বাইজি কন্যা | পর্ব – ৬২

আচম্বিতে অঙ্গনের ঠোঁটে হাসি ফুটল। দৃষ্টিজোড়া ভীষণ উচ্ছ্বসিত দেখাল। সম্মুখে মেয়ে কোলে দণ্ডায়মান শাহিনুর। পাশে জেবা। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আছে তার। ক্ষণকাল অতিবাহিত হতেই কিছু বলার জন্য উদ্যত হলো সে। কিন্তু পূর্বেই অঙ্গন কান থেকে ফোন নামিয়ে পকেটে রাখল। উল্লসিত কণ্ঠে বলল,
-‘খুব বেশি অপেক্ষা করাব না ভাবি। আমায় যেতে হবে। এখুনি যেতে হবে।’
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল অঙ্গন। কিঞ্চিৎ অবাক হলো শাহিনুর। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়াল শাশুড়ি মা’য়ের কক্ষের দিকে। পেছন পেছন জেবাও গেল। মুখভার করে বলল,
-‘আমি তোমায় এসব বলেছি বইলো না। আম্মা আমারে আস্ত রাখব না!’
শান্ত কণ্ঠে শাহিনুর জবাব দিলো,
-‘বলব না।’
জেবা তবুও মন খারাপ করে রইল। মনে মনে নিজেকে ভীষণ অপরাধী অপরাধী লাগছে তার। গুমোট অনুভূতিতে সিক্ত হৃদয়। সত্যি কি বাইজি গৃহে ফিরে যাবে নতুন বউ?

নাতি স্বপ্ন’কে কোলে নিয়ে বসে ছিল প্রেরণা। দ্বারের বাইরে শাহিনুরের কণ্ঠ পেতেই চমকে ওঠল ,
-‘আম্মা ভেতরে আসব?’
স্বপ্ন’কে সখিনার কোলে দিয়ে নড়েচড়ে বসল প্রেরণা।বলল,
-‘আসো আসো দাও দেখি আমার বুবু’কে আমার কোলে দাও।’
ঈর্ষান্বিতা সখিনা ছেলেকে কোলে নিয়ে গটগট পা’য়ে কক্ষ থেকে চলে গেল। শাহিনুর শান্ত চোখে তাকিয়ে কেবল তার মুখো ভঙ্গি দেখল। চাপা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো। শাশুড়ির কোলে দিলো মেয়েকে। প্রেরণা জেবার দিকে তাকিয়ে দু’জনকেই বসতে বলল। কিন্তু কেউই বসল না। প্রেরণা সেদিকে খেয়াল না দিয়ে নাতনির সঙ্গে আহ্লাদ শুরু করল৷ ক্ষণকাল পেরোতেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠল। হঠাৎ কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠল,
-‘ হে আল্লাহ আমার বুকের ধন তুমি ফিরিয়ে দাও। এই নিষ্পাপ শিশু’কে তুমি এতিম করো না। বউ নামাজ, কালাম পইড়ো। আল্লাহ ঠিক রহমত করব।’
শাহিনুর নিশ্চুপ রইল। প্রেরণা চোখ তুলে তাকাল। সেজো ছেলের বউয়ের মুখো ভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে শুধাল,
-‘কিছু বলবা মনে হয়?’
সংবিৎ ফিরে পেলো শাহিনুর। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আমি বাইজি গৃহে যেতে চাই আম্মা। এখানে আমার হাঁসফাঁস লাগছে।’
নিমিষেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল প্রেরণার। নাতনি’কে জেবার কোলে দিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
-‘সেটা এখন পরিত্যক্ত গৃহ৷ তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যেদিন ঐ গৃহে আমার ছেলের লাশ পাওয়া গেছে তার দু’দিন পরেই তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে তুমি কী করবে? ঐ অভিশপ্ত গৃহ আমার সব শেষ করে দিয়েছে!’
-‘আপনার ছেলের জন্য অপেক্ষা করব।’
-‘তা এখানেও করা যাবে।’
-‘আমি সেখানেই তার জন্য অপেক্ষা করতে চাই।’
প্রেরণা কঠিন কিছু বলতে গিয়ে সহসা থেমে গেল। মনে পড়ল, চিঠিতে লেখা প্রণয়ের সেই কথা, “জীবদ্দশায় আমার যদি কিছু হয়, আমার স্ত্রী, সন্তান’কে সুরক্ষা দেবেন। পাশে থাকবেন!”
