আমি পদ্মজা | পর্ব – ৭৭

পদ্মজা এক পা,এক পা করে উপরে উঠে আসে। পদ্মজার প্রতিটি কদম লিখনের হৃৎপিণ্ডে কাঁপন ধরায়। সে কথা বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শাহানা পদ্মজার এক হাত ধরে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,’ও পদ্ম,তোমার এই অবস্থা কেমনে হইলো?’
পদ্মজা চাপা স্বরে বললো,’বাড়িতে গিয়ে সব বলবো আপা।’

শাহানা চোখ দুটি বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পদ্মজার শরীরে যে দাগ সে দেখেছে,এতে নিশ্চিত কেউ পদ্মজাকে মেরেছে। গলা চেপে ধরেছে! গালে নখের আঁচড়ও রয়েছে। শাহানা স্তব্ধ হয়ে যায়। আমির পদ্মজার জন্য কতোটা পাগল সবাই জানে। আমির-পদ্মজার ভালোবাসা গল্প সবার মুখেমুখে। শাহানা,শিরিন দুজনই তাদের শ্বশুর বাড়িতে আমির-পদ্মজার ভালোবাসার গল্প করে। সেই পদ্মজার গায়ে মারের দাগ! আমিরের তো মারার কথা না,অন্য কেউও পারবে না। তাহলে কীভাবে কী হলো? শাহানার মাথায় কিছু ঢুকছে না। পদ্মজা লিখনের দিকে তাকাতেই লিখন নিঃশ্বাস ছাড়লো। নিঃশ্বাসের শব্দ উপস্থিত তৃধা,শাহানা,পদ্মজা তিন জনই শুনতে পায়। পদ্মজা তার রিনঝিনে মিষ্টি কণ্ঠে বললো,’ আপনার সাথে আমার কথা ছিল।’
লিখন ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে স্পষ্ট স্বরে বললো,’কী হয়েছে তোমার সাথে?’

লিখনের চোখের কার্নিশে জল জমে। পদ্মজা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কেউ তার মুখ দেখলে তাকে অনেক রকম প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হবে। তাই সে মুখ দেখাতে চায়নি কাউকে। পূর্ণা-প্রেমার সাথে যখন দেখা হয়, তখনও সে নিকাব খুলেনি। লিখন এক পা এগিয়ে এসে আবার প্রশ্ন করলো,’ কে মেরেছে?’
পদ্মজা বুক ধুকপুক করছে। তার মিথ্যে বলায় অভ্যেস নেই। আবার সত্যটাও বলা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি সেরকম নয়। পদ্মজা লিখনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তৃধার দিকে তাকালো। পুতুলের মতো সুন্দর মেয়েটা। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। তৃধা পদ্মজার শরীরের দাগ নিয়ে চিন্তিত নয়। সে আগ্রহ নিয়ে পদ্মজার চোখ দেখছে। কাঁদার কারণে ফুলে থাকলেও সৌন্দর্য হারিয়ে যায়নি। অসম্ভব সুন্দর চোখ। টানা টানা চোখ বোধহয় একেই বলে! তৃধা ঈর্ষান্বিত। পদ্মজা লিখনের প্রশ্নে বললো,’মারের দাগ হতে যাবে কেন?’
লিখন রুদ্ধশ্বাসে বললো,’মুখে দাগ,গলা চেপে ধরার দাগ,চোখ ফুলে আছে। কে বলবে এটা মারের দাগ না? আমির হাওলাদার মেরেছে?’
শাহানা চমকে যায়। রাগ হয়। শাহানা-শিরিন আমিরকে অনেক ভালোবাসে। আমিরকে নিয়ে এত বড় কথা কী করে বলতে পারে লিখন? শাহানা তেড়ে এসে রাগী স্বরে বললো,’বাবু মারবো কেরে? তুমি কিতা কও?’
পদ্মজা দ্রুত লিখনকে বললো,’সব বলব। আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। আপনার সাহায্য প্রয়োজন। অনুগ্রহ করে শুনুন।’
শাহানা পদ্মজার এক হাতে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,’ পর পুরুষের কাছে কিতার সাহায্য তোমার পদ্ম?’
পদ্মজা বললো,’আপা,আমি আপনাকে সব বলব। একটু সময় দিন।’

