‘এমন হাসছিস কেনো তুই? ‘
প্রানেশার মা মিসেস আরা খাবার বাড়তে বাড়তে প্রশ্ন করলো প্রানেশাকে ৷ প্রানেশা তখন মগ্ন তার মনের মানুষের চিন্তায়। আজ ছয়মাস যাবৎ সেই অজানা লোকটার সাথে কথা বলছে সে৷ কিছুক্ষণ আগেই ফোন দিয়ে পাগলামো কথাবার্তা বলে প্রানেশাকে হাসালো৷ প্রাণেশার এখন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে যেনো। এই বয়সটাই হলো ফ্যান্টাসির৷ যা দেখে সবই রঙিন। একটু কিছুতেই অনেক বড় স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলে এরা৷ প্রানেশাও ব্যাতিক্রম নয়। ঐ মুগ্ধ করা কন্ঠ শুনলে প্রানেশার মন ফুরফুরে হয়ে আসে৷ খাওয়ার টেবিলে বসে ভাত নাড়তে নাড়তে ফিক করে হেসে উঠতেই মিসেস আরা ভ্রু কুচকে বললেন কথাটি। প্রানেশা স্বাভাবিক মুখ করে বললো ‘কিছু না মম’
‘ গভীর প্রেম মনে হচ্ছে! ‘
ইভানানের কথায় কিঞ্চিৎ হাঁসলো সুফিয়ান। লাইব্রেরিতে বসে কিছু নোটস তৈরি করছিলো৷ সামনে পরীক্ষা, তাই কিছু সময় হলেও পড়তে হবে। কিন্তু মনটা প্রানেশার কাছেই পড়ে আছে। মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলো তাই ইভানান টিটকারি স্বরে কথাটা বললো। সুফিয়ান সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বললো- ‘প্রেম নয় নেশা! গভীর নেশায় পড়ে গেছি। এবার পরীক্ষাটা হোক তারপর আমার গানকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবো। আমার প্রাণকেও আমার কাছে নিয়ে আসবো ‘
কথাগুলো বলার সময় চোখ মুখে উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠলো সুফিয়ানের। ইভানান সেই আভায় নিজের নীল চোখদ্বয় নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো। সেই দৃষ্টি সুফিয়ান বুঝতে পারলো না। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো – ‘ ছোট চাচার তো ব্যবসা আছে, এত নামীদামী ব্যবসা থাকতে তুই কিনা গানকে পেশা হিসেবে নিবি!’
সুফিয়ানের হাস্যজ্জল মুখ শক্ত হয়ে এলো৷ খসখসে গলায় বললো -‘ ঐ লোকের ব্যবসায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার। তার ব্যবসা নিয়ে সে যা ইচ্ছে করুক। আমার রেয়ু ভালো পড়াশোনা করছে , তাই ও নিজে কাজ করে খাবে আর আমিও আমার ক্যারিয়ার নিজ হাতে গড়বো। তার নাম আমার সামনে নিবি না! আই জাস্ট হেট হিম’
‘সে তো বাবা হয় সুফি,একটা ভুল নাহয়.. ‘
সুফিয়ান উঠে দাড়িয়ে চেয়ারে লাথি মেরে রাগে ফুঁসতে
লাগলো৷ মুখ লাল হয়ে গেছে। হিংস্র রুপে বললো-
‘নাহ, কোনো যোগ্যতা নেই ঐ লোকের আমার বাবা হওয়ার। আমার সহজ সরল মাকে ঠকিয়েছে সে।সুখেই তো ছিলাম আমরা! টাকা নাহয় একটু কমই ছিলো। তাতে কী? সুখের কমতি তো ছিলো না ৷ কত সুখী ছিলাম আমরা। ছোট দুই রুমের একটা ঘর ছিলো, একটা টিভি ছিলো। আমি বাবার কোলে বসতাম আর রেয়ু মায়ের কোলে৷ বাবা মার প্লেটে খাবার না খেলে পেটই ভরতো না। মা সবসময় হাসিখুশি থাকতো। বাবা মায়ের খুনসুটি ঝগড়া, ভালোবাসা দেখতাম। সব তো ঠিকই ছিলো। কিন্তু , কেনো ঐ লোকটা আমার মাকে ঠকিয়ে বসের মেয়েকে বিয়ে করলো তাও কিনা টাকা পয়সার জন্য!
