অঙ্গারের নেশা | পর্ব – ৫

সদর দরজার দিকে সবার দৃষ্টি গেলো। ট্রলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে রেয়ান। প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে রেয়ানের কাছাকাছি যেতে নিলে সুফিয়ান হাত ধরে ফেললো৷ প্রানেশা দেখলো সুফিয়ানের মাঝে কোনো প্রকার অবাকের ছাপ নেই৷ এ যেন স্বাভাবিক একটা বিষয়৷ সুফিয়ান আগের মতোই চুপচাপ বসে কাটা চামচ দিয়ে চাওমিন খাচ্ছে। কিছুটা পানি পান করে চুপচাপ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো৷ কিন্তু প্রানেশার হাতটা ছাড়লো না৷ রেয়ান রাগী মুখে এগিয়ে এলো। জোরে চেচিয়ে বললো -‘এসবের মানে কী?’
তারপর বাবা মার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বললো-‘ তোমরা আমার সাথে এমন কী করে করতে পারলে! তোমাদের বড় ছেলে তো সবসময়ই তোমাদের অতি প্রিয় তাই বলে ছোট ছেলের কোনো মূল্যই নেই!’
মিস্টার রাহাত কিছু বলার আগেই সুফিয়ান ঠান্ডা গলায় বললো -‘সবাই খেতে বসো ‘
এক কথায়ই সবাই চুপচাপ বসে পড়লো৷ এতক্ষণ যেন কিছুই হয়নি৷ প্রানেশা সবার এহেন কান্ডে হতভম্ব হয়ে রইলো৷ এ কেমন রহস্য পরিবার! সুফিয়ানের এক কথাই মনে হয় শেষ কথা৷ সুফিয়ান চুপচাপ বসে কিছু ফাইল দেখছে ৷ প্রানেশা সবার এই নির্লিপ্ততা সহ্য করতে পারছেনা, নিজের একটা প্রশ্নের জবাবও সে পায়নি। সুফিয়ানের ধরে থাকা হাতটা ছাড়িয়ে দৌড়ে রেয়ানের সামনে দাঁড়ালো প্রানেশা। রেয়ানের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এলোমেলো। প্রানেশা রেয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। বহুযুগ পর যেন আপনজনকে খুঁজে পেলো সে৷ রেয়ান প্রানেশার মাথায় হাত রেখে বললো –
‘বিয়ে কেনো করলে প্রানেশা? আমার ভালোবাসা এত ঠুনকো ছিলো তোমার কাছে? ‘
প্রানেশা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে না বললো৷ হিচকি ওঠা গলায় বললো –
‘বিশ্বাস করো রেয়ান, আমি কাল তোমাকে ফোন করার আগ পর্যন্ত কিছুই জানতাম না । জানলে কখনো বিয়ে করতাম না ‘
রেয়ান প্রানেশার হাত ধরে বললো-
‘চিন্তা করো না, দ্রুত তোমার তালাক করিয়ে আমরা বিয়ে করে নেবো’
প্রানেশা হা করে কিছু বলতে নিলেই সুফিয়ান এসে একটানে রেয়ানের কাছে থেকে ছিনিয়ে নিলো প্রানেশাকে। তারপর হাত ভাজ করে রেয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো –
‘সে আশা ভুলে যা রেয়ান৷ এই আশা কখনো পূরণ হওয়ার নয় ‘ তারপর রেয়ানের কানের কাছে হালকা আওয়াজে বললো-‘ কী জানিস তো, অগাস্টিন বলেছেন- দুর্বলেরা ভাগ্যে বিশ্বাসী হয়, আর সবলেরা তা ছিনিয়ে নেয়’
