২০০৯ সাল। বাংলায় কার্তিকের শেষ সপ্তাহের উষালগ্ন। গতিশীল ট্রেনটি স্টেশনে এসে থেমেছে। সকল কামরা থেকে একে একে যাত্রীরা নামতে শুরু করেছে। তাদের খেয়াল করেই নিজের বুকের মাঝে লেপ্টে থাকা শাহিনুরের পাণ্ডুবর্ণ মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত করল প্রণয়৷ নিদ্রাহীন সারা রাত কাটিয়ে চোখ তুলে তাকাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল শাহিনুরের। তবুও সে প্রণয়ের পানে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। তার অমন চাহনি দেখে স্মিত হাসলো প্রণয়৷ বলল,
-‘ নামতে হবে। ‘
এ বাক্যে শাহিনুরের দৃষ্টিতে অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠল। কোথায় যাবে তারা? কীভাবে পালিয়ে বাঁচবে দু’জন? অস্থির চিত্তে বারকয়েক দু’চোখের পলক ফেলে প্রণয়ের পানে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ৷ সে দৃষ্টিজোড়ার ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলো না প্রণয়ের। তাই সে ভরসার সহিত বলল,
-‘ একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নেব। ‘
ট্রেন থেকে নামার পূর্বে প্রণয় নিজ হাতে নিকাব দিয়ে শাহিনুরের মুখমণ্ডল ঢেকে দিলো। নামার পরমুহূর্তে একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বরে ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকালো৷
-‘ এক্সকিউজ মি. আপনারা কোথায় থেকে এসেছেন? ‘
শাহিনুর কিঞ্চিৎ অবাক হওয়ার পাশাপাশি ভয়ও পেল। পর মুহুর্তে অচেনা মেয়ে এবং প্রণয়ের কথোপকথন শুনে তার ভয়টা কেটে গেল। অনুমান করা যায় মেয়েটির বয়স বাইশ কি তেইশ। তার করা প্রশ্নটি শুনে প্রণয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেয়েটির চোখে, মুখে সৌহার্দপূর্ণ হাসি৷ সে হাসিটি বজায় রেখেই পুনরায় বলল,
-‘ আপনাদের অপজিটে বসেই এসেছি। হয়তো খেয়াল করেননি। এমনিই জিজ্ঞেস করছি আকাশের অবস্থা সুবিধার নয়। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে আপনাদের কেউ নিতে আসবে নাকি স্টেশনে গিয়ে ভ্যান নেবেন? ‘
শাহিনুর কখনো মাথা নিচু করে রয়েছে, কখনো বা মেয়েটিকে দেখছে। প্রণয় প্রথমে বিরক্ত হলেও মেয়েটিকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল৷ মেয়েটির করা দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর না দিয়ে সে নিজেই প্রশ্ন করে বসল,
-‘ আপনার নাম? আই মিন পরিচয়? ‘
-‘ আমি সামান্তা। ‘
এরপরেও মেয়েটি কিছু বলার জন্য উদ্যত হয়েছিল৷ কিন্তু আকস্মিক বজ্রপাতের শব্দে আর বলতে পারলো না। একহাতে কাঁধের ব্যাগ ধরে অপরহাতে পরিহিত পাতলা জর্জেট শাড়ির কুঁচিগুলো উঁচিয়ে দৌড়ে গিয়ে সম্মুখের টং ঘরে দাঁড়ালো। তারপর প্রণয় এবং শাহিনুর উভয়কে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে ওঠল,
-‘ আরে আরে ভিজে যাচ্ছেন তো! এদিকটা ফাঁকা আছে। এখানে এসে দাঁড়ান। ‘
