আগে ধানের কাজ করতো টুনটুনি। সেই থেকেই আসা-যাওয়া, সেই থেকেই ও বাড়িতে টিভি দেখার অভ্যাস। দাদা আগে টিভি দেখতে পছন্দ করতো না৷ টুনটুনি দাদির জন্য এখন তারও অভ্যাস হয়ে গেছে। বুড়ো বয়সে এসেও বউয়ের আবদার রাখতে রাত-বিরেতে শেখ বাড়িতে যায় টিভি দেখতে। ভাগ্যিস টুনটুনি দাদি টিভি ভক্ত মানুষ। ভাগ্যিস দাদা ভালোবেসে এ বয়সেও তার আবদার রাখে। তাইতো তিনদিন আগে টিভি দেখে ফেরার পথে বিপদগ্রস্ত দু’টো মানুষ’কে নজরে পড়েছে তাদের। টিভি দেখা শেষ করে ঘরে ফিরে আবার রাতদুপুর সেসব নিয়ে গল্প করে তারা। কখনো হাসে, কখনো ঝগরা করে। এদের কাণ্ড দেখে অবাক লাগে শাহিনুরের। ভীষণ অবাক লাগে এই মানুষ দু’টিকে দেখে। বাঁচতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। জীবনের জটিলতা গুলো একেবারে সহজবোধ্য হয়ে যায়। বড়ো অনুপ্রেরণাদায়ক এই দু’টো মানুষ।
.
বিষণ্ণ বদনে কক্ষের এক কোণে বসে আছে প্রেরণা। অপরাধ বোধে বুকের ভিতরটা জর্জরিত হয়ে আছে তার। এতকিছু হারানোর পরও গতকাল আরো একটি অপরাধ করেছে সে৷ কী করবে সে যে এক নিরুপায় মা৷ তাইতো নিরুপায় হয়ে ভৃত্য সখিনাকে বিয়ে করতে বাধ্য করল অঙ্গনকে! অঙ্গন পুরোপুরি সুস্থ না হলেও আগের তুলনায় বেশ সুস্থ। নিজেদের মানুষদের প্রতি হুঁশ জ্ঞান রয়েছে। যখন ওষুধপত্রে অনিয়ম হয় শুধু তখনি উল্টাপাল্টা আচরণ করে। ওষুধ চলাকালীন কোন প্রকার সমস্যা করে না। সুস্থ মানুষদের মতোই আচরণ করে। সখিনার সঙ্গে বিয়েটা সে মন থেকে মেনে নেয়নি৷ গতকাল সখিনার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার। এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি। প্রেরণার মুখের দিকে তাকিয়ে, নিজেদের বংশধর’কে বৈধতা দেওয়ার প্রয়াসে, বড়ো ভাই পল্লবের আদেশ মোতাবেক শুধু বিয়েটা করে নিয়েছে। তবে নিজের কক্ষে স্থান দেয়নি সখিনা’কে। রান্না ঘরের এক কোণেই জায়গা হয়েছে মেয়েটার৷ তবুও আফসোস নেই সন্তানের বৈধতা পেয়েছে এই অনেক। সকালবেলা সকলের নাস্তা করা সম্পন্ন হলে শবনম অঙ্গনকে খাওয়াতে গেল। অঙ্গন শবনমকে দেখেই বলল,
-‘ সেজো ভাইয়ার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি ভাবি? ‘
বিস্মিত চোখে অঙ্গনের পানে তাকিয়ে রইল শবনম। হাতে থাকা খাবারগুলো টেবিলে রেখে বলল,
-‘ ভাই অঙ্গন দোয়া করো যেন খোঁজ না পাওয়া যায়। আমাদের এত বারণ সত্ত্বেও মামামশায় আর মেজো বউ মামলা করেছে ওর নামে। খোঁজ পেলে ফাঁসি নিশ্চিত! ‘
তীব্র রোষাবিষ্ট হয়ে অঙ্গন বলল,
-‘ আমার ভাইকে ফাঁসিতে ঝুলাবো আমার ভাইকে? মামাকে আমি দেখে নেবো, মামাকে আমি দেখে নেবো। ‘
কাঁপতে শুরু করল অঙ্গন৷ শবনম ভয় পেয়ে গেল৷ কাছে গিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
-‘ ভাই তুমি শান্ত হও, শান্ত হও। ‘
-‘ ভাই মরেছে আমার, মেরেছেও আমারই ভাই। তাকে কী শাস্তি দেবো সেটা আমি, বড়ো ভাই, বড়ো আম্মা, আম্মা বুঝবেন। মামা মামলা করে কোন সাহসে? ‘