বুকটা হুহু করে ওঠল। চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করল। এক অসহায় মা’য়ের প্রতিচ্ছবি স্বচক্ষে দেখতে পেয়ে নরম হলো শাহিনুর। আজ সেও একজন মা। প্রসব যন্ত্রণার কথা স্মরণ করলেই সন্তানের কদর বোঝা যায়৷ সে কেবল একটি সন্তান জন্ম দিয়েছে। অথচ প্রেরণা পাঁচ জনকে৷ ঠিক পাঁচ বার একই যন্ত্রণা হয়েছে তার৷ মা হয়ে আরেক মায়ের ব্যথা আজ সুক্ষ্ম ভাবে টের পেল। কিছুটা নরম গলায় বলল,
-‘আপনি আজো ঘৃণা করেন আমার আম্মার মতো বাইজিদের? আজো আপনি বা আপনার পুত্রবধূ’রা সে গৃহে গেলে ঘেন্না হয়? এতকিছুর পরও চোখ খুলেনি আপনার?’
-‘একদম মা’য়ের মতো হয়েছো।’
-‘আজকের শাহিনুর শুধু বাইজি শারমিনের আদর্শ মেনে চলছে না আম্মা। এই শাহিনুর কিন্তু আপনার ছেলের আদর্শ মেনেও চলে, কথা বলে।’
অকপটে জবাব শুনে থমকানো কণ্ঠে প্রেরণা বলল,
-‘একা থাকা যাবে না। সঙ্গে দু’জন ভৃত্যকে নিয়ে যাও। ও গৃহের আকৃতি দেখে ভয় পেও না। সেদিনের পর ও গৃহে কেউ প্রবেশ করেনি।’
স্বস্তির শ্বাস ফেলল শাহিনুর৷ প্রেরণা আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। গয়নার বাক্স থেকে একটি সোনার চেইন, কানের দুল, একজোড়া চিকন সোনার চুড়ি বের করে বলল,
-‘এগুলো তোমারই গয়না। বিয়ের সময় উপহার পেয়েছ। এগুলো পড়ে যাও। রাতের খাবারও দিয়ে আসা হবে। পল্লব গেছে ভাতিজির জন্য জামাকাপড় কিনতে। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো।’
নির্লিপ্ত কণ্ঠে শাহিনুর বলল,
-‘আমার আসল অলংকারই হারিয়ে গেছে। এসব দিয়ে কী করব!’
করুণ চোখে তাকাল প্রেরণা। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘চুড়ি দু’টো পড়ে যাও। এ নিয়ে আর কথা বাড়ালে বিরক্ত হবো।’
কথা শুনল শাহিনুর। এর মধ্যেই বাড়ির সকলের কানে পৌঁছে গেল শাহিনুর পরিত্যক্ত বাইজি গৃহে যাচ্ছে। কেউ অবাক হলো, বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। কেউ ভয়ে শিউরে ওঠল। প্রেরণা দু’জন ভৃত্য’কে তার সঙ্গে যেতে বললে তারা কেউ রাজি হলো না। কীসব ভূতুরে কাহিনী শুনিয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল৷ বিরক্ত হয়ে অরুণা সখিনা’কে বলল,
-‘আজ তুই যা রাতটা কাটিয়ে সকালে আসিস। তোর তো ওখানে থেকে অভ্যাস আছে।’
চোখে মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে সখিনা উত্তর দিলো,
-‘না গো না। আমার পোলার শরীরডা এমনেই ভালা না। আপনাদের পোলায় জানলেও রাগ করব।’
ভাবটি এমন যেন অঙ্গন তার ব্যাপারে ভীষণ যত্নশীল। শাহিনুর তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-‘কাউকেই যেতে হবে না বড়োম্মা। আমি একাই যেতে পারব। যেখানে জন্মেছি, যেখানে বড়ো হয়েছি, সেখানে যেতে কোন ভয় বা লজ্জা কোনটাই আমি পাই না৷ আমি আমার শেকড় ভুলে যাইনি।’
সখিনা হঠাৎ ঠাশ করে বলল,
-‘তুই কি কথাডা আমারে শুনাইলি।’
সঙ্গে সঙ্গে শাহিনুর প্রতিত্তোর করল,
-‘তুই নয় আপনি বল, মনে রাখিস তোর ছেলেকে যে পিতৃ পরিচয় দিয়েছে তার বড়ো ভাবি আমি!’
থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল সখিনার। সকলের দিকে তাকাল সে। কেউ যদি তার হয়ে একটি কথা বলত বড়ো শান্তি পেত। কিন্তু তার মনে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে কেউ তার পক্ষে একটি কথাও বলল না। চোখেমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে অরুণা শবনম’কে আদেশ করল। যেন সে শাহিনুরের সঙ্গে বাইজি গৃহে যায়। বাচ্চাটার কিছু কাপড়চোপড় যেন নিয়ে যায়। রাতের খাবারটাও পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সকালের আগে যেন শাহিনুর’কে ছেড়ে না আসে৷ কোন সমস্যা হলে খবর পাঠানোর জন্য ভৃত্য ইকবাল’কেও পাঠালো। আজ থেকে পরিত্যক্ত বাইজি গৃহের নতুন দৌবারিক হিসেবে নিযুক্ত করা হলো ইকবাল’কে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে জেবা। অতিরিক্ত সহজসরল মেয়েদের এই এক সমস্যা। ছোট্ট ছোট্ট বিষয়েই তারা খুব কষ্ট পায়। তাদের হৃদয়ে পরিবারের সকল সদস্যের প্রতিই ভীষণ মায়া থাকে। অরুণা, প্রেরণা বিরক্ত হলো খুব। শবনম তাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-‘বোকার মতো কাঁদছ কেন? হয় সঙ্গে চলো নয়তো কান্না বন্ধ করো।’
-‘ওখানে নাকি অতৃপ্ত আত্মা আছে? আমার খুব ভয় লাগে!’
-‘তাহলে এই কান্না বন্ধ করো।’
শবনমের কোলে শাহিনুরের মেয়ে ছিল। সে তাকে আরেকটু বুকে জড়িয়ে পা বাড়াল। জেবা পেছন থেকে তার আঁচল টেনে ধরল। বলল,
-‘দিনের বেলা অতো ভয় লাগবে না। আমি কাল সকালে যাব।’
গম্ভীর স্বরে শবনম জবাব দিলো,
-‘হুম এখন ভেতরে যাও।’
ইকবাল আগে শাহিনুর পেছনে শবনম তার পাশাপাশি যাচ্ছে। চারদিকে মাগরিবের আজান ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ মুনতাহার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ বিস্মিত হয়ে ইকবাল’কে প্রশ্ন করল,
-‘কোথায় যাচ্ছেন?’
-‘বাইজি গৃহে। আজ থেকে নতুন ভাবি ওখানেই থাকবে।’
কিঞ্চিৎ ঘাড় উঁচু করে পেছনে তাকাল। মৃদু পায়ে শাহিনুরের সামনে এসে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,
-‘যে যে স্থানের যোগ্য!’
শাহিনুর কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না৷ বরং তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে এগিয়ে চললো। মুনতাহা শবনম’কে দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল,
-‘তুমি যাচ্ছ কেন!’
-‘আমি বাড়ির বড়ো বউ। আমার দায়িত্ব অনেক বেশি। এত ছোটো বাচ্চা নিয়ে ওকে একা ছেড়ে দিতে পারি না।’
অকপটে জবাব পেয়ে মুনতাহা সন্তুষ্ট হলো না। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল৷
[১১১]
বাইজি গৃহের প্রধান ফটক পেরোতেই শাহিনুরের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠল। হাঁটা পা থেমে গেল। চোখ বন্ধ করে ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ল। শৈশবের কতশত স্মৃতিরা অন্তঃকোণে নাড়া দিলো হিসেব নেই। হঠাৎ বদ্ধ চোখ দু’টি খুলল। বামদিকে ফিরে দেখল, ছোট্ট টিনের ঘরটি ঝোপঝাড়, মাকড়সার জালে আবৃত হয়ে আছে। বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে পড়ল শেষবার যখন এই ঘরে প্রবেশ করেছিল, রঙ্গনের জন্য মরণ বিষ নিয়ে বেরিয়েছিল! মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক কুচকুচে কাক উড়ে যেতেই চমকে ওঠল শবনম৷ শাহিনুরও চমকাল। তার মেয়েটা সহসা কেঁদে ওঠল। শবনম তাকে বুকে জড়িয়ে দোয়া, দরূদ পড়তে শুরু করল৷ শাহিনুর ক্ষীণ স্বরে বলল,
-‘বড়ো ভাবি, ভয় পাচ্ছেন?’