পদ্মজাকে পাহারা দেয়া দুজন লোকের নাম হাবু আর জসিম। হাবু-জসিমকে একা একা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,রিদওয়ান পদ্মজাকে খুঁজতে থাকলো। খুঁজতে খুঁজতে ঘাটে এসে উঁকি দেয়। লিখনের সামনে পদ্মজাকে দেখে ভয়ে হয় রিদওয়ানের। লিখন দেশের একজন খ্যাতিমান অভিনেতা। সে যদি পদ্মজার মুখ থেকে সব জেনে যায়,যে কোনো মূল্যে তাদের ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগবে। আর সফলও হতে পারবে। পদ্মজা পারে না,কারণ তার স্বামী এতে জড়িত। তার দুই বোনকে নিয়ে ভয় আছে। সর্বোপরি সে একজন নারী! রিদওয়ান দূর থেকে ডাকলো,’পদ্মজা।’
রিদওয়ানের কণ্ঠ শুনে পদ্মজা আশাহত হয়। লিখনের সাথে কথা যে আর দীর্ঘ হওয়া সম্ভব নয় তা স্পষ্ট। পদ্মজা তাকালো। রিদওয়ান এগিয়ে এসে বললো,’চাচা যেতে বলেছেন।’
শাহানা রিদওয়ানকে বললো,’মাথাডা ঘুরতাছিল। পদ্ম আমারে ঘাটে আইননা পানি দিছে।’
রিদওয়ান আড়চোখে লিখনকে দেখলো। লিখনের প্রতিক্রিয়া দেখলো। লিখন তাকাতেই সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। রিদওয়ানের দৃষ্টি দেখে লিখনের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক বুঝে যায়, এই দৃশ্যে ঘাপলা আছে। পদ্মজা ভালো নেই,তার সাথে খারাপ কিছু হচ্ছে। আর রিদওয়ান সব জানে। সে জড়িত। রিদওয়ান শাহানাকে বললো ‘এখন ঠিক আছো?’
শাহানা এক হাতে নিজের কপাল চেপে ধরে বললো,’ হ ভাই।’
রিদওয়ান হেসে লিখনের দিকে তাকালো। করমর্দন করে বললো,’ কী খবর?’
রিদওয়ানের জবাব না দিয়ে লিখন বললো,’আমি পদ্মজার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই।’
রিদওয়ান পদ্মজার চোখের দিকে তাকায়। তারপর লিখনের দিকে। বললো, ‘কী কথা?’
‘ব্যাক্তিগত। দয়া করে সুযোগ করে দিলে খুশি হবো।’ লিখনের সোজাসুজি কথা।
রিদওয়ান দূরে সরে দাঁড়ালো। বললো,’পদ্মজা আমাদের বাড়ির বউ। সে যার তার সাথে বাইরে নির্জনে কথা বলতে পারে না।’
লিখনের হাঁসফাঁস লাগছে। সে জ্ঞানহীন হয়ে পড়ছে। নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। মন বার বার বলছে,পদ্মজা ভালো নেই! সত্যিই তো ভালো নেই। লিখন বললো,’পদ্মজা আমাকে কিছু বলতে চায়।’
রিদওয়ান পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আদেশের স্বরে বললো,’পদ্মজা চলো।চাচা ডাকে।’
পদ্মজা রিদওয়ানকে মোটেও ভয় পায় না। রিদওয়ানের আদেশ শোনা তো দূরের কথা। তবে এই মুহূর্তে কিছুতেই লিখনের সাথে কথা বলা সম্ভব নয়। তাই সে চলে যাওয়ার কথা ভাবে। চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই লিখন পথ আটকে দাঁড়ায়। তার গলার স্বর চড়া হয়,’ আমাকে বলে যাও তোমার গলায় কীসের দাগ? মুখে কীসের দাগ? কে মেরেছে?’

