অঙ্গনে হৃদরঙ্গন | পর্ব – ২

হাতমুখ ধুয়ে সাদাফ ঘরে এসে দেখলো মশারির এক কোণা খুলে মেয়েটিকে বসতে দিয়েছে নুরু মিয়া। আর সে বসেছে একসাথে করে রাখা প্লাস্টিকের ডবল চেয়ারে। গামছায় হাত মুখ মুছতে মুছতে সে বললো,
“কত এনেছো?”
“যা পাওনা আছো, তার চেয়েও বেশি।”
“বেশির দরকার নেই। ন্যায্যটুকু হলেই চলে। দাও…”
নুরু মিয়া বিছানা দেখিয়ে দিয়ে বললো,
“আরে বসো, বসো। কথা বলি।”
সাদাফ বিছানায় না বসে চোখের ইশারায় নুরু মিয়াকেই উঠিয়ে দিলো চেয়ার থেকে। এরপর সে বসে পড়লো ডাবল চেয়ারে। নুরু মিয়া নিজেই মেয়েটির পাশে বিছনায় বসে বলতে লাগলো,
“এর নাম শ্রাবণী। গরীব ঘরের মেয়ে। খুবই ভদ্র মার্জিত। কথাবার্তায়, চালচলন একেবারে সরলসোজা। দেখতেও তো মাশাআল্লাহ। গায়ের রঙ ধবধবে না হলেই কি, গরনে তো বেশ…”
“থামো, থামো! ওসব বাদ দাও। তার পরিচয়ে আমার কাজ নেই। আমার কাজের কথা বলো।”
“আরে শুনো তো। তোমার কাজের কথাই বলি। মেয়েটা একদমই সরলসোজা। যেমনে চালাইবা তেমনেই চলবো। কথার কোনো অবাধ্য হইবো না। এমন জিনিস নিয়া আমোদপ্রমোদ করা কতটা সুবিধাজনক, বুঝতেই…”
সাদাফ এতোক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ব্রু কুচকে তাকালো তার দিকে। নুরু মিয়া কথা থামিয়ে অহেতুক হেসে আবার বললো,
“বয়স হয়েছে মিয়া, কার কি প্রয়োজন বুঝি তো। এখনই তো সময় আমোদ প্রমোদের।”
“আর কোনো ফন্দি খুঁজে পাও না, না? এসব চালাকিতে কোনো লাভ নেই। আমার নগদ চাই।”
“কেমন কথা কও। নগদের চেয়ে কতগুনে বেশির আয়োজন করলাম, মন মানে না তোমার! যতদিন ইচ্ছা রাখো। পুরো তোমার নামে করে দিলাম।”
কথার সাথে সাথে নুরু মিয়া উঠতে যাচ্ছিলেন, সাদাফ চোখ রাঙিয়ে বললো,
“এই, বসো! যাও কই তুমি? হ্যাঁ? নিজে খাইতে পাই না, আরেকজন গলায় ঝুলায় দিয়ে পালাও মিয়া? একে দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। আমার নগদ আমার চাই। একে তোমার সাথে নিয়ে যাও।”
নুরু মিয়া আবার বসে হতাশার সুরে বললেন,
“এইটা কোনো কথা মিয়া! আমি আরও তোমার ভরসায় এতো দূর থেকে সকাল সকাল রওনা দিয়া তারে নিয়া আসলাম! কতগুলো টাকা আমার বাড়তি খরচ হইলো!”
“কে বলেছে খরচ করতে? আমি বলেছিলাম, তোমাকে টাকার বদলে আমাকে মেয়ে এনে দাও?”
“না, তা বলোনি। কিন্তু ভাবলাম তো সাদরে গ্রহণ করবা। ফিরায়া দিবা, সেইটাও ভাবি নাই।”
“এতো কথা আমি বুঝি না। আমার টাকা চাই আমি। তার বিনিময়ে অন্যকিছু না।”
নুরু মিয়া চিন্তিত হয়ে বললেন,
“তাহলে আর কি। টাকা চাও, দিমু টাকা। কিন্তু তারও তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আনলাম তো তোমার ভরসায়, তা তো আর হইলো না। থাকার জায়গাটাও তো ঠিক করা লাগবো। বলি কি, তোমার তো বাড়তি রুম আছে। দু’একটা দিন রাখো, ব্যবস্থা করা হইলেই তারে নিয়া যাইতাছি। তোমার টাকারও ব্যবস্থা করতাছি।”
“আমি কাউকে রাখতে পারবো না। নিজেরই আশ্রয়ের নিশ্চয়তা নেই, আবার পরের বোজা! সাথে নিয়ে যাও, যাও!”