-‘আল্লাহ ভরসা চলো।’
ইকবাল ভেতরে গিয়ে কারেন্টের লাইন ঠিক আছে কিনা দেখল। সকল লাইট, ফ্যানের সুইচ টিপে চেক করল। আসার সময় খেজুর গাছের ডাল কেটে নিয়েছিল৷ সে ডাল দিয়েই মাকড়সার জাল গুলো ছাড়াতে লাগল। ঝাড়ু দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করল। হাঁক ছেড়ে ডাকল,
-‘ভাবি’রা কই গো তাড়াতাড়ি আসেন। কোন ঘরে থাকবেন বলেন পরিষ্কার করে দেই।’
শাহিনুর যখন গৃহের ভেতরে প্রবেশ করল, সারা দেহে কাঁটা দিয়ে ওঠল। কেমন গা ছমছমে ভাব। গরম বাতাস শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে, পুরোনো পুরোনো অদ্ভূত গন্ধ আসছে। আটমাসের ব্যবধানে গৃহের চেহেরা কেমন বদলে গেছে। শবনম তার গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ শাহিনুর রুদ্ধ কণ্ঠে ইকবাল’কে বলল,
-‘ডানদিকের যে কোন একটি ঘর পরিষ্কার করুন।’
বা’দিকে তার মা’য়ের ঘর, মান্নাত বুবুর ঘর। তাছাড়া ডানদিকের ঘরের জানালা থেকে বাইজি গৃহের প্রধান ফটক স্পষ্ট দেখা যায়। সবটা বিবেচনা করেই ডানদিকের ঘর পরিষ্কার করতে বলল।

ডানদিকের তিন নাম্বার ঘর পরিষ্কার করে ইকবাল চলে গেল। সে ঘরে মেয়ে সহ শবনম’কে পাঠিয়ে আম্মার ঘরের দিকে পা বাড়াল শাহিনুর। শারমিন বাইজির কক্ষের সামনে যেতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল। উন্মুক্ত দ্বারের মেঝেতে বয়ে চলা সেই রক্তের স্রোতধারা মানস্পটে ভেসে ওঠল। আজ সেই রক্তের লাল বর্ণ কালচে বর্ণে পরিণত হয়েছে। ধুলাবালি, ছত্রাক সেই কালচে বর্ণকে খুব বেশি আড়াল করতে পারেনি। বিদঘুটে গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠল শাহিনুরের। অনুভব করল এক পাপীর রক্তের ঘ্রাণ চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। মরে গিয়েও নিজের শরীরী পঁচা গন্ধ বাইজি গৃহে ঠিক রেখে গেছে! আঁচল দিয়ে নাক চেপে ধরল শাহিনুর৷ ধীরপায়ে এগিয়ে চলল কক্ষের ভেতরে। বাইরের চেয়ে ভেতরের অবস্থা আরো খারাপ। দুর্গন্ধে টিকে থাকাও মুশকিল হয়ে পড়ল৷ কক্ষের প্রতিটি জানালা খোলা। দমকা হাওয়াতে ক্ষণে ক্ষণে ঠাশ ঠাশ শব্দ হচ্ছে। মাথায় দেওয়া যত্নশীল ঘোমটা বাতাসের ঝাপটায় কাঁধে পড়ে রইল। শরীর থেকে স্বেদজল নিঃসৃত হচ্ছে শাহিনুরের। বুকের ভিতর চলছে প্রবল উত্তেজনা। সহসা নাকে চেপে রাখা আঁচলখানা ছেড়ে দিয়ে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখল। কক্ষের দেয়ালে হাত বুলিয়ে সেই বাচ্চা শাহিনুরটি হয়ে গেল। ডাকল,
-‘ আম্মা, আম্মাগো, মান্নাত বুবু, ও বুবু!’