‘কে মেরেছে?’ প্রশ্নটা কানে আসতেই রিদওয়ানের গলা শুকিয়ে যায়। এতকিছু কী করে লিখন দেখলো? পদ্মজা দেখিয়েছে? এভাবে বাইরের পুরুষ মানুষকে নিজের গলা দেখিয়েছে! রিদওয়ান তার আসল রূপ,ভাষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বললো,’ তুমি না সতীসাবিত্রী! পর-পুরুষকে গলা দেখিয়ে বেড়াও আমির জানে?’
লিখনের মাথা চড়ে যায়। সে শেষ কবে নিজের ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সে জানে না। তবে আজ হারিয়েছে। তার কাছে পরিষ্কার, পদ্মজা অত্যাচারিত! তার উপর জুলুম করা হয়। লিখন রিদওয়ানের শার্টের গলা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’মুখ সামলিয়ে কথা বলুন।’
রিদওয়ান লিখনকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। লিখনের ঝাঁকরা চুল কপালে ছড়িয়ে পড়ে। রিদওয়ান বললো,’ অন্যের বউয়ের উপর নজর দেয়া বন্ধ করুন। পদ্মজা চলো।’ রিদওয়ান পদ্মজার হাত চেপে ধরে। পদ্মজা এক ঝটকায় রিদওয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,’ আমি একাই যেতে পারি।’
তারপর লিখনকে বললো,’কথা বাড়াবেন না। আমাকে যেতে দিন।’
লিখন কারো কথা শুনতে রাজি নয়। সে তার ধৈর্য্য,ব্যাক্তিত্ব থেকে সরে এসেছে। লিখন আবারও পদ্মজার পথ আটকালো। প্রশ্ন করলো,’কাকে ভয় পাচ্ছো তুমি? আমাকে বলো।’
শাহানা নিজেও অবাক পদ্মজার অবস্থা দেখে। কিন্তু লিখনের পদ্মজাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি তার ভালো লাগছে না। অন্য পুরুষ কেন তাদের বাড়ির বউয়ের জন্য এতো আকুল হবে? শাহানা কর্কশ কণ্ঠে লিখনকে বললো,’আপনে পথ ছাড়েন না ক্যান? অন্য বাড়ির বউরে এমনে আটকানি ভালা মানুষের কাম না।’

