রঙ্গন স্থির হয়ে বসে থাকতে পারল না। চা’য়ের কাপটি সামনের টেবিলে রেখে ওঠে দাঁড়াল। পলাশ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে একটি অঘটন ঘটিয়ে ফেলল। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে টেবিলে থাকা সমস্ত কিছু আছড়ে ফেলল। কাঁচের একটি গ্লাস ভেঙে চৌচির হয়ে গেল৷ দু’টো চায়ের কাপের সঙ্গে মেঝের সংঘর্ষ লেগে ঝনঝন শব্দ করল৷ আকস্মাৎ ভাইয়ের এহেন কাণ্ড দেখে ভয় পেয়ে গেল রঙ্গন। কেঁপে ওঠল শাহিনুর,ময়না দু’জনই। ঘাড় ঘুরিয়ে বৈঠকখানায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রণয়। পলাশ এবং রঙ্গন’কে দেখে শাহিনুরের একটি হাত প্রচণ্ড শক্ত করে চেপে ধরল। পলাশ এক মুহূর্তের জন্যও সেখানে আর স্থির থাকতে পারল না। তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে ত্যাগ করল বৈঠকখানা৷ হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল রঙ্গন। প্রণয় এক পলক শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে ময়না’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ ও’কে নিয়ে যান। ‘
চেতনা ফিরে পেল শাহিনুর। রঙ্গনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রণয়ের দিকে অবাক চোখে তাকালো। চোয়াল শক্ত করে দৃঢ়চিত্তে প্রণয় বলল,
-‘ যাও। ‘
প্রণয়ের দৃষ্টি থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে ময়নার সঙ্গে ধীরপায়ে চলে গেল শাহিনুর। ফোস করে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছাড়ল প্রণয়। বৈঠকখানায় তাকে প্রবেশ করতে দেখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল রঙ্গন। প্রণয় সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখল রঙ্গন’কে। তার দিকে তাকিয়েই শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসল। রঙ্গন’কেও ইশারায় বসতে বলল৷ রঙ্গন মৃদু হেসে তার পাশে বসল। বলল,
-‘ সরি ভাইয়া। ফিরতে বেশ সময় লেগে গেল। ‘
প্রণয় বিমর্ষ কন্ঠে বলল,
-‘ বাড়ি’তে কতো কিছু ঘটে গেল। পিতৃহীন হয়ে গেলাম আমরা! পরিবারের উপর এত চাপ। অথচ তুই কক্সবাজার গিয়ে পুরো একটা মাস বন্ধু’দের সঙ্গে এনজয় করেছিস। আব্বার মৃত্যুর পর সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলাম তোকে নিয়ে রঙ্গন। ‘
গলা শুকিয়ে গেল রঙ্গনের। সকল’কে ফাঁকি দেওয়া যতটা সহজ, প্রণয়’কে ফাঁকি দেওয়া ঠিক ততটাই কঠিন৷ প্রণয়ের কথায় পরিষ্কার বুঝতে পারল এতদিন সে কোথায় ছিলো, কার কার সাথে ছিলো সমস্তই জানে তার এই ভাইটা। শুকনো গলায় আমতা আমতা শুরু করল সে। প্রণয় তাকে জোরালো ভাবে কয়েকটি প্রশ্ন করতে উদ্যত হতেই বৈঠকখানায় আগমণ ঘটলো প্রেরণার। কনিষ্ঠ পুত্র রঙ্গন’কে বাঁচানোর জন্য সে প্রণয়’কে বলল,
-‘ দু’ভাই মিলে কি গল্প চলছে এখানে? আরেকজন যে ঘরে ভাঙচুর করছে সে খবর জানিস তোরা? ‘
মা’কে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রঙ্গন৷ করুণ দৃষ্টি’তে প্রেরণার দিকে তাকাতেই প্রেরণা তাকে আশ্বাস দিল।বলল,