-‘ মানুষ হত্যা মহাপাপ ভাই। ‘
-‘ সেটা মানুষ অমানুষ না। আমার দু’টো ভাই’ই অমানুষ ছিল! ‘
অঙ্গনের এহেন কথায় আম্মা বলে ডুকরে ওঠল শবনম। চিৎকার করে বলতে লাগলো,
-‘ আম্মা আপনার অঙ্গন একদম ভালো মানুষের মতো কথা বলছে, ছোটো তাড়াতাড়ি আয় আমাদের অঙ্গন দেখ কী বলে! ‘
চিৎকার শুনে অঙ্গন শান্ত হলো বুকের ভিতর তীব্র কষ্ট হচ্ছে তার। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সব হারিয়ে গেছে সব। প্রথমে রোমানা, তারপর আব্বা, তারপর ভাই’রা! সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগছে আব্বার মৃত্যু সময়ের কোন স্মৃতিই মনে করতে পারছে না সে। হঠাৎ মাথা চেপে ধরল। বির বির করে বলল,
-‘ আব্বা কবে মারা গেছে ভাবি? কাল রাত থেকে মনে করার চেষ্টা করছি, কিছুতেই মনে পড়ছে না। ‘
অঙ্গনের এ বাক্য শুনে অরুণা আর কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করল না। দরজার সম্মুখ থেকে ফিরে গেল৷ বৈঠকখানায় জেবাকে দেখে তাগাদা দিয়ে বলল,
-‘ তাড়াতাড়ি অঙ্গনের ডাক্তাররে ফোন দেও। ‘
[১০১]
একরে পর এক দিন এগুচ্ছে আর শীত বাড়ছে। একেতো মাটির ঘর ঠাণ্ডা হয় তারওপর শীত নিবারণের জন্য তেমন কোন পোশাক নেই। মাত্র দু’টি কাঁথায় শীত মানে না। হাড় কাঁপিয়ে তুলে। তাই রাতের খাবার সেরে ঘরের ভিতরেই কাঠের টুকরো জড়ো করে আগুন ধরালো প্রণয়। দাদা, দাদি গেছে টিভি দেখতে৷ এই শীতেও তাদের টিভি দেখতে যেতে হবে। দশটা না বাজিয়ে ফিরবে না। বাড়িতে, ঘরে একা শুধু তারা দু’জন। শাহিনুর কাঁথা গা’য়ে দিয়ে শুয়ে আছে। অতিরিক্ত শীতে তার শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। তা দেখে প্রণয় ডাকলো তাকে। হাত, পা সাপের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কাঁথার নিচে গরম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। রোজ রোজ এমন ঠাণ্ডায় ভুগে শরীর খারাপ হচ্ছে। না জানি এর প্রভাব বাচ্চার উপরে পড়ে! ভাবতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল, ত্বরিত বেগে শোয়া থেকে ওঠে প্রণয়ের সম্মুখে বসে আগুন দ্বারা হাত, পায়ে তাপ নিতে লাগলো। আজো ব্লাউজ বিহীন আঁটসাঁট ভাবে শাড়ি পরা শাহিনুর। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘরের মাঝখানে আগুন জ্বলছে। মুখোমুখি বসে আছে দু’জনে৷ হঠাৎ অপলকভাবে তাকিয়ে প্রণয় বলল,
-‘ আর কিছু দিন অপেক্ষা করো। হাঁটে যে শাড়িওয়ালা বসে, তার থেকে শাড়ির দাম শুনে দামাদামি করেছি। তিন’শ পঞ্চাশ টাকা হলেই একটা দেবে। ‘
বুক কেঁপে ওঠল শাহিনুরের। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল প্রণয়ের চোখের দিকে৷ কর্কশ কণ্ঠের, ভারী ব্যক্তিত্বের গম্ভীর মানুষ’টার এই কী রূপ! সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়ায় আজ এ কী অসহায়ত্ব! সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেটার আজ এ কী দারিদ্র্যতা! সহ্য হয় না, সহ্য করা যায় না। ছলছল দৃষ্টিতে শাহিনুর বলল,
