জমিদার আজহার চৌধুরীর পুত্র অলিওর চৌধুরী। অলিওর চৌধুরী এবং প্রেরণা চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র আমি। প্রণয় চৌধুরী। ছোটোবেলা থেকেই ঘরকুনো স্বভাবের ছিলাম। আর চারজনের মতো বিশাল সাম্রাজ্যের বিলাসিতা আমাকে ছুঁতে পারতো না৷ যে বয়সে ওরা খেলাধূলা করতো, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগরা, মারামারি করে আব্বা, আম্মা, বড়ো আম্মার কাছে বিচার নিয়ে আসতো, সে বয়সে আমি পড়ার টেবিলে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতাম। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম, আব্বা, আম্মা’কে সবার মতো বিরক্ত করিনি৷ প্রয়োজন ব্যতীত কারো সাথে কথা অবধি বলিনি৷ মেজোভাই, আর রঙ্গন’কে হাইস্কুল অবধি খাওয়িয়ে দিতে হতো। আর আমি বড়ো ভাই’কে দেখে দেখে নিজেই খাওয়া শিখেছি, অঙ্গন’কে শিখিয়েছি। বড়ো ভাই আবার আরেক ধরনের মানুষ। তাকে কেউ একটা থাপ্পড় দিলে চুপ থাকতো। আবার কেউ ভালোবাসলেও চুপ থাকতো। আম্মার ভাষায় বড়ো সন্তান’রা হাবাগোবা স্বভাবের হয়৷ বড়ো ভাই তেমনি একজন মানুষ হয়েই গড়ে ওঠেছেন, বোকা, মুখচরা স্বভাবের মানুষ। মেজোভাই ছোটো থেকেই জেদি ছিল, এট্যানশন প্রিয় মানুষ সে। সব সময় চাইতো বাড়ির সকলের মনোযোগ তার দিকে থাকুক। সবাই তাকে ভালোবাসুক, তাকে গুরুত্ব দিক, সকলের পছন্দনীয় পাত্র সে হোক। সবচেয়ে বড়ো কথা আব্বা, আম্মা তার চারপুত্রের থেকে তাকে বেশি প্রাধান্য দিক। এটাই চাইতো। সেই শিশু বয়স থেকেই প্রচণ্ড দুষ্ট স্বভাবের তিনি। সত্যি বলতে এতটাই দুষ্ট ছিল, তার জন্য আমি পড়াশোনা করতে পারতাম না। আব্বা বুঝতো আর সবার চেয়ে আমি আলাদা গোছের। পড়াশোনার প্রতি আমার তীব্র টান দেখেই শহরে হোস্টেল রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন৷ আমি ক্লাস সিক্স থেকেই বাড়ির বাইরে। এতে আমার আফসোস হয়নি। বরং শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্ত পেয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিতাম। অঙ্গনও ব্যাতিক্রম ছিল। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। যে বয়সে ওর বেঁকে যাওয়ার কথা ছিল ঐ বয়সে রোমানাতে ব্যস্ত থেকে বেঁকে যাওয়া হয়ে ওঠেনি ওর। প্রতিটি মানুষেরই নির্দিষ্ট একটা জগৎ থাকে। আমার জগৎ পড়াশোনায় ছিল ওর ছিল রোমানাতে। আর রঙ্গন? সে তো আমাদের সকলের আদরের। বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সদস্য। সকলের চেখের মণি সে। ওর জন্য আব্বা, আম্মার আলাদা একটা দরদ কাজ করতো সব সময়। এখন আব্বা নেই ওর দরদের একটা মানুষ কমেছে। তাই বলে আমি ওকে ভালোবাসি না এটা নয়৷ ওর প্রতি সব রাগ, অভিমান শেষে ও আমার খুবই আদরের৷ ছোটোরা ভুল করবেই তাদের ভুলগুলো শুধরে দিতে হবে। রঙ্গন’কে আমি খারাপ ভাবতে পারি না৷ ভাবতে চাই না৷ আমার সব সময় মনে হয় ওর এমন হওয়ার পেছনে আমরাই দায়ী। স্পেশালি মেজোভাই! একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলি,
