আমি পদ্মজা – ৬৫
_____________
তুষার হাঁসফাঁস করা অস্বস্তিকর ভ্যাপসা গরমে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। পদ্মজা তখনও শূন্যে দৃষ্টি রেখে বিড়বিড় করছে। মেয়েটা যেদিকে তাকায় সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। তুষার রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ডাকলো,’মিস পদ্মজা?’
পদ্মজা তাকাল। তার চোখ দুটি ফোলা। আর ঠোঁট দুটি সবসময় তিরতির করে কাঁপে। তুষারের তীক্ষ্ণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে পদ্মজা বললো,’আমার ফাঁসি কবে হবে? এত দেরি হচ্ছে কেন?’
পদ্মজার কণ্ঠে ফাঁসির জন্য আকুতি! একটা মানুষ কতোটা নিঃস্ব হলে পৃথিবী থেকে মুক্তি চায়? তুষারের ধারণা নেই। সে তার ভেতরের মায়া লুকিয়ে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,’আপনাকে যা প্রশ্ন করা হয়েছে তার উত্তর দিলেন না তো?’
পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কোন প্রশ্ন?’
মুহূর্তে ভুলে গিয়েছে! তুষার অবশ্য এতে রাগলো না। সে আবার প্রশ্ন করলো,’তিনি কি পাপ থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছিলেন? তারপর আর ভালোবেসেছিলেন আপনাকে?’
‘আগে বলুন,পিশাচের মতো যাদের আচরণ তারা কাউকে ভালোবাসতে পারে?’
তুষার তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবলো। ভেবে বললো,’পারে। তারা কম মানুষকে ভালোবাসে। কিন্তু যাকে ভালোবাসে তার সাথে সব ভালো করে। আর যার সাথে খারাপ তার সাথে খারাপই। তবে এদের পিশাচসিদ্ধে বাঁধা পড়লে তখন ভালোবাসা থাকে কি না আমার জানা নেই।’
পদ্মজা উদাস হয়ে বললো, ‘আমি সব জেনে যাওয়ার পর,কখনো মনে হতো তিনি ব্যাকুল আমার জন্য। আর কখনো মনে হতো আমার সামনে স্বয়ং শয়তান দাঁড়িয়ে আছে। এই ভালো,এই খারাপ! উনি উন্মাদের মতো হয়ে যেতেন। কি করছেন না করছেন তা যেন নিজেও বুঝতেন না।’
‘আই থিংক, তিনি দুটো জীবন নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলেন। তারপর সময় চলে আসে একটা বেছে নেয়ার তখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।’
পদ্মজা চকিতে তাকাল। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,’মানসিকভাবে বিপর্যস্ত!’
____________
অতীত।
শিশির ভেজা ঘাসে পা দিতেই সর্বাঙ্গ শীতল হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা পূর্ণার বেশ ভালো লাগছে। সে ভোরের নামায পড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে এসেছে তার বোনের খবর যেন পাওয়া যায়। এখন সে উত্তরের হাওড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে মৃদুলের জন্য। ভোরের দমকা বাতাস ও কুয়াশায় তীব্র শীতে সে কাঁপছে। তবুও ভালো লাগছে। পূর্ণার শীতে কাঁপতে খুব ভালো লাগে! কি আশ্চর্য ভালো লাগা! মৃদুল কুয়াশা ভেদ করে পূর্ণার সামনে এসে দাঁড়াল। পূর্ণার পরনে বেগুনি রঙের সোয়েটার। তার কাঁপুনি চোখে পড়ার মতো। মৃদুল তার গায়ের শাল দিয়ে পূর্ণার মাথা ঢেকে দিল। বললো,’এই ঠান্ডার মধ্যে টুপি ছাড়া ঘর থাইকা বাইর হইছো কেন? আর জুতা খুলছো কেন? পরো।’
‘পরো’ শব্দটি ধমকে উচ্চারণ করলো। পূর্ণা দ্রুত জুতা পরে নিল। বললো,’শাল দিয়ে দিলেন যে,আপনার ঠান্ডা লাগবে না?’
‘আমারে দেইখা লাগে আমার ঠান্ডা লাগতাছে? গেঞ্জি পরছি,তার উপর শার্ট, তার উপর সোয়েটার। এইযে গলায় মাফলার, মাথায় টুপি। হাত,পায়েও মোজা আছে। এরপরেও আমার ঠান্ডা লাগবো?’
পূর্ণা হেসে বললো,’না।’
তারপর পরই বললো,’আজ দুপুরে না আবার যাবেন বলছিলেন।’
‘হু,যাব তো। লিখন ভাইরে নিয়া যাবো। পদ্মজা ভাবি আমির ভাইয়ের সাথে যখন আছে ভালোই আছে। তবুও খোঁজ নিমু আমি। এতো চিন্তা কইরো না।’
পূর্ণা অন্যমনস্ক হয়ে বললো,’আচ্ছা।’
‘খাইয়া আইছো?’
মৃদুলের ফর্সা গাল,সহজ-সরল দুটি চোখ,জোড়া-ভ্রু আর গোলাপি ঠোঁটগুলো এক নজর দেখে পূর্ণা বললো,’হুম। আপনি খেয়েছেন?’
‘আর খাওয়া।’
‘কেন? খাননি?’