লিখনের চোখেমুখে অসহায়ত্ব স্পষ্ট! অন্য বাড়ির বউ! অন্যের বউ! এই শব্দগুলো কেন পৃথিবীতে এসেছে? সহ্য করা যায় না। রিদওয়ান লিখনকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলো। লিখন রিদওয়ানের হাতে ধরে ফেলে। রিদওয়ানের মুখের কাছে গিয়ে চাপাস্বরে বললো,’পদ্মজা আমার হৃদয়ে যত্নে রাখা জীবন্ত ফুল। তার গায়ে আঘাত করার সাহস যে করেছে তাকে আমি টুকরো টুকরো করবো।’
লিখনের হুমকি রিদওয়ানের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে আমিরকে সহ্য করে, কারণ আমির ঠান্ডা মাথার খুনী। চোখের পলকে যে কাউকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা,পাতালঘর, বাড়ি,অফিস,গোডাউন সবকিছুর একমাত্র মালিক আমির। তাই রিদওয়ান রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তাই বলে সাধারণ জগতের একজন অভিনেতার হুমকি সহ্য করবে? কিছুতেই না। রিদওয়ান লিখনের চোখে আগুন চোখে তাকিয়ে বললো,’ এসব সিনেমায় গিয়ে বলুন। নাম বাড়বে।’
লিখন রিদওয়ানকে ছেড়ে পদ্মজার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। বললো,’ পদ্মজা তুমি তো ভীতু না। ভয় পেয়ো না। আমাকে বলো কী হয়েছে তোমার সাথে?’
পদ্মজা বললো,’আমি কাউকে ভয় পাচ্ছি না। আপনার সাথে পরে কথা বলব।’
রিদওয়ান পদ্মজার দিকে তেড়ে এসে বললো,’পরে কীসের কথা?’
রিদওয়ান পদ্মজার মুখের উপর ঝুঁকেছে বলে লিখনের রাগ বাড়ে। সে রিদওয়ানের পিঠের শার্ট খামচে ধরে। সঙ্গে,সঙ্গে রিদওয়ান লিখনের মুখ বরাবর ঘুষি মারলো। তৃধা,পদ্মজা,শাহানা চমকে যায়। তৃধা আতঙ্কে লাল হয়ে যায়। সে দৌড়ে এগিয়ে আসে। লিখন তার ঘোলা চোখ দিয়ে রিদওয়ানের উপর অগ্নি বর্ষিত করে। রিদওয়ানকে তার ঘুষি ফিরিয়ে দেয়। দুজন মারামারির পর্যায়ে চলে যায়। তৃধা,পদ্মজা কেউ থামাতে পারে না। আর কিছু সময় এভাবে চললে,কেউ একজন খুন হয়ে যাবে। শাহানা চিৎকার করতে করতে স্কুলের সামনে ছুটে যায়। তার চিৎকার শুনে উপস্থিত মানুষদের মাঝে হট্টগোল শুরু হয়। শৃঙ্খলা ভেঙে যায়। মজিদ,খলিল ছুটে আসে স্কুলের পিছনে। পরিচালক আনোয়ার হোসেন লিখনকে মারামারি করতে দেখে খুব অবাক হোন। সবাই মিলে লিখন ও রিদওয়ানকে থামালো। তারপর দুজনকে নিয়ে স্কুলের সামনে আসে। উপস্থিত মানুষরা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। গুরুজনরা জিজ্ঞাসা করে,তারা কেন মারামারি করছিল? মজিদ হাত তুলে সবাইকে থামালেন। তারপর রিদওয়ানের দিকে তাকালেন। রিদওয়ান চোখের ইশারায় কিছু বলছে। কিন্তু মজিদ বুঝতে পারেননি। তিনি রিদওয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন,’ কী সমস্যা রিদওয়ান? এমন অসভ্যতামির মানে কী?’
রিদওয়ান বাঁকা চোখে উপস্থিত মানুষদের দেখলো। সবাই তাকিয়ে আছে। আজ কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে নিশ্চিত! রিদওয়ান মাথা নীচু করে বললো,’লিখন শাহ পদ্মজার পথ আটকাচ্ছিল।’
রিদওনায়ের কথা শুনে মানুষদের মুখ থেকে লিখনের উদ্দেশ্যে ছিঃ,ছিঃ বেরিয়ে আসে। লিখন হতবাক হয়ে যায়। হতবাক হয় পূর্ণা,প্রেমা,প্রান্ত, পদ্মজা। মজিদ লিখনকে প্রশ্ন করলেন,’রিদওয়ান যা বলছে সত্য?’
লিখন পদ্মজার চোখের দিকে তাকালো। তারপর বললো,’ সত্য। কিন্তু আমি পদ্মজার গলায়,মুখে দাগ দেখেছি। গলায় যে দাগ সেই দাগ দেখে বুঝা যায় তার গলা কেউ চেপে ধরেছিল। মুখে ক্ষত,নখের আঁচড়। চোখ ফোলা। আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম এসব কী করে হয়েছে? কে মেরেছে?’
লিখনের কথা শুনে মজিদের মাথা ঘুরে যায়। আমির বলেছিল,পদ্মজাকে সমাবেশে না আনতে। এতে সমস্যা হতে পারে। মজিদ আমিরের কথায় গুরুত্ব দেননি। ভেবেছেন,পদ্মজা গ্রামে আছে সবাই জানে। আর গত সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, পরবর্তী সমাবেশে আমির বা পদ্মজা বিতরণ করবে শীতবস্ত্র। আমির তো চলে গেল। তাই পদ্মজাকে এনেছেন। আর এই সমাবেশে বাড়ির মেয়ে-বউরা অসুস্থ থাকলেও উপস্থিত থাকে। যদি কেউ প্রশ্ন করে,আমিরের বউ কোথায়? প্রশ্নটা সহজ,উত্তরও বানিয়ে দেয়া যেত। তবুও মজিদ হাওলাদার প্রশ্ন এড়াতে পদ্মজাকে নিয়ে এসেছেন। তিনি প্রশ্ন শুনতে পছন্দ করেন না।
মজিদের মুখের রঙ পাল্টে যাওয়াটাও লিখনের চোখে পড়ে। সে ভেবে নেয়,এ সম্পর্কে মজিদও জানে। সে সবার সামনে প্রশ্ন করে, ‘আপনার বাড়ির বউয়ের শরীরে মারের দাগ কী করে এলো?’
মজিদের কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়। তিনি কাঠ কাঠ স্বরে বললেন,’তুমি কী করে দেখেছো?’
‘পদ্মজা ঘাটে নিকাব খুলে মুখে পানি…’
মজিদ লিখনের কথায় বাঁধা দিয়ে বললেন,’তুমি বাড়িতে এসো এ নিয়ে কথা হবে।’
মজিদ ভেতরে ভেতরে ভয়ে জমে গিয়েছেন। পদ্মজা যদি মুখ খুলে কী হবে? এখানে মজিদের প্রতিপক্ষরাও রয়েছে। তারা সুযোগ নিবে। লিখন কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। তার পূর্বে মজিদের নতুন প্রতিপক্ষ ইয়াকুব আলী বললেন,’বাড়ির বউয়ের গায়ে মারের দাগ! এটা তো ভালো কথা না। মাতব্বর কি ছেলের বউয়ের উপর অত্যাচার করে?’

মজিদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়েন! পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে। যে করেই হউক পরিস্থিতি হাতে আনতে হবে। মজিদ ইয়াকুব আলীকে হেসে বললেন,’ অহেতুক কথা বলবেন না। আমাদের বাড়িতে বউরা রানির মতো থাকে। গায়ে হাত তোলার প্রশ্নই আসে না। কথা বলার পূর্বে বিবেচনা করে বলবেন।’
ইয়াকুব আলী হাসলেন। বললেন,’তাহলে কী নায়ক সাহেব মিথ্যা বলছেন?’
ইয়াকুব আলীর সাথে আরো দুজন তাল মিলিয়ে বললো,’আমরা সত্যটা জানতে চাই।’
হাওলাদারদের অবস্থায় দরজার চিপায় পড়ার মতো। পদ্মজা তাদের অবস্থা দেখে মুচকি হাসে। পদ্মজার শরীরে মারের দাগ আছে! এ কথা শুনে পূর্ণা মানুষজনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে উঁচু মাটির টিলার উপর উঠলো। পদ্মজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। বললো,’আপা? লিখন ভাই কী বলছে?’
পদ্মজা নিরুত্তর। খলিল উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সব না সবাই জেনে যায়! আতঙ্কে তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন,’লিখন শাহ মিছা কথা কইতাছে।’

খলিলের কথা শুনে মজিদের ইচ্ছে হয় খলিলকে জুতা দিয়ে পিটাতে। লিখন বললো,’এইটুকুও মিথ্যা না। দাগগুলো এখনো তাজা। পদ্মজা তো সামনেই আছে।’
একজন বয়স্ক মহিলা বললেন,’পদ্ম মার নিকাবডা সরাইলেই হাচামিছা জানা যাইবো।’
মজিদ জানতেন কেউ এরকম কিছুই বলবে। এখন প্রমাণিত হয়ে যাবে খলিল মিথ্যা বলেছে! মজিদের ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে। তিনি কী করবেন? কী বলবেন? বুঝতে পারছেন না। পদ্মজা চেয়েছিল অন্যভাবে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি করতে। যেহেতু সবার সম্মূখে সব প্রকাশ করার সুযোগ এসেছে সেহেতু উচিত সব ফাঁস করে দেয়া। এতে সব শুনে কেউ না কেউ মেয়েগুলোকে উদ্ধার করতে পদক্ষেপ নিতে পারবে। সে পুরো নিকাব না খুলে শুধু মুখটা উন্মুক্ত করলো। তার মুখের স্পষ্ট,কালসিটে দাগগুলো দেখে মানুষজনের কোলাহল বেড়ে যায়। সবাই ফিসফিসিয়ে কথা বলতে থাকে। পূর্ণা পদ্মজার গালের একটা ক্ষত দেখেছে। শুনেছিল তো দূর্ঘটনায় এমন হয়েছে। নখ ডেবে যাওয়া দুটো দাগ আর চোখের অবস্থা দেখে তার বুক ছ্যাঁত করে উঠে। সে পদ্মজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিকাব তুলে গলা দেখে চমকে যায়। অশ্রুসজল চোখে পদ্মজা দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ডাকে,’আপা!’
ইয়াকুব আলী খুব অবাক হয়েছেন এরকম ভান করে বললেন,’মেয়েটার কী অবস্থা! মাতব্বর এভাবেই কী বউদের রানী করে রাখেন?’

মজিদের বুকের ব্যাথা বাড়ে। এক পা পিছিয়ে যান। কী হচ্ছে এসব! রিদওয়ান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। সে পদ্মজার ভাব দেখে ধারণা করছে,পদ্মজা এখুনি সব বলে দিবে। আর সব শোনার পর এত মানুষের সাথে তাদের পেরে উঠা সম্ভব নয়। রিদওয়ান ঢোক গিলে আচমকা বলে উঠলো,’আমির মেরেছে। এমনি এমনি মারেনি! পদ্মজার লিখন শাহর সাথে ছয় বছর আগে সম্পর্ক হয়েছিল। বিয়ের পরও লুকিয়ে ঢাকা অবৈধ মেলামেশা করে গেছে। আমির কয়দিন আগে হাতেনাতে ধরেছে। আর তাই মেরেছে।’