ঠোঁট কামড়ে ভিতর থেকে উপচে পড়া কান্নাগুলো আঁটকাল। মেঝেতে স্থির দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ল। খামচে ধরল, শুকিয়ে যাওয়া কালচে রক্তের দাগে মাখামাখি তলোয়ারটি। আম্মার দেওয়া শেষ উপদেশ, শেষ উপহারটি সযত্নে নিজের কাছে রাখবে বলে তলোয়ারটি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।
___
ডাক্তার বলল,
-‘আপনার রোগি ভীষণ স্ট্রং। যতটুকু বুঝলাম মনের জোর অনেক বেশি। সাধারণত প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। আপনার রোগির উদ্দেশ্য কি জানি না৷ তবে এটুকু বলতে পারি সেই উদ্দেশ্যের প্রতি এতটাই আকর্ষণ, মনোবল এত প্রখোর যে ‘ভেজিটেটিভ স্টেট’ থেকে মাত্র তিন সপ্তাহেই ফিরে এসেছে। যে পেশেন্ট বাঁচতে চায়, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে চায় তার সফলতা ৯৯%।’
রমেশ বলল,
-‘ও ভীষণ ব্যক্তিত্ববান ডাক্তার। একদম নির্ভেজাল ব্যক্তিত্বের মানুষ। আর ওর ভালোবাসা ওর ব্যক্তিত্বের চেয়েও নির্ভেজাল, নিখুঁত।’
বিস্মিত হয়ে ডাক্তার বলল,
-‘ওহ আই সি, এসব দেখলে, শুনলে সত্যি বিশ্বাস হয় পৃথিবীতে সত্যিকারের ভালোবাসা আজো বেঁচে আছে। এ প্রথম এমন একজন কোমা পেশেন্ট পেলাম।’
-‘এবার করণীয়?’
নড়েচড়ে বসলেন ডাক্তার। পুরোপুরি বোঝানের উদ্দেশ্যে সবটা খুলে বললেন,
– ‘সাধারণত কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোমার একটি পরিসমাপ্তি ঘটে। হয় রোগী আবার জেগে ওঠে বা সচেতন হয়, নয়তো মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু বিরল ক্ষেত্রে কেউ কেউ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কোমায় থাকতে পারে। কোমার কাছাকাছি দুটি শব্দ হলো ‘ব্রেইন ডেথ’ আর ‘ভেজিটেটিভ স্টেট’। ব্রেইন ডেথ অর্থ, মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি বা মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম থেমে যাওয়া। আর ভেজিটেটিভ স্টেট অর্থ, রোগীর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে, কিন্তু চেতনা দিয়ে বা স্বেচ্ছায় কিছু করতে পারে না। বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই? আপনার পেশেন্টের মস্তিষ্ক সজাগ ছিল, এখনো আছে, আজ বিকেলে মাত্র দু’টো কথা বলেছে। বাকিগুলো বোঝা যায়নি। আশা করছি ধীরে ধীরে বাকিটাও সেরে যাবে।’
-‘ কিন্তু ওর পা!’
-‘আই থিংক আমৃত্যু পঙ্গুত্বকে বরণ করে বাঁচতে হবে!’
কেবিনের বাইরে চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অঙ্গন৷ রমেশ ডাক্তারের সঙ্গে কথা শেষ করে এসে বলল,
-‘প্রণয়ের কেবিনে চল। এ পর্যন্ত দু’টো কথা বলেছে। দু’টোই বউ, বাচ্চা নিয়ে অথচ নিজের দিকে এখনো খেয়াল দেয়নি।’
থমথমে গলায় অঙ্গন বলল,
-‘ডাক্তার কী বলল?’
-‘ওর মস্তিষ্ক সজাগ আছে কথা বলতে পারবে। তবে বেশি কথা বলা নিষেধ।’
প্রণয়ের কেবিনে ঢুকতেই নার্স’রা বেরিয়ে গেল৷ স্যালাইন চলছে। একদৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে প্রণয়। দু’জন মানুষ তার পাশে এসে বসেছে। টের পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না। অঙ্গন হাত বাড়িয়ে তার বুকে স্পর্শ করল। অনুভব করল, বুকের ভিতর অস্বাভাবিক ঢিপঢিপ করছে। এক ঢোক গিলে মৃদুস্বরে ডাকল,
-‘ভাই।’
কেঁপে ওঠল প্রণয়। নিজে ঘুরল না, শুধু চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখল অঙ্গন’কে। অঙ্গন তার বুকে আরেকটু শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল,
-‘নতুন ভাবি একদম ঠিক আছে ভাই। তোমার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। ঠিক তোমার মতো, নতুন ভাবি নাম রাখেনি। তুমি ছাড়া কাউকেই নাম রাখতে দেবে না।’
কথাগুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠল অঙ্গন। রমেশ ওর কাঁধ চেপে ধরল। চাপা গলায় বলল,
-‘কী করছ! তুমি এমন করলে ও ভেঙে পড়বে।’
অঙ্গন শান্ত হলো, খেয়াল করল প্রণয় ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে। বার বার নিজের শরীরের দিকে তাকাচ্ছে। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে, হয়তো ওঠার চেষ্টা করছে। কোমড়ে ভর দিতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে নিচের অংশের সাদা ব্যান্ডেজ গুলোকে দেখছে। হঠাৎ চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে ওঠল,
-‘আমার পা!’