‘জাকিররে চিনো না? জাকিরের বাড়িত উঠছি। ওর আম্মা গেছে বাপের বাড়ি। ওর আব্বা আর আমি একসাথে আছিলাম। রাঁধবো কে?’
‘জাকিরের দাদি কোথায়?’
‘বুড়ির অসুখ। আইচ্ছা বাদ দেও।’
‘বাদ দেব কেন? ফুপা কয়টা কথা বলেছে বলে এভাবে বাড়ি ছেড়ে দিবেন? নিজেরই তো ফুপা।’
‘ আত্মসম্মান বলে তো একটা কথা আছে। পদ্মজা ভাবির খোঁজটা তোমারে দেওনের লাইগগাই আছি। নইলে রাইতেই যাইতামগা। আমার এতো বড় বাড়ি রাইখা আমি এইহানে কথা শুনে পইড়া থাকুম কেন?’
পূর্ণা রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে জানতে চাইলো,’তাহলে আজ চলে যাবেন?’
মৃদুল পূর্ণার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আড়চোখে পূর্ণার দিকে তাকাল। পূর্ণা চোখ বড় বড় করে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। মৃদুল মুচকি হাসলো। মৃদুলের হাসি দেখে পূর্ণা উশখুশ করে বললো,’হাসার কি বললাম?’
‘তুমিও চলো।’
‘কোথায়?’
‘আমার বাড়িতে।’
‘ধুর! এ হয় নাকি!’
মৃদুল কপালে ভাঁজ সৃষ্টি করে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,’সব পুরুষরা তো বিয়ে করে বউ নিয়ে নিজের বাড়িতেই যায়। তাহলে আমার বেলা এ হয় না ক্যান?’
মৃদুলের কথায় পূর্ণা বাকরুদ্ধ! মৃদুল তাকে বিয়ের কথা বলেছে! পূর্ণার শ্যামবর্ণের মায়াবী মুখটায় লজ্জারা জমে বসে। ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠে। সে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলো। মৃদুল বললো,’চলে যাইতাছো ক্যান?’
‘আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন।’
‘আরে যাইয়ো না।’
‘যাচ্ছি।’
‘কথা হুনো।’
পূর্ণা থামে না। তাই মৃদুল দৌড়ে আসে পূর্ণার পাশে। হাঁপাতে, হাঁপাতে বললো,’এতো শরম পাও ক্যান?’
পূর্ণা লজ্জাশরম আর নিতে পারছে না। মৃদুলের কথায় সে লজ্জায় ঝিমিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,’আমাদের বাড়িতে চলুন। খেয়ে যাবেন।’
‘উম,খাওন যায়। বাসন্তী খালার রান্না কিন্তু এক্কেরে খাঁটি।’
‘আপনি তো বড় আম্মার সব রান্না খেয়ে দেখেননি। খেলে বুঝতেন কত মজা!’
‘তাহলে তো এই বাড়িতে জামাই হতেই হবে।’
পূর্ণা হেসে দিল। বেশি লজ্জা পেলে মানুষ হাসি আটকে রাখতে পারে না। পূর্ণার বেলাও তাই হলো। তারা দুজন গল্প করতে করতে মোড়ল বাড়িতে আসে। পথেঘাটে অনেকের সাথে দেখা হয়। সবাই জহুরি চোখে তাদের দেখে। তাতে অবশ্য মৃদুল-পূর্ণার যায় আসে না। দুজন একই রকম।তারা সমাজকে উপেক্ষা করে নিজেদের আনন্দ নিজেরা বুঝে নিয়েছে। কিন্তু সমাজকে উপেক্ষা করতে চাইলেও কি উপেক্ষা করা যায়? এই সমাজ নিয়েই বাঁচতে হয়।
দুপুরে মৃদুল লিখনের খোঁজে গেওয়া পাড়ার বড় ধানক্ষেতে আসলো। ধানক্ষেতের মাঝে শুটিং চলছে। একটা সুন্দর গ্রাম্য গানের তালে,লিখন নাচছে। মাথায় গামছা বাঁধা। পরনে লুঙ্গি,শার্ট। সব বেশভূষাতেই তাকে সুন্দর লাগে। আকর্ষণীয়! দূরের পথের বট গাছের আড়ালে কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা তাদের স্বপ্নের পুরুষকে দেখছে। যার সামনে দাঁড়ানোর সাহস এবং ক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। লিখনের সাক্ষাৎ তাদের ঘুম কেড়ে নেয়। মৃদুল দাঁড়িয়ে থেকে শুটিং দেখে। লিখনের খেয়ালে মৃদুল পড়তেই সে হাত নাড়ায়। মৃদুলও হাত নাড়ালো। শুটিং শেষ হতেই লিখন আসে। মাথা থেকে গামছা সরাতেই ঝাঁকড়া চুলগুলো সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠে। সে মৃদুলের সাথে করমর্দন করে বললো,’দুঃখিত, তোমাকে অপেক্ষা করতে হলো।’
‘আমার ভালোই লাগতেছিল।’
একজন দুটো চেয়ার নিয়ে আসে। লিখন বললো,’বসো।’
দুজন বসলো। মৃদুল বললো,’ও বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি যাবা তো?’
‘হু যাবো। তবে,আমি বাড়ির চেয়ে দূরে থাকবো। বাড়ির ভেতর বা কাছে যাব না। এটা ভালো দেখাবে না।’
‘খারাপ দেখাইবো কেন?’