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর হুঁশ ফিরল প্রণয়ের। ভিজে যাচ্ছে শাহিনুর! এ দৃশ্য দেখতেই আর স্থির থাকতে পারলো না সে। একহাতে ব্যাগ অপরহাতে শাহিনুরের কোমল হাতটি চেপে ধরে টং ঘরের ভিতরে চলে গেল। মাটিতে বেশ শব্দ করে ভারি ব্যাগটা রেখে বোরখা এবং নিকাবের বহিরাংশের বৃষ্টির পানিগুলো ঝাড়তে শুরু করল। উৎকণ্ঠিত প্রণয়ের ব্যস্ত হয়ে এভাবে শাহিনুরের ভেজা শরীর শুকানোর পাঁয়তারা দেখে সামান্তা নামের মেয়েটি মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বলল,
-‘ আপনার বউ? ‘
এ প্রশ্নে আরেকদফা বিরক্ত হলো প্রণয়। বিরক্তি প্রকাশ করেই তার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ হ্যাঁ। ‘
যতটা বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে হ্যাঁ বলল মেয়েটির দিকে তাকানোর পর ঠিক ততটা বিরক্তি এলো না। বরং শরীরের কোন এক অংশ দুর্বল হয়ে পড়ল খুব। প্রণয়ের পাশ থেকে কিছুটা উঁকি দিয়ে শাহিনুরও তাকিয়ে দেখলো সামান্তা নামের মেয়েটিকে।
শীতের আগমনী বার্তা দেওয়ার জন্যই বোধহয় কার্তিক মাসের বিদায় মুহূর্তে ভারি বর্ষণ শুরু হলো। ট্রেন থেকে নামার পর বেশিরভাগ যাত্রীরাই বৃষ্টির কবলে পড়ে আশেপাশে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ ভিজতে ভিজতেই নিজেদের ঠিকানায় চলে যাচ্ছে। টং ঘরের ভিতরে স্ত্রীর হাত ধরে অনিশ্চিত জীবনে একটু নিশ্চয়তার প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়। সামান্তা নামের মেয়েটা হঠাৎ তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। মিটিমিটি হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল,
-‘ শহর থেকে মেয়ে পটিয়ে পালিয়ে এসেছেন নাকি? ‘
তপ্ত মেজাজে কঠিন কিছু কথা শোনাতে গিয়েও চুপ মেরে গেল প্রণয়৷ নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
-‘ হ্যাঁ। ‘
এমন উত্তরে সামান্তা বিচলিত হয়ে বলল,
-‘ সত্যি! অনুমান করে বলা কথাটা এভাবে মিলে গেল? তাহলে আপনারা তো বেশ বিপদে আছেন। যাবেন কোথায় আশপাশে আত্মীয় স্বজন আছে? ‘
আশপাশে সুক্ষ্ম নজর বুলিয়ে প্রণয় বলল,
-‘ কেউ নেই। ‘
সামান্তা বলল,
-‘ আপনি বেশ গম্ভীর মানুষ মনে হচ্ছে। এমন মানুষও প্রেম করে মেয়ে নিয়ে পালায়? কী আশ্চর্য! ‘
শাহিনুর কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রণয় এক পলক শাহিনুর’কে দেখে নিয়ে সামান্তার দিকে তাকালো। তার বিচক্ষণ দৃষ্টিজোড়ায় ধরা পড়ল এই নারীর দ্বারা তার উপকার হলেও হতে পারে। যদিও আগ বাড়িয়ে খাতির জমানো মেয়ে মানুষ তার পছন্দ নয়। তবুও কিছু কারণে মেয়েটির খাতিরে সায় দিলো সে। মেয়েটির দিকে কিছুটা ঝুঁকে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,
-‘ একটা ঘরের ব্যবস্থা করা যাবে? ‘
দুষ্টু হাসিতে গালে টোল পড়ল সামান্তার। সে টোল পড়া গালে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল প্রণয়। তার সে চোখে চোখ রেখে সামান্তা বলল,
-‘ পাশের মেয়েটা আপনার জন্য বৈধ হলে করা যাবে। কিন্তু বিশ্বাস করি কী করে? ‘
মৃদু হেসে অভয় দিয়ে দৃঢ়চিত্তে প্রণয় বলল,
-‘ পাশের মেয়েটা বৈধ। তার গর্ভে আমার যে অংশ রয়েছে সেও বৈধ। এবার বিশ্বাস করা না করা একান্তই আপনার বিষয়। ‘
বিস্মিত হয়ে শাহিনুরের দিকে তাকালো সামান্তা। বলল,
-‘ ও মা তুমি প্র্যাগনেন্ট? ক’মাস গো? দেখে তো বুঝতেই পারছি না। ‘
বিরক্তি প্রকাশ করে প্রণয় বলল,
-‘ আপনি ব্যবস্থা করতে পারবেন? ‘