-‘ একজন পড়াশোনা, পরীক্ষা এসবের জন্য ঢাকা শহরে আঁটকে ছিল। আরেক জন বিয়ে করে মহা ব্যস্ত। আমার অসুস্থ ছেলেটা’কে তার ভাই’রা কেন সময় দেবে…আমি মা, নাড়ি ছেঁড়া ধন সে আমার। সুস্থ, অসুস্থ যাই হোক আমিতো মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি না। ‘
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল প্রেরণা। রঙ্গন ওঠে এসে মা’কে জড়িয়ে ধরল। স্বান্তনা দিয়ে বলল,
-‘ আম্মা এভাবে কাঁদবেন না। ভাইয়ার জন্য আমরা সবাই আছি৷’
রঙ্গনের বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল প্রেরণা৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল প্রণয়। কেন জানি মা’য়ের এই কান্নাটা বিরক্ত লাগলো তার। তবুও মা’য়ের প্রতি সম্মান রেখে ভাই’য়ের প্রতি স্নেহ রেখে বলল,
-‘ আমি যাচ্ছি অঙ্গনের কাছে আম্মা, আপনি কাঁদবেন না।’
অঙ্গনের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল প্রণয়। প্রেরণা কান্না থামিয়ে বলল,
-‘ প্রণয়, আমার সব ছেলেদের চেয়ে তোমার প্রতিই বেশি আস্থা ছিল আমার৷ সেই তুমিই আমাকে এভাবে আঘাত করলে! ‘
থেমে গেল প্রণয়। বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘ আপনি ভুল বুঝছেন আম্মা। ‘
রঙ্গনের থেকে নিজেকে সরিয়ে প্রণয়ের দিকে এগিয়ে গেল প্রেরণা৷ প্রণয়ের দৃষ্টি মা’য়ের পানেই স্থির। প্রেরণা জমিদার গিন্নির সরূপ কাঠিন্য সুরে বলল,
-‘ কি করেছ, কি হয়েছে সেসব বলে আর লাভ নেই। কিন্তু মনে রেখ আমার পাঁচ জন সন্তান’কেই আমি সমান ভালোবাসি৷ তোমাদের চার ভাইয়ের ছোটো আমার রঙ্গন৷ ছোটো’দের ভুল গুলো’কে গুরুত্ব দিতে নেই৷ তোমাদের আব্বা আজ দুনিয়া’তে নেই৷ তার চোখের মণি ছিল রঙ্গন৷ তিনি চলে গেছেন বলে আমার রঙ্গনের প্রতি কোন অবহেলা সহ্য করব না। অঙ্গন কখনো সুস্থ হবে কিনা জানিনা। অঙ্গনের দায়িত্ব পালনে কোন ত্রুটি থাকবে না জানি। তাই ওর বিষয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই৷ আমি চাই তোমাদের বাবার মতোই তোমাদের তিন ভাইয়েরও চোখের মণি হয়ে থাক রঙ্গন।’
-‘ অহেতুক চিন্তা করে এসব বলার প্রয়োজন নেই আম্মা।’
তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রণয়ের বলা বাক্যটি শেষ হতেই প্রেরণা অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। প্রণয়ের একটি হাত জোরপূর্বক নিজের মাথায় চেপে ধরে বলল,
-‘ তোকে আমার কসম রইল প্রণয় জীবনে কোন পর্যায়ে, কোন পরিস্থিতি’তে রঙ্গন’কে একলা ছাড়বি না। সব সময়, সব পরিস্থিতি’তে ওর পাশে থাকবি, সব বিপদ থেকে রক্ষা করবি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি যে কোন বিপদে ওর ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়াবি।’
বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রণয়৷ হঠাৎ প্রেরণার এসব কথার কোন অর্থ খুঁজে পেল না সে। তার বিচক্ষণ মনে ঠিকই প্রশ্ন জেগে ওঠল,
-‘ অঙ্গনের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি থাকবে না, এটা আম্মা জানে। অথচ রঙ্গনের প্রতি ত্রুটি থাকতে পারে এ মনোভাব সৃষ্টি হলো কেন?’