রঙ্গন ছোটো বলে ওকে বেশি কেয়ার করতো আম্মা। মানে ওর প্রতি সবার চেয়ে বেশি যত্নশীল ছিল৷ এটা নিয়ে আর কারো সমস্যা না হলেও মেজো ভাইয়ের মারাত্মক সমস্যা হতো। আম্মা যখন ও’কে খাওয়িয়ে দিতো, তখন সেটা দেখে মেজোভাইয়ের জেদ হতো তাকেও খাওয়িয়ে দিতে হবে। ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে বড়ো আম্মা খাওয়িয়ে দিতো মেজোভাইকে। ওর ছোটো ছোটো সকল জেদই এভাবে পূরণ করা হতো। ও বুঝতে চাইতো না রঙ্গন ছোটো বরং ভুল বুঝতো আম্মা ওর চেয়ে রঙ্গন’কে বেশি ভালোবাসে। আমাদের ভাইদের স্বভাবের ভিন্নতা দেখেই বড়ো আম্মা বাড়ির নাম দিলেন ‘পাঁচফোড়ন গৃহ’ কিন্তু ঐ গৃহ কোনকালেই আমার শান্তি এনে দিতে পারেনি। আমি যেদিন প্রথম বুঝতে পারলাম ‘বাইজি গৃহ’ সম্পর্কে, মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়ি। তখন আমি সবে ক্লাস নাইনে ওঠেছি। মধ্যরাতে মেজো ভাই মাতাল অবস্থায় ঘরে ফিরলেন। এই নিয়ে আব্বা, আম্মার সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর আব্বা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আম্মা মেজোভাইকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদলেন। আর আমি জানতে পারলাম, জমিদারের জমিদারিত্বের আড়ালে বীভৎস ঘটনাগুলো’কে! মেজো ভাই উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে তখন। সেই বয়সেই প্রথম নারীদের সংস্পর্শে যায় সে৷ বড়ো ভাই তখন নতুন বিয়ে করেছে। বড়ো ভাবির সামনে মেজোভাই সেদিন মাতাল অবস্থায় আম্মা’কে বললেন,
-‘এই আম্মা কান্দো ক্যা? বড়ো ভাই যে যায় তখন তো কান্দো না!’
সেদিনের পর বড়ো ভাবি বাপের বাড়ি চলে যায়৷ বড়ো ভাই বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসে৷ কিন্তু নিজের মাঝে কোন পরিবর্তন আনতে পারে না৷ বছর গড়াতে না গড়াতেই জেবা ভাবি’কে বিয়ে করে ঘরে তুলেন। তারপর থেকে বড়ো ভাবিও কেমন বদলে গেলেন। সেদিনের অল্পবয়সী মেয়েটা বাড়ির বড়ো বউ হয়ে ওঠলো ঠিকি অথচ একান্তই নিজের স্বামী পেলো না। এসব দেখে আমার সব সময় মনে হতো, আজো হয়, আমার পরিবার শুধু মানুষদের ঠকায়, শুধু বিশ্বাসঘাতকতা করে। নারীদের অসম্মান করে। সবচেয়ে বড়ো কথা আমার আম্মা। আমার আম্মাও প্রাপ্ত সম্মানটুকু পায়নি৷ বড়ো আম্মাও পায়নি। শবনম, জেবা, মুনতাহা কেউ পায়নি। এই অসম্মানিত পরিবারে আমি আমার সম্মান, আমার ভবিষ্যতের সম্মান ধরে রাখতে পারব না৷ এই ভয়ে ভীত থাকততাম সব সময়।
আব্বা, বড়ো ভাই, মেজোভাইদের পরিস্থিতি দেখে আমার মনটা আরো বিষিয়ে ওঠে৷ কেন জানি কোনভাবেই টিকতে পারি না ঐ বাড়িতে। বছরের পুরোটা সময়ই হোস্টেলে কাটিয়ে দেই। ছুটির দিনেও ফিরি না। হোস্টেলে থাকতে সমস্যা হলে মধ্যবিত্ত বন্ধুদের গ্রামের বাড়ি ঘুরতে চলে যাই। নিজের বিশাল সাম্রাজ্যের বিলাসিতা থেকে ঐ গ্রামের ছোট্ট মাটির ঘর, টিনের ঘরে পাটি বিছিয়ে ঘুমানোতেই প্রশান্তি খুঁজে পাই। আম্মা কাঁদতো ইদের সময়, নববর্ষের সময়, চার ছেলেকে কাছে পেতো, পেতো না শুধু আমাকে। দু’একদিনের জন্য যদি আম্মার কাছে, আম্মার কোলে মাথা রাখার জন্য আসতাম। কান্নাকাটি করে, শতশত অভিযোগ করে বুক ভাসিয়ে দিতো। সবসময় স্বান্তনা দিতাম,