-‘ আমার বাড়িতেই রুম খালি আছে। টিনসেট বিল্ডিং চলবে? ‘
প্রণয় হ্যাঁ সূচকে মাথা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘ এক রুমের ভাড়া কত নেবেন? ‘
উত্তরে সামান্তা বলল,
-‘ আরো দু’জন ভাড়াটিয়া আছে। তাদের একজন রুম ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল সহ দু’হাজার দেয় আরেকজন পনেরোশো দেয়। যিনি পনেরোশো দেয় উনি মা’য়ের দূরসম্পর্কের মামাতো ভাই। তাই পাঁচশ টাকা কম দেয়। আপনার সমস্যা আমি মা’কে বলে বলব, যাতে আপনার থেকেও পাঁচ’শ কম রাখে। ‘
অবাক হয়ে প্রণয় বলল,
-‘ আমার কী সমস্যা? ‘
সামান্তা আশপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘ মেয়ে নিয়ে পালিয়েছেন হাতে নিশ্চয়ই গোনা টাকা? এটা কী সমস্যা নয়? ‘
প্রণয় বুঝলো মেয়েটা বড্ড বেশি বুঝে, কথাও বলে বেশি। অতিরিক্ত পাকনামি পছন্দ না করলেও এই পাকনা মেয়েটার দ্বারা উপকারই হবে বলে মনে হচ্ছে। তাই সম্মতি দিয়ে বলল,
-‘ বৃষ্টি অনেক কমে গেছে আমার স্ত্রী অসুস্থ জলদি একটা ব্যবস্থা হলে উপকার হতো। ‘
স্ত্রী অসুস্থ এ কথা শুনতেই সামান্তা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে
স্যাঁতস্যাঁতে কাঁদা মাটিতে হাঁটতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করে প্রণয় আর শাহিনুরও পা বাড়ালো। কিন্তু খুব বেশি এগুতে পারলো না। কাঁদা মাটিতে হোঁচট খেলো অসংখ্যবার৷ শেষে বাঁধ্য হয়ে শাহিনুর’কে কোলে তুলে নিলো প্রণয়। বড়োসড়ো ব্যাগটাও কৌশলে একহাতে ধরে রাখলো। পিছু ফিরে একবার প্রণয়, শাহিনুরকে দেখে নিলো সামান্তা। বলতে চাইল,
-‘ লোকজন কিন্তু মাইন্ড করবে। ‘
পরোক্ষণেই ভাবলো একজন স্বামী তার স্ত্রী’কে সাহায্য করছে। এতে দোষের কিছু নেই। স্টেশন অবধি যেতে যেতে অসংখ্য আড়দৃষ্টি পড়ল ওদের ওপর। কেউ কেউ কানাঘুষা করল, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা মিটি মিটি হাসতে লাগলো। বাস স্টেশনে পৌঁছানোর পর পরিচিত এক ভ্যানওয়ালার দেখা পেল সামান্তা। তাই হাঁক ছেড়ে বলল,
-‘ চাচা বাড়ির সামনে দিয়ে আসেন তো। ‘
ভ্যানওয়ালা সামান্তার পেছনে থাকা প্রণয়কে কেমন করে যেন দেখলো। সামান্তা মৃদু হেসে বলল,
-‘ আমার খালাতো ভাই আর তার বউ। ভাবি অসুস্থ হাঁটা, চলা করতে পারে না। ‘
এ পর্যায় সামান্তার দিকে কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রণয়৷ সামান্তা হাসলো, প্রশস্ত হাসি। যেন তাদের উপকার করে ভীষণ আনন্দিত সে। ভ্যানের সামনে প্রণয় শাহিনুর বসল। পেছনে বসল সামান্তা। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সামান্তা ভাবলো, এতোক্ষণ সময় পরিচিত হলো, নিজের বাড়ির একটা রুম অবধি ভাড়া দিয়ে দিলো, অথচ লোকটার নামই জানা হলো না। আবার সঙ্গে থাকা বউটাও এখন অবধি কথা বলেনি। অথচ সে কত কথাই বলল। বউটা বোবা নাকি!
স্টেশন থেকে কাঁচা রাস্তার অনেকটা পথ যাওয়ার পর তিন গলির এক পাশে একটি বাড়ির সামনে এসে ভ্যান থামলো। সামান্তা ভাড়া মিটিয়ে দেওয়ার পর ভ্যানওয়ালা চলে গেল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মা’কে ডাকার পূর্বে প্রণয়কে প্রশ্ন করল,
-‘ আপনার নাম তো জানা হয়নি ? কী নাম আপনার?’