প্রণয় চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল। কোনভাবেই কিছু মেলাতে পারল না। সুক্ষ্ম এক চিন্তায় বিভোর হয়ে রইল সে।
[৫৫]
রান্নাঘরে ভৃত্য’রা কাজ করছে৷ সেখানে মহিলা সদস্যদের প্রায় সকলেই উপস্থিত। মুনতাহা একপাশে চেয়ার পেতে বসে আছে। সকাল সকাল তার কাঁচা আম খেতে ইচ্ছে করেছে। ইচ্ছে টুকু প্রকাশ করা মাত্রই গাছ থেকে আম পাড়া হয়েছে। সেগুলো এখন চিকন করে কেটে কাঁচা মরিচ,লবণ চিনি,কাসুন্দি দিয়ে ভর্তা করা হচ্ছে। ভর্তা করছে শবনম। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই মুনতাহার মনে শুচিবায়ু রোগটি বাসা বেঁধেছে। সব কিছুতেই খুঁতখুঁতে ভাব। সব কিছুতেই সে আঁষটে গন্ধ পায়। আম পেরে এনেছিল হাফিজা খালা। যিনি প্রায় পনের বছর যাবৎ পাঁচফোড়ন গৃহে কাজ করছে। ঘর্মাক্ত শরীরে তাকে আম কাটতে বসতে দেখেই মুনতাহার গা গুলিয়ে বমি পায়। সে ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের। বলা যায় ভিতর মুখী মানুষ। তাই সামনাসামনি কিছু না বলে গোপনে শবনম’কে জানায়, হাফিজা খালার থেকে আঁষটে গন্ধ পাচ্ছে। সে ভর্তা বানালে গলা দিয়ে নামবে না। শবনম প্রথমে অবাক হয় পরে তার সন্তান সম্ভবার কথাটি স্মরণ করে হাফিজা খালা’কে কৌশলে অন্য কাজে পাঠিয়ে দেয়, এবং নিজেই আম ভর্তা করতে বসে। শাহিনুর তেমন কোন কাজ পারে না। রান্নাবান্না একেবারে জানে না বললেই চলে। সংসার সম্পর্কেও তার ধারণা নেই। প্রতিটি মেয়েই জন্মের পর মা’য়ের সংসার দেখতে দেখতে বড়ো হয়৷ নিজের সংসারের পূর্বে মা’য়ের সংসার সম্পর্কে অবগত হয়ে নেয় তারা৷ কিন্তু শাহিনুর মা’য়ের সংসার দেখেনি। অন্যান্য মেয়েরা ছোটোবেলায় পুতুল খেলে বড়ো হয়। তাদের মা যেমন সকালবেলা তাদের খাওয়িয়ে স্কুলে পাঠায়, গোসল করায়,ঘুম পাড়ায়, দাদা,দাদির সঙ্গ পায়, মামাবাড়ি বেড়াতে নিয়ে যায় তারাও পুতুল খেলায় সেসব কল্পনা করে করে খেলে। আর শাহিনুর ছোটোবেলায় পুতুল খেলার সময় সুই সুতা দিয়ে পুঁতির ঘুঙুর বানাতো। নিজে হতো বাইজি, পুতুল’কে বানাতো নিজের কন্যা৷ সে কন্যা’কে একা একা বড়ো করে নৃত্য শিক্ষা দিত। শারমিন তাকে যেসবের ধারে কাছে যেতে দিত না সে কল্পনায় সেসবেই ডুবে থাকত।কল্পনায় জমিদার’দের থেকে আড়াল করত পুতুল দের। তার জীবনী যেখানে সীমাবদ্ধ ছিল পুতুলদের জীবনীও সেখানে বদ্ধ রাখত। বাস্তবতা সম্পর্কে বিন্দু মাত্র ধারণা ছিল না তার। যে মেয়ে মা’য়ের সংসার দেখেনি সে মেয়ের জন্য নিজের সংসার বড্ড কঠিন।