পাঁচফোড়ন গৃহে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। কারো মুখে ‘রা’ নেই৷ নিস্তব্ধ গৃহের আনাচে-কানাচে গুমোট ভাব স্পষ্ট। এই গুমোট ভাবে প্রেরণার আচরণ আচমকাই বিস্ফোরণ ঘটাল। গৃহের সবাই যার যার কক্ষে বসে নিরবতা পালন করছিল। পল্লব প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে বসে ছিল বৈঠকখানায়। ইতিমধ্যেই গৃহের সমস্ত খবর প্রণয়ের কাছে পৌঁছে গেছে। হাসপাতালে কার্যভার অবস্থায় থাকাকালীনই গৃহের এক বিশ্বস্ত ভৃত্যের মধ্যমে খবর পেয়েছে প্রণয়। চোখের পলকেই কখন প্রণয় হাজির হয় আর কখন সংকীর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয় বলা যায় না। ভয়াবহ এই বিপদটুকু কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেই চিন্তায় কপালের ঘাম চুইয়ে চোয়াল বেয়ে পড়ছে তার। এদিকে মুনতাহা কক্ষে দ্বার দিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তার স্বামী’কে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এটুকুতেই যদি শেষ হতো তবে ঠিক ছিল, কিন্তু না প্রণয় যে বৈশিষ্ট্যের মানুষ না জানি কি করে ফেলে! সকলেই যখন প্রণয়ের ভয়ে তটস্থ, অরুণা যখন ক্রোধের তাড়নায় নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। প্রেরণা তখন উপায় না পেয়ে সকলের চিন্তা দূর করার জন্য প্রণয়ের কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হলো। শাহিনুর অনড় হয়ে বসে ছিল পালঙ্কে। শবনম পাশে বসে স্বান্তনা দিচ্ছিল তাকে। প্রেরণা সোজা কক্ষে ঢুকে শাহিনুরের সামনে দাঁড়াল। শাশুড়ি’কে কক্ষে দেখে শবনম, শাহিনুর দুজনেই পালঙ্ক ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল। প্রেরণা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি’তে শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
-‘আমার ছেলে যদি বাড়ি ঢুকে কোন প্রকার অশান্তি করে, কোনোদিন তোমার ভালো হবে না বলে দিলাম।’
শবনম, শাহিনুর দু’জনই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের মনে হলো তাদের সামনে কোন জমিদার গিন্নি দাঁড়িয়ে নেই। সম্মুখের মহিলাটি জমিদার গিন্নি হতে পারে না। পারে না কারো আদর্শ মা হতে। যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি প্রণয়ের মা’ও নন। হতে পারে তিনি প্রণয়’কে গর্ভে ধারণ করেছে কিন্তু মা নয়৷ সে কেবল পলাশের মতো কুলাঙ্গারের মা। এমন মা’য়ের অমন সন্তান থাকাই স্বাভাবিক। প্রণয়ের মতো আদর্শবান সন্তান তার গর্ভে এসেছে ভাবতেও সংশয় লাগল।
প্রেরণা আবার বলল,
-‘প্রণয় বাড়ি আসার পর যদি অশান্তি হওয়ার আগেই সবটা তুমি সামলাতে পারো ভালো কথা। নয়তো সকলের সামনে আজ আমি গলায় দড়ি দিব!’
প্রেরণার এই ভয়ানক বাণী শুনে শবনম,শাহিনুর দু’জনের দেহই নড়ে ওঠল। দ্বারের বাইরে থেকে তৎক্ষনাৎ তীব্র ক্রোধে জর্জরিত ভয়ানক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
-‘যে পরিস্থিতি তৈরি হলে আপনার ছেলেকে আপনি সামলাতে পারবেন না। সে পরিস্থিতি’তে তার স্ত্রী সামলাতে পারবে এই ধারণা কেন হলো!’