[১১২]
বাইজি গৃহে তিনমাস কেটে গেল। সারারাত বিছানায় ছটফট করে শাহিনুর। নিদ্রাহীন রাতগুলো বড়ো যন্ত্রণায় ডুবিয়ে রাখে তাকে। প্রতি মাঝরাতে শবনম এক ঘুম দিয়ে ওঠে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখতে পায়, শাহিনুর বিছানার এক কোণায় জানালা ঘেসে বসে আছে। তার চুলের লম্বা বিনুনিটা সন্তর্পণে পড়ে আছে বিছানায়৷ পৃষ্ঠদেশে চোখ পড়তেই বুঝতে পারে মেয়েটার নিঃশ্বাসে প্রবল আন্দোলন হচ্ছে। এটুকুন মেয়ে জীবনে আর কত যুদ্ধ করবে? ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। স্বামী সোহাগি বউ’রা স্বামী ছাড়া দুনিয়াতে টিকতে পারে না। শাহিনুরও পারছে না৷ এত দহনেও এক টুকরো সুখের আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। স্মৃতির পাতায় বার বার ভেসে ওঠে প্রণয়ের ভালোবাসার ছোঁয়া, প্রেমময় কাব্যগুলো। মানুষ’টা সর্বস্ব দিয়ে তাকে ভালোবেসেছে। এই বাইজি গৃহের বাইজিরা শুধু পুরুষ চিনত৷ কিন্তু সে পুরুষের পাশাপাশি একজন প্রেমিক পুরুষ, আদর্শ স্বামী’কেও চিনেছে৷ এই গৃহের আনাচে-কানাচে অসংখ্য নারীদের চিৎকার মিশে আছে, শীৎকার মিশে আছে। শুনেছিল বাইজি বুবুরা পুরুষের স্পর্শে চিৎকার করতো, ক্লেশ মিশ্রিত শীৎকার করতো। কত ভয় ছিল তার এই পুরুষদের নিয়ে, অবুঝ মনে শুধু জানতো পুরুষ মানেই মন্দলোক। অথচ আজ সে জানে পুরুষ মানে আস্ত এক ভালোবাসা। তবে সব পুরুষ নয়, সব পুরুষ তো আর তার প্রেমিক পুরুষটির মতো নয়৷ পুরুষে পুরুষে তফাৎ অনেক। সব পুরুষ যত্ন নিয়ে ভালোবাসতে পারে না। সব পুরুষ যত্ন নিয়ে শারীরিক সুখ নিতে জানে না। বাইজিদের কপালে যেসব পুরুষ জুটেছে তারা শুধু সুখ নিতে জানে দিতে জানে না৷ প্রণয় সেই পুরুষ যে ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসাকে জিতে নিয়েছে। প্রেমের মতো গভীর অনুভূতি দিয়ে অর্জন করে নিয়েছে শাহিনুরকে। তার স্পর্শে কখনো চিৎকার আসেনি, ক্লেশবোধ হয়নি৷ যে স্পর্শে যত্ন থাকে সে স্পর্শের প্রতি নারীরাও যত্নশীল হয়। শাহিনুরও হয়েছিল। তাই তো তাদের যত্নের ফল হিসেবে দুনিয়াতে তাদের সন্তান এসেছে।
___
মেয়ের বয়স চারমাস চলছে। মা’য়ের মতো ধবধবে ফর্সা হলেও মুখের গড়ন বাবার মতোই মনে হচ্ছে। ছোট্ট দেহখানি আগের তুলনায় একটু বেড়েছে। হাত, পা প্রচণ্ড নাড়ায়। অরুণা বলেছে, এই মেয়ে ভীষণ দুষ্টু হবে৷ শবনম বলেছে ভীষণ বুদ্ধিমতী হবে। জেবা বলেছে মায়ের চেয়েও বেশি রূপবতী হবে। মুখ দিয়ে অবিরত শিশুসুলভ শব্দ করে বলে সেদিন প্রেরণা এসে বলল,
-‘প্রণয় ছয়’মাস বয়স থেকেই বু,বু করেছে। আটমাসে আম্মা ডেকেছে আম’ বলে আর আব্বাকে ডেকেছে স্পষ্ট বাবাহ বলে। তার ধারণা প্রণয়ের মতোই তাড়াতাড়ি ডাকবে তার নাতনি। আর প্রথম তাকেই ডাকবে বু, বু করে।’
