বাইজি কন্যা | পর্ব – ৩৩ (দ্বিতীয় খন্ড শুরু)

পরনে ফিকে কমলা বর্ণযুক্ত একটি সূতি শাড়ি। যার পার টকটকে লাল বর্ণের৷ মাথার মধ্যেখানে লম্বা সিঁথি কাটা। দু’পাশের চুলগুলো যত্নসহকারে পিছনে নিয়ে বড়োসড়ো একটি খোঁপাও বাঁধা। হাতে,কানে, গলায় তেমন অলংকার নেই। সব ঘুমানোর পূর্বেই খুলে রেখেছে। কক্ষের ভিতরে ঝকঝকে আলো থাকায় নিজের হাত দু’টো চোখের সামনে মেলে ধরলো। দু’হাত মেহেদি’র রঙে রাঙানো। কব্জিতে মোটা দু’টো স্বর্ণের বালা। শাহিনুর কিঞ্চিৎ চিন্তান্বিত হয়ে বালা দু’টো খুলে ফেলল৷ তারপর তা পালঙ্কের পাশের টেবিলে রেখে দিলো। বিশাল পালঙ্কের এক পাশে বলিষ্ঠ দেহের প্রাপ্ত বয়স্ক যুবকটি অচেতনীয় গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ছে৷ দ্বিতীয়’বারের মতো আবারও নজর পড়লো তার উন্মুক্ত বলবান শারীরে। আবারও লজ্জায় দৃষ্টি সরিয়ে নিলো৷ ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে টেবিলের এক পাশে থাকা টর্চটি সন্তর্পণে ওঠিয়ে নিলো। পা বাড়ালো উপযুক্ত জায়গাটির উদ্দেশ্যে। শেষ রাতে বাসর ঘর ছেড়ে, স্বামী’কে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় রেখে অতি গোপনে নববধূ গৃহ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সদর দরজা পেরিয়ে “পাঁচফোড়ন গৃহের” পশ্চাৎমুখী হতেই চারদিক ফজরের আজান ধ্বনি’তে মুখরিত হয়ে ওঠল। ত্বরিতগতি’তে ফেলা চরণদ্বয় সহসা থামিয়ে দিলো শাহিনুর। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিলো।মনে পড়ে গেলো তার আম্মার কথা… আজানের সময় মাথায় কাপড় দিতে হয়। তার আম্মা সব সময় দিতো এবং তাকে বলতো দিতে। কখনো কখনো শারমিন নিজেই হাত বাড়িয়ে মাথায় কাপড় টেনে দিতো। পুরোনো স্মৃতি ভাবতে ভাবতে আবারো পা বাড়ালো শাহিনুর। জমিদার বাড়ি’তে রহস্যের শেষ নেই। প্রতিটি চরিত্রের মাঝেই রহস্য আর রহস্য। শুধু চরিত্র নয় শাহিনুরের মনে হচ্ছে গৃহের প্রতিটি কোণায় কোণায়, জমিদারের জমির ভূমির তলদেশ অবধিও রহস্য ডেবে আছে৷ আর সব তাকে উন্মোচন করতে হবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস তার আম্মা’কে অলিওর খু’ন করেনি। যদি তাই হতো অলিওর বেঁচে থাকতো, সে মরে যেত না। যোজন বিয়োজন চিন্তায় বিভোর হয়েই সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে পৌঁছালো শাহিনুর। যে স্থানে কিছু সময় পূর্বে দু’জন আগন্তুক এসেছিল। ডান দিক থেকে সামান্য দূরেই শারমিনের কবর অবস্থিত। টর্চ উঁচিয়ে আম্মার কবর’টায় দৃষ্টি বুলালো। চাপা একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো এবং সুক্ষ্মভাবে তাজা ঝুরঝুরে মৃত্তিকার দিকে দৃষ্টিপাত করল। আশপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে নিচু হয়ে তাজা মাটিতে স্পর্শ করল সে। সঙ্গে সঙ্গেই হৃৎপিণ্ড’টা মুচড়ে ওঠল। কেন জানি কান্না পেলো খুব। এই কান্নার অর্থ খুঁজে পেলো না। মাটির সঙ্গে কান্নার কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? হয়তো আছে গভীর কোনো সম্পর্ক। আরেক পলক আম্মার কবরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শাহিনুর। মানুষ মারা যাওয়ার পর যখন তাকে কবর দেওয়া হয় তখন ঝুরঝুরে মাটি দিয়েই কবর দেওয়া হয়৷ যে মাটি’কে অনেকে বলে তাজা মাটি। বুকের ভিতর সুক্ষ্ম এক ব্যথা অনুভব করলো শাহিনুর৷ কেন জানি আপনজন হারানোর ব্যথার আভাস পেল সেখানে। চারদিকের মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর কেঁপে ওঠল। বক্ষগহ্বরে গুমোট ভাব স্পষ্ট। একহাতে টর্চ লাইট ধরে অপর হাতে উঁচু হয়ে ওঠা তাজা ঝুরঝুরে মাটি সরাতে শুরু করল। রক্তের সম্পর্কের পর এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো একটি সম্পর্ক হলো আত্মার সম্পর্ক। আত্মার টান রক্তের চেয়েও তীব্র হয়। সেই টানেই হয়তো ছুটে এসেছে শাহিনুর। তার প্রিয় বুবুর টানে! মান্নাত বুবু! দ্বিতীয় মা মান্নাত বাইজি। প্রায় এক মিনিট এভাবেই মাটি সরালো শাহিনুর। বেরিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি। যেটি সে “ডাক্তার সাহেবে’র” কক্ষ থেকে স্বল্প আলোয় দু’জন ব্যক্তি’কে পুঁততে দেখেছিল। লাল কাপড়ে গোল করে মোড়ানো ভারী বস্তুটি’তে স্পর্শ করতেই তার শুভ্র হাত লাল তরলে রঞ্জিত হয়ে গেল। সর্বাঙ্গ ভয়ঙ্কর মাত্রায় কেঁপে ওঠল। গণ্ডস্থল থেকে বক্ষঃস্থল পর্যন্ত শুষ্ক কাষ্ঠ’তে পরিণত হলো। একহাতে টর্চ ধরে অপরহাতে কাঁপা কাঁপা ভাবে হাতের তালু দেখল। তীব্র উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করতে শুরু করল। শুকনো এক ঢোক গিলে টর্চ’টা মাটিতে শুইয়ে দু’হাতে ভেজা লাল পুটলির বাঁধন খুলে ফেলল। কি বীভৎস এক দৃশ্যের সম্মুখীন সে হলো, তা কেবল এক উপরওয়ালাই জানলো। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মৃদু আওয়াজ বেরিয়ে এলো শাহিনুরের মুখ দিয়ে। কেমন ছটফটিয়ে ওঠল ওর আত্মা। থরথর করে কাঁপতে থাকা একটি হাত বাড়িয়ে টর্চ লাইটা উঁচিয়ে ধরতেই একটি সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত নগ্ন দেহ স্পষ্ট দেখতে পেল৷ সঙ্গে সঙ্গেই ছিটকে দূরে সরে গেল। টর্চ লাইট পড়ে গেল মাটিতে। শাহিনুর দু-হাতে মুখ চেপে ধরে গগনবিদারী এক চিৎকার দিলো, -‘মান্নাত বুবু! ‘