-‘ সুজন। ‘
-‘ আগে পড়ে কিছু নেই? ‘
এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না প্রণয়। সামান্তা উত্তরের অপেক্ষা না করেই শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ তোমার নাম কী? ‘
চট করে প্রণয় বলল,
– ‘ আমার মিসেস, শায়লা। ‘
-‘ ও কথা বলতে পারে না? বোবা নাকি! ‘
নড়েচড়ে দাঁড়ালো শাহিনুর৷ কিছু বলার জন্য ঠোঁটজোড়া ফাঁক করার মুহূর্তেই কিঞ্চিৎ ক্রোধ মিশ্রিত কণ্ঠে প্রণয় বলে ওঠল,
-‘ সে বোবা নয়, আপনার মতো বাচালও নয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। নামটা যেহেতু আমি বলেছি তাই সে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। ‘
মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে সামান্তা বলল,
-‘ ভেরী ইন্টারেস্টিং। ‘
[৯১]
সামান্তাদের বাড়ির পরিবেশ’টা খুব একটা পছন্দ করল না প্রণয়। এমন পরিবেশে অভ্যস্ত নয় সে। এবার থেকে অভ্যস্ত হতে হবে। পছন্দের মানুষ’টা পাশে থাকলে অপছন্দের জায়গাটাও পছন্দের হয়ে যায়৷ ঠিক যেমন বাইজিদের ঘৃণা করে আসা প্রণয় চৌধুরী বাইজি কন্যাকে মন দেওয়ার পাশাপাশি বাইজিদের প্রতিও তার ধারণা পাল্টে নিল। এত তাড়াতাড়ি থাকার বন্দোবস্ত করতে পেরে স্বস্তি ভরে শ্বাস নিলো প্রণয়। সবচেয়ে বড়ো কথা সামান্তার মাঝবয়েসী মা’য়ের আচরণে মুগ্ধ হলো সে৷ মহিলার নাম সানজি খানম। স্বামী হারিয়েছেন প্রায় দশ বছর আগে। দুই ছেলে, মেয়ে নিয়ে বেশ কষ্টের সংসার তার। বাবার বাড়ির ওয়ারিশ পেয়েছিল বলে স্বামীর ভিটেয় থাকার মতো একটা সুন্দর ব্যবস্থা করতে পেরেছে। ক্ষুদ্র আলাপচারিতায় এটুকুই জানতে পারলো প্রণয়। সকালের নাস্তা তৈরির জন্য সামান্তা তখন রান্নাঘরে। সানজি প্রণয় আর শাহিনুর’কে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখালো। পাশাপাশি দু’টো টিনসেট বিল্ডিং। বাড়ির ভেতরে ছোট্ট একটি উঠান। উঠানের এক পাশে চাপকল। কলের পাশেই পাশাপাশি শৌচাগার এবং স্নানাগার। দু’টো বিল্ডিংয়ের একটিতে দু’টো রুম৷ সেখানে সানজির মাঝবয়সী মামাতো ভাই আর কলেজে পড়ুয়া এক ছেলে থাকে। আর একটিতে সামান্তা, সানজি খানম থাকে। এ বিল্ডিংয়ে চারটা রুম থাকায় একটি ফাঁকাই পড়েছিল৷ সেটাই প্রণয়, শাহিনুর’কে দেওয়া হলো। সামান্তার বড়ো ভাই ঢাকা শহরে থাকে। তার পেশা সম্পর্কে প্রণয়কে তেমন কিছু বলা হলো না। সে এখানে থাকে না এটুকুই বলা হলো মাত্র। সব ঠিকই ছিল শুধু চিন্তা হলো একটি বিষয় নিয়ে, সবার জন্য একটিই চাপকল, একটি শৌচাগার, স্নানাগার। যা প্রণয়ের কাছে শোভনীয় লাগল না।
নাস্তা তৈরি করে সামান্তা খেতে ডাকল ওদের। প্রণয় শাহিনুর দু’জনই হাত,মুখ ধুতে গেল। ভিতর থেকে সামান্তা খেয়াল করল, শাহিনুর’কে। এতক্ষণ নিকাবের আড়ালে থাকায় সেভাবে খেয়াল করেনি। তবে এবার ভীষণ চোখে লাগছে। নিঃসন্দেহে অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটা। এতক্ষণে বুঝতে পারলো সুজন নামক পুরুষটির স্ত্রীর প্রতি এত ভালোবাসার রহস্য। পুরুষ মানুষ রূপের পূজারী এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই সামান্তার। মুচকি হাসলো সে। পেছন থেকে সানজি বলল,
-‘ মেয়াডা বড়ো সুন্দরী। পোলাডাও মাশাআল্লাহ। ‘
-‘ এইজন্যই তো এত কদর। লোকটা নিঃসন্দেহে বউ পাগল। ‘
