বাহিরে বোধহয় হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। সুফিয়ান বুকে গুটিয়ে থাকা যুবতীর দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো৷ ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে গেছে প্রাণেশা, গাঁয়ের সঙ্গে নিবিড় হয়ে লেপ্টে আছে। উপরে একটা কম্ফর্টার দেয়া আছে গায়ে, কিন্তু তারপরও প্রাণেশার ঠান্ডা কমছে না। সুফিয়ান হাত বাড়িয়ে মোমের মতো সাদা নাকটা ছুয়ে দিতেই প্রানেশা হালকা কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে স্নিগ্ধ হাসলো। সুফিয়ান প্রানেশার হাতটা আলতো হাতে ধরে দীর্ঘক্ষণ অধরে লাগিয়ে রাখলো৷ প্রানেশা সরালো না , তার দৃষ্টিও নিবদ্ধ সুদর্শন যুবকের খাড়া কাটা চোয়ালের উপর, ছেলেদের চোখ ছোট থাকে কিন্তু সুফিয়ানের বড় চোখ তার ভেতরে গভীর ডার্ক চকলেট বলের মতোন চকচকে মণি। প্রাণেশার হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো গভীর চোখদ্বয়ে গভীর ছুঁয়ে দিতে, ঘোরের মাঝেই মুখটা উঁচু করে চোখের পাতায় চুমু খেয়ে কাঁধে মুখ গুজে রইলো৷ সুফিয়ানের নিশ্বাস ঘন হয়ে গেলো, প্রাণেশার মাথায় হাত রেখে বললো-
‘একটু আগে তো শুনবো শুনবো বলে জেদ করছিলে, এখন শুনবে না?’
‘হু, শুনবো বলুন ‘
‘এমন করে থাকলে বলবো কীভাবে?’
প্রানেশা দুষ্টু হেঁসে বললো –
‘কিছু জানিনা, এভাবেই বলুন ‘
সুফিয়ান বুঝতে পারলো এসব তাকে জ্বালানোর উসিলা মাত্র। সুফিয়ান প্রানেশাকে টেনে বালিশে শুয়ে দিলো। প্রাণেশা ভাবলো সুফিয়ান রেগে গেছে, এখন খুব বকবে। তাই সরি বলতে প্রস্তুতি নিতেই তাকে অবাক হয়ে দিয়ে প্রাণেশার আগের ভঙ্গিতে নিজেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। প্রানেশার থমকে যাওয়া মুখ দেখে মৃদু হেসে বললো –
‘এবার ঠিক আছে ‘
প্রানেশাও প্রতুত্তরে হেঁসে ফেললো। সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে সেই অন্ধকারে ঢেকে থাকা দিনটার কথা মনে করলো। কী কুৎসিত একটা দিন ছিলো সেটা! ভাবতেই সুফিয়ানের গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে।
সেদিন যখন সুফিয়ানের দীর্ঘ আট দিন পর জ্ঞান ফিরলো সেদিন সে সবার প্রথমে সৃষ্টিকর্তাকে বিরাট ধন্যবাদ জানালো। এত বড় এক্সিডেন্টের পর সে যে বেঁচে আছে ভাবতেই শুকরিয়া আদায় করলো। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো তার প্রানেশার সঙ্গে তো তার দেখা করার কথা ছিলো! লাফিয়ে উঠে বসলো সে। হাতের ক্যানালোতে টান লাগতেই কয়েক ফোটা রক্ত গড়িয়ে পড়লো। অতকিছু খেয়াল না করে জোরে চেচিয়ে মাকে ডেকে উঠলো, কিন্তু একি!তার গলা দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছে না। অতিরিক্ত মাত্রায় স্ট্রেসের কারণের গলা দিয়েও রক্ত পড়তে শুরু করলো। বাহির থেকে আওয়াজ পেয়ে নার্স ভেতরে ঢুকে পড়লো, মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেবও আসলেন৷ সুফিয়ানের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গলা আওয়াজ বের করতে না পেরে গলায় চেপে ধরে আছে। ডক্টর এসে সুফিয়ানকে তার গলায় ইনজুরির কথা জানালেন। সুফিয়ান ইশারায় জিজ্ঞেস করতেই ডক্টর বললেন-
