‘আপনার বাবা বেছে বেছে তাদেরই নিজের দলে টানে যাদের পরিবারে খুবই অভাব। খেয়ে পড়ে বাচাঁ মুশকিল। কেননা একমাত্র তারাই বোঝে টাকার কতটা মূল্য! তারা পরিবারের সবাইকে সুখি রাখতে সবকিছু করতে রাজি থাকে। সম্পান, সিরাজ আর আমি!! এই তিনজনই আপনার বাবার শিকার মাত্র। কিন্ত আমার বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আপনার বাবার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। নিজেকে অনেক চতুর মনে করে আপনার বাবা। কিন্ত শেষে সে নিজের জালে নিজেই ফেসেছে। যারা যারা আপনার বাবার কর্মচারী ছিলো তাদের কোন না কোনভাবে হ*ত্যা করেছেন আপনার বাবা। কারণ আপনার বাবার সব অ*প*কর্মের স্বাক্ষী ছিল তারা। আমাকেও এতদিনে মে*রে ফেলতেন কিন্ত পারেনি। কেন জানেন? কারণ আপনার বাবার কু*কৃ*র্তির সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমি যদি মা*রা যাই তাহলে সব প্রমাণ পুলিশের হাতে চলে যাবে এজন্যই আপনার বাবা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আর সম্পান কে মে*রে ফেলেছেন। সিরাজ কে বাঁচিয়ে রেখেছেন কারণ ও আপনার বাবার মতোই নির্দয়। টাকার বিনিময়ে ও সব করতে পারে। এজন্য আপনার বোনকেও ফা*সিয়েছে। শুধুমাত্র টাকার জন্য মানুষ ভুলে যায় সে একজন মানুষ।’
শায়ের দম ফেলে পরীর দিকে তাকাল। পরী এখনও শায়েরের বুকে মাথা রেখে আছে। শায়ের বলল, ‘আপনি কি শুনছেন পরীজান?’
‘হুম শুনছি। আপনিও তো টাকার জন্য খু*ন করেছেন।’
‘ভুল পরীজান। টাকার জন্য আমি সব করলেও খু*ন করিনি। আমি প্রথম খু*ন করি পালককে।’
পরী মাথা তুলে শায়েরের দিকে তাকালো,’কেন খু*ন করলেন তা সম্পূর্ণটা এখনও আপনি আমাকে বললেন না। আজ অন্তত বলুন!!’
পরী অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। শায়ের আবার বলতে শুরু করে,’পালকের কোন দো*ষ নেই অন্তত আপনার দৃষ্টি থেকে। পালকের ধর্ম ভিন্ন তা কি আপনি জানেন? তবুও সে আমাকে পেতে চেয়েছিল। এতে আমি ওর কোন দো*ষ দেখি না। মানুষ জাতি বড়ই অদ্ভুত পরীজান। কখন কার দৃষ্টিতে কে আটকে যায় তা বলা মুশকিল। সেজন্যই পালক আমাতে আটকে ছিল। আমি পালককে হ*ত্যা করতাম না। কিন্ত শেষে সে সবকিছু জেনে গেল। শুধু তাই নয় সে আমাকে হু*মকি দিল যে সে আপনাকে সব বলে দিবে। যদি আমি তাকে বিয়ে করি তাহলে সে চুপ থাকবে। সুযোগের সদ্যব্যবহার,তবে তার দো*ষ আমি দেখি না। ভালোবাসা পেতে আমি নিজেই খু*ন করেছি আর সে তো হু*মকি দিয়েছে মাত্র। তখন কানাইকে নিয়ে ঝা*মেলা চলছিল তার মধ্যে পালক চলে আসে। মাথা কাজ করছিল না তাই ওর মুখ বন্ধ করার জন্য মে*রে দিয়েছি।
তারপর আরো পাঁচজন কে মে*রেছি আমি। চারজন ছিল বিন্দুর ধ*র্ষ*ণ*কা*রী। মেয়েদের সম্মান না করলেও অসম্মান করি না আমি। সম্পান ও। ওইদিন বিন্দুকে মা*রা*র কোন পরিকল্পনা ছিল না। সম্পান কে প্রথমে আপনার বি*রুদ্ধে নেওয়া হয়েছিল। কিন্ত সে আপনার আর বিন্দুর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ। এ থেকে আমি বুঝতে পারলাম নারীর ভালোবাসা হিং*স্র মানবকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।
