বাইজি কন্যা | পর্ব – ২৩

শারমিনের বলা কঠিন কঠিন উপদেশগুলো একদম মস্তিষ্কে গেঁথে ফেললো শাহিনুর। শারমিন কয়েক পল নিরবতা পালন করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সন্তর্পণে শাহিনুরের মাথাটা নিজ বক্ষঃ থেকে সরিয়ে নিজ মাথা উঁচু করে,সিনা টানটান হয়ে ওঠে দাঁড়ালো। শাহিনুর তার কৃষ্ণবর্ণীয় ভাসা ভাসা চক্ষুদ্বয়গুলো নিষ্পলকভাবে মেলে ধরলো তার মা’য়ের অভিমুখে। মা’য়ের পানে তাকিয়ে থাকতে ভীষণ ভালো লাগে তার। কারণ তার মা’য়ের মাঝে শুধু মা’কে দেখতে পায় না। দেখতে পায় নিজের আদর্শ’কে। দেখতে পায় মহীয়সী এক নারী’কে। যার দৃষ্টিতে নিজের জন্য আজ অবদি কোন ভয় দেখতে পায়নি। কিন্তু তার জন্য ভালোবাসা, স্নেহ,মায়া,ভয় সবটাই সুস্পষ্ট ভাবে দেখেছে। খুব বেশী মানুষ সম্পর্কে জানেনা সে। কিন্তু নিজের মা’কে যতোটুকু জেনেছে এতেই সে প্রশান্তি পেয়েছে। সাধারণত মেয়েরা মা’য়ের দুঃখ কষ্টগুলো একদম অন্তর থেকে অনুভব করে৷ শারমিনের জীবনের কঠিন সত্যিটা জানার পর শাহিনুরও অনুভব করেছে তার মায়ের যন্ত্রণাগুলোকে। মূলত সেদিন থেকেই মা’য়ের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে গেছে৷ ইদানীংকালে নিজের মন’কে নিজেই খুব বোঝ দেয়, ‘একদিন অনেক বড়ো হবি নুর অনেক অনেক বড়ো। আর সেদিন মা’য়ের মতো সাহসী হয়ে সকল ভয়’কে জয় করে নিবি। সকল দুঃখ,কষ্ট’কে দূর করে মা’য়ের মুখে হাসি ফুটাবি। আর এই যে বদ্ধ কারাগারের মতো জীবন এটা থেকেও নিজে মুক্ত হবি এবং সকল’কে মুক্ত করবি। ‘
শাহিনুর সুদূরপ্রসারী এক ভাবনার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। আর শারমিন তার সর্বাঙ্গে দৃঢ়তা বজায় রেখে এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেলো কক্ষের ভিতরে থাকা একটি কাঠের আলমারির সামনে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে আলমারি খুলে এক কোণা থেকে লাল কাপড়ে প্যাঁচানো একটি তলোয়ার বের করলো। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে গেলো শাহিনুরের। বুকের ভিতর কেমন ধকধকানি শুরু হলো তার। এক ঢোক গিলে ভয়কাতুরে দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো সে। শারমিন ধীরে ধীরে প্যাঁচানো লাল কাপড় খুলে তা মেঝেতে ফেলে দিলো। মা’য়ের হাতে অমন ধারালো তলোয়ার দেখে আরেক দফা ঢোক গিললো শাহিনুর। কিন্তু শারমিনের মুখোভঙ্গির কোন পরিবর্তন ঘটলো না। সে একই ভণিতায় পুরো কক্ষে পায়চারি করতে শুরু করলো৷ শাহিনুর লক্ষ করলো তার মা’য়ের মুখের পরিবর্তন ঘটছে। পুরো পৃথিবীসম ক্রোধে যেনো নিমজ্জিত হয়ে গেলো তার মা। চারদিক থেকে কেমন হিমশীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিতে থাকলো শারমিন, শাহিনুর দু’জন’কেই। লোমহর্ষক অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে গেলো শাহিনুর৷ এমন পরিস্থিতি’তে সহসা শারমিন শাহিনুরের দিকে তাকালো। মধ্যবয়স্কা,মাঝারি গড়নের নারী’টির রূপে উত্তাপের কোন কমতি নেই৷ কমতি নেই সুদীর্ঘ দৃষ্টির প্রখরতারও। এক হাতে তলোয়ার উঁচিয়ে নিজ কন্যার দিকে প্রখর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শারমিন। শাহিনুর ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। তবুও শারমিন একই মূর্তি’তে ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে তেজীয়ান ধ্বনি’তে বললো,
