বাইজি কন্যা | পর্ব – ১৬

তিন’টে প্রাণ উন্মুখ হয়ে বসে আছে শাহিনুরের উপস্থিত হওয়ার আশায়৷ রঙ্গন সেই যে গিয়েছে আর আসার নাম নেই। নুর আসবে শুনে রোমানা তো বেজায় খুশি। অঙ্গন আর রোমানা এখন নুর আর রঙ্গন’কে নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করতে ব্যস্ত। সে ব্যস্ততা থেকেই হঠাৎ রোমানা প্রণয়ের বাহু চেপে ধরে বললো,
-‘ আচ্ছা প্রণয় খালুজান আর খালামুনি ওদের সম্পর্কের পরিণতি ঘটতে দেবে তো? যদি না দিতে চায় তুমি প্লিজ খালুজান’কে বোঝাবে? ‘
রোমানার এহেন বক্তব্যে প্রণয়ের কর্ণকুহরে অকস্মাৎ বোমা বিস্ফোরিত হলো। ফলশ্রুতিতে তার মুখোভঙ্গি এমন কঠিন রূপ ধারণ করলো যে, পাশ থেকে দৃঢ় চোয়াল দেখেই গণ্ডস্থল থেকে বক্ষঃস্থল অবদি শুঁকিয়ে গেলো রোমানার। রোমানার শুষ্ক মুখশ্রী, ভীতিগ্রস্ত দৃষ্টিজোড়া দেখে অঙ্গন তটস্থ হয়ে তাকালো প্রণয়ের দিকে। ক্ষীণ স্বরে ডেকে ওঠলো,
-‘ ভাই! ‘
অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেলে মানুষ যেমন চমকে তাকায় ঠিক তেমনভাবেই অঙ্গনের দিকে তাকালো প্রণয়। তারপর বিচলিত হয়ে একবার রোমানা আরেকবার পথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। যে পথ দিয়ে আসার কথা রঙ্গন এবং শাহিনুরের। সে পথে দৃষ্টি রেখেই প্রণয় প্রশ্ন করলো,
-‘ রোমানা, আজ আকাশে চাঁদ ওঠেছে? ‘
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেলো রোমানা, অঙ্গন দু’জনেরই। পরোক্ষণেই দু’জন তৎপর হয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করে ওঠা চন্দ্র’কে একবার দৃষ্টিপাত করে নিলো। তারপর চার’জোড়া চোখ চিন্তিত হয়ে তাকালো প্রণয়ের দিকে। অঙ্গন চুপ রইলো,রোমানা নিচু স্বরে জবাব দিলো,
-‘ হুম ওঠেছে। ‘
রোমানার উত্তর পেয়ে এবার পথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রোমানার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রণয়। তারপর শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ কাল ভোরে সূর্যও ওঠবে তাইনা? ‘
আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো রোমানা। অঙ্গনও একই ভাবে তাকালো। রোমানার আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিজোড়ায় দৃষ্টি মিলিত করে শান্ত কন্ঠেই প্রণয় বললো,
-‘ একই আকাশে চন্দ্র, সূর্য উভয়ই বিরাজ করতে পারে। ‘
বোকা চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো রোমানা৷ কিন্তু অঙ্গনের সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠলো। বিস্ফোরিত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো সে৷ প্রণয়ের কথার অর্থ রোমানা বুঝতে না পারলেও অঙ্গন বেশ সন্দেহ করলো। প্রণয়ের তীক্ষ্ণ নজর, বক্র হাসি কোনটাই চোখ এড়ালো না অঙ্গনের। হঠাৎ অঙ্গনের মুখ বিমূঢ় হয়ে যেতেই প্রণয় বললো,
-‘ তুই কি বিরোধিতা করতে চাচ্ছিস নাকি ? ‘
বক্ষঃস্থলে প্রচণ্ডবেগে এক ধাক্কা খেলো অঙ্গন। ম্লান হেসে বললো,
-‘ একই আকাশে চন্দ্র, সূর্য উভয়ই বিরাজ করে ভাই কিন্তু লক্ষ করে দেখো তারা উভয়ই একটা গণ্ডি মেপে চলে। রাতের আকাশটা চন্দ্রের দখলে আর দিনের আকাশ সূর্যের। ‘
রোমানা বাঁধ সেধে বললো,
-‘তোমরা আকাশ নিয়ে তর্ক শুরু করলে কেন? আকাশে চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র সবারই স্থান হয়। আকাশের হৃদয় বিশাল বুঝলে সে কাউকে নিরাশ করে না। ‘
রোমানার কথা শুনে অঙ্গন দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেও প্রণয় বেশ মজা পেলো। তার ওষ্ঠাধরে লেপ্টে থাকা কিঞ্চিৎ হাসিটুকু প্রশস্ত হাসিতে রূপ নিলো৷ সে হাসি দেখে রোমানা লজ্জা পেলো,আর অঙ্গন পড়ে গেলো দুঃশ্চিন্তায়! কিন্তু সেই দুঃশ্চিতাটুকু ধামাচাপা পড়ে গেলো রঙ্গন এবং শাহিনুরের উপস্থিতি’তে। অত্যন্ত হাস্যজ্জ্বল, চঞ্চল প্রবণ যুবক’টির পাশে জড়োসড়ো হয়ে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতি সুদর্শনীয় কিশোরীটি৷ ভূমিতলে বসে থাকা তিন’টে প্রাণই সুদর্শন যুবক এবং সুদর্শনীয় কিশোরীর দিকে দৃষ্টিপাত করলো। রোমানা সকলের সম্মুখে বলেই ফেললো,
-‘ ইশ কি সুন্দর মানিয়েছে দু’জন’কে নজর না লাগুক। ‘
অঙ্গন মৃদু হাসলো। প্রণয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে তাকিয়েই রইলো। শাহিনুর লজ্জায় আরক্ত হয়ে বার বার রঙ্গনের পিছনে লুকানোর চেষ্টা করলো। অঙ্গন বললো,
-‘ এতো দেরি হলো ১১ঃ৫০ বাজে আর মাত্র দশমিনিট… ‘
এটুকু বলার পরপরই অঙ্গনের উরুতে মৃদু কিল বসালো রোমানা। চোখ রাঙিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-‘ এটা কি করছিলে? ‘
-‘ সরি সরি বেখেয়ালি ভাবে বলে ফেলেছি। ‘
রোমানা আর অঙ্গন ফিসফিসিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রণয় গাঢ় চোখে তখনো তাকিয়ে আছে শাহিনুরের দিকে৷ পা থেকে মাথা অবদি কতোবার যে চোখ বুলিয়েছে এটুকু সময়ে হিসেবের বাইরে। আর পাঁচ’টা মেয়ের মতোন শাহিনুর স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে না। তা তার বাহ্যিক দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায়। এই যে রোমানা শাড়ি পরেছে। তার মধ্যে ভদ্রতা,সভ্যতার স্পর্শ পুরোটাই রয়েছে। অথচ শাহিনুর,তার শাড়ি পড়ার ধরন দেখলেও শরীরের রক্ত তপ্ত হয়ে ওঠে প্রণয়ের। ফর্সা, লম্বা, কোমল পা দুটোতে চোখ যেতেই শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো প্রণয়ের৷ পায়ের গোড়ালি থেকে বেশ উঁচু অংশ অবদি শাড়ি বিহীন। কারণ শাহিনুর বেশ উঁচিয়ে শাড়ি পরেছে। যার ফলে পা থেকে উপরের দিক অনেকটাই বেরিয়ে আছে। যদিও আজ লম্বা হাতা ব্লাউজ পরেছে কিন্তু পূর্বের দিনে খাটো হাতা ব্লাউজ পরতে দেখেছে প্রণয়। রুদ্ধশ্বাসে চোরা দৃষ্টিতে একবার শাহিনুরের উদরে তাকালো প্রণয়, তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাসও ত্যাগ করলো, নাহ ব্লাউজটা ঠিকঠাক আছে। পেট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যখনি শাহিনুরের গণ্ডস্থল থেকে বক্ষঃস্থলে দৃষ্টি পড়লো। মাথা ঝিম ধরে গেলো তার। নিজের পাশে অঙ্গন,শাহিনুরের পাশে রঙ্গন’কে দেখে মেজাজ খিঁচে ওঠলো। রোমনার দিকে তাকিয়ে রোমানার শাড়ির আঁচল লক্ষ করলো। কোথায় রোমানার তো সব ঠিকঠাক আছে তবে কেন শাহিনুরের শাড়ির আঁচল ওভাবে দেওয়া? শাহিনুর কেন শাড়ির আঁচল কাঁধ থেকে পিছন দিয়ে টেনে কোমড়ে গুঁজেছে? একনজরে রোমানার দিকে তাকালে তো চোখ আঁটকে যায় না। তার দিকে একনজরে তাকালে কত-শত পুরুষের চোখ আঁটকে যাবে সে জানে? এর জন্য দায়ী তো পুরুষগুলো নয়, এর জন্য দায়ী সে নিজে। তার বেশভূষা এমন যে শরীরের প্রতিটি অংশ পর্দার বাইরেও সুস্পষ্ট হয়ে চোখে ধরা দিচ্ছে! দৃষ্টি নত করে ফেললো প্রণয়। ঘনঘন কয়েকবার ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বুকের ভিতর কেমন এক যন্ত্রণা বোধ করছে সে। অশান্ত প্রণয়ের দিকে ভীরু চোখে একবার চেয়ে দেখলো শাহিনুর। রঙ্গন শাহিনুর’কে ইশারা করলো খড়ের উপর বসতে। কিন্তু শাহিনুর ঠাঁই দাঁড়িয়েই রইলো। রঙ্গন মুচকি মুচকি হেসে অঙ্গন’কে বললো,
-‘ দেখছো এখনো ভয় পাচ্ছে। তোমরা আছো বলে আসতেই চাইলো না, খুব জোর করলাম পরে কি করেছি জানো আমার কসম দিয়ে নিয়ে এসেছি। ‘
রঙ্গনের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করলো রোমানা আর অঙ্গন। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রণয় বললো,
-‘ তাহলে এখন বসার জন্যও কসমটা দিয়ে ফেল।’
প্রণয় রেগে যাচ্ছে বুঝতেই রঙ্গন শাহিনুরের হাত টেনে বসিয়ে দিলো। শাহিনুর লজ্জায় মাথা নত করে সেই যে বসলো আর মাথা উঁচিয়ে কাউকে দেখলো না। রোমানা ধীরগতি সরে শাহিনুরের পাশে গিয়ে বসলো৷ তারপর তাকে স্বাভাবিক করার জন্য কথাবার্তা বলতে লাগলো। সকলের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা চলতে চলতে যখন বারোটা বেজে গেলো তখন আচমকা রোমানা ওঠে প্রণয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর রঙ্গন’কে ইশারা করতেই রঙ্গন খড়ের নিচ থেকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ বের করে রোমানার হাতে দিলো। রোমানা গোলাপগুচ্ছ নিয়ে প্রণয়ের সম্মুখে ধরে লাজুক ভঙ্গিতে চটপটে কন্ঠে বললো,
-‘ শুভ জন্মদিন প্রণয়, আই লাভ ইউ সো মাচ। ‘
রঙ্গন শিষ বাজিয়ে ওঠলো। অঙ্গন মৃদু হাসলো। কিন্তু শাহিনুর অবুঝের ন্যায় মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো প্রণয় এবং রোমানার মুখপানে। আচমকা প্রণয়ের দৃষ্টি তখন শাহিনুরের দিকে যেতেই দু’জনের দৃষ্টি মিলন ঘটে গেলো। প্রণয়ের শানিত দৃষ্টি’তে দৃষ্টি মিলন হতেই হৃদপিণ্ড ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো নুরের। পাশে থাকা রঙ্গনের দিকে কিছুটা চেপে রঙ্গনের বাহুতে ধরতে গিয়ে শার্ট খামচে ধরলো। আচমকাই রঙ্গনের দিকে চেয়ে কম্পিত কন্ঠে বললো,
-‘ আমি এখানে থাকবো না! ‘
এ’কথা শুনে রঙ্গন অবাকান্বিত হয়ে শাহিনুরের দিকে তাকালেও প্রণয় বাঁকা হেসে রোমানার দিকে তাকালো। তারপর ফুলের তোড়া নিয়ে রোমানা’কে বললো,
-‘ ধন্যবাদ রোমানা। ‘
একে একে সবাই প্রণয়’কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। শুধু শাহিনুর বাদে। রঙ্গন শাহিনুর’কে কিছু সময় থাকার জন্য খুব জোর করে রাজি করালো। তারপর তার বড়ো ভাই’কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে বললো। ভীতিগ্রস্ত শাহিনুর কিছুতেই রাজি হলো না। শেষে প্রণয় বললো,
-‘ রঙ্গন, বড়োদের প্রতি যে মেয়ের সম্মানবোধই নেই সেই মেয়ে জমিদার বাড়ির পুত্রবধূ হবে কি করে তা নিয়ে আমি ভীষণ চিন্তিত। ‘
প্রণয়ের এমন কথা শুনে রোমানা মন খারাপ করলো। অঙ্গন শুধুই নিরব দর্শক। কিন্তু শাহিনুর চুপ রইলো না সে মাথা নত করেই বললো,
-‘ আপনাকে আমার খুব ভয় লাগে, আপনার তাকানোতে কিছু একটা আছে! ‘
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো সকলেই কেবল প্রণয় বাদে। তার ওষ্ঠাধরে দুর্বৃত্ত হাসির দেখা মিললো। রঙ্গন তার সকল বিস্ময় কাটিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠলো। তার হাসির শব্দ শুনে স্বাভাবিক হলো রোমানা, অঙ্গন। রঙ্গন বললো,
-‘ আরে ধূর তুমি যে কি ভীতু নুর, ভাইয়া একটু গম্ভীর স্বভাবের বলে তোমার এমন মনে হচ্ছে তাছাড়া কিছুই নয়। ‘
রোমানা বললো,
-‘ একদম ঠিক বলেছিস রঙ্গন৷ প্রণয়কে দেখে এখনো আমার ভয় কাটলো না। নুর তো কেবল নতুন। ‘
ওদের কথার মাঝে অঙ্গন বললো,
-‘ রাত তো বেড়ে যাচ্ছে এখন একটু গান টান হোক। রোমানা, ভাইয়ার জন্মদিন উপলক্ষে আজ তোমার গলায় একটা গান শুনতেই পারি আমরা। ‘
রোমানা লজ্জা পেয়ে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ তোমার অনুমতি না পেলে গাইবো না। ‘
প্রণয় নুরের দিকে দৃষ্টি ঠাঁই রেখেই উত্তর দিলো,
-‘ অনুমতি দেবো না মানে রঙ্গন তোর গিটার’টা এখানে আছে? ‘
-‘ হ্যাঁ ভাইয়া কিন্তু… ‘
-‘ কোন কিন্তু নয় যা গিয়ে নিয়ে আয়। ‘
রঙ্গন গিটার নিতে চলে গেলো। বহুদিন এমনি পড়ে থাকায় বেশ ময়লা পড়ে গেছে। তাই সেগুলো পরিষ্কার করতে করতে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলো। নুর খুব অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। তার অস্বস্তি টুকু দ্বিগুণ করার জন্য শুনিয়ে শুনিয়ে প্রণয় রোমানা’কে বললো,
-‘ বুঝলে রোমানা দিনকাল ভালো না। আমি আমার ভবিষ্যৎ সন্তান’দের নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। ‘
রোমানা বিস্ফোরিত চোখে প্রণয়ের দিকে তাকালো। হায়! প্রণয় তার সঙ্গে রসিকতা করছে?
-‘ কেন চিন্তিত জিজ্ঞেস করলে না রোমানা? ‘
-‘ কেন? ‘
-‘ দিনকাল ভালো না রাত, বিরাতে কোন ছেলে টপকে নিয়ে যেয়ে আমার মেয়ের সঙ্গে প্রেম, টেম করে বসবে। ‘
হেসে ফেললো রোমানা। বুঝলো নুর’কে ক্ষেপাচ্ছে প্রণয়। কিন্তু সে তো এমন মানুষ নয় তাহলে হঠাৎ এমন আচরণ যে! তীব্র অস্বস্তি নিয়ে শাহিনুর এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। প্রণয় আবারো বললো,
-‘ রোমানা,তুমি কখনো তোমার মা’কে ফাঁকি দেওয়ার কথা, মিথ্যা বলার কথা ভাবতে পারো? ‘
-‘ উহুম। ‘
-‘ কখনো মা’কে ঠকানোর কথা ভাবতে পারো? ‘
-‘ একদম না প্রণয়। এ পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে বেশী কেউ আপন হয় না। আর আপনজন’দের কখনো ঠকাতে নেই। ‘
-‘সঠিক। আপনজনদের ঠকালে দিনশেষে নিজেকেই ভয়ংকর ভাবে ঠকতে হয়! ‘
এটুকু বলে শাহিনুরের দিকে তাকালো প্রণয়। মেয়েটার মুখটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দু’টো পানিতে টলমল করছে। প্রণয় সে চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ যদি কখনো এমন ভুল করো মা’কে বলে ক্ষমা চেয়ে নিও। ‘
এ পর্যায়ে প্রণয়ের দৃষ্টিতে নজর পড়লো রোমানা, অঙ্গন দু’জনেরই। তখনি রঙ্গন চলে এলো। গিটার নিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে বললো,
-‘ আপা গান শুরু করো। ‘
প্রণয় রোমানার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে অবাকান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই মুচকি হেসে প্রণয় বললো,
-‘ গান ধরুন ম্যাডাম। ‘
ব্যস এটুকুতেই মস্তিষ্কে ঘোর লেগে গেলো রোমানার। লাজুক হেসে গান ধরলো সে,
” তোমাকে ভালোবেসে দিতে পারি প্রান, আমি মাটি তুমি নীল আসমান, আমি মাটি তুমি নীল আসমান
তোমাকে ভালোবেসে দিতে পারি প্রান, আমি মাটি তুমি নীল আসমান,আমি মাটি তুমি নীল আসমান…।”

গান শেষে লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো রোমানা। অঙ্গন মুচকি হেসে প্রণয়’কে বললো,
-‘ ভাই এবার কি তোমার কন্ঠে একটি গান শোনার সৌভাগ্য হবে? ‘
এ পর্যায়ে নুরের দিকে তাকালো প্রণয়। বিমর্ষ মুখে ঠাঁই বসে আছে মেয়েটা। হয়তো ছোট্ট হৃদয়ে মা’কে ঠকানোর ফলে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু এই যন্ত্রণাটুকুর খুব প্রয়োজন ছিলো। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে রঙ্গনের দিকে তাকালো প্রণয়৷ বললো,
-‘ গিটার টা কি রেখে দেওয়ার জন্য আনতে বলেছি নাকি,
রঙ্গন বললো,
-‘ সত্যি গাইবে? ‘
-‘ ইয়েসস। ‘
দু’ভাই হৈহৈ করে ওঠলো। আশ্চর্য হয়ে তাকালো রোমানাও। খুশি’তে আত্মহারা হয়ে শাহিনুরের বাহুচেপে ধরলো সে। রঙ্গন গিটারে মৃদু টুংটাং আওয়াজ তুললো। আর প্রণয় নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নুরের দিকে। রঙ্গন গিটারের তালে,রোমানা ভালোলাগা,ভালোবাসার সীমাহীন সুখের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। কিন্তু অঙ্গন ঠিক খেয়াল করলো প্রণয়’কে। তার গভীর দৃষ্টিজোড়া’কে। আর প্রণয় স্মরণ করলো, সেই রাতকে। যেই রাতে তার চক্ষে তির্যক জ্যোতির ন্যায় বিঁধেছিলো শাহিনুরের সুশ্রী মুখশ্রী’টি। স্মরণ হলো সেই ক্ষণ, যে ক্ষণে শাহিনুরের হরিণাক্ষ দৃষ্টিজোড়ায় তলিয়ে গিয়েছে সে। সেই দিনটুকুর স্মরণ করেই শাহিনুরের উদ্দেশ্যে গান ধরলো সে,
“ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে,
আমার মনের ঘরে চাঁন্দের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে
পুষে রাখবো রাখবো রে বন্ধু তোমায় যতনে,
ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না
দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম,মন তো আর মানে না,কাছে আইসো আইসো রে বন্ধু প্রেমের কারণে
ভালোবাইসো বাইসোরে বন্ধু আমায় যতনে”

প্রণয়ের কন্ঠে গান শুনে বিমোহিত হয়ে রইলো
সকলেই। কিন্তু শাহিনুর বিমোহিত হওয়ার পাশাপাশি থরথর করে কাঁপতেও শুরু করলো। তার এই কাঁপাকাঁপি ততোক্ষণ থামলো না যতোক্ষণ না প্রণয়ের সম্মোহনী দৃষ্টিজোড়া তার থেকে বিচ্যুত হলো!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।