সম্পান নিজে থেকে আপনার বাবার কাজ ছাড়তে চেয়েছিল কিন্ত আপনার বাবা আপনাকে মা*রার পর তাকে যেতে বলেছিল। কিন্ত সম্পান তা নাকচ করে দেয়। তারপর বিন্দুকে মা*রার হুমকি দেন আপনার বাবা। নিজের ভালোবাসা বাঁচাতে সম্পান আমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে চাইল। কিন্ত সে জানতো আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে পরিকল্পনা করেই যাত্রা দেখতে পাঠানো হয় যাতে আমি কিছু জানতে না পারি। তবে সেদিন সম্পান ওখানে গিয়ে আমাকে খবরটা দেয়। আমাদের আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে সব শেষ। সম্পান নিজের ভালোবাসাকে ওইভাবে দেখতে পারেনি তাই ছয় জনের মধ্যে দুজনকে ওখানেই মে*রে দেয়। আর বাকি চারজনকে আমি মা*রি। বিন্দু যদি বেঁচে থাকতো তাহলে সম্পানের বধূ হয়ে আজ ওর ঘরে থাকতো। কিন্ত বিধাতার কি লিখন। দুজনকেই তিনি টেনে নিয়েছেন। আমি আর সম্পান হিং*স্র*তাকে জিততে দেইনি পরীজান। ভালোবাসাকে জয়ী করেছি। ভালোবেসে ওরা দুজন প্রা*ণ দিয়েছে আর আমরা দুজন একসাথে রয়েছি।’
-‘আর নাঈমকে কেন মিথ্যা আ*সামী বানালেন?’
-‘মিথ্যা আ*সামী তাকে বানিয়েছে নওশাদ। আপনার বিয়ে ভাঙার সব পরিকল্পনা নওশাদের ছিল। আমি জানতাম আপনাকে আমি শেখরের মতো করে সুখি রাখতে পারব না। তাই আপনার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্ত মাঝপথে জানতে পারলাম যে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তারপর আপনার বাবা পরিকল্পনা করে আপনাকে মে*রে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেবে আর গ্রামের লোকেরা ভাববে বিয়ে ভাঙার কষ্টে আপনি আ*ত্ম*হ*ত্যা করেছেন। আমি তা হতে দেইনি। আপনার বাবাকে বলেছি আমি আপনাকে বিয়ে করব এবং আমার গ্রামে নিয়ে গিয়ে হ*ত্যা করব। কিন্ত বিশ্বাস করুন পরীজান আমি আপনার সাথে সুখে থাকতে চেয়েছি শুধু। কিন্ত সেই সুখটাও ওরা কেড়ে নিল। আমি মানছি আমি পাপ করেছি।’
কথাগুলো শেষ করে পরীর দিকে তাকালো শায়ের। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে পরীর। সে মুচকি হেসে বলে,’আমি জীবনে অনেক পা*প করেছি কিন্ত পূণ্য করেছি আপনাকে ভালোবেসে। এর চেয়ে পবিত্রতা বুঝি দুনিয়াতে নেই।’
-‘এজন্যই তো এতো ভালোবাসা আমার কপালে সইলো না মালি সাহেব। যু*দ্ধে নামতে হয়েছে আমাদের। সেখানে আপনি আমার শ*ত্রু*পক্ষ।’
-‘শত্রুপক্ষ যে আপনাকে ভিশন ভালোবাসে। ত*লো*য়া*রের আঘাতে নয় শ*ত্রু*র ভালোবাসায় আপনার দম বন্ধ হয়ে আসবে পরীজান।’
-‘আমি যে এই যুদ্ধে প্রাণ হারাব মালি সাহেব। তখন আপনি কি করবেন?’