নুরু মিয়া উঠে এসে তার কাধে হাত রাখতেই সাদাফ বিরক্তি নিয়ে হাত সরিয়ে দিলো। নুরু মিয়া করুণার সাথে বললো,
“ভাই, দুইটা দিন একটু আশ্রয় দাও। ব্যবস্থা হইলেই নিয়া যাইতাছি। যদি আজ বিকালের মধ্যে ব্যবস্থা হইয়া যায় তো, বিকালেই নিয়া যামু। রাগ কইরো না ভাই, রাগ কইরো না। ঠান্ডা মাথায় ভাবো।”
কথা শেষ করে হনহনিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে নুরু মিয়া। সাদাফকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না। সে আশ্চর্য হয়ে পেছন থেকে তাকে ডাকলো,
“এই, কোথায় যাও! এদিকে আসো বলছি!”
“আরে, চিন্তা কইরো না। তোমার টাকার ব্যবস্থাও করতাছি।”
সাদাফের ডাকে না থেমে বলতে বলতে চলে গেলো নুরু মিয়া। তার এই চঞ্চলতার উপর চরম বিরক্ত সাদাফ। সে বিরক্তিকর দৃষ্টি বাইরে থেকে সরিয়ে সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকে নিয়ে এলো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
“তোমার কি মনে হয় বিকেলের মধ্যে আসবে লোকটা?”
এতোক্ষণ যাবত মেয়েটি দুইজন পুরুষলোকের কথা শুনছিলো এবং তাদের মুখপানে নিশ্চুপ তাকাচ্ছিলো। সাদাফ প্রশ্ন করার সাথে সাথে তার মাথা নত হয়ে গেছে। জলে ভরে গেছে চোখদুটো। সাদাফ নিজের দুই হাটুতে শব্দযোগে হাত ফেলে বললো,
“আমার তো মনে হয় না, দুইদিনেও আসবে! শালা, ভণ্ড কোথাকার!”
তারপর আবার মেয়েটির দিকে লক্ষ্য করে বললো,
“কাঁদছো কেন তুমি? তুমিও ভণ্ডামির জাল বুনছো? এসব আমোদপ্রমোদের কোনো প্রয়োজন নেই আমার। তুমি যেতে পারো।”
মেয়েটি কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নত রেখেই ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছতে লাগলো। হাত কাঁপছে তার। তা দেখে সাদাফ জিজ্ঞেস করলো,
“সে কি হয় তোমার?”
“কেউ না।”
“হ্যাঁ! কেউ না! তাহলে তার সাথে এলে কেমন করে? কোথায় পরিচয়?”
“গ্রাম থেকে এসেছি। ছোট থেকেই তার খালাতো বোনের বাড়িতে কাজ করতাম। দুবেলা খেতে পেতাম, বছরে দুইটা পোশাক পেতাম, সমস্ত ঘরের কাজ করতাম। কোনো পারিশ্রমিক পেতাম না।”
“পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ!”
“হ্যাঁ, খাওয়ায় পরায় আবার পারিশ্রমিক দিবে কেন! মাঝে মাঝে হাত খরচ দাবি করলে কিছু দিতো। লোকটা সেদিন আমার দুরাবস্থার কথা শুনে গোপনে কাজের প্রস্তাব দেয়। শহরে ভালো কাজ পাওয়া যায়, অনেক টাকা ইনকাম করা যায়। ভালো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় রাজি হয়ে লুকিয়ে চলে আসি উনার সাথে।”
কথাটুকু বলেই সে থেমে গেলো। সাদাফ বললো,
“সে যে তোমাকে বিক্রি করতে এনেছে, জানো তুমি?”
“হুম। আগে জানতাম না। এখন আপনাদের কথা শুনে জানতে পেরেছি।”
আবারও চোখ মুছে নিলো সে। এবার যেন ঘন ঘন ফোঁটা ঝরছে চোখ থেকে। সাদাফ বললো,
“তো কি করবে এখন?”
“কি আর করবো। এখন আমি আপনার কেনা গোলাম, যা আদেশ করবেন তাই করবো।”
সাদাফ এক গাল হেসে বললো,
“আমি তোমাকে কিনি নি। টাকা আমি আদায় করেই ছাড়বো।”
“তাহলে একটু অপেক্ষা করি, তিনি এলেই চলে যাবো। আমি তো কিছু চিনি না এখানকার! কোথায় যাবো!”
“তোমার কি এখনো মনে হয় সে আসবে? আর এলেই বা কি? তোমাকে ভালো কাজের সন্ধান দিবে? অন্যত্র বিক্রি করে নিজে টাকা হাতিয়ে নিবে।”
“ভাগ্যে লিখা থাকলে তাই হবে। খেলনার পুতুল হয়ে জন্মেছি, খেলবেই তো লোকে।”
“পরিবার পরিজন নেই?”
মেয়েটি দু’দিকে মাথা নাড়লো। সাদাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বললো,
“রান্নাবান্না করতে জানো?”
মেয়েটি এবারও মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। সাদাফ বললো,
“আর ঘর ঝাড়ামোছা, কাপড়চোপড় ধুতে জানো। তাই না?”