রিদওয়ানের কথা শুনে পদ্মজা ও লিখনের মাথায় যেন বাজ পড়ে। মজিদের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠে। রিদওয়ান বাঁচার পথ খুঁজে দিয়েছে! মানুষজনের কোলাহল দ্বিগুণ হয়। মজিদ কখনো ভাবেননি,তার পরিবার নিয়ে আবারো এমন সভা হবে! যা হওয়ার হয়ে গেছে,পদ্মজার সম্মান উৎসর্গ করে হলেও তাদের সম্মান রক্ষা করতে হবে। লিখন ক্রোধে-আক্রোশে রিদওয়ানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাবু,জসিম সহ আরো কয়েকজন লিখনকে আটকায়। লিখন চেঁচিয়ে বললো,’মিথ্যাবাদী।’
কেউ একজন বললো,’মাতব্বর সাহেব,সত্যিডা খুলে বলেন।’
মজিদ হাওলাদার কেশে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,’আমি চাইনি,আমার বউয়ের কোনো দূর্নাম হউক। হাজার হউক সে আমার একমাত্র ছেলের বউ। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বাধ্য করছে তখন না বলে উপায় নেই। আপনারা অনেকেই জানেন,মোড়ল বাড়িতে লিখন শাহ একবার শুটিং করতে এসেছিল। তখন পদ্মজা আর লিখন শাহর মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারপর আমার ছেলে আমিরের সাথে পদ্মজার বিয়ে হয়। আমির পদ্মজাকে নিয়ে ঢাকা চলে যায়। ঢাকা লিখন শাহের সাথে পদ্মজার অবৈধ সম্পর্ক চলতে থাকে। আমার বোকা ছেলে কখনো ধরতে পারেনি। গ্রামে আসার পর লিখন শাহ দুইবার আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। প্রমাণ আছে কিন্তু। অনেকেই দেখেছেন। দেখেছেন তো?’

কয়েকজন বলাবলি করলো, তারা দেখেছে! মজিদ বললেন,’ লিখন শাহ কিন্তু পদ্মজার জন্য যেত। একদিন রাতেও যায়। তখন আমির হাতেনাতে ধরে দুজনকে। তাই আমির পদ্মজার গায়ের উপর হাত তুলে। রাগে একটু মার দেয়। এতে কী কোনো দোষ হয়ে গেছে আমার ছেলের?’

পদ্মজা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো চিৎকার করে উঠে,’মিথ্যা কথা। আপনি বানিয়ে কুৎসা রটাচ্ছেন।’
মজিদ হাওলাদার বুকভরা নিঃশ্বাস নেন। তিনি জানেন,এই গ্রামবাসী তাকে কতোটা বিশ্বাস করে। আর লিখনকেও অনেকে বাড়িতে যেতে দেখেছে। পদ্মজার নামে একবার সালিশ বসেছিল। যদিও সেটা তার ছেলের সাথে তবে মেয়ে নির্দোষ হলেও তার একবারের বদনাম সারা জীবন রয়ে যায়! তিনি সবার সামনে দুই হাত তুলে নরম স্বরে বললেন,’আমার আর কিছু বলার নেই। বিশ্বাস, অবিশ্বাস আপনাদের উপর।’

লিখন হাবু ও জসিমকে আঘাত করলো। রিদওয়ান লিখনকে চেপে ধরে। রিদওয়ানের ইশারায় আরো কয়েকজন লিখনকে জাপটে ধরে। পরিচালক আনোয়ার হোসেন মাথা নিচু করে ফেলেন। মজিদ হাওলাদার মিথ্যা বলবেন না! তিনি মহৎ মানুষ। লিখন একটা মেয়ের জন্য পাগল সেটা তিনিও জানতেন। মজিদের কথা অবিশ্বাস করার কারণ নেই। তবে তিনি লিখনকে সৎ চরিত্রের ছেলে ভাবতেন। মুহূর্তে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দ্বিতীয়বারের মতো পদ্মজার চরিত্রে ছিঃ,ছিঃ ধিক্কার ছুঁড়ে মারে গ্রামবাসী। কেউ যেন গায়ে হাত না দিতে পারে,আত্মরক্ষার জন্য পদ্মজা কোমরে ছুরি খুঁজলো! ছুরি নেই। সে অসহায় হয়ে পড়ে। চিৎকার করে সবার উদ্দেশ্যে বললো,’সবাই আমার কথা শুনুন।’
কেউ পদ্মজার কথা শুনলো না। সবার চেঁচামিচিতে তার গলার স্বর কারো কানেই যায় না। মজিদ হাওলাদারকে তারা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। নিয়তি পদ্মজার সম্মানে দ্বিতীয়বারের মতো আঘাত হানে!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।