চারদিকে তখন ধীরে ধীরে আলো ফুটছে। ঘনান্ধকার কেটে গিয়ে আবছা আলোয় নিমজ্জিত হয়ে আছে চারপাশ। শাহিনুরের দু-হাত রক্তে এবং মাটিতে মাখামাখি হয়ে আছে। প্রচণ্ড যত্ন নিয়ে সে মান্নাতের সুঁদরি দেহে’র খণ্ড খণ্ড অংশগুলো মাটি চাপা দিয়ে দিলো। এক পলক আম্মার কবরে তাকিয়ে আরেক পলক তাকালো মান্নাতের সদ্য দেওয়া কবরের পানে। হাহাকার মিশ্রিত এক নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বিরবির করে বলল,
-‘ তোমাদের কান্নায় একদিন হাসি ফুটবে। এই মাটির অভিশাপ ওদের ধ্বংস করে দেবে! মান্নাত বুবু, আমি কাউকে ছাড়ব না। তুমি দেখে নিও বুবু…আমি কাউকেই ছাড়ব না। ‘
এক মুঠো মৃত্তিকা তুলে নিজের মাথায়, দু’গালে, দু’বাহুতে যত্ন করে মাখিয়ে নিলো শাহিনুর। বলল,
-‘ শেষ আদরটুকু নিয়ে নিলাম বুবু। এই মাটি ছুঁয়ে কসম করলাম, ঐ দু’জন’কে খুঁজে বের করে,আমার আম্মার খু’নি’কে,তোমার বীভৎস খু’নের পিছনে যে বা যারা আছে প্রত্যেকের রক্তে গোসল করব আমি! ‘
[৫৩]
স্নানাগার থেকে পানির শব্দ পেয়ে প্রণয়ের ঘুম ছেড়ে গেল। পাশে ফিরে ফাঁকা বিছানা দেখে নিঃশব্দে ওঠে বসল সে। ভ্রু কুঁচকে স্নানাগারের দরজার পানে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
-‘ এই ভোরে ‘ও’ গোসল করছে কেন? আমাদের তো কিছু হয়নি। ‘
গুরুগম্ভীর একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বিছানা ছাড়ল সে। বেশ কিছুক্ষণ রুমে পায়চারি করে গলায় তয়ালে ঝুলিয়ে স্নানাগারের সামনে দাঁড়াল। চার মিনিট পর লাল রঙের একটি জামদানি শাড়ি পরা অবস্থায় বের হলো শাহিনুর৷ মাথায় তয়ালে পেঁচানো। হাতে একটি ছোট বালতি। প্রণয় দেখল সেখানে গতকাল রাতে পরা কাপড়গুলোই পিষ্টকরণ ভাবে রয়েছে। সাধারণত গোসলের পর পনেরো,ষোল বছর বয়সী কিশোরী’কে যেই রূপে প্রত্যাশ্যা করেছিল শাহিনুর’কে ঠিক সেই রূপে পেল না। শাহিনুরের স্বচ্ছ দৃষ্টিজোড়ায় ঘনীভূত হয়ে আছে অজস্র অশ্রুকণায়। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে অশ্রুকণার বর্ণ আজ রক্তিম। প্রণয়ের বুকের ভিতর ছটফটে অনুভূতির সৃষ্টি হলো। সহসা এক হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে শাহিনুরের কপোল ছুঁয়ে প্রশ্ন করল,
-‘ কী হয়েছে তোমার? ‘
শাহিনুর মুখ ফিরিয়ে নিলো। প্রণয়’কে পাশ কাটিয়ে দু’কদম এগিয়ে নম্র কন্ঠে বলল,
-‘ এই কাপড়গুলো কোথায় শুখাতে দেবো? ‘
কিঞ্চিৎ রাগ হলো প্রণয়ের। অপমানে দুই বাহুর পেশি গুলো ফুলে ফেঁপে ওঠল। চোয়াল শক্ত করে জবাব দিতে ইচ্ছে করল,
-‘ কতোবড়ো স্পর্ধা তোমার? আমার প্রশ্নের জবাব দাও না… ‘
পরোক্ষণেই রাগটুকু নিয়ন্ত্রণ করে শাহিনুরের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল। আবারও দেখতে পেল রক্তিম দু’টো চোখ। সে চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘ ভোর সকালে ওঠে গোসল করে চোখ,মুখের এই হাল করার কোনো মানে হয়? ‘