‘আর বলো না, একজন মজার ছলে আজ আমাকে বলেছে, আমাকে হাওলাদার বাড়িতে দেখা যায় সবসময়। কার জন্য যাই? পদ্মজার জন্য নাকি? আমাদের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল নাকি। এমন অদ্ভুত কথা। কিন্তু গিয়েছি মাত্র দুই দিন। একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে এভাবে ছড়িয়ে গেলে পদ্মজার জন্য খুব খারাপ হবে। সম্মানহানি হবে।’
‘মানুষ মিথ্যা কইলেই হইবো?’
‘তোমাকে আমি আগেও বলেছি,পদ্মজা একবার অসম্মানিত হয়েছে। এজন্য আমার খুব ভয় করে। আমার এই একটাই ভয়। মিথ্যে হউক অথবা সত্য,পদ্মজা দুর্নামি হউক সেটা চাই না।’
‘তাইলে যাওনের কি দরকার?’
লিখন হাসলো। হেসে বললো,’রাগ করো না মৃদুল। ছয় বছর আগ থেকেই আমার নামের সাথে পদ্মজার নাম জড়িয়ে একটু কানাঘুষা আছে। এখন যদি বার বার ওই বাড়িতে যাই মানুষ অনেক কথা বানাবে।’
‘বুঝছি ভাই। রাগ করি নাই।’
‘তাহলে চলো। আমি কাপড় পাল্টে নিই। তারপর যাবো।’
দুজন চলে আসে হাওলাদার বাড়িতে। লিখন হাওলাদার বাড়ির চেয়ে দূরে একটা মাঠে অপেক্ষা করে। দারোয়ান মৃদুলকে ঢুকতে দিল। মৃদুল দারোয়ানের পেটে থাপ্পড় দিয়ে বললো,’শালার পেটলা! এখন ঢুকতে দিলি ক্যান?’
‘বড় চাচায় কইছে।’
মৃদুল আলগ ঘরের বারান্দায় দেখলো মজিদকে। সে দারোয়ানের মাথায় একটা টোকা দিয়ে আলগ ঘরে চলে আসে। মজিদ হাওলাদার চেয়ারে বসে বই পড়ছেন। এই মানুষটা মৃদুলের খুব পছন্দের। এমন সৎ,উদার মানুষ সে দুটো দেখেনি। দেখলেই ভক্তি চলে আসে। অলন্দপুরের মানুষ সুখী এই মানুষটার জন্যেই। সবসময় বাইরে থাকেন। হুটহাট বাড়িতে পাওয়া যায়। মৃদুল মজিদের সামনে এসে দাঁড়াল।সালাম দিল,’আসসালামু আলাইকুম মামা।’
মজিদ হাওলাদার বই থেকে চোখ তুলে উত্তর দিলেন,’ওয়ালাইকুম আসসালাম। মৃদুল নাকি?’
‘জি,মামা।’
‘তুমি বাড়ি ছেড়ে কোথায় গিয়েছো? রাতে দেখলাম না।’
মৃদুল মাথা নত করে বললো,’আলম ভাইয়ের বাড়িতে। জাকিরের আব্বা।’
‘তুমি আমার বাড়ি রেখে অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকছো,এটা ঠিক না মৃদুল। আমি অসন্তুষ্ট হয়েছি।’
‘কেউ অপমান করলে কি আর থাকা যায়?’
‘শুনছি আমি, এটা খলিলের বাড়ি নাকি আমার বাড়ি? তুমি এখানেই থাকবে।’
‘আইজ চইলা যামু বাড়িত।’
‘এ তো তোমার রাগের কথা। রাগের সিদ্ধান্ত। আর কয়টা দিন থেকে যাও। ফুপার কথা রাখো। তোমার আব্বা শুনলে কি বলবেন?’
‘আব্বারে কইতাম না।’
‘যা বলছি শুনো।’
‘আচ্ছা,মামা।’
‘যাও ঘরে যাও। দুপুরের খেয়েছো? না খেলে খেয়ে নাও।’
‘যাইতাছি। আচ্ছা,মামা আমির ভাই কই?’
‘আমিরতো ঢাকা গেছে।’
‘কয়দিন ধরে?’
‘গতকাল বিকেলেই গেল।’
‘পদ্মজা ভাবিরে নিয়ে গেছে?’
‘হুম। দুজনই গিয়েছে। চলে আসবে দুই-তিনদিনের মধ্যে।’
‘আচ্ছা মামা,গত কয়দিন আমির ভাই কই আছিল?’