সহসা তিনটে প্রাণই আতঙ্কিত হয়ে ওঠল। দ্বারের বাইরে যন্ত্র মানবের ন্যায় অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়। তার শ্যামবর্ণীর চেহেরাটা হঠাৎই যেন কৃষ্ণবর্ণে রূপান্তরিত হয়েছে। স্পষ্ট এবং সুক্ষ্ম দৃষ্টিজোড়া রক্তিম বর্ণে নিমজ্জিত হয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে তার মধ্যে প্রাণ নেই, নিঃশ্বাস রুদ্ধ। প্রাণহীন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল প্রণয়,
-‘আমি এতটা মহান না। আমিও কিন্তু জমিদার অলিওরের সন্তান। হ্যাঁ আমার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা আছে, সম্মান আছে। তাই বলে সব পরিস্থিতি’তে তার বাধ্য হয়ে থাকার মতো পুরুষ আমি না। সবচেয়ে বড়ো কথা আমার স্ত্রী আমার কাছে নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। বাচ্চা’দের বায়না মেটানো যায় কিন্তু ভুল’কে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না।’
কিঞ্চিৎ ভীত হয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শাহিনুর। বারকয়েক ঢোক গিলে শুঁকনো গলা ভিজিয়ে নিল শবনম। প্রণয়ের পেছনে এসে দাঁড়াল পল্লব। ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করতে কাঁধে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গে হাতটা নামিয়ে দিল প্রণয়। তার প্রখর দৃষ্টিজোড়া মা প্রেরণার দিকে তখনো স্থির৷ ছলছল দৃষ্টিতে প্রেরণা কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই প্রণয় হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল৷ চোয়ালজোড়া শক্ত করে বলল,
-‘প্রশ্ন যেখানে স্ত্রীর সম্মানের সেখানে প্রণয়ের মতো নিষ্ঠুর প্রাণী এ ধরণীর বুকে দ্বিতীয় কেউ না’ও থাকতে পারে। আমার নিষ্ঠুরতা দেখতে চান আপনি, আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী প্রেরণা!’
চমকে ওঠল প্রেরণা। ছেলের চোখে নিজের প্রতি সীমাহীন ঘৃণা দেখে কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠল। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সে। তার কান্না দেখে প্রণয় রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। ঘাড় বাঁকিয়ে পল্লবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আপনার আম্মা’কে কাঁদতে নিষেধ করুন বড়ো ভাই। আর বলে দিন চোখের পানি দিয়ে আজ আমাকে আটকানো যাবে না। যে বাড়িতে আমার স্ত্রী নিরাপদ নয় সে বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকতে রাজি নই আমি।’
এ পর্যায়ে মাথা ধরে ধপাস করে বসে পড়ল প্রেরণা। শবনম আর পল্লব দু’জনই দ্রুত এসে ধরল প্রেরণা’কে। প্রণয় তখনও অনড় হয়ে রইল। শাহিনুরের দিকে না তাকিয়েই আদেশ করল,
-‘তৈরি হয়ে নাও আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
এমন একটি রূপ আজ প্রণয় দেখালো, যা দেখে আশ্চর্য হতে পারল না শাহিনুর। যেখানে স্বামী’কে নিয়ে গর্ববোধ করা উচিৎ সেখানে গণ্ডস্থল থেকে বক্ষঃস্থল পর্যন্ত শুঁকিয়ে কাঠের মতো নীরস হয়ে গেল তার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নিচু করে তৈরি হতে চলে গেল সে। এই বিধ্বস্ত অনুভূতি’তে শাহিনুরের বাধ্যতা কিঞ্চিৎ স্বস্তি দিল প্রণয়’কে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে সে আবার প্রেরণার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘আমি বরাবরই আপনার থেকে দূরে ছিলাম। শেষ অবধি আমিই দূরে থাকি। আপনি আপনার পুত্র পলাশ’কে নিয়েই থাকুন।’
দু’হাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে প্রেরণা চিৎকার করে ওঠল,
-‘আব্বা গো, ও আব্বা এতবড়ো শাস্তি তুমি আমারে দিও না আব্বা। আমি তোমাদের পেটে ধরছি, তোমরা কেউই আমার পর না। তোমরা সবাই আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন গো আব্বা।’
-‘আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার তো উপরওয়ালার কাছে শুকরিয়া জানানো উচিৎ। কারণ যা ঘটেছে এরপর একই বাড়িতে পলাশ চৌধুরী আর প্রণয় চৌধুরী থাকলে পলাশ চৌধুরীর মরা মুখ দেখার সম্ভাবনা ছিল আপনার। বড়ো আম্মা যদি আজ যোগ্য জবাব না দিত পলাশ চৌধুরী ভাবতেও পারছে না তার সাথে আমি কী করতাম!’