‘এই এক দেড় মাস লাগবে! কিন্তু গলায় প্রেশারাইজ করলে রিকোভার করতে টাইম লাগবে। মেডিসিন নিয়মিত নিলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন, ডোন্ট নিড টু ওয়ারি ‘
সুফিয়ান ততক্ষণে শান্ত, নিশ্চুপ। মিসেস অদিতি থাকতে চাইলেও সুফিয়ানের ভয়ে আর থাকতে পারেনি। সুফিয়ান বলেছে সে কিছুটা সময় একা থাকতে চায়।
কয়েক দিন পরই রিলিজ হয়ে বাড়ি ফিরলো সুফিয়ান৷
সবার আগে প্রাণেশার সঙ্গে দেখা করার জন্য মন ছুটে গেলো। প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো প্রাণেশা নিজেই ফোন দিবে, কিন্তু মোবাইল অন করতেই দেখলো প্রানেশার কল তো দূরের কথা, তার নাম্বারই পড়ে আছে ব্লক লিস্টে। প্রতিবার সুইচ অফ বলছে৷ সুফিয়ানের হার্টটা তখন মিনিটে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেগে ছুটতে লাগলো। আরেকটা নাম্বারে কল দিতেই সেটা বিজি শোনালো। সুফিয়ানের বুকে তখন তীব্র ব্যাথায় ভরে উঠেছে, একজনকে দিয়ে খোঁজ লাগাতেই শুনলো প্রানেশা অন্য কারো সাথে রিলেশনে আছে এটা খবর পেয়েছে। সুফিয়ান মাথা ঘুড়িয়ে নিচে বসে পড়লো। এসব তার কিছুতেই বিশ্বাস হলো না। সে নিজেই ক্ষত গলা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। অদিতি আর রাহাত সাহেব ঘরে ছিলো বলে জানতে পারেনি৷
কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে গেলো, প্রানেশা নাকি মায়ামতী
ঝিলে একটা ছেলের হাত ধরে বসে আছে। সুফিয়ান তখনও বিশ্বাস করেনি। কিন্তু নিজে যখন দেখলো ঠিকই প্রানেশা একটা ছেলের হাত ধরে কথা বলছে স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। রেয়ানই ছিলো সেটা, কিন্তু সাইড থেকে চেহারা খেয়াল করেনি সুফিয়ান।
বেড়িয়ে গেলো তখন সে, আর সহ্য করতে পারছিলো না অন্য কারো সাথে। কী অসহ্য তেঁতো যন্ত্রণা!
সেদিন রাতেই সুফিয়ান টিকিট বুক করে, সকালে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলো সে। সাথে ছিলো তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ইভানান। যে ইমোশনাল ব্লেইকমেইল করে রওনা হলো। সুফিয়ান কষ্টে জর্জরিত মনে আর কিছু ভাবতে পারেনি৷ বন্ধু সাথে থাকলে কষ্ট কমবে ভেবেই সে সাথে নিলো৷ কিন্তু তখনও সে জানতোনা, ইভানান কী ভয়ংকর খেলায় মেতেছে! সুফিয়ানের কানে যেনো কোনোভাবেই রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্কের কথা না জেনে সব ব্যবস্থা করে ফেললো। আর সুফিয়ানকে অনবরত ব্রেইন ওয়াশ করতে থাকতে থাকলো। প্রাণেশা যে তার সাথে বেইমানি করেছে তা একপ্রকার জোর করে বিশ্বাস করালো। সুফিয়ান মেতে থাকলো পার্ট ক্লাব, মেয়ে নিয়ে। ইভানানের গভীর ফাঁদে পুরোপুরি পা দিয়ে ফেললো৷ শুধু মিসেস অদিতির রিকুয়েষ্টে, নতুন করে একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো৷ ব্রিলিয়ান্ট হওয়ায় অল্প দিনের মাঝেই পাকাপোক্ত ভাবে সকল কিছু আয়ত্ত্বে করে নিলো। আর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করলো এক মিথ্যা বন্ধুকে। ইভানানের কথাই তার কাছে একসময় সত্যি মনে হলো। কিন্তু সুফিয়ানের বোধ হয় মনেই ছিলো না
‘ Evil was once an angel‘