শুক্রবার৷ রাত তখন প্রায় এগারোটা। অলিওর চৌধুরী’র মিত্রগণরা তখন প্রমত্তকর রস পান করে বেহুশের ন্যায় আচরণ করছে। বাইজি চুমকি আর বাইজি রূপসী নৃত্যে নৃত্যে শরীরে ঘাম ঝরিয়ে ফেলছে। শুভ্র দেহের গণ্ডস্থলে, উদরে লেপ্টে থাকা ঘামগুলো মুক্তোর দানার মতো চকচক করছে।নারীদ্বয়ের স্বেদাক্ত উন্মুক্ত উদরের প্রতি তীব্র আকর্ষণে দিশেহারা হয়ে সকলের সম্মুখেই প্রমুখ নামে অলিওয়ের এক মিত্র বাইজি চুমকি’কে একটানে নিজের কোলে বসিয়ে বিকৃত লোভাতুর ওষ্ঠাধর গভীরভাবে ছুঁইয়ে দিলো উদরে। একের পর এক চুম্বন লেপ্টে দিয়ে এক পর্যায়ে হিংস্র পশুর ন্যায় খুবলে খেতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে গৃহ শূন্য হয়ে গেলো। কেউ আতঙ্কিত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো, কেউ অধরে দুর্বৃত্ত হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বের হলো। সকলের সম্মুখে নিজের অর্ধনগ্ন বক্ষে, উদরে বাবার বয়সী এক পুরুষের বিধ্বংসী লীলাখেলার সূচনা হওয়াতে প্রথমে লজ্জায়,ঘৃণায় মূর্ছিত ধরলো চুমকি। কিন্তু সে মূর্ছনা বেশীক্ষণ স্থির রইলো না। সকল চেতনা ভুলে গিয়ে অচেতন, উন্মাদ,ভোগ্য বস্তু রূপে ধরা দিলো প্রমুখ নামক পুরুষটির কাছে। বাইজি রূপসী স্বেচ্ছায়ই অলিওরের এক মিত্র পুত্রের সঙ্গে পাশের ঘরে চলে গেলো। কারণ সে বেশ চতুর নারী। নিজ শরীরের ওপর করা তাণ্ডবগুলোকে কীভাবে উপভোগ করতে হয় তা খুব ভালোভাবেই জানে সে। অন্যান্য ঘর থেকেও ঘুঙুরের শব্দ ভেসে আসছে। নানাবিধ গানে, ঘুঙুরের আওয়াজে, নারী কন্ঠের মৃদ্যু আর্তনাদে মুখরিত পুরো বাইজি গৃহ। প্রধান নৃত্য কক্ষে রয়েছে জমিদার অলিওর চৌধুরী, যেখানে তার সেবায় নিমজ্জিত বাইজি শর্বরী। তার বাম,ডান পাশের কক্ষগুলোতে পল্লব চৌধুরী এবং পলাশ চৌধুরী রয়েছে নিজ পছন্দনীয় বাইজিদের সঙ্গে। বাকি কক্ষগুলোতেও অতিথিরা নিজ আমদে ব্যস্ত, রয়েছে অগণিত বাইজিও। বাইজিদের প্রধান শারমিন বাইজি নিজ কক্ষে মান্নাতের সঙ্গে শুয়ে আছে। শারমিন বাইজিদের প্রধান হলেও সে নৃত্য ব্যতিত অন্যকিছু দিয়ে জমিদার বাড়ির কোন পুরুষ বা জমিদারের কোন মিত্রের মন জয় করার প্রয়োজন মনে করেনা৷ আর না তার ওপর কেউ জবরদস্তি করতে পারে। জমিদার অলিওর চৌধুরী চরিত্রহীন হলেও নিজ প্রতিজ্ঞায় বরাবরই অটল। মান্নাত শারীরিক ভাবে অসুস্থ থাকায় তার কিছুদিন ছুটি। দুই সখীতে শুয়ে আছে একই বিছানায়। চারপাশ থেকে অগণিত আওয়াজ এসে বারি খাচ্ছে ওদের কর্ণে। এক পর্যায়ে শারমিন তাচ্ছিল্য সহকারে মান্নাতকে বললো,
-‘ পুরো দুনিয়া জানে আমরা বাইজি গৃহের বাসিন্দা। অথচ আমরা জানি এটা নাম মাত্র বাইজি গৃহ। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে গৃহের সামনের দেয়ালে বাইজি গৃহ কেটেকুটে লিখে দেই পতিতা গৃহ। চিৎকার করে বলি আমরা পতিতা গৃহের সদস্য। হ্যা জমিদার অলিওর চৌধুরী’র পতিতা গৃহে বাস করি আমরা। শহরের আনাচে কানাচে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মুখোশধারী জমিদার অসহায় নারী’দের ভোগের বস্তু মনে করে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসহায়, নিরুপায় নারীদের বাধ্য করে পতিতা রূপে জীবন কাটাতে! ‘
শারমিনের তেজস্বী বাক্যলাপ শুনে হুহু করে কেঁদে ওঠলো মান্নাত। শারমিন তার মুখ চেপে ধরে বললো,
-‘ চুপ কর, চুপ কর। জানোয়ার’টা আজ এসেছে। নরপিশাচ টা এসেছে আজ। আমি খুব কষ্টে অলিওর’কে বুঝিয়েছি তোর স্ত্রীরজ সমস্যা ঘটেছে। জানিস তখন জানোয়ার’টা ঠোঁট টিপে হাসছিলো।’
-‘ মানুষ এতোটা নির্দয় কেন হয় সখী? এতো নৃশংস!’