-‘ আপনি অনেক শুকিয়ে গেছেন, গালের হাড় দেখা যাচ্ছে। শরীরটা কেমন ভেঙে পড়েছে। সব সময় তো আমাকে নিয়েই ভাবেন একটু কি নিজের কথা ভাবা যায় না? ‘
মৃদু হেসে প্রণয় বলল,
-‘ বোকামেয়ে, আমি একদম ঠিক আছি। একদম ফিট। তুমিই শুকিয়ে গেছো। তোমার এই অবস্থাতেও তোমাকে ঠিকভাবে খাবার দিতে পারছি না। আমাদের সন্তান তেমন খাবার পাচ্ছে না৷ কীভাবে বেড়ে ওঠবে ও? এই চিন্তায় ঘুম আসে না। ‘
-‘ চিন্তা করবেন না খাবার যা পাচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের ভালোবাসা, আল্লাহর রহমতেই ও বেড়ে ওঠবে, পৃথিবীতে আসবে। ‘
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রণয়। শাহিনুর বলল,
-‘ এত কী দেখেন? সব সময় এত মুগ্ধতা কীসের? ‘
-‘ আমার সুখ কে, আমার শান্তি কে আমার চন্দ্রকান্তাকে, সর্বোপরি আমার আঁধার রাতের চান্দের আলোকে। ‘
অধরে প্রশস্ত হাসি রেখে একদমে বলা প্রণয়ের বাক্য শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল শাহিনুর। কিছু মানুষ থাকে যারা তাদের মুগ্ধ অনুভূতি দিয়েই বিপরীত মানুষ’টাকে মুগ্ধ করে তুলে। কিছু পুরুষ আছে যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে নির্দিষ্ট একজন নারীকে ভালোবাসা দিয়ে দিশেহারা করে ফেলা। প্রণয় সেই মানুষ, সেই পুরুষ। এইতো কেমন করে তাকিয়ে কেমন করে কথা বলে শাহিনুর’কে মুগ্ধ করে তুললো। ফলাফল সরূপ তার মতো করেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সে। কণ্ঠে অগাধ প্রেম মিশিয়ে প্রশ্ন করছে,
-‘ আপনি খুব সুন্দর করে ভালোবাসেন আমায়, খুব সুন্দর করে কথাও বলেন। এমন সুন্দর কথা কে শেখালো আপনাকে? মনে হয় শুধু কথা বলছেন না কবিতা শোনাচ্ছেন প্রেমের কবিতা! ‘
-‘ বাংলাদেশের প্রায় সব ডক্টরদের মাঝে একটা কাব্যিক ব্যাপার আছে বুঝলে? ‘
মুখ ফসকে কথাটা বলেই থমকে গেল হঠাৎই তার দৃষ্টিজোড়া বিক্ষিপ্ত হলো। সম্মুখে বসে থাকা শাহিনুর চট করে ওঠে তার পাশে বসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল,
-‘ আমার ডাক্তারসাহেব, আমাদের ডাক্তারসাহেব। তাইতো আপনার হৃদয়ে এত প্রেম এত ভালোবাসা। ‘
অনেকটা সময় প্রণয়ের বুকে মাথা রেখে বসে রইল শাহিনুর। শান্ত করে দিলো অশান্ত বুকটাকে। ধীরে ধীরে শাহিনুর মাথা ওঠিয়ে প্রণয়কে দৃষ্টিপাত করল৷ বোঝার চেষ্টা করল তার অনুভূতি। কিন্তু বুঝতে পারলো না। প্রণয় থমকে রয়েছে। অদ্ভুত অনুভূতি পেলো , চাপা কষ্টে বুক ভারী হয়ে ওঠল। উন্মাদের মতো প্রণয়ের গালে, কপালে চুমু খেলো। তবুও প্রতিক্রিয়া দেখালো না মানুষটা। এতে আরো ক্ষিপ্র হয়ে প্রণয়ের ওষ্ঠধারে নিজের ওষ্ঠজোড়া মিলিয়ে দিলো। সংবিৎ ফিরে পেয়ে দু’হাতে শাহিনুরকে আঁকড়ে ধরল প্রণয়। বুঝলো তার বউ তার অনুভূতি না বুঝে অস্থির হয়ে ওঠেছে। কী পাগল মেয়ে!