‘ঢাকা ছিল। তারপর এসে পদ্মজাকেও নিয়ে গেছে। পদ্মজার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যাপার বোধহয়। এত কি আর আমাদের বলে? তুমি এতো ভেবো না। যাও খেতে যাও।’
মৃদুল মজিদের কথা বিশ্বাস করে নিল। অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না। মৃদুল ভাবলো। তাহলে দাঁড়াল যে, ‘আমির ভাই এতদিন ঢাকা ছিল তাই পদ্মজা ভাবিকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। এজন্য কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমির ভাই পদ্মজা ভাবির জন্য কেমন পাগল সবাই জানে! তাই এই পাগলামি মানা যায়। তারপর কোনো জরুরী কাজে পদ্মজা ভাবিকেও নিয়ে যাওয়া হয়। মজিদ মামার কথামতো সেই জরুরি কাজ পদ্মজা ভাবির বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যপার হতে পারে। পরীক্ষা বা অন্য কিছু।’
মৃদুল মনে মনে খুশি হয়। সে মজিদকে বললো,’মামা আমি আইতাছি।’
তারপর বেরিয়ে আসলো। লিখনকে সব বললো। তার ভাবনাও জানালো। লিখনও মেনে নিল। মৃদুল চলে যেতেই মজিদ হাওলাদার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমিনার কাছ থেকে তিনি শুনেছেন,মৃদুল,লিখন এসেছিল। আর কী কথা হয়েছিল তাও জেনেছেন। তাই গুছিয়ে ব্যাপারটাকে সামলাতে পেরেছেন।
___________
হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে পদ্মজা। তাকে স্বাগতম দরজা দিয়ে এওয়ান( A1) নামে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। দুপুর অবধি সে ঘরে বন্দি ছিল। হাত-পা বাঁধা ছিল না। তারপর যখন কতগুলো মেয়ের বুকফাটা আর্তনাদ তাকে কাঁপিয়ে তুলে, বাতাস ভারি হয়ে ওঠে তখন দরজায় জোরে,জোরে শব্দ করেছে। ফলস্বরুপ তার হাত-পা বেঁধে তাকে অন্য দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। রাফেদ নিয়ে এসেছে। গত রাতের পর আমিরের সাক্ষাৎ আর মিলেনি। মানুষটা এখানেই আছে,সে কণ্ঠ শুনেছিল। শুধু তার কাছে আসেনি।
আমির পাতালঘরের দরজার সামনে বসে আছে। এক পাশে ধ-রক্ত লেখা দরজা,অন্য পাশে স্বাগতম দরজা। ধ-রক্তের ভেতর চারটি ঘর। স্বাগতমের ভেতর পাঁচটি ঘর। এ নিয়েই পাতালঘর। সে হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে কিছু চিন্তা করছে। কপালের রগগুলো দপদপ করছে। সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। রিদওয়ান,খলিলের এখানে আসার কথা ছিল। সকালে মজিদ ও খলিলের সাথে তার কথা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ আহত হলে হাসপাতালে রাখা হয় না। নিজেদের দেখাশোনা নিজেদের করতে হয়। রিদওয়ানের জ্ঞান ফিরেছে। তবে অবস্থা ভালো নয়। এতে আমিরের যায় আসে না। বেঁচে আছে তো তাকে হাসপাতালে আর থাকতে দিবে না। অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য্য হয়ে আমির উঠে পড়ে। তখন ফট করে পাতাল দরজা খুলে যায়। প্রবেশ করে মজিদ,খলিল আর রিদওয়ান। রিদওয়ানের মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। মাথায় ব্যান্ডেজ। চোখ নিভু,নিভু। খলিলের হাতে বিভিন্ন ঔষধপত্র, স্যালাইন। মজিদ প্রবেশ করেই বললেন,’তোর বউ কোথায়?’
আমির উত্তর দিল না। সে পদ্মজার ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহী নয়। খলিল বললেন,’এই ছেড়ির কইলজাডা বেশি বড়। এইহানে আইয়া পড়ছে। আমি কইতাছি ভাই, এই ছেড়িরে সময় থাকতে সরায়া না দিলে এই ছেড়ি একদিন আমরারে সরায়া দিব। বাবলুর মতো জাত খুনিরে মাইরা ফেলছে। আর আমরারে পারব না?’
আমির কারো সাথে কোনোরকম কথা না বলে,’রিদওয়ানের শার্টের কলার চেপে ধরলো। কিড়মিড় করে চাপাস্বরে বললো,’পদ্মজার গলায় দাগ হলো কী করে? ‘
রিদওয়ানের অবস্থা শোচনীয়। তাকে আরো কয়টা ঘন্টা সময় দিলে সে কিছুটা শক্ত হয়ে যেত। আমির এভাবে চেপে ধরাতে তার জান বেরিয়ে আসতে চাইছে। মজিদ আমিরকে টেনে সরিয়ে আনে। বলে,’মারিস না,মরে যাবে।’
আমির তার ভয়ংকর চোখ দুটি রিদওয়ানের মুখের উপর রেখে বললো,’কুত্তার বাচ্চারে আমি জবাই দেব।’
‘আমির আব্বা, এখন বউয়ের প্রতি মায়া দেখানোর সময় না। মাত্র আট দিন বাকি। রিদওয়ানকে সুস্থ হতে হবে। আমাদের সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। একুশজন মেয়ে আটদিনের মধ্যে যোগাড় করতে হবে।’
মজিদের কথা আমিরের উপর কাজ করে। সে খলিলকে বলে, এটু( A2) ঘরে রিদওয়ানকে রাখতে। খলিল রিদওয়ানকে নিয়ে যান। মজিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমিরকে দেখে বললেন,’আমরা কিন্তু এখন বিপদের উপরে আছি। কিছুতেই মন অন্য জায়গায় দেয়া যাবে না। বিপদ থেকে রক্ষা না পেলে এতদিনের কষ্টে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য জলে যাবে। তোর হাতে সব দিয়েছি। কারণ, আমি জানি আমার ছেলে বাঘের বাচ্চা। সে সব কিছু পারে। থাবা দিয়ে সব ধ্বংস করে দিতে পারে। অর্থের উপরে কিছু নেই। অর্থ দিয়ে সব কেনা যায়।’
মজিদের কথাগুলো আমিরের উপর বিষাক্ত বিষের মতো প্রভাব ফেলে। মুহূর্তে মধ্যেই তার পূর্বের ধ্যান-জ্ঞান মস্তিষ্ক জুড়ে বসে। পদ্মজার সাথে দেখা হওয়ার পর সে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এমন তো হওয়া যাবে না। কিছুতেই না। নারীর আকুতি-মিনতি আর অর্থের চেয়ে সুন্দর পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আমির অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকাল। তারপর মজিদকে নিয়ে ধ-রক্তে প্রবেশ করলো। ধ-রক্তের বিওয়ান(B1) ঘরে প্রবেশ করতেই মজিদের মনটা ভরে যায়। নগ্ন কতগুলো দেহ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে এক-দুটো নড়ছে। গোঙাচ্ছে! যা তাদের জন্য চক্ষু শীতল দৃশ্য। আরভিদ এসে জানালো,’ দুটো মেয়ে মারা গেছে।’
আমির ভ্রুকুটি করে জানতে চাইলো,’কোন দুটি মেয়ে?’
আরভিদ লাঠি দিয়ে ঠেলে দুটি নিস্তেজ দেহ দেখালো। আমির বললো,’ দুটোকে আলাদা করো। আর একটা বস্তা আর ছুরি,রাম দা নিয়ে আসো। চাচারে বলবা আসতে।’
আরভিদ চলে গেল। মজিদ বললেন,’আজ ট্রলার লাগবে?’
‘লাগবে। লাশ রেখে দিলে দূর্গন্ধ ছড়াবে। আর মন্তুরে বলে দিও, বড় নদীতে ফেলতে। মাদিনীতে যেন না ফেলে। শফিক বলছে, কয়দিন পর পর একই নদীতে লাশ পায় যা সন্দেহবাতিক। ওদের থানায় তদন্ত চলছে।’
মজিদ মহা বিরক্তি নিয়ে বললেন,’মন্তুরে মনে চায় জুতা দিয়ে পিটাই। বার বার বলার পরও একই ভুল করে।’
‘কয়টা ঘা দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
রাফেদ পদ্মজার জন্য খাবার নিয়ে আসে। প্লেট বিছানার এক পাশে রেখে পদ্মজার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েই রাফেদ কিছু বুঝে উঠার পূর্বে রাফেদকে জোরে ধাক্কা মারলো পদ্মজা। রাফেদ এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। দুশো বছরের পুরনো পাতালঘরের দেয়ালে বারি খেতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। ততক্ষণে পদ্মজা বেরিয়ে যায়। পদ্মজা নিশ্চিত হয়ে গেছে,তাকে কেউ আক্রমণ করবে না। আমির আক্রমণ করতে নিষেধ করেছে। তাই সে নির্ভয়ে রাফেদকে আঘাত করে বেরিয়ে আসে। এক ছুটে প্রবেশ করে ধ-রক্তে। আমিরের সাথে তার কথা আছে। সে কি চায়? জানতে চায়। এভাবে সময়টাকে থামিয়ে রাখলে চলবে না। বিওয়ান(B1) ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল পদ্মজা। গতকাল দেখেনি দরজার বিওয়ান লেখাটি। আজ দেখেছে। তার বুক কাঁপছে দুরুদুরু! মজিদ হাওলাদারের হাসি শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে গোঙানির শব্দ। পদ্মজার লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ে। সে দরজা ঠেলে উঁকি দেয়। গতকাল দৃশ্যের চেয়েও ভয়ংকর এক দৃশ্য ভেসে উঠে। মেঝেতে রক্তের বন্যা। প্রতিটি মেয়ে অচেতনের মতো পড়ে আছে। তারা চিৎকার করছে না। যেন প্রাণ যাওয়ার অপেক্ষাতেই আছে তারা। মজিদ হাওলাদার লাঠি দিয়ে মেয়েগুলোর স্পর্শকাতর স্থানে পাশবিক উল্লাসে আঘাত করছে। তার চেয়ে কিছুটা দূরে দামী একখানা চেয়ারে বসে আমির কিছু কাগজ দেখছে। পাশেই খলিল হাওলাদার বসে আছেন। একটা মেয়ের দেহ ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভরছেন। যাতে কেউ দেহ শনাক্ত না করতে পারে। সামনে রয়েছে রাম দা তিনটে। বীভৎস দৃশ্যটি যে কাউকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলবে। পদ্মজার বেলাও তা হয়। বমি গলায় এসে আটকে যায়। শরীর বেয়ে একটা আগুন ছুটে এসে মাথায় থেমে যায়। সঙ্গে,সঙ্গে পদ্মজার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। সে ঝড়ের গতিতে তেড়ে এসে বয়স্ক শয়তান মজিদকে এক ধাক্কায় ছুঁড়ে ফেলে দূরে। মজিদ হাওলাদার উঁবু হয়ে পড়ে যান। নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। মজিদ মেঝেতে উঁবু হয়ে পড়তেই খলিল উঠে দাঁড়ায়। পদ্মজার চুলের মুঠি টেনে ধরে। সেকেন্ড খানিক পার হতে পারেনি তার আগেই আমির খলিলকে থাবা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এক হাতে জড়িয়ে ধরে পদ্মজাকে। আমিরের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই পদ্মজা ছ্যাঁত করে উঠলো। এই ঘৃণ্য মানুষটিকে সে এখন সহ্য করতে পারছে না। আমিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মেঝে থেকে রাম দা তুলে নিল। আমিরের দিকে রাম দা তাক করে সাপের মতো হিশহিশ করতে করতে বললো,’আমি কিন্তু মেরে দেব। একদম…একদম মেরে দেব।’