বলে সুফিয়ান দূরে সরে আসলো। রেয়ানের মুখ লাল হয়ে আছে৷ দুজনের চোখে যেন এক নিশ্চুপ যুদ্ধ চলছে৷ একজনের চোখে জিতে যাওয়ার জ্যেতি আর আরেকজনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ। রেয়ান ফসফস করতে করতে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। প্রানেশা সেই দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। নিজেকে বেইমান মনে হচ্ছে তার। ভালোবাসার মানুষটাকে ধোঁকা দিয়ে কী করে সুখী হবে সে! যদিও সে সেচ্ছায় কিছুই করেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। সুফিয়ান এতক্ষণ হাসলেও এখন চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে প্রানেশার দিকে। সাহস কী করে হয়, পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরে স্বামীর সামনে! প্রানেশার হাত ধরে নিজের রুমের দিকে নিতে ধরলেই রাহাত সাহেব বললেন -‘ আহা, মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। ওর কী দোষ! ‘
সুফিয়ান চোখ লাল করে রাহাত সাহেবের দিকে তাকালো। ঘাড় বাকিয়ে বললো- ‘আমার এবং আমার স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যাক্তিকে কথা বলার অনুমতি দেইনি আমি। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি একা নিতে শিখেছি বহু আগেই ‘
রাহাত সাহেব মুখ নিচু করে রাখলেন৷ সুফিয়ান প্রানেশাকে ধরে উপরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো৷ দরজা খুলে প্রানেশাকে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললো। সুফিয়ান দরজা লক করতেই প্রানেশা উঠে দাড়িয়ে গেলো। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। লোকটা যে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় তা একদিনেই বুঝতে পেরেছে প্রানেশা। সুফিয়ানের মুখটা অস্বাভাবিক লাগছে প্রানেশার কাছে, কেমন যেন উন্মাদের মতোন৷ ঘাড়ের নীল রগটা ফুলে আছে৷ চোখের পলকও যেন আটকে আছে। প্রানেশার কপালে কপাল ঠেকিয়ে পেছনে হাত বাকিয়ে ধরলো সুফিয়ান৷ প্রানেশার মুখ চোখ কুচকে এলো ব্যাথায়৷ সুফিয়ান জোরে হাসা শুরু করলো, এমন পরিস্থিতিতে কেউ এভাবে হাসতে পারে তা প্রথম দেখলো প্রানেশা , ভয়ে গা গুলিয়ে আসছে তার । ভেতরের সব যেন এখনই বেরিয়ে আসবে। সুফিয়ান প্রানেশার কপাল ছুয়ে হেসে বললো –
-‘এত ভয় পাও তাহলে ওই কাজ কেন করলে প্রাণ?’
প্রানেশা থরথর করে কাপছে। সুফিয়ান আরও জোরে চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-
-‘ কেনো করলে বলো? সাহস কী করে হলো অন্য কারো ছোঁয়া শরীরে মাখার!’ বলে সুফিয়ান ঘন ঘন শ্বাস নেয়৷ তারপর মুখটা এমন করলো যখন কোনো বাচ্চার মাথায় চমৎকার বুদ্ধির আবির্ভাব ঘটে। এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বোকা হেসে বললো –
-‘পেয়েছি! চলো আমার সাথে ‘
প্রানেশার মাথা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ এতক্ষণে সে বুঝে গেছে, সুফিয়ান স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ নয়। সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন ভালো না তার। নাহলে এমন ব্যবহার নরমাল কেউ করেনা। সুফিয়ান বাথরুমের ভেতরে তাকে ঢুকাতেই প্রানেশার ভেতরটা ধক করে উঠলো, তাহলে কী এবার বাথটাবে চুবিয়ে মারবে! মানুষ সব কিছু হারাতে পারলেও প্রাণ হারাতে চায় না। প্রানেশা ভয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘প্লিজ, ছেড়ে দিন আমায়। আর কক্ষনো এমন হবেনা। মারবেন না আমাকে ‘