“হুম।”
“আচ্ছা, তাহলে চাইলে থেকে যেতে পারো। আমার বাড়িতেই নাহয় কাজ করো। থাকার জায়গা আছে ওপাশে, খাবারও নাহয় যেমন যোগান দিতে পারি খেয়ো। তবে মাসে মাসে বেতনটা আমি ফিক্সড দিতে পারবো না বলে দিচ্ছি। যখন যেমন থাকবে দিবো। কম থাকলে কম দিবো, বেশি থাকলে বেশিই দিবো। আশেপাশে ভালো কাজের খোঁজ পেলে চলে যেয়ো। আমি তোমাকে কিনে রাখছি না। কাজের জন্য এসেছো, কাজ দিচ্ছি। তবে নিজেকে বিক্রি না করতে চাইলে ওই লোকটা থেকে সাবধান থেকো। প্রয়োজনে পালিয়ে যেয়ো তবুও তার কাছে আশ্রয় চাইতে যেয়ো না।”
“কোনো মেয়ে কি চায় নিজেকে বিক্রি করে দিতে!”
“কে বলেছে চায় না? তোমার দেখা না থাকতে পারে কিন্তু এই শহরে অভাব নেই এমন মেয়ের।”
মেয়েটি চুপ করে রইলো। সাদাফ কাঠের আলমারির ড্রয়ার থেকে একটা চাবি নিয়ে মেয়েটির পাশে বিছানায় ফেলে বললো,
“ওইপাশে একটা রুম আছে। ওইটাতে তুমি থেকো। বিছানা কিন্তু নেই। এই খাট থেকে মাদুরটা উঠিয়ে নিতে পারো। নয়তো নিজে কোনো ব্যবস্থা করে নাও। মাঝখানে যেই রান্নাঘর আর বাথরুম আছে, এগুলো এই দুই রুমের। মানে আমার ভাড়া করা। এগুলো ব্যবহার করো।”
মেয়েটি তার সাথে নিয়ে আসা কাপড়চোপড়ের ছোট ব্যাগটা হাতে তুলে চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। পাশের রুমের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে অন্ধকার রুম দেখতে পেলো। দরজা খোলার কারণে কিছুটা আলোকিত হয়েছে। সে এগিয়ে এসে জানালা খুলে দিতেই এবার অন্ধকারভাবটা অনেকটাই লাঘব হয়ে গেছে। রুমটা যে তেমন ব্যবহার করা হয় না, দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রুমে একটা পড়ার টেবিল ছাড়া কোনো আসবাবই নেই। এমনকি টেবিলে বইখাতাও নেই। রুমের এক কোণে পুরাতন একটা বালতি পড়ে আছে আরেকটা ঝাড়ু এবং ফ্লোর মোছার ব্রাশ। কিন্তু ফ্লোর অপরিষ্কার। ফ্লোর পাকা হলেই কি, বাইরে থেকে ফিরে জুতা নিয়েই ঘরে প্রবেশ করে। তাই এই অবস্থা। মেয়েটি তার ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো। এমনি সাদাফ শার্ট পরে এসে এই রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
“এই, তোমার নাম যেন কি?”
“হুম! শ্রা..শ্রাবণী।”
“শ্রা শ্রাবণী? হিন্দু জাত? শ্রা হবে নাকি শ্রী?”
হঠাৎ প্রবেশে মেয়েটির নাম বলতেও আমতা আমতা করতে হলো যা ধরতেই পারলো না সাদাফ। এবার সে ঝটপট বললো,
“না, না৷ শুধু শ্রাবণী। জাতে মুসলমান।”
“ও, আচ্ছা। কি শ্রাবণী টাবনী রাখা হয়েছে। শ্রাবণ হলেই কি চলতো না! আবার দীর্ঘ ঈ কার লাগানো হয়েছে৷ আচ্ছা, যাইহোক। এটা রাখো, হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিয়ো। আমি রান্নাবান্না করে খাই না।”
“হোটেল থেকে কেন খাবো। আপনি বাজার এনে দিলেই আমি রান্না করতে পারবো।”
“হ্যাঁ, দিবো। কিন্তু এখন পারবো না। পাশে হোটেল আছে, আপাতত খেয়ে এসো। পরে যদি বাজার নিয়ে ফিরি তবে রান্না করে খেয়ো। আমার হাড়িপাতিলও আছে কিছু। সেগুলোতে চালাতে পারলে চালিয়ে নিয়ো, না চললেও কিছু করার নেই।”
সাদাফ টেবিলের উপর পঞ্চাশ টাকার একটা নোট রেখে বেরিয়ে গেলো। মেয়েটি টাকাটা তুলে তার ছোট ব্যাগটায় রাখলো। ঘরটা একটু গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ক্ষুধাও লেগেছে প্রচুর। আগে ঘর গুছাবে নাকি নাস্তা করবে সেটাই ভাবতে লাগলো সে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।