-‘ আম্মা তুমি কেঁদো না৷ আমি পড়াশোনা করছি। আমার অনেক বড়ো স্বপ্ন আছে আম্মা। অনেক বড়ো ডাক্তার হবো আমি। মানুষের প্রাণ বাঁচাব। অসুস্থদের সুস্থতা এনে দেব। বহু মানুষের আশীর্বাদ থাকবে আমার মাথার ওপর। ‘
শুধু বলতে পারিনি – আম্মা আমি নিজের একটা আলাদা পরিচয় গড়ে তুলব। আমার এই পরিচয় ভাল্লাগে না৷ আমি জমিদার অলিওরের পুত্র ছাড়াও আরো একটা পরিচয় তৈরি করব৷ যে পরিচয়টা অনেক সম্মান এনে দেবে আমাকে। যে সম্মানের আড়ালে ঘৃণা থাকবে না, অভিশাপ থাকবে না। আমি সত্যি আমার পরিচয় তৈরি করেছি। স্বপ্ন পূরণ করেছি। আমার ডাক্তারি জীবনের আজ মাত্র দু’বছর। যখন ডাক্তারি পাশ করলাম, খুশি হয়ে আম্মা বললেন, এবার বিয়ে করাবে আমাকে। বিয়ের কথা বলতেই সকলের মাথায় এলো, অনেক বড়ো ঘরের মেয়েকে বউ করে আনবে। ডাক্তার ছেলের বউ যে সে হলে চলবে নাকি? এ সময় কোনোভাবে আম্মা টের পেলেন, রোমানা আমাকে পছন্দ করে। আমার প্রতি রোমানার অন্যরকম কিছু টের পেতেই তিনি বেঁকে বসলেন, রোমানাকেই আমার বউ করবেন। সকলের পরিকল্পনা চুপ করে দেখে গেলাম। দিনশেষে যখন বাড়ি ছেড়ে বের হলাম লম্বা একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। মস্তিষ্কে চক্কর দিয়ে ওঠল,
মাত্র কয়েকঘন্টা যে বাড়িতে থাকা দায়, যে বাড়ি থেকে কিঞ্চিৎ মুক্ত হতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ি। সে বাড়িতে সারাজীবন কীভাবে কাটাবো! চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পাই, গ্রামের ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর। ঘরের ভেতর তেমন আসবাবপত্র নেই, দু’টো পাতিল, একটি থালা, একটি গ্লাস। অল্পচালের ভাত, আলু সেদ্ধ, কিছু সবুজ শাকসবজি। খাবারগুলো সামনে নিয়ে বসে আছি আমি আর আমার বউ। দু’চোখ ভর্তি ভালোবাসা, সীমাহীন তৃপ্ততার একটি সংসার। যেখানে টাকা, পয়সার ছড়াছড়ি নেই। বিলাসবহুল জীবন নয় তবুও শান্তি আছে, তৃপ্তি আছে, নেই কোন বিতৃষ্ণা বা বীভৎস অনুভূতি। আমার ঐ ছোট্ট সংসারে এক সমুদ্র ভালোবাসার উজানে রোমানা’কে কখনোই কল্পনা করতে পারতাম না৷ কারণ, রোমানা আমার বউ হলে এই স্বপ্নগুলো স্বপ্নই রয়ে যেতো৷ কারণ এই স্বপ্ন রোমানা দেখেনি৷ এই পরিস্থিতিতে রোমানা মানিয়ে নিতে পারবে না। আম্মা রোমানাকে আমার বউ করার পেছনের আসল উদ্দেশ্য ছিল, আমাকে পাঁচফোড়ন গৃহে আঁটকে দেওয়া। সহজসরল, একেবারে বাঁধ্য মেয়ে রোমানা। আম্মার বিরুদ্ধে একটা সঠিক কথা বলারও সাহস হতো না ওর৷ যে গৃহ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছিলাম, সেই গৃহে বন্দি হওয়ার ভয়ে রোমানাকে বিয়ে করার প্রতিও বিতৃষ্ণা ধরে গেল। আম্মা আমার জেদ জানতো, তাই ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে রাজি করিয়েও নিল। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে রোমানাকে করব তবে শর্ত থাকবে, পাঁচফোড়ন গৃহ ছাড়তে হবে। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাথায় তোমার দেখা পেলাম। সেদিন রাতে আকাশে চাঁদ ছিল না কিন্তু আমি চাঁদের দেখা পেয়েছিলাম। পুরো পৃথিবী সেদিন চন্দ্রকান্তার অভাবে ভুগলেও আমি আমার চন্দ্রকান্তা’কে পেয়েছিলাম৷ সে তিথিতে অনুভব করেছিলাম, ভালোবাসার। রোমানার লজ্জামাখা মুখ সহস্র বার দেখেও যে অনুভূতি হয়নি তোমার লজ্জাহীন, নিষ্পাপ মুখের স্বচ্ছ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়েই অনুভব করেছিলাম অদ্ভুত এক অনুভূতি’কে। বহু বার বহু চেষ্টা করেও এই অনুভূতি কাটাতে পারিনি। তারপর থেকে যতবার তোমায় দেখেছি, যতবার এই মুখটা দেখেছি ততবার সৃষ্টিকর্তা আমাকে একটি কথা ভাবতে বাঁধ্য করেছে, তুমি আমার, শাহিনুর আমার, ঐ শারমিন বাইজির মেয়েটা প্রণয় চৌধুরীর। কত কিছু হয়ে গেল। কতবার এগিয়েছি, কতবার পিছিয়েছি সব শেষে পেয়েছি তোমায় নিজের করে। রোমানা’কে ভালোবাসার অনেক কারণ থাকলেও ও’কে আমি ভালোবাসতে পারিনি৷ আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য যাকে আমি কল্পনাই করতে পারিনি তাকে ভালোবাসতাম কী করে? তোমাকে ভালোবাসার একটিই কারণ, আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য তোমাকে আমি কল্পনা করতে পারি৷ যাকে দেখে আমার আমার লাগেনি তাকে কী করে আমার করতাম বলো? আর যাকে একবার দেখেই আমার আমার লেগেছিল তাকে কীভাবে আমার করে নিলাম ভাবো।
শেষ কথা হলো- আমার স্বপ্ন পূরণের কারিগর রোমানা ছিল না। তুমি ছিলে তাই তোমায় পেয়েছি আমি। আমার দুটো স্বপ্ন ছিল, এক. ডাক্তার হয়ে নিজের সম্মানজনক পরিচয় তৈরি করা। দুই. আমার ছোট্ট একটি ঘর, ছোট্ট একটি সংসার। একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয়টি তুমি পূরণ করবে। আমাদের ছোট্ট সংসারে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা দিয়ে সংসার আলোকিত করবে তুমি, আমার চন্দ্রকান্তা।
***
লম্বা একটি শ্বাস ছাড়লো প্রণয়৷ দীর্ঘসময় ধরে একইভাবে কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠেছে সে। কথার ফাঁকে কখন সে শাহিনুরের থেকে আলাদা হয়ে গেছে টের পায়নি। শাহিনুর তার পেছনে ছিল। পিঠ মুখি হয়ে দাঁড়িয়ে দূর আকাশপানে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল প্রণয়৷ তাই কথা শেষে সহসা পেছন ঘুরে দাঁড়াতেই শাহিনুরের বিধ্বস্ত মুখ দেখে আঁতকে ওঠল।
বলল,
-‘ নুর তুমি ঠিক আছো? ‘
ঝাপসা দৃষ্টিতে ক্ষণকাল প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে শাহিনুর বলল,
-‘ আমাকে নিয়ে এত স্বপ্ন কেন দেখলেন ডাক্তারসাহেব?’
এটুকু বলেই জ্ঞান হারিয়ে প্রণয়ের বুকে ঢলে পড়ল সে। হঠাৎ শাহিনুরের এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল প্রণয়৷ কাছের মানুষের অল্প কিছুতেই অতি সাহসী মানুষটাও ভীত হয়ে পড়ল খুব৷ পরোক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ত্বরিতগতিতে শাহিনুর কে কোলে তুলে ছুটে গেল শোবার ঘরে।