সংসারে মা’য়েদের সংগ্রাম দেখা প্রতিটি মেয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি থেকেই বঞ্চিত হয়েছে শাহিনুর৷ রান্নাবান্নার ব্যাপারে বড্ড আনাড়ি সে। বুঝতে পেরে অরুণা তাকে আদেশ দিয়েছে,রোজ যখন রান্না করা হবে পুরোটা সময় সে যেন উপস্থিত থাকে। জমিদার বাড়ির বউ হওয়া অত সোজা নয়৷ তাছাড়া প্রণয় এ বাড়ি’তে দীর্ঘদিন থাকবে না৷ স্বামীর সঙ্গে যখন একা সংসার করবে তখন স্বামী’কে রেঁধে বেড়ে খাওয়াতে হবে। একা সংসার গোছানোর পূর্বে সব কিছু শিখে পড়ে নিতে হবে শাহিনুর’কে। অরুণার মুখে এসব কথা শুনে চমকে ওঠে শাহিনুর। প্রণয়ের সঙ্গে একা একা থাকতে হবে তাকে ? এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে? যদি তাই হয় সে তো লক্ষ্য ভ্রষ্ট হবে!
রান্নাঘরেই ছিলো শাহিনুর। ছিলো মুনতাহা, শবনম দু’জনই। অরুণা,প্রেরণা ভোজন কক্ষে। ভৃত্য’রা একে একে খাবার নিয়ে যাচ্ছে। পল্লব,পলাশ, প্রণয়, রঙ্গন চারভাই’ই একসঙ্গে খেতে বসেছে। এমন সময় ময়না এসে খবর দিল, আকাশের অবস্থা ভীষণ খারাপ। মেঘ গুড়গুড় করছে। ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা বেশি। প্রেরণা হাফিজা’কে ছাদে যেতে বলল। অঙ্গনের কিছু জামাকাপড় শুখাতে দিয়েছিল সে তাই। অরুণা ময়না’কে বলল,
-‘ তুই রান্নাঘরে বউ’দের বলে আয় আবহাওয়া সুবিধার না। ‘
ময়না অপেক্ষা করল না ছুটে গিয়ে সবাই’কে জানালো। কাউকে তেমন চিন্তিত দেখাল না। শুধু শাহিনুর নিঃশব্দে মৃদু পায়ে দ্বারের কাছে এলো। শবনম’কে বলল,
-‘ বড়ো ভাবি আমি একটু পর আসছি। ‘
সঙ্গে সঙ্গে ময়না বলল,
-‘ আপনার যাইতে হবো না ভাবি। আমারে কন কি কাজ, আমিই কইরা দেই।’
শাহিনুর শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল ময়নার দিকে। শবনম বলল,
-‘ নুর ও’কেই বলে দাও। বড়ো আম্মা,আম্মা এসে না দেখলে আবার দু’কথা হতে পারে। ‘
নির্লিপ্ত দৃষ্টি’তে এক পলক শবনম’কে দেখে নিয়ে ময়নার চোখে চোখ রাখল শাহিনুর। নম্র গলায় বলল,
-‘ বারান্দায় আমার কিছু কাপড় রয়েছে ওঠিয়ে বিছানায় রেখ। আমি পরে গুছিয়ে রাখব।’
ময়না আর দেরি করল না। চঞ্চল পা’য়ে ছুটে গেল প্রণয়ের কক্ষে। ময়না চলে যাওয়ার পর পরই জেবা এলো। বরাবরের মতোই সেজেগুজে কোমড় হেলিয়ে দুলিয়ে, বিনুনি নাচাতে নাচাতে রান্নাঘরে প্রবেশ করল সে। মুনতাহা’কে আম খেতে দেখে জিবে জল চলে এলো তার। কোন কিছু না ভেবে চটপট আমের বাটি’তে হাত দিতে গেল ৷ শবনম দ্রুত তাকে থামিয়ে দিল। হাত ধরে বলল,
-‘ খালি পেটে টক খেতে নেই। কিছুক্ষণ পর সকলের সঙ্গে সকালের খাবার খেয়ে তারপর খাবে। তোমার জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছি।’
খুশিতে গদগদ হয়ে শবনম’কে জড়িয়ে ধরল জেবা৷ বলল,
-‘ এজন্যই তোমাকে আমার সতিন সতিন লাগে না। বড়ো আপা, বড়ো আপা লাগে।’