-‘ লোভে পাপ পাপে মৃত্যু তুই যে লোভ করেছিলি। ভালোবাসার লোভ জমিদার পুত্রের পত্নী হওয়ার লোভ তোকে মৃত্যুপুরীতে নিয়ে এসেছে। আমাদের মতো মেয়েদের যে ভালোবাসতে নেই হয় যদি উচ্চবংশীয় কেউ সেখানে ভালোবাসা খুবই নগন্য। ‘
-‘ যে ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে আমার দেহ,মন আজ ক্ষতবিক্ষত সে ভালোবাসার ফাঁদে যেনো আর কেউ না পড়ে। আর কারো গর্ভে যেনো না আসে ঐ জমিদার বাড়ির অংশ, আর কোন নিষ্পাপ প্রাণের যেনো না ঘটে মৃত্যু! ‘
মান্নাতের কথা শুনে তাচ্ছিল্য হেসে শারমিন বললো,
-‘ অভিশাপ দিতে হবে না মান্নাত প্রকৃতিই অভিশাপ বয়ে আনবে ওদের জীবনে। তুই কি এখনো টের পাসনি পল্লব চৌধুরী নিঃসন্তান, পলাশ চৌধুরীর স্ত্রীরও বাচ্চা ধরে না। আমার মন বলছে ওরা নির্বংশ হবে। শেষ জামানায় জয় আমাদেরই হবে। ‘
পলাশ চৌধুরী নামটা শুনতেই আবারো বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো মান্নাত। বললো,
-‘ আমি ওকে খুব ভালোবেসেছি সখী। ও কেন আমাকে ধোঁকা দিলো, কেন আমাদের সন্তানটাকে নিঃশেষ করে দিলো। আমি ওর স্ত্রী’র মর্যাদা পাইনি কিন্তু ওর বাচ্চার মা’য়ের মর্যাদাটুকু ও কেন আমায় দিলো না? তোমার মতো ভাগ্য কেন আমার হলো না। কেন আমি কারো মা ডাক শোনার অধিকার রাখিনা।’
-‘ কারণ তুই বাইজি! তুই সেই বাইজি যাকে জমিদারের পুত্র পলাশ চৌধুরী ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে জমিদার বাড়িতে নিয়ে এসেছে। অথচ স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারেনি৷ কি নির্মম ভালোই তোকে বাসলোরে যে স্থান দিলো বাইজি গৃহে। হলি তার ভোগের সামগ্রীমাত্র! ‘
-‘ তাহলে এই সন্তানটাকেও স্বীকৃতি না দিয়ে বাঁচতে দিলেই পারতো। নাই পেলো বাবার পরিচয় শুধু মা ডাকটুকু শুনতে দিতো আমায়। নূরের মতোই মায়ের পরিচয়ে বেড়ে ওঠতো ও। ‘
-‘ এতো বছরেও মানুষ টাকে চিনলি না মান্নাত… ‘
-‘ মন তো মানে না কি করি আমি বলো? ‘
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শারমিন। দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ আবেগটুকু নিঃশেষ করে দে মান্নাত শান্তি পাবি। ‘
আচমকাই উতলা হয়ে মান্নাত বললো,
-‘ সখী আমাদের নুরের কি হবে পলাশ চৌধুরী যে অপেক্ষায় আছে গুণে গুণে আরো সাতটি মাসের অপেক্ষা। ‘
সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো শারমিনের। রহস্যেঘেরা একটি হাসি দিয়ে বললো,
-‘ ওর বাপ’কে দিয়েই আমার মেয়েকে নিরাপত্তা দেবো আমি। ‘