হাত,মুখ ধৌত করে ফিরে আসার পথে শাহিনুরের শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিল প্রণয়। শাহিনুরও সন্তর্পণে মাথায় ঘোমটা তুলে নিল। মৃদু হেসে প্রণয় ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পেছন পেছন শাহিনুরও পা বাড়ালো৷ এ কেমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য! মুগ্ধ চোখে তাকিয়েই রইল সামান্তা৷ টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে চারজনই বসল। শাহিনুর খেতে পারছিল না তেমন। বাচ্চাদের যেভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে খাওয়ানো হয় প্রণয়ও তেমন করে শাহিনুর’কে বোঝাতে লাগল। সানজিও শাহিনুর’কে বলল,
– ‘ খেয়ে নাও মা৷ এসময় অ’রুচি থাকলেও খেতে হয়। ‘
প্রণয় আকুতিভরা চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘ অল্প হলেও খেতে হবে৷ ‘
যদিও তার মন জানে শাহিনুরের বুকের ভিতর কী চলছে। তবুও স্বাভাবিক হতে হবে তো। যা কিছু ঘটেছে তা না হয় দুঃস্বপ্ন হিসেবেই ধরে নেবে৷ জোর পূর্বক শাহিনুরকে খাওয়ার পর প্রণয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তা দেখে সামান্তা মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলল,
-‘ আপনার মতো গম্ভীর টাইপ ছেলেরা এত বউ পাগল হয় জানতাম না। ‘
শাহিনুর অস্বস্তি, লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল। প্রণয় গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল শাহিনুরের পানে। সামান্তা লক্ষ করল প্রণয় প্রয়োজন ব্যতীত শাহিনুর থেকে ভুলেও দৃষ্টি সরায় না। যতটা সরায় প্রয়োজনের খাতিরেই। কী আশ্চর্য মানুষ!
নাস্তা শেষে সানজি বলল,
-‘ সুজন তুমি শায়লাকে নিয়ে এবার রুমে যাও। একটা বিছানা পাতাই আছে, তোমাদের আর বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে না। বাকিসব ধীরে ধীরে করে নিও। ‘
প্রণয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শাহিনুরকে নিয়ে তাদের রুমে গেল। মোটামুটি থাকার উপযুক্ত তাই দরজা আঁটকে সর্বপ্রথম শাহিনুর’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণের জমিয়ে রাখা আবেগগুলো যেন একেবারে উগ্রে বের হলো। ভেজা কণ্ঠে বলল,
-‘ স্বাভাবিক হও নুর। একটু চেষ্টা করো। আমাদের কোন অতীত নেই, আমাদের কোন অতীত নেই। ‘
ফুঁপিয়ে ওঠল শাহিনুর৷ প্রণয়ের বুকের ভিতরটা ভয়াবহ কাঁপতে শুরু করল। তা দীর্ঘক্ষণ পর টের পেল শাহিনুর৷ চমকে ওঠল সে। কান্না থামিয়ে প্রণয়ের বুকের বাম পাশে মুখ নিয়ে গাঢ় একটি চুমু খেল। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-‘ আপনি আজ অনেকগুলো মিথ্যা বলেছেন। এক বাইজি কন্যার প্রেমে এতটাই মরিয়া হয়েছেন যে এত ত্যাগ স্বীকার করলেন! সাজিয়ে গুছিয়ে এতগুলো মিথ্যা বললেন ! ‘
-‘ স্ত্রী, সন্তানের সুরক্ষায় একটা কেন অনায়াসে হাজারটা মিথ্যা বলতে পারব আমি। এর জন্য তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছো? এর সম্পূর্ণ দায় আমার। ‘
অভিমানী স্বরে শাহিনুর বলল,
-‘ সব দায় শুধু আপনার আমার যেন কিছুই নেই। ‘
লেখকের কথা: সারপ্রাইজ’টা কেমন লাগলো সবার? ভেবেছিলাম এক তারিখই দেব কিন্তু হঠাৎ করেই পেজে গিয়ে দেখি ১৩ হাজার ফলোয়ার ডান। এতদিন লেখা স্থগিত ছিল তবুও পাঠকদের ভালোবাসার কমতি নেই। আবেগে আপ্লুত হয়ে সারাদিন ব্যয় করে লিখেই ফেললাম ৫০তম পর্ব’টা। অনেকদিন গ্যাপ ছিল বলে লিখতে গিয়ে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ভুলগুলো চিহ্নিত করে কমেন্টে দিয়ে দেবেন আমি শুধরে নেব। সকল পাঠক’কে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসা।