আজ আনন্দরা দলবদ্ধ হয়ে যেনো ধরা দিয়েছে। কী সুন্দর অনুভূতি! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর ঘটনা বুঝি এটিই?
নাহলে সুফিয়ানের চোখের কোণে জল জমবে কেনো?
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহের ভিতর ভর করলো সজীবতা।
ক্লান্ত হয়ে ফিরে যে এত বড় সুসংবাদ পাবে ভাবতেই পারেনি সে৷ হাতে এখনো চিরকুট মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট কাঁপছে, চোখের জল গড়িয়ে পড়বে খানিক বাদে। সুফিয়ান কাঁপন ধরানো পায়ে এগিয়ে গেলো বারান্দায়। প্রানেশার গায়ে কমলা রঙের সুতি শাড়ি। রেলিংএ হেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে কী যেনো দেখছে। সুফিয়ান নিঃশব্দে প্রানেশাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সুফিয়ান কাঁধে থুঁতনি রেখে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো –
‘এটা কী সত্যি? ‘
প্রানেশা নির্লিপ্ত ভাবে বললো –
‘হু’
সুফিয়ান প্রানেশাকে নিজের দিকে ফেরালো। প্রানেশার উদাস হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘কিছু নিয়ে মন খারাপ প্রাণ? ‘
প্রানেশা হুট করে রেগে উঠলো। চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো –
‘ডাক্তার হতে কে বলেছিলো আপনাকে?’
সুফিয়ান বিস্মিত ভঙ্গিতে বললো-
‘এ্যা!’
‘এ্যা কী? কয়টায় আসার কথা ছিলো আজ? ‘
সুফিয়ান এবার অভিমানের কারণ বুঝলো। শুক্রবার থাকা সত্বেও হসপিটালের কাজে ব্যস্ত ছিলো আজ। প্রানেশা সকালে বলেছিলো একটু তাড়াতাড়ি আসতে। সুফিয়ান বলেছিলো ‘চেষ্টা করবো’। কারণ দ্রুত আসবো, এটা ডাক্তারী পেশায় যুক্ত হওয়ার পর আর বলা যায় না। দ্রুত আসার চেষ্টা করলেও পারেনি সুফিয়ান, কারণ প্যাশেন্ট বেশি ছিলো। সুফিয়ান অসহায় মুখ করে বললো –
‘সরি প্রাণ ‘
প্রানেশার অভিমানের কারণ আছে বটে। সে যে সন্ধ্যা থেকে সুফিয়ানের অপেক্ষা করছিলো৷ শাড়ি পড়ে এই গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলো। সুফিয়ানের উপর খুব অভিমান হলো তার। এই স্পেশাল একটা দিনেও কী কেউ দেরি করে!
প্রানেশার বিস্তর ভাবনার থেকে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সুফিয়ান প্রানেশাকে কোলে তুলে নিলো৷ প্রানেশা হকচকিয়ে হয়ে তাকিয়ে দেখলো সুফিয়ানের মুখের উজ্জ্বল প্রাণবন্ত হাসি। প্রানেশাকে কোলে তুলে চারপাক ঘুরলো সুফিয়ান। বিছানায় বসে সুফিয়ান প্রানেশাকে নরম হাতে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশা অবাক হয়ে হেসে নিজেও বাহুতে জড়িয়ে নিলো৷ সুফিয়ানের শরীর কম্পমান। মৃদু মৃদু কেঁপে উঠছে৷ প্রানেশা বললো-
‘আপনি কী কাঁদছেন? ‘
সুফিয়ান ধাতস্থ হয়ে প্রানেশার কোলে মাথা রাখলো৷ উদরের আঁচল সরিয়ে মুখ গুঁজে রাখলো। প্রানেশা আলতো হাতে সুফিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো৷ সুফিয়ান মাথা হালকা উঁচু করে বললো –
‘আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না প্রাণ! ‘
পরক্ষণেই প্রানেশার হাত নিজের হৃদপিণ্ডের জায়গাটায় রেখে বললো –
‘আজকে তুমি যা চাও তাই পাবে, বলো প্রাণ কী দিতে পারি আমি ‘
প্রানেশা খানিক নড়েচড়ে বসলো। যেনো খুব বড় কিছু চাইবে সে। সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘সত্যি? যা চাইবো তাই দেবেন!’