শবনম আর জেবা’কে এভাবে দেখে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শাহিনুর৷ এ বাড়ি’তে প্রবেশ করার পর এই একটি দৃশ্য যা দেখে তার মন’টা খুশি হলো,শান্তি পেল৷ সতিন মানে কী বেশ ভালো করেই বুঝে সে। এটা বুঝেছে অবশ্য তার আম্মার থেকেই। সেই যে তার বাবার জীবনে অন্য একজন নারী’কে জুড়ে দিয়ে সংসার ত্যাগ করেছিল তার আম্মা। সতিনের সংসার করতে, স্বামী’কে অন্য নারীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে বুকে লেগেছিল তার, মানেও লেগেছিল। সবটাই শুনেছে বুঝেছে সতিন কথাটির অর্থ। জেবার প্রতি তেমন শ্রদ্ধা অনুভব করল না তবে শবনমের প্রতি শ্রদ্ধার অন্ত রইল না। কাজের থেকে মনোযোগ সরে গিয়ে সম্পূর্ণ মন পড়ে রইল শবনমের কাছে। শবনম’কেও তো ভাগ করতে হয়েছে তার স্বামী’কে! তবুও সতিনের সঙ্গে এত সুন্দর, স্বাভাবিক সম্পর্ক কীভাবে হলো? এ বাড়ি’তে এ মানুষ’টাই কি তবে আলাদা ধাঁচের?
[৫৬]
সকালের খাবার সেরে সবাই যার যার মত ব্যস্ত৷ দোতলার বারান্দায় বসে জেবার মাথায় বিলি কেটে কেটে উঁকুন এনে দিচ্ছে শবনম৷ আর মৃদুস্বরে ধমকাচ্ছে।
-‘ ভেজা চুল বেঁধে রাখতে কতবার নিষেধ করেছি তোমায়? উঁকুন মারা তেল আনিয়েছি উনা’কে দিয়ে। আর উনি বলে দিয়েছেন, মাথা থেকে উঁকুন না যাওয়া পর্যন্ত উনাকে না ডাকতে।’
জেবা মন খারাপ করে বলল,
-‘ আপা উনাকে বলো, আমার ভালোভাবে ঘুম হয় না৷ উনাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারি না, রাত কাটে না। ‘
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শবনম। ক্ষীণ স্বরে বলল,
-‘ বলে দেব। এবার তেল’টা দিয়ে দেই? ‘
-‘ দাও আজই উঁকুন মরে সাফ হবে তো? ‘
-‘ হুম। ‘
-‘ তাহলে তো আজই আসবে উনি। ‘
জেবার কন্ঠে উৎফুল্লতা। শবনম চাপা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
-‘ আজ না গেলেও কাল ঠিক যাবে দেখে নিও। আজ হয়তো উনার জরুরি কিছু কাজ আছে। তুমি তো জানো কাজের সময় উনার মাথা ঠিক থাকে না। আর মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য আমাকেই লাগে। সারারাত জেগে চা বানানোর দায়িত্ব’টা তো আর নিতে পারবে না। ‘
-‘ না না আমি রাত জাগব না। তাহলে আমার চোখের নিচে ডেবে যাবে। চেহেরা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি শুনেছি রাত জাগলে মেয়েরা তাড়াতাড়ি বুড়ি হয়। আমি বুড়ি হলে উনি আর ভালোবাসবে না আমায়৷ মনও উঠে যাবে আমার থেকে।’
আফসোস মিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেলে শবনম বলল,
-‘ তাহলে আজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর চেষ্টা করো। উনার ব্যস্ততা কেটে গেলে ঠিক যাবে। ‘