পদ্মজার গলা কাঁপছে,শরীর কাঁপছে। চারপাশে রক্তাক্ত দেহ ছড়িয়ে আছে। এক পাশে মানুষের দেহের টুকরো! সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। এই পরিবেশ সে নিতে পারছে না। এমন নির্দয়,বর্বর মানুষ ছিল পাক সেনারা। এই কথা সে শুনেছে তার মায়ের কাছে। সে যেন পাক সেনাদের বাঙালি রূপে দেখছে। পদ্মজা অস্থির হয়ে চারপাশ দেখে। মেয়েগুলো কীভাবে বাঁচানো যায়? জানা নেই। কোনো পথ নেই। খলিল পদ্মজার দিকে ছুরি ছুঁড়ে মারার জন্য উদ্যত হয়,তখন আমির হুংকার দিয়ে উঠলো,’শুয়ো** বাচ্চা,হাত নামা।’
কি জঘন্য আমিরের ভাষা,চোখের দৃষ্টি,হুংকার! পদ্মজার গা রি রি করে উঠে। সে আমিরের দিকে রাম দা উঁচু করে বললো,’যারা যারা আছে সবাইকে ছেড়ে দিন। নয়তো…নয়তো আমি…আমি আপনাকে মেরে ফেলবো।’
পদ্মজা ঘামছে। তার কথা এলোমেলো। তার শরীরে অস্থিরতা। একবার এদিকে তাকাচ্ছে,আরেকবার ওদিকে। দিকদিশা হারিয়ে ফেলেছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার মাথা কাজ করছে না। বমি ঠেলেঠুলে উপরের দিকে আসছে। আরভিদ দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। রাফেদ তার পিছনে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই পদ্মজা ফিরে তাকালো। সুযোগ পেয়ে আমির পিছন থেকে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরলো। পদ্মজার হাত থেকে রাম দা ছিনিয়ে নিল। পদ্মজা কিড়মিড় করতে থাকে। মুখ দিয়ে ক্রোধে বের হতে থাকে অদ্ভুত কিছু শব্দ! আমির পদ্মজাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ধমকে বললো,’এইবার বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। থামো।’
পদ্মজা অগ্নি চোখে আমিরের দিকে তাকালো। সে আমিরের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে। নিজের অজান্তে খামচে আমিরের হাত থেকে রক্ত নিয়ে আসে। ছটফট করতে থাকে। পদ্মজার গা থেকে শাড়ি পরে যায়। ভেসে উঠে শরীরের অনেকাংশ! সম্পর্কে মজিদ,খলিল যাই হোক না কেন আমির জানে তারা কতোটা নিকৃষ্ট। তাদের চরিত্র,চাহনি সব নিয়েই তার ধারণা আছে। তাই সে দ্রুত পদ্মজাকে শাড়ি দিয়ে ঢেকে দিল। শক্ত করে চেপে ধরলো। আচমকা পদ্মজা বমি করতে শুরু করে। যা ছিটকে পড়ে আমিরের চোখেমুখে। সে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। পদ্মজার শরীর নেতিয়ে পড়ে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে এওয়ানে(A1) চলে আসে। দূর্বল শরীরেও পদ্মজার তেজ কমে না। আমিরও হারার পাত্র নয়। তার পুরুষালি শক্তির সাথে পদ্মজা পেরে উঠেনি। একসময় পদ্মজা থেমে গেল,ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমির দূরে সরে দাঁড়ায়। এ কি শুরু হয়েছে! তার এই রাজত্বে এমন বিশৃঙ্খলা কখনো হয়নি। পদ্মজার জন্য বার বার কাজে বিঘ্ন ঘটছে। পদ্মজাকে অন্দরমহলে পাঠানোও সম্ভব না। পদ্মজা যেভাবে রিদওয়ানকে আঘাত করেছে,তাতে আর ভরসা নেই পদ্মজার উপর। যেকোনো মুহূর্তের পদ্মজা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। একমাত্র সে পারে পদ্মজাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আর এই মুহূর্তে তার অন্দরমহলে ফেরা যাবে না। দুই-তিনদিন লাগবে ফিরতে। আমির মনে মনে ভেবে নেয়, বাকি যেকয়টি দিন সে এখানে আছে পদ্মজাকে এক ঘরে বেঁধে রাখবে। কিছুতেই বাঁধন খোলা যাবে না। আমির পদ্মজার দিকে এগোয়। পদ্মজা চিৎকার করে উঠলো,’খারাপ লোক! ঘেন্না হচ্ছে আমার! ঘেন্না হচ্ছে।’
পদ্মজা প্রবল আক্রোশে আমিরের পায়ের কাছে থুথু ফেললো। আমির পদ্মজার দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। বেঁধে ফেললো দড়ি দিয়ে। তারপর বিছানায় ফেলে পা বাঁধতে বাঁধতে বললো,’ভুল করলে এখানে এসে। এতো নাক না গলালে ভালো থাকতে। সুখে থাকতে।’
পদ্মজা ক্রোধে-আক্রোশে ঘোরে আছে। হাত-পা বেঁধে ফেললেও মুখ তো আছে। পদ্মজা মুখের থুথু দিয়ে বুঝিয়ে দিল,সে আমিরকে সহ্য করতে পারছে না। আমিরের মুখে থুথু পড়তেই তার মাথা চড়ে যায়,’পদ্মজা!’