সুফিয়ান কোনো উত্তর দিলো না। প্রানেশাকে রেখে রুম থেকে একটা সোবা নিয়ে এলো। যা দিয়ে থালা বাসন মাজা হয়। ভীষণ রুক্ষ, মাঝে মাঝে বেশি ঘষা লাগলে হাত ছুলে যায়। প্রানেশাকে বাথটাবে বসিয়ে হাতের চুড়ি খুলে একনাগাড়ে ঘষতে থাকলো। হাত থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত অনবরত ঘষে গেলো। প্রানেশার মুখ যখন ব্যাথায় লাল হয়ে গেলো তখন সুফিয়ান থামলো৷ মুখের অভিব্যাক্তি এখনও স্বাভাবিক নয় তার, প্রানেশা প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে তখন সুফিয়ান প্রানেশার মুখটা আজলায় নিয়ে নরম গলায় বললো -‘ আমার জিনিসে আর কখনো অন্য কারো ছোঁয়া লাগাবে না প্রাণ। দেখলে তো কত কষ্ট হয় ছোঁয়া মুছতে! আমি একবার হারিয়েছি আর হারাতে দেবোনা। ‘
প্রানেশা সুফিয়ানের পাগলামিতে তাচ্ছিল্য করে হাসলো৷ ভেঙে যাওয়া গলায় ধীরে ধীরে বললো-
‘আপনি একটা পাগল। মানুষ খুন করতেও আপনার হাত কাঁপবে না ‘
সুফিয়ান প্রানেশার চুলের মুঠি ধরে কানের কাছে বললো-‘ খবরদার প্রাণ! আজ বলেছো ক্ষমা করলাম , দ্বিতীয়বার আমায় পাগল বললে ক্ষমা পাবেনা। আর খুন করতে পারি আমি কিন্তু তোমায় শেষ করা আমার সাধ্যের বাইরে। নিজের প্রাণকে শরীরের থেকে আলাদা করা কী এতই সহজ! ‘
প্রানেশা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সুফিয়ান কোলে করে উঠিয়ে বেডে নিয়ে শুইয়ে দিলো৷এসির সাথে এডজাস্ট ফ্যান অন করে, টাওয়াল দিয়ে প্রানেশার হাত পা মুছে নিলো। ব্যাথা কমার একটা ক্রিম নিয়ে হাতে আর গলায় লাগিয়ে দিলো। তারপর বেডে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে হসপিটালে কল করলো –
‘ আসাদ, তুমি আজকের প্যাশেন্টগুলোকে অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি আজ আসবো না৷ প্যাশেন্টদের কিছু ফাইল আছে এসে নিয়ে যেও, দেখে রেখেছি ‘
বলে ফোনটা সুইচ অফ করে দিলো৷ সে পেশায় একজন সিনিয়র হার্ট সার্জেন। বর্তমানে সে নিজের একটা হাসপাতাল বানানোর একটা প্ল্যান করছে। সেটার কাজ কমপ্লিট হলে সেখানে জয়েন করবে সে।
প্রানেশার মুখের দিকে তাকিয়ে সুফিয়ান দেখলো মুখ লাল হয়ে গেছে।একটা চিনির পুতুল প্রানেশা, ছোট খাটো ব্যাথায়ও তার নাজেহাল অবস্থা হয়। সুফিয়ান যে ঔষধ দিয়েছে তাতে রাতের আগেই ব্যাথা কমে যাবে। কিন্তু এখন সুফিয়ানের নিজেরই চিন্তা হচ্ছে, নিজের ডাক্তারিতেও ভরসা করতে পারছেনা। তাই, হসপিটালে মানা করে দিলো। কিছুর যদি প্রয়োজন হয়! প্রানেশাকে জড়িয়ে ধরে সেও পাশে শুয়ে পরলো। প্রানেশার হাতটা মুখের সামনে নিয়ে বিরবির করে বললো-
” প্রাণ, এই পৃথিবীতে প্রেমিক অনেকেই হয় । কিন্তু পাগল প্রেমিক সবাই হতে পারে না। পাগল প্রেমিক হওয়া সহজ নয়, কারণ পাগলদের ভালোবাসার সীমা বোঝে না ”

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।