-‘আপনাকে রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব।’
-‘আমি মারা গেলে আমার কবরের পাশে একটা বেলি ফুল গাছ লাগাবেন মালি সাহেব!! আমার দেহটা পঁচে সার হয়ে মিশে যাবে ওই গাছে। আর প্রতিটি ফুলের ঘ্রাণে আপনি আমাকে পাবেন।’
এই প্রথম শায়ের পরীর কথার জবাব দিতে পারল না। সে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল পরীজানের পানে। পরী দেখতে পেল ক্ষত বিক্ষত চোখদুটো। ওই চোখে কত ভালোবাসা দেখেছে সে। আর আজ ওই চোখজোড়া সে নিমিষেই রক্তাক্ত করে দিয়েছে। আচমকা পরীকে শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করে শায়ের। বলে ওঠে,’আপনাকে এভাবেই ধরে রাখব আমি পরীজান। আপনি আর কোথাও যেতে পারবেন না। আচ্ছা,চলুন না আমরা ফিরে যাই আমাদের গ্রামে? আমরা ভাল থাকব।’
-‘কিন্তু আমার মা বোন ভাল থাকবে না। ওদের শেষ করে দেবে ওই জঘন্য লোকগুলো।’
-‘সবাইকে নিয়ে যাব আমরা। তাহলেই তো হবে।’
-‘এসব বাদ দিন। আমি আপনাকে একটু কাছে পেতে চাই। এই মুহূর্তটা স্মরণীয় করে রাখতে চাই।’
পরী আঁকড়ে ধরে স্বামীকে। শায়ের আজ নিজে থেকে সব সত্য স্বীকার করেছে অথচ পরীর রাগ হচ্ছে না। কারণ সে নওশাদের বিনাশ করতে পেরেছে তাই আজকে সে খুশি থাকবে। এই মধুরতম রাতটা শায়ের কে দিবে। ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ এঁকে দিবে। তাইতো সে এতো রাতে স্বামীকে তলব করে এনেছে।
সকাল হতেই ঘুম ভাঙে শায়েরের কিন্ত তার এই মুহূর্তে উঠতে একদম ইচ্ছে করছে না। পরীর উষ্ণ আলিঙ্গনে তার আরো থাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্ত সে ইচ্ছা ভঙ্গ করে পরীই উঠে দাঁড়াল। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে কলপাড়ের দিকে এগোলো। কিছুক্ষণ বাদে শায়ের নিজেও গেল কিন্ত উঠোনে আসতেই সে দেখতে পেল শেফালি আর কুসুম গোবর দিয়ে উঠোন লেপছে। বিষয়টা শায়েরের সন্দেহজনক মনে হল কিন্ত সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। কারণ আর কিছুক্ষণ বাদে তাকে অন্দর ত্যাগ করতে হবে। এটা পরীর হুকুম। তাই সে বিনা বাক্যে প্রস্থান করে।
বেলা দশটা বাজতেই ডাক পড়ল নওশাদের। তাকে বৈঠক ঘরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্দরে নওশাদ যাবে না এটা সবাই শতভাগ নিশ্চিত। তবে গেল কোথায়। সবাইকে খুঁজতে পাঠালো আফতাব। কিন্ত নওশাদের হদিস পাওয়া গেল না। আখির তাতে ক্ষেপে গিয়ে বলে,’নিশ্চয়ই পরী কিছু করেছে ভাই। সে’ই নওশাদ কে গুম করেছে। নাহলে রাতারাতি ছেলেটা উধাও হয় কীভাবে?’