-‘ বাবা, ছেলেতে তাণ্ডব সৃষ্টি হবে সখী, পলাশ যে বড়োই নিষ্ঠুর। ‘
-‘ আমি নুরকে ঢাকা শহরে পাঠিয়ে দেবো মান্নাত। এর জন্য সর্বাত্মক সহোযোগিতা করবে জমিদার অলিওর চৌধুরী। ‘
-‘ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে? ‘
-‘ শেষ করে দেবো ওকে। ‘
-‘ শেয়ালের কাছে মুরগী বাগি দেওয়া কি ঠিক সখী। ‘
-‘ জমিদার আমায় কথা দিয়েছে মান্নাত। তুই ভালো করেই জানিস শয়তান টা কথা দিয়ে ঠিক কথা রাখে। আর যে কথা রাখে না সে কথা রাখবে বলে মিথ্যা প্রতিজ্ঞাও করেনা। এটা জমিদার অলিওর চৌধুরীর বিরাট গুণ। ‘
-‘ নুর’কে ছেড়ে থাকতে পারবে? ‘
-‘ ওর সুন্দর ভবিষ্যৎের জন্য যদি আমাকে বলিও দিতে হয় তাই দেবো। ‘
-‘ কবে চলে যাবে নূর আমাদের থেকে? ‘
-‘ এই তো আর কয়েকটা মাস মায়ের আরেকটু আদর পেয়ে নিক। যত্ন সহকারে আরেকটু কড়া শাসনে মেখে থাকুক। আরেকটু মায়ের বুকে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ুক। মেয়েটা আমার বড্ড অবুঝ, বড্ড ছোট। মানাতে একটু পরিশ্রম তো হবেই বল। ‘
[৭]
পুরো জমিদার বাড়ি প্রস্ফুটিত পুষ্পপুঞ্জে সজ্জিত করা হয়েছে। পাঁচফোড়ন গৃহেও নেমে এসেছে বিষাদ সিন্ধু। নিজ ঘরে দগ্ধ হৃদয়ে বসে আছে মুনতাহা। জমিদার অলিওর চৌধুরী’র দ্বিতীয় পুত্র পলাশ চৌধুরী’র প্রকাশ্য প্রথম এবং একমাত্র পত্নী মুনতাহা চৌধুরী। বাইজি মান্নাতের সঙ্গে পলাশের প্রেমের সম্পর্ক তারপর বিয়ে পুরোটাই অপ্রকাশিত রয়েছে। অত্যন্ত কৌশলে গ্রামের সহজ সরল গরিব ঘরের মান্নাত’কে প্রেমের ফাঁদে ফেলে গোপনে বিয়ে করে পলাশ। তারপর নিয়ে আসে নিজ গৃহে। কিন্তু বউ হিসেবে নয় বাইজি গৃহের এক বাইজি হিসেবে! তার ঠিক তিনমাসের মাথায়ই মা প্রেরণার ভাইয়ের মেয়ে মুনতাহা’কে স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়ে পাঁচফোড়ন গৃহে নিয়ে আসে। মন, প্রাণ দিয়ে পলাশকে ভালোবাসে মুনতাহা। বিয়ের পূর্বে তার চরিত্রের বেহাল দশা দেখে মা প্রেরণা এবং মুনতাহা ভেবেছিলো ঘরে সুন্দরী বউ এলে আর যাই হোক কোন বাইজির প্রতি আসক্তি থাকবে না। গোপন সূত্রে প্রেরণা খবর পেয়েছিলো তার পুত্র পলাশ মান্নাত নামক এক বাইজির প্রেমে মাতোয়ারা। ভিতরের খবর কেউ জানেনা। বাইরে থেকে যতোটুকু অবগত হয় ততোটুকুরই নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করে। চেষ্টা করেছিলো মা প্রেরণা আর মুনতাহাও। কিন্তু লাভ হয়নি। হবে কি করে গোড়ায় গণ্ডগোল থাকলে আগা কি সঠিকভাবে বাড়তে পারে?