-‘ বহু বছর ধরে এই তলোয়ার’টি নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিয়েছি নুর। এটা কিন্তু শুধু তলোয়ার নয়। এটা হচ্ছে সেই অস্ত্র যে অস্ত্র কোন মানুষ’কে হত্যা করবে না। এই অস্ত্র হত্যা করবে শুধু নরপশুদের! ‘
কথাগুলো বলতে বলতে শাহিনুরের দিকে এগিয়ে গেলো শারমিন। ধীরে ধীরে শাহিনুরের মুখোমুখি হয়ে রক্তিম চোখে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বললো,
-‘ তুমি কি বুঝতে পেরেছো নুর? এই অস্ত্র দিয়ে কোন মানুষ হত্যা হবে না। যদি কখনো আমার অবর্তমানে মুখোশ পরিহিত মানুষ তোমার আশপাশে বিচরণ করে সেদিনই বুঝবে এই অস্ত্র ঠিক তার জন্যই তৈরি।’
শাহিনুর কেঁদে ফেললো। তবুও নম্র হলোনা শারমিন৷ কর্কশ গলায় একটি ধমক দিলো মেয়ে’কে। ধমক খেয়ে ডুঁকরে ওঠলো শাহিনুর। কিঞ্চিৎ দমে গেলো শারমিন। ক’দিন পর শাহিনুর’কে দূরে পাঠিয়ে দেবে। এখন থেকেই যদি মেয়েটা’কে গড়তে না পারে, তৈরি করতে না পারে তাহলে তো ভারী মুশকিল। আর মাত্র চার’টা মাস রয়েছে। এরপরই পনেরো পেরিয়ে ষোল’তে পদার্পণ করবে শাহিনুর৷ যতো দিন এগোচ্ছে ততো হায়েনার দলেরা আনন্দানুভূতি পাচ্ছে। দুঃস্বপ্নটা দেখে শারমিনের মনে সংশয়ও জেগেছে। কেন জানি মন বলছে অলিওর তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও করতে পারে। শাহিনুরের প্রতি অলিওরের কোন মায়া নেই, নেই কোন ভালোবাসা। সে যেটুকু করছে শুধুমাত্র তার জন্যই করছে দেখানো মাত্র। ভিতরে ভিতরে যে কোনো ছক কষে রাখছে না তারই বা নিশ্চয়তা কী? যতোই হোক পলাশ চৌধুরী তার ছেলে আর নুর? নুর তার পরম শত্রুরই অংশ। সবটা ভেবে আবারো কঠিন্যতা ভর করলো শারমিনের মাঝে। নুর’কে শক্ত করার জন্য জোরপূর্বক নুরের হাতে তলোয়ার তুলে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে ওঠলো শাহিনুর। ভয়ে জর্জরিত হয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। শারমিন উচ্চ কন্ঠে ক্রমাগত বলতে লাগলো,
-‘ আমাকে কথা দে নুর প্রয়োজনের তাগিদে, নিজের সম্মান বাঁচাতে, এই তলোয়ার দিয়ে মানুষ নয় অমানুষদের হত্যা করতে কোন দ্বিধা করবি না। দুনিয়াটা বড়ো কঠিন, এ দুনিয়া’তে বেঁচে থাকাটা আহামরি কঠিন নয় কিন্তু বাঁচার মতো বাঁচা খুব কঠিন। কথা দে নুর, জীবনে চলার পথে কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করবি না। কথা দে মা, জান নিবি তবুও ইজ্জত নিতে দিবি না। ‘
শারমিনের তীব্র কন্ঠস্বরে শেষ বাক্যটি শুনতেই হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠলো শাহিনুরের। আকস্মাৎ কান্না থেমে গেলো তার। অদৃশ্য কোন এক শক্তি এসে ভর করলো তার সর্বাঙ্গে। মা’য়ের তীব্র চাহনিতে চেয়ে দৃঢ় হয়ে ওঠলো নিজের নম্র দৃষ্টিজোড়াও, কন্ঠে পেলো সীমাহীন তেজ। অজান্তেই বলে ওঠলো,
-‘ কথা দিলাম আম্মা জান নিবো তবুও ইজ্জত নিতে দিব না। ‘
[ ৩১ ]
মাঝরাত। মন’টা প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে রঙ্গনের। জঙ্গলের ভিতর নিজের ছোট্ট কুটিরে বসে মদ্যপান করছে সে। একের পর এক বোতল শেষ করছে নিমিষেই। সর্বশেষ বোতলটি শেষ করে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে বলতে ডিভানে ধপাশ করে শুয়ে পড়লো সে। বেশ কিছু অসংলগ্ন বাক্যে একটি বাক্য স্পষ্ট বোঝা গেলো। ওষ্ঠকোণে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটিয়ে তুলে তর্জনী আঙুল দ্বারা গাল চুলকাতে চুলকাতে বললো,