‘আমাকে ডাকবেন না আপনি। পিশাচ একটা।’
‘আমি কিন্তু তোমার গায়ে হাত তুলবো।’
‘আমি আশা করি না যে,আপনি আমাকে মারবেন না।’
মজিদ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছেন। তিনি পদ্মজাকে নিয়ে আতঙ্কে আছেন। মনে মনে তিনি পদ্মজাকে কয়েকবার খুন করেছেন,কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়তো সম্ভব না,যতদিন পদ্মজার উপর আমিরের আকর্ষণ আছে। তিনি খলিলকে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন,’আমিররে পদ্মজার কাছ থেকে নিয়ে আয়। ওই মা* ঝি মায়াবিনী। রূপ দিয়ে আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে বশ করে নিবে।’
খলিলের কানে মজিদের কথা গেল না। তিনি রাগে ফুলে আছেন। আমির সবসময় তার সাথে এবং রিদওয়ানের সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করে। দুই বাপ-ব্যাঠা মিলে অনেকবার পরিকল্পনা করেছে,আমিরকে খুন করার। কিন্তু আমিরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, প্রখর শ্রবণশক্তি,নিজেকে রক্ষা করার মতো কৌশল ডিঙিয়ে তাকে আক্রমণ করার সাহস কখনো হয়ে উঠেনি। এছাড়া,আমিরের একেকটা চামচা তার মতোই জাত খুনি! তবে খলিল দমেও যাননি। একদিন সুযোগ হবে। সেদিন এক কোপে আলাদা করে দিবেন আমিরের মাথা। তাছাড়া মজিদকেও খলিলের পছন্দ নয়। সব সম্পত্তি আমিরের নামে করে দিয়েছে! মনের ক্রোধ মনেই রয়ে যায়। কাজ করতে হয় আমিরের হয়ে। নিজেরা আর দখল নিতে পারে না। মজিদ হাওলাদার পা দিয়ে খলিলের পিঠে ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন,’খলিল?’
খলিল সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো,’কও ভাই।’
‘যা,আমিররে গিয়ে বল,রায়পুর যেতে। ওদিকে মেলা হচ্ছে।’
‘মেলায় ধরা পইড়া যাইবো না?’
‘এখন ঝুঁকি নিতেই হবে। সময় নেই। আর আমির পারবে।’
খলিল এওয়ানে আসে। আমিরকে বলে রায়পুরের কথা। আমির দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। আর মজিদকে হুমকি দিয়ে বলে গেল, পদ্মজার গায়ে কোনো টোকা যেন না লাগে!
তারপর সাথে নিয়ে যায় রাফেদকে। ট্রলারে আছে মন্তু আর শ্রীভব। পদ্মজা পড়ে থাকে ঘরে। তার চোখ বেয়ে জল নেমে আসে। মাথা ঘুরাচ্ছে খুব। চোখ দুটি বার বার বন্ধ হয়ে আসছে। মন এবং শরীর দুটোর উপর দিয়েই ধকল যাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে। চোখের পর্দায় ভেসে উঠে পূর্ণা ও প্রেমার মুখ। এই পাপের কবলে যদি পূর্ণা,প্রেমা পড়ে! পদ্মজা চট করে চোখ খুলে। তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। চিন্তায় মাথা ব্যথা বেড়ে যায়।
দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ক্লান্ত চোখদুটি খুললো পদ্মজা। ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান। তার ঠোঁটে হাসি। পদ্মজার পাশে এসে বসে। পদ্মজা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। রিদওয়ান হেসে বললো,’এই দিনটার অপেক্ষা করছিলাম অনেকদিন ধরে।’
পদ্মজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। রিদওয়ান বললো,’আমির কি ঠকানোটাই না ঠকালো তোমাকে।’
রিদওয়ান দাঁত বের করে হাসলো। হাসি দেখে মনে হচ্ছে সত্যি আজ তার সুখের দিন। সে তো এটাই চেয়েছে। পদ্মজা জেনে যাক সব। রিদওয়ান বললো,’তোমাকে অনেক সংকেত দিয়েছিলাম। যাতে আমিরকে চিনে ফেলতে পারো। কিন্তু তোমার আগে সেই সংকেত আমিরের চোখে পড়ে যেত। কি কপাল আমিরের! দুনিয়ায় সব সুখ নিয়েই ও জন্মেছে।’
পদ্মজা প্রশ্ন করলো,’আপনি কেন চাইতেন? আপনি তো এই দলেরই।’
‘দলের তো বাধ্য হয়ে। দেখো,আমি তোমাকে আগে পছন্দ করেছি সেই হিসেবে আমার তোমাকে পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কে পেয়েছে? আমির! যে একজন নারী অত্যাচারী, নারী ব্যবসায়ী,খুনি,শয়তান।’
‘শয়তান তো আপনিও।’
‘আমি শয়তান হলে তোমার কী যায় আসে? তোমার স্বামী হলে-
‘এখানে কেন এসেছেন?’