যেদিন লোকটা ঐ মহিলাকে বিয়ে করে অন্য বাড়ি চলে গেলো সেদিন মা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিলো, রেয়ুর পাঁচ আর আমার সাত বছর। লোকটা একবারও ভাবেনি আমার সহজ সরল মায়ের কী হবে! প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে দিতো। মা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব অন্যায় মুখ বুজে সয়ে গেলো। রেয়ু চুপচাপ হয়ে গেলো, শান্ত, স্থির। আর আমি সারাদিন বাহিরে থাকা শুরু করলাম। ঘরে গেলেই মায়ের বিষন্ন মুখটা দেখে ভেতরটা খানখান হয়ে যেতো। চার বছর আগে যেই দ্বিতীয় বউ মারা গেলো, আবার ইনিয়ে বিনিয়ে আমার মায়ের কাছে মাফ চেয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে এলো। টাকা পয়সা তো তখন সব ঐ লোকটারই। কারণ, দ্বিতীয় ঘরে কোনো সন্তান হয়নি, মহিলাটি সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম হওয়ার জন্যই এত বড়লোকের মেয়ে হয়েও সাধারণ কর্মচারীকে বিয়ে করলো৷ মায়ের থেকে দূরে যেতে পারিনা বলেই তো এখনও ঐ বাড়ি পড়ে আছি। নাহলে, লোকটার মুখ দেখতেও আমার জাস্ট ঘেন্না হয়! ‘
বলতে বলতে সুফিয়ানের চোখে পানি এসে গেলো প্রায়। লম্বা শ্বাস ফেলে ব্যাগটা কাঁধে তুলে শান্ত ভেজা গলায় বললো -‘ ছন্নছাড়া পরিবারে সন্তানরা ঠিক কতটা কষ্টে বড় হয়, তা বলে প্রকাশ করা যায় নারে, আজ আসি ‘
বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো মিস্টার রাহাত টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন। সুফিয়ান বিরক্তিতে চোখ সরিয়ে এগোতেই মিস্টার রাহাত নরম কন্ঠে বললো-
‘সুফিয়ান বাবা, এসো খাবার খেয়ে নাও’
সুফিয়ান উত্তর না দিয়ে ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে পান করে চুলে হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। মিস্টার রাহাত আবারও বললেন –
‘কী হলো এসো! কিছু তো খাওনি নিশ্চয়ই ‘
সুফিয়ান তাচ্ছিল্য হেঁসে বললো –
‘এত ভাবতে হবে না আপনাকে, পুট ওয়েল অন ইয়োর হুইল’
মিস্টার রাহাত আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক তপ্ত নিঃশ্বাস। মিসেস অদিতি পাশেই বসে ছিলেন এতক্ষণ। এসব নতুন নয়। প্রতি দিনই মিস্টার রাহাত নিজ থেকে কথা বলার চেষ্টা করেন কিন্তু সুফিয়ান খুব বেশি হলে হ্যা, না মতো কথা বলে চলে যায়। মিসেস অদিতি এ নিয়ে উচ্চ্যবাচ্য করেন না। কারণ, সুফিয়ান আগেই বলে দিয়েছে যদি কোনো রকম মানিয়ে নেয়ার কথা বলা হয় সে বাড়ি ছাড়তে এক মিনিটও ভাববে না। মিসেস অদিতি খাবার খাওয়ার পর চুপচাপ বিনাবাক্যে চলে গেলেন। রাহাত সাহেব অসহায়ের মতো বসে রইলেন, এখন তার ভুল সে বুঝতে পেরেছেন। বুঝেছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক বছর পরই। দুই সন্তান, প্রথম ভালোবাসার বউকে ছাড়া যে থাকা সম্ভব না তা ঠিকই বুঝেছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় বউ কাগজ পত্রে সই করিয়ে নিয়েছিলো। দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে যদি কোনো প্রকার সন্তানদের সঙ্গে দেখা করে তাহলে জেলে যেতে হবে। তখন কিছুই করার ছিলো না৷ অদিতি যতই বলুক ক্ষমা করে দিয়েছে, কিন্তু সে জানে অদিতি সেই আঘাত এখনো ভোলেনি। তা-ই তো এখন তার সাথে প্রয়োজনীয় কিছু ছাড়া কথা বলেনা। এ যেনো বিনা আঘাতে রক্তাক্ত করা৷ অপরাধবোধ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি। এর চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া পৃথিবীর বুকে সম্ভব নয়।
বেলকনিতে বেছানো মেট্রেসের উপর নিথর হয়ে শুয়ে আছে সুফিয়ান। চোখ মুখ শুকনো। প্রায় রাতেই এভাবে বসে থাকে সে। একাকীত্ব কুড়ে কুড়ে খায় তখন। এ যেনো নিত্যদিনের সঙ্গী সুফিয়ানের। সেও চায় স্বাভাবিক একটা জীবন। যেখানে এই বিষন্নতা আর দীর্ঘশ্বাসের কোনো স্থান থাকবে না। কিন্তু সবার কপালে যে এই সুখ লেখা থাকে না। রাতের নিস্তব্ধতায় মোড়া শহরের দিকে এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আছে। মুখে শব্দ নেই। চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে স্মার্টফোনের ঝকঝকে স্কিৃনে ‘নেশা ‘ ইজ কলিং লেখা দেখা যাচ্ছে। ঠোঁট আপনাআপনি প্রসারিত হয়ে হাসির ভঙ্গিমা হয়ে এলো৷ এই একটা মানুষের কন্ঠে ভেতরের সকল বিষন্নতা দূর হয়ে যায় তার৷ দ্রুত রিসিভ করে কানে দিতেই ভেসে এলো অভিমানী সুর -‘আমায় আপনি ভুলে গেছেন তাইনা? ‘
সুফিয়ান হেঁসে উঠে দাড়িয়ে দোলনায় বসে পড়লো। দোল খেতে খেতে বললো-
‘ আমি ভুলে গেলে কী তোমার কিছু এসে যাবে প্রানেশা? আমি কী খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ?’