শাহিনুর কী জবাব দেবে বুঝতে পারল না। প্রণয় যেন কোনমতেই তাকে সন্দেহ না করে তাই অকপটে জবাব দিল,
-‘ ভাবি বলে দিয়েছিল, আগেভাগেই গোসল সেরে নিতে। ‘
আর সময় ব্যয় করল না শাহিনুর। বালতি হাতেই কক্ষ ছাড়তে উদ্যত হলো। হতবুদ্ধি অবস্থায় ত্বরিত বেগে হাত বাড়িয়ে শাহিনুরের একটি হাত টেনে ধরল প্রণয়। কেঁপে ওঠল শাহিনুর। চোখ বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। কট শব্দ করে বালতি’টা নিচে পড়ে গেল। ধীরপায়ে এগিয়ে শাহিনুরের সামনে এসে গাঢ় চোখে তাকালো প্রণয়। বলল,
-‘ এসব নিয়ে বাইরে যেও না। ওপাশে বারান্দা আছে সেখানে শুখা দাও। ‘
শাহিনুর চট করে হাত ছাড়িয়ে বালতি তুলে বারান্দায় চলে গেল৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রণয়ও স্নানাগারে ঢুকে পড়ল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। কিছুক্ষণ পূর্বে বলা শাহিনুরের কথাটি মনে করছে আর ভাবছে,
-‘ নুর এটা কি বলল? ভাবি সকাল সকাল গোসল করতে বলেছে বলেই করল? মানে সিরিয়াসলি, ও সত্যি ভাবির কথা শুনে এটা করল! ‘
বারান্দায় কাপড় মেলে দিয়ে আসার পর পরই মাথাটা কেমন চক্কর দিলো শাহিনুরের। গা গুলাচ্ছে কেমন৷ বার বার সেই দৃশ্যটি মনে পড়ছে তার৷ অন্তর কাঁপিয়ে শুধু একটি কথাই ভেসে চলেছে,
-‘ মান্নাত বুবু তুমিও নেই, তুমিও নেই। ‘
ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে শুরু করলো সে। পালঙ্কে বসে দু-হাতে ভর করে নিচের দিকে মাথা রেখে ক্রমাগত নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো। প্রণয় এসে তাকে ওভাবে দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে গেল। ব্যস্ত গতিতে কাছে এসে কাঁধ স্পর্শ করে বলল,
-‘ তুমি ঠিক আছো? ‘
শাহিনুর কিছু বলল না। বিন্দু প্রতিক্রিয়াও দেখালো না সে। প্রণয় আরেকটু ঘেঁষে বসে ধরলো তাকে। শাহিনুর কেমন করে যেন শরীর ছেড়ে দিলো। ওর মাথা এসে ঠেকলো প্রণয়ের বাহুতে। বুকের ভিতর ধক করে ওঠল প্রণয়ের৷ আতঙ্কিত কন্ঠে কয়েকবার ডাকল শাহিনুর’কে। জবাব দিলো না শাহিনুর। প্রণয় ওকে শুইয়ে দিলো। শাহিনুর নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইলো বিছানায়৷ প্রণয় আদুরে হাতে ওর ললাটে স্পর্শ করল। জ্বর নেই। স্বস্তি নিয়ে মাথায় হাত বুলালো। নরম গলায় প্রশ্ন করল,
-‘ নুর, তোমার শরীর খারাপ লাগছে? ‘
শাহিনুর মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো৷ তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে প্রণয় বলল,
-‘ কি হয়েছে? ‘
-‘ কিছু হয়নি। আপনি সরুন। ‘
প্রণয় সরলো না বরং আরেকটু কাছে গেল। আরেকটু গভীর হলো। ওর কপালের সঙ্গে কপাল ছুঁইয়ে প্রশ্ন করল,
-‘ গতকাল রাতে কি বলেছি ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই? অর্ধাঙ্গিনী তুমি আমার। তোমার সবটা জানার অধিকার রয়েছে আমার। ‘