দীর্ঘসময় পর প্রণয়ের থেকে সরে গেল শাহিনুর৷ দু-চোখে তার শ্রাবণ ধারা। প্রণয় হাত বাড়িয়ে ওর কপোলদ্বয় স্পর্শ করল। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল শাহিনুর৷ সে চোখে অপরাধ বোধও স্পষ্ট। প্রণয় জানে মনে মনে সে এখন নিজেকে দোষারোপ করছে। তাই তার অশ্রুসিক্ত হরিণাক্ষী দৃষ্টিজোড়ায় গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে৷ নয়তো ক্ষতি হবে শাহিনুরের। কি করা যায় কি করা যায় ভাবতেই সম্মুখের জ্বলন্ত আগুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার শাহিনুরের দিকে তাকাল। সহসা মনে পড়ে গেল সেই ক্ষণ যে ক্ষণে প্রথমবারের মতো শাহিনুরের সুশ্রী মুখটা তার চোখে তীর্যক জ্যোতির ন্যায় বিঁধেছিল। মনে পড়ে গেল সেই ক্ষণ যে ক্ষণে গভীর অরণ্যে দ্বিতীয় দফায় প্রেমে পড়ে রোমাঞ্চকর পরিবেশে গানে গানে প্রেমের বার্তা দিয়েছিল। আগুনের কাছাকাছি বসে পাশে বসে থাকা রমণীর উদ্দেশ্যে পুনরায় আবারও প্রেমের বার্তা দিলো। গেয়ে ওঠল গান,
ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে, ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে,
সহসা চমকে ওঠল শাহিনুর। বিস্মিত হয়ে তাকালো প্রণয়ের দিকে। লজ্জাও পেলে খুব৷ তাই তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওঠে দাঁড়ালো। অথচ কর্ণে প্রণয়ের বলা গান শুনলো,
আমার মনের ঘরে চাঁন্দের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে
পুষে রাখবো রাখবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে,
প্রণয়ও ওঠে দাঁড়ালো। শীতার্ত রজনীতে বদ্ধ ঘরে আগুন জ্বলছে এক পাশে অতি সুদর্শনীয় রমনী দাড়িয়ে রয়েছে। যার চোখেমুখে ছেয়ে আছে জগতের সবটুকু লাজুকতা৷ সেই লজ্জাটুকু হরণ করার প্রয়াসে তাকে সন্তর্পণে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। উন্মুক্ত কাঁধে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে শিহরিত করে তুললো সর্বাঙ্গ, কণ্ঠে পুনরায় সুর তুলল,
দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না,
ভয়ানক লজ্জায় মৃদু কাঁপছে শাহিনুর৷ একেতো হঠাৎ গান গেয়ে লজ্জা দিচ্ছে। তারওপর গানের কথাগুলো কী ভয়ানক! গানের সাথে মিলিয়ে কী স্পর্শ! শাহিনুর ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। বলতে চাইলো,
-‘ পাগল হয়ে গেলেন নাকি! ‘
কিন্তু তার চাহনি দেখে কেমন মাতাল করা কণ্ঠে প্রণয় সুর তুলল,
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম,
মন তো আর মানে না, কাছে আইসো আইসো রে বন্ধু প্রেমের কারণে, ভালোবাইসো বাইসোরে বন্ধু আমায় যতনে,
গাইতে গাইতে অধরস্পর্শ করতে উদ্যত হলো। শাহিনুর মৃদু ধাক্কা সরে যেতে উদ্যত হতেই প্রণয় দু’হাতে আবদ্ধ করে নিলো তাকে।
– নিশি ভোরে জোনাক নাচে মনেরও গহীন বনে
স্বপ্ন দেখাও বন্ধু তুমি নিগূঢ় আলিঙ্গনে!
এটুকু বলেই শাহিনুরকে কোলে তুলে ঘরজুড়ে ঘুরতে লাগলো মোহনীয় স্বরে বলল,
-‘ আরে বাবা রোমান্টিকতাও বুঝো না দেখছি! ‘
শাহিনুর অবাক করা গলায় বলল,
-‘ ইস কী রোমান্টিকতা, মনে হয় নাটকের অভিনেতা।’
-‘ অভিনয়? এ গান যেদিন প্রথম গেয়েছিলাম তোমার জন্যই গেয়েছিলাম৷ বুঝতে পেরেছিলে? অনুভব করেছিলে? করোনি। তাই আজ আবার গাইলাম অনুভব করেছো কিনা বুঝিনি৷ তাই এবার স্পর্শে বোঝাবো! ‘
সেই গানটি যার মর্মার্থ শাহিনুর সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ বুঝলো। বুঝিয়ে দিলো প্রণয় তার করা প্রতিটি স্পর্শে। প্রকৃতি যেন চারপাশ থেকে বলে ওঠল, এ প্রেমের অন্ত নেই রে শাহিনুর শায়লা এ প্রেমের অন্ত নেই।