প্রানেশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো৷ সারাদিন শুধু মোবাইল হাতে নিয়ে ফোনের অপেক্ষা করেছে সে। কিন্তু নিষ্ঠুর মানুষটা কী তা বোঝে! একটুও বোঝে না। এই যে প্রানেশা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে নিজে থেকে প্রথম বার কল করলো অথচ তাকে কী লজ্জাটাই না দিচ্ছে। প্রানেশা হালকা লজ্জা আর রাগ মেশানো কন্ঠে বললো- ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ফোন রেখে দিচ্ছি। খুব ডিস্টার্ব করে ফেলেছি আপনাকে ‘
রাগে গলার স্বর ডেবে গেছে প্রানেশার। সুফিয়ান বুঝলো এই রাগ সহজে ভাঙার নয়, সারাদিন যে প্রানেশা তার অপেক্ষা করেছে ভাবতেই ভালো লাগায় শরীর জুড়িয়ে গেলো। আদুরে কন্ঠে বললো-
‘খুব ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন হবে না রাণী’
প্রানেশা নাক টেনে টেনে বললো-
‘আর যদি হয়?’
‘তাহলে, এই আমিটাকে আপনাতে সপে দেবো। পুড়িয়ে অঙ্গার বানিয়ে নিয়েন ‘
প্রানেশা লজ্জামিশ্রিত হেঁসে বললো –
‘ তা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু একটা জিনিস যে আপনি এখনো বললেন না!’
‘কী বলিনি? ‘
‘আপনার নাম! ছয় মাস হয়েছে অথচ আপনার নামটাই বললেন না ‘
‘ আমি ঠিক করে রেখেছি যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন আপনাকে আমার নাম বলবো। তার আগ পর্যন্ত আপনি নাহয় আমায় ‘অঙ্গার ‘ বলেই ডাকুন ‘
‘অঙ্গার! অদ্ভুত তো! ‘
‘ অদ্ভুত হলেও এটাই ডাকবেন। যেদিন আমাদের দেখা হবে এর অর্থ আপনাকে ব্যাখ্যা করবো, এই শব্দে যে কতটা মায়া লেগে আছে তা দেখাবো৷ ‘
‘আচ্ছা ‘
সুফিয়ান মৃদু হেঁসে বললো –
‘ রাণী শাস্তি মওকুফ করেছেন তো? নাকি আরও বাকি!’
প্রানেশা চাপা হেঁসে বললো –
‘নাহ, আরও বাকি। অঙ্গার সাহেব যদি নিজের অতীব সুন্দর কন্ঠে একখানা কবিতা শোনায় তাহলে রাণী ভেবে দেখবেন ‘
সুফিয়ান দোলনায় হেলান দিয়ে হাসিমুখে বললো-
একটা হলুদ বিকেল হবো
একপশলা হাসি হবো
তোর বাঁকা ঠোঁটে রাখবি আমায়?
তোর জেগে থাকা রাত্রি হবো
পূর্ণিমার ঐ চাঁদ হবো
জানালাতে দেখবি আমায়?
তোর পায়ের আলতা হবো
একটা লাল টিপ হবো
তোর কপালে রাখবি আমায়?
তোর খোঁপার ফুল হবো
রেশমি কাচের চুড়ি হবো
তোর হাতে পড়বি আমায়।
তোর লেখা চিঠি হবো
একটা প্রেমের গল্প হবো
লিখবি আমায়?
– কাব্য আহমেদ