‘একদমই তাই’
প্রানেশা সুফিয়ানের হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললো-
‘তবে, এই পারিবারিক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নিন ‘
সুফিয়ানকে শান্ত দেখে আরেকটু সাহস জমিয়ে বললো-
‘ আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না, আপনার সন্তানও আপনার আর রেয়ানের মতোন একা একা বড় হোক। আপনার মা বাবা দুজনেই বেঁচে ছিলেন কিন্তু দ্বন্দ্ব, ধোঁকা এইসব কিছু সবার জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে। আপনি ঠিক থাকতে পারলেও, রেয়ান পারেনি। ইভানানের প্রতিশোধের স্পৃহায় রেয়ানের একাকিত্বকেই ব্যবহার করেছে হাতিয়ার হিসেবে। ‘
কিছুটা থেমে বললো-
‘নিজেকেও তো কম কষ্ট দিচ্ছেন না! বাবার চোখেও আমি অনুতপ্ততা দেখেছি। আগে সে হয়তো একটা ভুল করেছে, টাকার লোভে আপনাদের ঠকিয়েছে। কিন্তু কম শাস্তি তো পায়নি৷ ওই সংসারে সন্তান ছিলো না, আপনাদের কাছে আসতে চেয়েও পারেনি। সেও কিন্তু তার ভাগের শাস্তি পেয়েই গেছেন। এখন যেহেতু সে অনুতপ্ত, আপনার উচিত এক কদম বাড়ানো। বাকিটা তার উপর ছেড়ে দিন ‘
সুফিয়ান মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ কথা শুনে বললো-
‘আমি চেষ্টা করবো, প্রাণ’
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে। প্রানেশাও লম্বা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। এবার কিছুটা হলেও চিন্তামুক্ত। সুফিয়ান যেহেতু বলেছে চেষ্টা করবে তাহলে কিছুটা হলেও করবে৷ ওয়াশরুমে চলে যাওয়ার কারণও প্রানেশা জানে। জীবনের কিছু মুহূর্তে সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র আমাদের নিতে হয়। তখন একাকী থাকাটা খুব প্রয়োজন।
গ্রীষ্মের টগবগে গরমকাল৷ আম,কাঁঠালের পদার্পণ ঘটেছে এরইমধ্যে। ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজাচ্ছিলেন মিসেস অদিতি। রাহাত সাহেব চেয়ার টেনে বসলেন। পায়েশ নানা রকম পিঠে দিয়ে ভরপুর টেবিল ৷ গ্রীষ্মের গরমে পিঠের আয়োজন অনেকটাই বেমানান। কিন্তু, প্রানেশার নাকি এসবই খাওয়ার স্বাদ জেগেছে। প্রেগ্ন্যাসিতে মেয়েরা টক ঝাল নাকি বেশি খায়। কিন্তু প্রানেশার শুরু থেকেই মিষ্টির প্রতি দারুণ আকর্ষণ। নিজের মা যখন আচার, টক ঝাল খাবার পাঠাতে চেয়েছিলো তখনও সে মিষ্টি পাঠাতে বলেছে। কয়েক দিন বাপের বাড়ি থেকেও এলো সে৷ সুফিয়ানও বউয়ের পিছনে পিছনে সেখানে থেকেছে। কী আর করবে, একরাত নিজের বাড়িতে কাটিয়ে নিজের বেহাল দশা করে ফেলেছিলো সে৷ প্রানেশার থেকে দূরে থাকা তার পক্ষে অন্তত সম্ভব বলে মনে হয়না।
প্রানেশার আট মাস চলছে৷ আগের পাতলা ফড়িংয়ের মতো শরীরটা হালকা মুটিয়েছে৷ পেট অনেকটাই উঁচু হয়েছে। সুফিয়ানের কড়া নিরাপত্তা, মিসেস অদিতির আদর, রাহাত সাহেবের স্নেহে ভালোই দিন কাটছে প্রানেশার।
সুফিয়ান তখন হসপিটালের একটা অপারেশনে ব্যস্ত ছিলো৷ প্রানেশা সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে মুখ মুচ্ছিলো৷ মোবাইলের টুংটাং আওয়াজে মুচকি হেসে উঠলো প্রানেশা। সুফিয়ান দশ মিনিট পরপরই কল করতে থাকে। হয়তো এখন মেসেজ পাঠিয়েছে ভেবেই মোবাইলটা হাতে নিলো। মেসেজ অপশন অন করতেই মাথা ঘুরে গেলো। প্রানেশার চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে টুপ করে পড়লো পায়ের আঙুলে। সুফিয়ানের সঙ্গে চার পাঁচটা মেয়ের বিছানায় ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি। প্রানেশার দুর্বল শরীর আর নিতে না পেরে ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে রইলো৷ দূর্ঘটনার হাত থেকে আর রেহাই পাওয়া গেলো না অবশেষে। প্রানেশার মাথাটা ড্রেসিং টেবিলের উপর বাড়ি খেয়ে রক্তের ফোঁটায় রঞ্জিত হয়ে গেলো ফ্লোর।