‘গল্প করতে।’
‘মেয়েগুলোকে মারা হচ্ছে কেন?’
রিদওয়ান মুচকি হেসে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে সব বলার জন্যই এখানে এসেছে। পদ্মজা ও আমির প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তার যে আনন্দ হবে সেই আনন্দ বোধহয় বেহেশতেও নেই। এটা রিদওয়ানের ভাবনা। তাই তো সে যখনই শুনলো,আমিরের উপস্থিতি এখন নেই। সঙ্গে,সঙ্গে অসুস্থ শরীর নিয়েই পদ্মজার কাছে চলে এসেছে। রিদওয়ান ধীরেসুস্থে জানালো এই পাতালঘরের ইতিহাস। দুশো বছর পুরনো এই পাতাল ঘর। আগে মন্দির ছিল। মন্দিরের নিচে পাতালঘর বানানো হয়েছিল। সেখানে সোনার মূর্তি ছিল। মূর্তির গায়ে ছিল হীরা,পান্না। তখনকার আমলের রাজার দায়িত্বে ছিল এই পাতালঘর। তারপর সেটা কোনোভাবে হাওলাদার বাড়ির হয়ে যায়। সোনার মূর্তিও নাই হয়ে যায়। তার খোঁজ কেউ জানে না। তখনের প্রজন্মে হাওলাদার বংশের একজন পুরুষ ছিলেন নারী আসক্ত। তিনি যখন বাড়ির পিছনে এমন একটা পাতাল ঘরের সন্ধান পেলেন,মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নারী আসক্তি। তারপর থেকেই মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ করে, খুন করা হয়ে উঠে প্রতি দিনকার অভ্যাস। আস্তে আস্তে এই পাপ ছড়িয়ে পড়ে বংশের সব ছেলেদের মধ্যে। পাতালঘর তাদের মনে নিষিদ্ধ, মহাপাপের বাসনা জাগিয়ে তুলে। আস্তে আস্তে ধর্ষণের সাথে সাথে নারী বিক্রি শুরু হয়। শুরু হয় পতিতাবৃত্তি। লম্পট ক্ষমতাশালীরা অর্থ দিয়ে নারী ভোগ করতে আসতো পাতালঘরে। এই পাপ মজিদ হাওলাদার অবধি একই ভাবে চলে আসে। আমির হাওলাদার সেটাকে বিদেশ অবধি নিয়ে যায়। টাকার পাহাড় গড়ে তুলে। পাতালঘরকে করে তুলে আধুনিক। বানায় আরো কয়েকটি ঘর। চারিদিকের নিরাপত্তা শক্ত করে। প্রতি বছরের শীতে এবং বর্ষাকালে কয়েকটি মেয়েকে ধরে এনে হাওলাদার বাড়ির পুরুষেরা নিজেদের পুরুষত্বের ক্ষমতা প্রমাণ করে। তারপর চৌদ্দ দিন ধরে একটানা তাদের করা হয় নির্মম অত্যাচার। চৌদ্দ দিনের মধ্যে অনেকে মারা যায়। আবার অনেকে বেঁচে থাকে। যারা বেঁচে থাকে তাদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তারপর লাশের গায়ে,পাথর বেঁধে ট্রলারে করে ডুবিয়ে দেয়া হয় সব বড়,বড় নদীতে। আর বছরে চারবার নারী পাচার করা হয় বিদেশে। পুরো বছর জুড়ে খোঁজ চলে নারী শিকারের। এ পাপ হাওলাদার বাড়ির রক্তে মিশে গিয়েছে। বয়স পনেরো হতেই বাড়ির ছেলেদের জড়িয়ে দেয়া হয় এই চক্রের সাথে। এ যেন হাওলাদার বংশের রীতি! ছেলে হয়ে জন্মালে এই রীতি অনুযায়ী চলতেই হবে! সব শুনে পদ্মজা পায়ের তালু থেকে মাথার চুল অবধি কেঁপে উঠে! দুশো বছর ধরে চলছে এই পাপ! কেউ বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি! অথচ,এই হাওলাদার বাড়ির সুনাম সব জায়গায়। হিন্দুরা হাওলাদার বাড়ির পুরুষদের দেবতার সাথে তুলনা করে,আর মুসলিমরা ফেরেশতার সাথে! অথচ এদের রক্তেই শয়তানের বসবাস। এই তবে এই বাড়ির রহস্য! এজন্যই কি মেয়ে হওয়ার পর সৃষ্টিকর্তা তাকে বন্ধ্যা করে দেয়! আমির…আমিরও কী নারী আসক্ত! এটাই তো স্বাভাবিক! হাওলাদার বংশের ছেলে হয়ে নারী ভোগ করেনি এমন ভাবনা মানায় না! পদ্মজার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করতে থাকে। বার কয়েক ঢোক গিলে। রিদওয়ান পদ্মজার অস্থিরতা টের পেয়েছে। তার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। সে খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বললো,’এবার চলো ছয় বছর পূর্বে ফিরে যাই। সেই ঝড়ের সন্ধ্যেতে। যেদিন আমির আর তোমার প্রথম দেখা হয়েছিল।’