এহেন কথা শুনে প্রেরণা একদম চুপ মেরে গেল। নির্বাক হয়ে দেখল সারাজীবনের মতো পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে যাওয়া প্রণয়’কে। যাওয়ার পূর্বে প্রণয় আরো কয়েকটি কথা বলে গেল,
-‘এটা হওয়ারই ছিল। আপনার পুত্র বিষয়টা সহজ করে দিয়েছে। দূর থেকে আপনাদের জন্য যতটুকু করা যায় করব৷ আমার জন্য সবসময় আপনার দোয়া আছে জানি৷ আপনার দোয়াটুকু না রাখলেও চলবে শুধু দয়া করে আমার স্ত্রী’কে অভিশাপ দেবেন না। সব সময় মাথায় রাখবেন, নুরের ক্ষতি মানে আপনার নাড়িছেঁড়া ধন প্রণয়েরও ক্ষতি। তার কিছু হলে আপনার ছেলেকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে। কারণ সে আপনার ছেলের অর্ধাঙ্গিনী। সহজ ভাষায় অর্ধেক অঙ্গ!’
[৭১]
হাসপাতাল কোয়ার্টারে প্রণয়ের জন্য যে ফ্ল্যাটটি দেওয়া হয়েছে, সেটি বেশ বড়োসড়ো। দু’টো শোবার ঘর, একটি ভোজনালয়, একটি বসার ঘর, একটি রান্নাঘর। সবমিলিয়ে একটা সংসারের জন্য যথেষ্ট। পাঁচফোড়ন গৃহের মতো বড়োসড়ো খোলামেলা পরিবেশ নয়। তবুও অদ্ভুত এক শান্তি রয়েছে এখানে। সাজানো, গোছানো আস্ত একটি সংসার শাহিনুর’কে উপহার দিয়েছে প্রণয়। যেখানে নতুন করে তেমন কিছুই সাজাতে হবে না৷ গতরাতে এলেও সকাল বেলায় সবটা দৃষ্টিগোচর হলো শাহিনুরের। রাতের বেলা প্রণয়ের ঘরে, অর্থাৎ তাদের দু’জনের ঘরে চুপচাপ দু’জনই বসে ছিল। কেউ কারো সঙ্গে একটি শব্দও বিনিময় করেনি। সকাল হতেই কিছু না বলেই বেরিয়ে গেছে প্রণয়। যাওয়ার পূর্বে বলে গেছে বাইরে থেকে দরজা লক করে যাবে। লক মানে তালাবন্ধ করে যাওয়া এটাও বুঝেছে। সে যেন ভয় না পায়। চাইলে ভিতর থেকে সেও ছিটকিনি লাগাতে পারে। যেহেতু প্রণয় লক করে গেছে সেহেতু সে আর ছিটকিনি লাগালো না। সে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে হেঁটে তার নতুন সংসার দেখতে লাগল। এ ঘর, ও ঘর, বসার ঘর থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গা বার বার ঘুরে ঘুরে দেখল। কখনো কখনো একটু করে ছুঁয়ে দিল দেয়ালগুলোতে। অদ্ভুত এক শিহরণে শিহরিত হয়ে ওঠল মন। দেয়ালে দেয়ালে যেন প্রণয়ের ভালোবাসা মিশে আছে, প্রতিটি আসবাবপত্রেও ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করল সীমাহীন ভালোবাসা, অজস্র স্বপ্ন। কত যত্ন নিয়ে, কত ভালোবাসা নিয়ে এই সংসারটি সাজিয়েছে প্রণয় তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে শাহিনুর অনুভব করল, এই সেই সংসার, এই সেই ঘর, যে ঘরের আনাচে কানাচে ভালোবাসা মিশে রয়েছে। প্রণয়ের অবয় ভেসে ওঠতেই বিরবির করে বলল,