মুনতাহার নয়নজুড়ে আজ শোকের ছায়া। কারণ
তার স্বামী আজ বাইজি গৃহে বাইজি শরীরে মগ্ন রয়েছে। যদিও এটা আজ নতুন নয় তবুও ক্ষতগুলো ঠিক নতুনের মতোই যন্ত্রণা দিচ্ছে। ঘরে স্ত্রী রেখে স্বামী বাইজি গৃহে কোন এক বাইজির সঙ্গে মিলিত হচ্ছে… একজন স্ত্রীর কাছে এটা কতো বড়ো অসম্মানের সহিত ক্লিষ্টপূর্ণ ভাবা যায়! বিছানার এক পাশে গুটিশুটি হয়ে অশ্রুপাত করছে মুনতাহা। এমন সময়ই ঘরে প্রবেশ করার জন্য অনুমতি চাইলো পল্লব চৌধুরী’র প্রথম স্ত্রী শবনম চৌধুরী। বললো,
-‘ মুনতাহা, অন্দরে আসবো? ‘
শবনমের কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই শব্দ করে কেঁদে ওঠলো মুনতাহা। তা দেখে দেরি করলোনা শবনম। ত্বরিতগতিতে অন্দরে প্রবেশ করে মুনতাহাকে বক্ষে চেপে ধরলো। বললো,
-‘ কাঁদিস না বোন জেনে শুনে যে অভিশাপকে বুকে ঠাঁই দিয়েছিস সে অভিশাপ সইতেই হবে। ‘
-‘ আপাগো শরীরে আগুন ধরলে পানি দিয়ে নিভানো যায়, বুকের ভিতর আগুন ধরলে কি দিয়ে নিভানো যায় তা তো আমি জানিনা। তুমি কি জানো আপা? ও আপা একটা উপায় বলো…’
-‘ এই আগুনের পূর্বাভাস তো তোরে আগেই দিছি মুন তুই তো বুঝলি না। ‘
-‘ আপা ও আপা ঐ বাইজিদের শরীরে যা আছে আমারও তো তাই আছে উনি কেন বুঝেনা আপা? আমি উনাকে খুব ভালোবাসি আপা। আমি আর সইতে পারছিনা, আর পারছিনা। ‘
স্নেহপূর্ণ বুক’টি পেয়ে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মুনতাহা। আফসোসে সিক্ত হয়ে ওঠলো শবনমের মন। বিরবির করে বললো,
-‘ আমি না হয় না জেনে মরেছি তুই তো জেনে শুনে মরলিরে বোন। অভিশপ্ত এই জীবনের বোঝা যে বড্ড ভারী। দেখ ক’দিন বইতে পারিস। ‘
জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলের প্রথম স্ত্রী, বড়ো বউ শবনম চৌধুরী। অলিওর চৌধুরী’র বন্ধু’র মেয়ে হওয়ার সুবাদেই এই বাড়ির প্রথম পুত্রবধূ হিসেবে পদচারণ হয় তার। বিয়ের পূর্বে জমিদার বাড়ি, জমিদার গৃহিণী, জমিদার পুত্র সর্বজন’কে নিয়েই রূপকথার গল্পের মতোই ভাবনা ছিলো তার। ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি জমিদার বাড়ি,অলিওর চৌধুরী এবং তার পুত্ররা ঠিক মাক্কাল ফলের মতো। সারাজীবন জেনে এসেছে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মাঝে শারীরিক সম্পর্ক হয়। আর এ বাড়িতে প্রবেশ করার পর জানতে পারে, বাইজিদের সঙ্গেও জমিদার’দের শারীরিক সম্পর্ক হয়। আর এই সম্পর্কে যুক্ত তার স্বামী পল্লব চৌধুরীও। না জেনে ভালোবেসে,বিশ্বাস করে সে ঠকেছে। কিন্তু মুনতাহা জেনে বুঝে ঠকলো এটা ভাবতেই শবনমের ভিতর থেকে আফসোসের অবিরত নিঃশ্বাস নিঃসৃত হতে শুরু করলো।
[৮]