রক্তিম দৃষ্টিজোড়া মেলে তাকালো শাহিনুর। প্রণয়ের ছোট ছোট গভীর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে চাপা একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। প্রণয় তাকিয়েই রইলো। তাকে অবাক করে দিয়ে শাহিনুর কাঁপা কাঁপা হাতে তার এক গাল স্পর্শ করল। থেমে থেমে বলল,
– ‘ ডাক্তার সাহেব, আমি মিথ্যে কথা বলতে চাই না। আর সত্যিটা আপনাকে জানাতে চাই না। তাই কোন প্রশ্ন করবেন না। ‘
উদবিগ্ন বক্ষে সহসা শান্তি অনুভব করল প্রণয়। শান্তির সরূপ ঠিক এমন যেন চৈত্র মা’সে মরুভূমির বুকে শতশত বরফ খণ্ড ঢেলে দিলো কেউ। কর্ণকুহরে শীতল হাওয়ারা ছুঁয়ে দিলো। শাহিনুরের মুখে “ডাক্তারসাহেব” শব্দটি শুনে মনে হলো, এ প্রথম এমন সম্মানের সঙ্গে কেউ তাকে ডাকল। মন বলল,আর একটি বার ডাক্তারসাহেব বলার জন্য আদেশ করতে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলল না৷ কঠিন ব্যক্তিত্বটুকুর পুরোটাই খোয়ানোর মতো মন তার হলো না। সে সরে গেল। কক্ষের বাইরে থেকে আওয়াজ এলো,
-‘ নতুন ভাবি উঠছেন? ‘
প্রণয় শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে দেখল সে চোখ বুজে শুয়ে আছে। তাই ভৃত্যের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘ কী প্রয়োজন? ‘
দ্বারের ওপাশ থেকে বলল,
-‘ জনাব, আমাকে বড়ো গিন্নি পাঠাইছে নতুন ভাবি’রে পাকঘরে নিয়া যাওয়ার জন্য। ‘
বিয়ের পরেরদিন সকাল সকাল নতুন বউ’কে, ছেলের বউ’কে রান্নাঘরে আশা করেন শ্বাশুড়ি মা’য়েরা। তেমনি হয়তো অরুণা আর প্রেরণাও আশা করছে৷ তাই প্রণয় চিন্তিত হয়ে বলল,
-‘ আপনি দাঁড়ান ও আসছে। ‘
[৫৪]
মাথায় ঘোমটা টেনে নববধূ রূপে কক্ষ থেকে বের হলো শাহিনুর। দ্বারের সামনেই তার বয়সী এক ভৃত্য’কে দেখতে পেল। মেয়েটি সুন্দরী নয় ভীষণ সুন্দরী। শাহিনুরের মনে হলো, এই মেয়েটি জমিদার বাড়ির কাজের লোক হতেই পারেনা৷ পরোক্ষণেই আপনমনে প্রশ্ন জেগে ওঠল, -‘ হঠাৎ এমন মনে হচ্ছে কেন তার? দেখতে সুন্দরী বলে সে কি কাজের লোক হতে পারে না? ‘ শাহিনুর কিছু বলার পূর্বেই মেয়েটি বলল,
-‘ নতুন ভাবি আমার নাম ময়না। আপনার দরকার, অদরকার সব কিছুর জন্যই আমারে ঠিক করা হইছে। আমি এই বাড়ির দাসী আছিলাম কিন্তু আজ থেকে এক্কেবারে আপনার খাস দাসী করা হইছে আমারে। ‘
শাহিনুরের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেলো। ময়না’কে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল,
-‘ কে তোমাকে আমার খাস দাসী করে পাঠালো? ‘
ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ময়না৷ সুক্ষ্ম নজরে তার চাহনি দেখলে মনে হবে সে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে৷ শাহিনুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