-‘সত্যিই যদি পরী কিছু করে থাকে তাহলে ওর আজকেই শেষ দিন। শায়েরের কোন কথাই আমি শুনব না। এতে যা হয় হোক।’
আফতাব তার দলবল নিয়ে অন্দরের দিকে পা বাড়ায়। কিন্ত দরজা পর্যন্ত যেতেই শায়ের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আফতাব বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে,’সামনে থেকে সরে যাও শায়ের। আজ পরী বাঁচবে না। তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।’
-‘পরীজান কিছু করেনি। সে জানে না নওশাদ কোথায়!’
-‘তুমি এতটা নিশ্চিত হলে কীভাবে?’
-‘কাল সারাদিন নওশাদ আমাদের চোখের সামনেই ছিল। এমনকি রাতে আমার সামনে দিয়েই নিজের ঘরে গেল।’
-‘ঘুমানোর পর হয়তো পরী ওকে ধরে নিয়ে গেছে।’
-‘নাহ! কারণ কাল রাতে আমি পরীজানের সাথে ছিলাম।’
-‘তুমি ছিলে পরীর কাছে! কেন গিয়েছিলে?’
সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে শায়ের। রাগন্বিত হয়ে বোকা একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। শায়ের আবারও সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলে,’আপনি বড়ই নির্লজ্জ। একজন স্বামী তার স্ত্রীর কাছে কেন যায় সেটা কি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে জমিদার মশাই? আচ্ছা বাদ দিলাম আমার কথা। আপনি নিজ স্ত্রীকে ফেলে পর নারীর কাছে কেন যেতেন? সেটা কি আমি একবারও জিজ্ঞেস করেছি?’
শায়েরের কথা পুরোপুরি না শুনে রক্ষিরা সব চলে গেছে। এই মুহূর্তে শুধু আখির আর আফতাব দাঁড়িয়ে। শায়েরের কথা শুনে বিড়ম্বনায় পড়ল আফতাব। ভাইকে কিছু বলতে না দেখে আখির বলে উঠল,’তুমি মুখে মুখে তর্ক করো খুব। তুমি জানো কাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছো তুমি?’
-‘হুম! আমি মস্তিষ্কহীনদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কেন একথা বলছি জানেন? কারণ আপনাদের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। যারা আপনাদের সাহায্য করে তাদের কেই মে*রে ফেলেন আপনারা। তাহলে আপনাদের তো মস্তিষ্কহীন বলা উচিত তাই না?’
বিপরীতে আখির পাল্টা জবাব দিলো না। শায়ের আবার বলল,’পরীজানের দিকে নজর বুলাবেন না বলে দিলাম। নাহলে ফল খারাপ হবে।’
চলে গেল শায়ের। ক্ষোভে ফেটে পড়ে দুই ভাই। তাদের সমস্ত পরিকল্পনা সব শায়ের নষ্ট করে দিচ্ছে বারবার। আফতাব নিচুস্বরে বলে,’সিরাজ কে খবর দে। শায়ের কে আগে সরাতে হবে তারপর পরীকে সরাব। পুলিশ কে হাতের মুঠোয় নিতে আমার সময় লাগবে না। আগে একটা আপদ সরাই তারপর আরেকটাকে সরাব।’
কথাটা শেফালির কর্ণগোচর হয়ে গেল। সে দৌড়ে পরীকে গিয়ে খবর দিল। ওর বাবার সব পরিকল্পনা জানিয়ে দিলো। পরী চুপ থেকে সব শুনল। তারপর বেশ শান্ত ভাবেই নিজ ঘরে চলে গেল। শেফালি বুঝল যে ঝড় আসতে চলেছে। পরীর চুপ থাকা মানেই ঝড়ের পূর্বাভাস। কিছুক্ষণ বাদে পরী ঘর থেকে বের হয়ে আসে। শেফালিকে বলে,’তোরা তৈরি থাক পরবর্তী শিকার সিরাজ।’