বাইজি গৃহের গোপন কক্ষে নরম তোশকে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলো শাহিনুর। নিঃশ্বাসে তার ভীষণ অস্থিরতা। আজকাল মা যখন এই কক্ষে নিয়ে আসে তাকে আনন্দে নেচে ওঠে হৃদয়খানি। যখন এই কক্ষে না নিয়ে আসে তখনই বরং মন খারাপ হয়। ভাগ্যিস আজ বাইজি গৃহে জমিদার বাড়ির মন্দ মানুষ, মন্দ অতিথিরা এসেছে। নয়তো মা তাকে আজ এখানে রেখে যেতো না ঠিক যেমন গত দুদিন রেখে যায়নি। মনের সাথে মনের প্রলাপে হঠাৎ অপেক্ষারত শাহিনুর শোয়া থেকে ওঠে বসলো। গা থেকে চাদর সরিয়ে অধৈর্য সহকারে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পরনের অতি সাধারণ সূতি কাপড়ের শাড়িটির আঁচলখালা দিয়ে পুরো কাঁধ মুড়িয়ে ঢেকে নিলো৷ ভীষণ শীত তাই গা ঢেকে কাঠের বেড়া সরিয়ে জানালা খুলে দিলো। রাতের সময় তখন কতো জানা নেই শাহিনূরের। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলো বাঁশিওয়ালার বাঁশি বাজানোর সময় পার হয়ে গেছে। একরাশ বিষণ্ণতার কালো মেঘে জড়িয়ে গেলো বালিকার শুভ্র মুখশ্রীটি। জ্যোৎস্না আলোতে নিষ্পলক দৃষ্টি জোড়া মেলে ধরলো কৌতুহলী বনটার দিকে। নিস্তব্ধ নিবিড় রজনীতে জমিদার বাড়ির বিস্তীর্ণ অরণ্য থেকে শীতল হাওয়ার পাশাপাশি গুটিকয়েক মনুষের হাসির শব্দগুচ্ছও ভেসে আসছে। নেই শুধু বক্ষস্থলে নৃত্যের ঝর তোলা সুরের মেলা। কিন্তু শাহিনুরের কেন জানি মনে হচ্ছে ঐ হাসিগুলোর মালিকের জায়গায় বাঁশিওয়ালা ঠিক রয়েছে। কিন্তু আজ বাঁশি বাজে না কেন? তবে কি আজ বাঁশিওয়ালার মন খারাপ। কিছুটা বিষণ্নতা জেঁকে বসলো বালিকার নয়নজুড়ে। ললাটজুড়ে পড়লো চিন্তার ভাঁজ। কর্ণদ্বয় খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলো কোন হাসিটি বাঁশিওয়ালার। ভাবলো,
-‘ বাঁশিওয়ালার মন খারাপ হলে সে হাসবে কেন? তাহলে কি আজ বাঁশিওয়ালার মন ভালো? বাসির সুর কি তার কষ্টের প্রতীক? ‘
অজস্র কৌতুল, সীমাহীন উত্তেজনায় আড়ষ্ট হয়ে অপেক্ষায় রইলো শাহিনুর। বক্ষস্থলে কেবল একটি প্রশ্নই ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরতে লাগলো,
– ‘ও বাঁশিওয়ালা তোমার বাঁশি বাজে না কেন? ও বাঁশিওয়ালা তোমার বাঁশি বাজে না কেন? ‘
জানালার অতি নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা শাহিনুর হঠাৎই আনমনে জানালার চৌকাঠে ওঠে বসলো। পাল্লাতে মাথা ঠেকিয়ে অপেক্ষারত নয়ন দু’টি আলতো ভাবে বুজলো। তারপর কতোটা সময় পার হলো জানা নেই। কিন্তু কর্ণকুহরে আচমকাই সে চেনা সুর পৌঁছানো মাত্রই আঁতকে ওঠলো শাহিনুর। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মেয়েটি। আচমকাই ঘুম ভাঙার ফলে মস্তিষ্ক বুঝে ওঠতে পারছিলোনা সে কোথায় আছে। শরীরের পুরোটা ভার ছেড়ে চৌকাঠে বসা ছিলো বিধায় ঘোরের মাঝে বাম দিকে ঘুরতে নিতেই একতলার খোলা জানালা দিয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো ভূমিতলে। সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র ভয়ে, কোমল দেহে অগণিত কাঁটাজাতীয় কিছুর আঁচড়ে অসহনীয় ব্যথায় চোখ,মুখ খিঁচে আর্তনাদ করে ওঠলো,
-‘ ও মা গো! ‘
সেই আর্তনাদ শুনতে পেয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হলো গুটিকয়েক মানব-মানবী। থেমে গেলো বাঁশির সুর।