-‘ ময়না, আমি কিছু প্রশ্ন করেছি। ‘
নড়েচড়ে দাঁড়াল ময়না। কিঞ্চিৎ সংকুচিত হয়ে গেল সে। বলল,
-‘ বড়ো গিন্নি পাঠাইছে আমারে। বড়ো গিন্নি পাঠাইছে আমারে। ‘
শাহিনুর সন্দেহ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
-‘ চলো যাই। ‘
দু’জনই রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। যেতেই যেতেই শাহিনুর আবার প্রশ্ন করল,
-‘ কতদিন এ বাড়ি কাজ করছো? ‘
-‘ এই আজ পনের দিন। ‘
হাঁটা পা থেমে গেল শাহিনুরের। আরেক পলক ময়না’কে দেখে নিলো সে। ময়না কেমন চোরা চোখে আশপাশে তাকালো। শাহিনুর আবার হাঁটতে শুরু করল। ময়নাও এগিয়ে চললো। রান্নাঘরে যাওয়ার পথ থেকে বৈঠকখানা স্পষ্ট দেখা যায়। ময়না আগে শাহিনুর পিছে হেঁটে যাচ্ছিলো৷ আকস্মাৎ শাহিনুরের দৃষ্টি পড়লো বৈঠকখানার দিকে। পলাশ আর রঙ্গন এক সঙ্গে বসে চা পান করছে। অত্যন্ত গম্ভীর ভণিতায় পলাশ কিছু বলছে আর রঙ্গন মাথা নেড়ে নেড়ে সবটা শুনছে। এ’দৃশ্য দেখে বক্ষঃস্থল কেঁপে ওঠল শাহিনুরের। চরণদ্বয় আচমকাই থামিয়ে দিয়ে ওষ্ঠ কাঁপিয়ে নিচু কন্ঠে বলল,
-‘বাঁশিওয়ালা!’
ঠিক সে মূহুর্তেই পেছন থেকে ডেকে ওঠল প্রণয়। বলল,
-‘ নুর দাঁড়াও। ‘
বৈঠকখানা থেকে পলাশ,রঙ্গন দু’জনই ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। শাহিনুরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল রঙ্গনের। পলাশ শাহিনুরের পা থেকে মাথা অবদি কামুক দৃষ্টি বুলালো। শেষ দৃষ্টি ঠায় রাখলো শাহিনুরের গণ্ডস্থলে। একমাত্র এই একটি জায়গাই সে কাপড় বিহীন স্বস্তি নিয়ে দেখতে পারলো। বিরবির করে বলল,
-‘ সারারাত মস্তি করে এখন ঢাইকা ঢুইকা বাইর হইছে বাইজির বাচ্চা… ‘
প্রণয় এসে পলাশের দৃষ্টিকে বাঁধা দিয়ে দাঁড়াল। পলাশের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। একহাত শক্ত মুঠ করে চায়ের কাপটি ঠাশ করে টেবিলে রাখলো। কিছু দেখতে না পেলেও শুনতে পেল সে। কিন্তু রঙ্গন সবটা স্পষ্ট দেখতেও পেল শুনতেও পেল।
প্রণয় বলল,
-‘ তোমার হাত দু’টো দেখি? ‘
শাহিনুর রঙ্গনের দিকে তাকিয়েই হাত দু’টো বাড়িয়ে দিলো। নাকে বেশ বড়োসড়ো একটি নাকফুল রয়েছে শাহিনুরের। প্রণয় সেদিকে এক পলক তাকিয়ে দু’টো বালা সযত্নে ওর কোমল হস্তে পরিয়ে দিলো। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে ওঠল,
-‘ বিয়ের পর এগুলো সবসময় পরতে হয়। বাঙালি নারী’রা সর্বক্ষণ এগুলো পরে থাকে স্বামী’র জন্য। তুমি বিবাহিত, তুমি আমার বউ তার সিল সরূপ আপাতত এই গহনা রইল। একদিন জীবন্ত সিলমোহর দেব ইনশাআল্লাহ।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।