-‘ যারে মন, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলাম সে বড়ো ভাই’য়ের বউ হয়ে গেলো। যারে প্রেমিকা বানাইলাম সেও বড়ো ভাই’য়ের বউ হবো। শালার আমার জন্মই হইছে ভালোবাসার মানুষ আর প্রেমিকাদের ভাবি ডাকার জন্য! ‘
কথাগুলো বলেই চট করে ওঠে বসলো রঙ্গন। পাশে থাকা বোতলগুলোতে এক লাথি মেরে মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে দাঁড়ালো। কিছু অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে কুটির থেকে বেরিয়ে পা বাড়ালো বাইজি গৃহের উদ্দেশ্যে। মাতাল হয়ে রঙ্গন বাইজি গৃহে প্রবেশ করলেও সকল বাইজিরা তাকে স্বাগতম জানালো। দেখা হয়ে গেলো বড়ো ভাই পলাশের সঙ্গেও। পলাশ প্রথমে অবাক হলেও পরোক্ষণে বিকৃত ভঙ্গিতে হাসলো। রঙ্গনের গা ঘেষে ফিসফিস করে বললো,
-‘ এর আগে তো লুকিয়ে লুকিয়ে হাউস মিটাতি আজকে প্রকাশ্যে যে? বুকের পাটা কি শক্ত হয়ে গেলো নাকী! ‘
ভয়ংকর রেগে গেলো রঙ্গন। সকল বাইজিদের সামনেই পলাশের কলার চেপে ধরলো। রগচটা গলায় বললো,
-‘ এই বাল তুই আমার কোন বাল? শোন বাল আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো তোর বাপের কী?’
প্রথমে রেগে গেলেও পরোক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো পলাশ। রঙ্গনের হাত ছাড়িয়ে কলার ঠিক করতে করতে বললো,
-‘ শালা আমার বাপের যা তোর বাপেরও তাই। ভেজা বেড়ালের জবান দেখে আমি শিহরিত। ‘
এটুকু বলেই বাইজি শিল্পা’কে ইশারায় ডাক দিলো পলাশ। অর্ধনগ্ন শরীরে কোমড় হেলিয়ে,দুলিয়ে শিল্পা সামনে আসতেই পলাশ বললো,
-‘ বেশ চটে আছে সব ঠাণ্ডা করে দিবি একদম। মনে রাখিস জমিদারের ছোট পুত্র সে। ‘
শিল্পা ঠোঁট কামড়ে হাসলো গদগদ হয়ে রঙ্গনের কাঁধ স্পর্শ করলো। সঙ্গে সঙ্গে রঙ্গন শিল্পার বক্ষে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,
-‘ এই এই কাপড় খোল, খোল কাপড়। ‘
বলেই পলাশের দিকে তাকালো রাগান্বিত হয়ে বললো,
-‘ এই জমিদারের বাচ্চা এই বেশ্যার বাচ্চা’রে কাপড় খুলতে বল, বল কাপড় খুলতে। ‘
চোখ বড়ো বড়ো করে পলাশ শিল্পার দিকে তাকালো। বললো,
-‘ হয়ে গেছে কয় বোতল গিলছে কে জানে? যা তুই ওরে নিয়ে যা চোটপাট বেশী করবো সকালে ডাক্তার পাঠাই দিমুনি ভয় পাইস না যাহ। ‘

লেখকের কথা: ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধীরে ধীরে উপন্যাসের মোড় পাল্টে যাচ্ছে আশা করি বুঝতে পারছেন। আমার সবগুলো লেখার মধ্যে এটাই সবচেয়ে জটিল লেখা তাই খুব ভেবেচিন্তে এবং পূর্বের পর্বগুলো বেশ কয়েকবার পড়ে নিয়ে পরবর্তী পর্ব লিখতে হয়। যার ফলে সময় বেশী লেগে যায়। আশা করি বুঝতে পারবেন আপনারা। একটু সময় নিয়ে ভালো কিছু এবং ইউনিক কিছুই উপহার দিতে চাই আমার পাঠকদের। আর হ্যাঁ আমার পাঠকদের চাওয়াতেই কিন্তু রহস্যময় উপন্যাসটি লিখছি। অনেকেই রিকোয়েস্ট করেছিলো একটি রোমান্টিক, রহস্যময় উপন্যাস লিখতে। আমার লেখা সর্বোচ্চ রোমান্টিকতা এবং রহস্য এটাতেই থাকবে ইনশাআল্লাহ

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।