শাশুড়ির কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে হেসে ফেলেছিল শাহিনুর। অদ্ভুত এক সুখ লাগছিল তার। সেদিনের পর থেকেই নামাজ পড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে, মেয়ের মুখে প্রথম বাবা ডাক যেন মেয়ের বাবার শোনার ভাগ্য হয়৷ এরপরের দিন বিকেলবেলা। শাহিনুরের মেয়েকে নিয়ে শবনম পাঁচফোড়ন গৃহে গেছে৷ শাহিনুর অবসর সময় পেয়ে জানালার কাছে বসে আছে। উদাসীনতায় আচ্ছন্ন মন৷ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রধান ফটকের পথটাতে৷ এই পথে মনে প্রাণে যার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে সে না এলেও তার কন্যাটি ঠিক আসবে। ভাগ্যিস মেয়েটা ছিল। নয়তো কবেই পাগল হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তো৷ তার ডাক্তারসাহেবের ভালোবাসার একটা অংশ তো রয়েছে! নয়তো বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। চাতক পাখিটির মতো তাকিয়েছিল সে৷ হঠাৎ ইকবালের কাছে একজন অপরিচিত ছেলে একটি খাম দিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বলে চোখের নিমিষে চলে গেল। শাহিনুরও সত্বর গতিতে পালঙ্ক ছেড়ে ছুটে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে ইকবালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘আমার চিঠি?’
হতভম্ব হয়ে শাহিনুরকে আপাদমস্তক দেখে খামটা এগিয়ে দিলো ইকবাল। শাহিনুর খপ করে খামটা নিয়ে ফিরে গেল৷ কক্ষে গিয়ে দ্বার রুদ্ধ করে দিলো।বুকের ভিতরের যন্ত্রটা কাঁপছে ভীষণ। হাত, পা অসাড় লাগছে। ধীরে ধীরে শরীরের কাঁপন বাড়ল। হাড়কাঁপানো শীতে যেমন কাঁপতে কাঁপতে দাঁতে দাঁত লাগে। তেমনিভাবে দাঁতে দাঁত লাগতে শুরু করল। সাদা কাগজের ভাঁজ’টা খুলতেই যখন, অক্ষর যোগে শব্দ বুননে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে পেল হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদেও ওঠল। পরোক্ষণেই উদভ্রান্তের মতো চোখমুখ মুছে তীক্ষ্ণ নজরে লেখাগুলো দেখল। পরিবর্তন খুঁজেও পেল আগের মতো সুন্দর সাবলীল লেখা নেই। কিছু একটা আঁচ করতেই মনে ভয় সৃষ্টি হলো। কাগজটা বুকে চেপে ধরে নিঃশ্বাসের অস্থিরতা কমাল। পুনরায় আবার দৃষ্টি বোলালো লেখাগুলোতে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবগুলো লাইনও পড়ল,

প্রিয় সুখের আম্মু,
আমার আকাশে চাঁদ ওঠে কিন্তু জ্যোতি নেই।
থাকবে কি করে? আমার চাঁদ যে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। আমার চন্দ্রকান্তা আমার সুখ’কে নিয়েও সুখী হতে পারেনি। আমাদের আকাশে মেঘেদের রাজত্বের সময়টা খুবই অল্প। আমার চাঁদে মেঘ কাটবে, নিশ্চয়ই কাটবে৷ আমার চন্দ্রকান্তাও সুখী হবে। ঠিক যেভাবে আমায় সুখী করেছে সেভাবেই। মেয়ের নাম রেখেছি “শায়েরা জাহান প্রীতি” প্রণয়কন্যা- প্রীতি। এ নামের বিশ্লেষণ হচ্ছে – সে আমাদের সন্তুষ্টি, তৃপ্তি, প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, সর্বোপরি সে আমাদের সুখ।
ইতি তোমার,
প্রিয় সুখের আব্বু।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।