সহজসরল জেবা’কে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। পল্লব চৌধুরী এই মেয়েটা’কে ভালোবাসে কিনা জানে না শবনম। হয়তো বাসে হয়তো না। ভালোবাসলে অবশ্য উঁকুনের ভয়ে টানা ন’দিন শুধু প্রথম স্ত্রী’র সঙ্গে রাত কাটাত না। পৃথিবীতে কিছু পুরুষ থাকে যারা সত্যিকারের অর্থে কাউকে কখনো ভালোই বাসেনি৷ শবনমের মনে হয় পল্লব সেই পুরুষদের মধ্যেই একজন। পল্লব আজ পর্যন্ত তাকে কখনো ভালোবাসি বলেনি। জেবা আসার পূর্বে মনে হতো হয়তো ভালোবাসে খুব ভালোবাসে। কিন্তু প্রকাশ করে না। সে ধারণা বদলে গেছে জেবা আসার পর। শুরু হয়েছে স্বামী ভাগাভাগির খেলা!
কক্ষে এসে বিছানায় থাকা নিজের কাপড়গুলো ভাঁজ করতে গিয়ে শাহিনুর লক্ষ্য করল,তার ভিতরে পরার একটি বস্ত্রাদি নেই৷ ভ্রুদ্বয় কুঁচকে পুরো কক্ষ খুঁজল। না পেয়ে বারান্দায় দেখে এলো। তবুও পেল না। প্রণয় কক্ষে এসে তাকে কিছু খুঁজতে দেখে বলল,
-‘কি খুঁজছ?’
বিচলিত হয়ে প্রণয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিছানায় থাকা কাপড়গুলো তুলে প্রণয়ের কাবার্ডে রাখতে গেল। প্রণয় ত্বরিতগতি’তে গিয়ে কাবার্ডের কপাট খুলে দিল। শাহিনুর এক পলক শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার দৃষ্টি সরিয়ে তাকে কাপড় রাখল। মৃদু হাসল প্রণয়। শাহিনুর দাঁড়াল না। ধীরপায়ে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে খুঁজতে গেল ময়না’কে। কিন্তু পেছন পেছন যে প্রণয়ও আসছে সেটুকু খেয়াল করল না৷ ময়না’কে খুঁজতে গিয়ে সে একদম রঙ্গনের কক্ষের সামনে এসে পড়ল। রঙ্গন তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুনিয়ে গান করছিল আর চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করছিল। শাহিনুর কিছু সময়ের জন্য থেমে গেল৷ উন্মুক্ত দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে একধ্যানে তাকিয়ে দেখতে লাগল রঙ্গন’কে। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই পেছন থেকে বলিষ্ঠ একটি হাত পেট মুড়িয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। আঁতকে ওঠে চোখ উল্টে তাকাতেই প্রণয়ের গম্ভীর মুখটি দেখতে পেল। প্রণয় নিমিষেই সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে একদম নিজের কক্ষে চলে এলো। শাহিনুর কিছুমাত্র বলার পূর্বেই প্রণয় তাকে ছেড়ে দিল এবং নিজের দিকে ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বলল,
-‘যে পুরুষ’কে চোখে ধরে সে পুরুষ’কে কখনো মনে ধরে না।’
লেখকের কথা: কয়েক পর্ব ধীরে চলবে ইনশাআল্লাহ। তারপর শুধু ধামাকা! পাঠকদের অনুরোধ আমার ভুলগুলো চিহ্নিত করবেন আমি শুধরে নেব। অবশ্যই অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করতে ভুলবেন না।