-‘এই সেই চোখ যে চোখে সহস্র স্বপ্নেরা হাতছানি দেয়, এই সেই বুক যে বুকে আমার শান্তি মেলে।’
সকাল দশটা নাগাদ একজন ভৃত্য’কে নিয়ে ফিরল প্রণয়৷ যার দু’হাত ভর্তি বাজার ছিল। বাসায় ফিরে বাজারগুলো দেখিয়ে প্রণয় প্রথম যে কথাটি বলল তা হলো,
-‘নুর, কোন মহিলা খুঁজে পেলাম না। আজকের জন্য একটু কষ্ট করতে হবে তোমায়।’
গোপনে একটু হাসল শাহিনুর৷ যদিও টের পেল প্রণয় তবুও কিছু বলল না। গোপন হাসিটুকু শেষ করে নরম গলায় সে জবাব দিল,
-‘আমি পারব।’
বাজারগুলো রেখে ভৃত্য চলে গেল। প্রণয় যতটুকু পারে সাহায্য করল শাহিনুর’কে। দু’জন মিলে সবজি কাটা থেকে শুরু করে রান্না করা, সবকিছু ফ্রিজে গুছিয়ে রাখা সমস্তই করল। নতুন সংসারে রান্নাবান্না করে প্রথম দিন সকালের খাবার দুপুরে খেলো তারা। তবুও কী যে অসীম শান্তি, তৃপ্তি’তে বুক ভরে গেল তা কাউকে বলে, বুঝিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব না। এভাবে প্রায় দু’দিন কেটে গেল৷ এই দু’দিনে পুরো সংসারের সমস্ত কিছু মুখস্থ করে নিল শাহিনুর। তৃতীয় দিন নির্দিষ্ট সময়ে প্রণয় হাসপাতালে চলে গেল। শাহিনুরেরও একা সময় কাটতে লাগল। হঠাৎ খুব মনে পড়ল, মা সমতুল্য বড়ো ভাবি শবনম’কে। বোন সমতুল্য জেবা’কে, ভাই,বন্ধু অঙ্গন’কে। কেবল এদের মনে করেই মনটা কিঞ্চিৎ খারাপ হয়ে গেল তার৷ শেষে আম্মা আর বুবু’কে মনে পড়তেই মনটা বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরের মধ্যেই পায়চারি করতে করতে ভাবল,
-‘পড়ার বইগুলোও রেখে এসেছি। ওগুলো থাকলেও তো পড়তে পারতাম৷ ইস এ সময়টাতেই বড়ো ভাবির কাছে পড়তাম আমি।’
একা একা কিছুই ভালো লাগলো না শাহিনুরের৷ করার মতো কোন কাজও খুঁজে পেলো না৷ কী করবে, কী করবে ভাবতে ভাবতেই সহসা মনে পড়ল,
বারান্দায় প্রণয়ের কিছু শার্ট,প্যান্ট শুখাতে দিয়েছে। কড়া রোদে সেগুলো শুখিয়ে গেছে দেখে তুলে এনে নিজহাতে যত্নসহকারে ইস্ত্রি করে ভাঁজ করে আলমারি’তে রেখে কপাট বন্ধ করে দিল। হঠাৎ কী যেন ভেবে পুনরায় কপাট খুলল। তার কয়েকটা শাড়ি বের করে আবার নতুন করে ভাঁজ করে রাখল। প্রণয়ের সবগুলো শার্ট, প্যান্ট,পাঞ্জাবি বের করে আবার নতুন করে ভাঁজ করল। সময় কাটাতেই মূলত এসব করছিল সে। সবশেষে যখন আবার সেগুলো আলমারিতে রাখতে যাবে তখনি খেয়াল করল একদম ভিতরের দিকে সুন্দর ভাঁজে সাদা একটি কাগজ পড়ে আছে। আলমারির ভিতরে কিছুটা আঁধার থাকায় সাদা চিরকুট টুকু ভালোভাবেই চোখে বেজেছে। এত কাপড়ের মাঝে একটি কাগজ বড্ড বেমানান লাগল শাহিনুরের কাছে। তাই কাগজটি নিয়ে কাপড়গুলো গুছিয়ে কপাট লাগিয়ে দিল। চিন্তিত ভঙ্গিতে কাগজের টুকরো’টা নিয়ে রাখল বিছানার তলায়। পরোক্ষণেই কী ভেবে যেন টুকরো’টা বের করল। ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাগজের ভাঁজ খুলতেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষর স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল তার দৃষ্টিতে। এতদিন শবনমের কাছে খুব ভালো করেই বাংলাটা শিখে নিয়েছে। অবশ্য দু’একটা ইংরেজিও সে এখন পারে। যেহেতু বাংলা পড়তে জানে সেহেতু সাদা পাতায় লেখা কালো অক্ষরগুলো বেশ গুছিয়েই পড়ল সে,
।।
~ আমার পুরো শরীরে বীভৎস এক যন্ত্রণা হচ্ছে।
কারণ’টা তুমি জানো প্রণয়। আজ আমি কলুষিত হয়েছি। কি ভাগ্য আমার যাকে সবচেয়ে বেশি ভরসা করে এসেছি তাকে দিয়েই কলঙ্কিত হলাম আমি। আচ্ছা প্রণয় নেশার ঘোরে অঙ্গন কেন বন্ধু না হয়ে পুরুষ হয়ে ওঠল? আমিই বা কেন মাতাল হয়ে নিজের এতবড়ো সর্বনাশ ঘটালাম? আমি জানি তুমি আর কখনোই আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না৷ আমিও আর কোনোদিন প্রশ্ন করব না তোমায়!
।
আমার শরীর থেকে অঙ্গনের শরীরের গন্ধ বের হচ্ছে। কী বিদঘুটে গন্ধ। কই তোমার শরীরের সুবাস তো কখনো আমার শরীরে লাগেনি। অথচ ওর শরীরের বিদঘুটে গন্ধটা দিব্যি লেগে গেল। তোমার ছোটোভাই’কে নিয়ে এমন করে বলছি বলে রাগ করবে না তো? তোমার ভাই হওয়ার আগে সে আমার খুব ভালো বন্ধু। তবুও বলছি, আমার কাছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিশ্রী ছেলেটা আজ অঙ্গন৷ কারণ ‘ও’ তোমার, আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে। তুমি জানো, আমার শরীরের কিছু অংশে দাগ পড়ে গেছে। কেমন নির্লজ্জ ছেলে বলো? এমনটা ও করতে পারল? ও আমার দিকে তাকাবে কী করে? আমিই বা ওর সামনে যাব কী করে? সবচেয়ে বড়োকথা তুমি ও’কে আস্ত রাখবে?
।
আচ্ছা প্রণয়, এই দাগগুলো বোধহয় আমাদের বিয়ের রাত্রিতে তোমার দ্বারাই হওয়ার ছিল তাই না? ঐ’রাতে নিশ্চয়ই তুমি আমায় খুব ভালোবাসতে, খুব আদর করতে… কী ভাবছো? আজ আমি লজ্জা পাচ্ছি না কেন? কোন মুখে আজ লজ্জা পাব বলো, কতবড়ো সর্বনাশ ঘটে গেল আমার, কতবড়ো সর্বনাশ করে দিলাম তোমার। তুমি আমাকে ভালোবাসো না এটা যেমন সত্যি, আমি তোমার হবু স্ত্রী এটাও সত্যি৷ প্রণয় চৌধুরী তার হবু স্ত্রী’কে এইরূপে সহ্য করতে পারেনি। আমি জানি তোমার মনে আঘাত না লাগুক, তোমার সম্মানে আঘাত লেগেছে। তোমাকে আঘাত করার দুঃসাহস আমার হবে এমন ভাবনা দুঃস্বপ্নেও আনিনি বিশ্বাস করো।
।
এ পৃথিবীর সকলের ঊর্ধ্বে তোমাকে ভালোবাসি৷
তোমার সমস্তটায় আমার অধিকারের মাত্রা যাই থাকুক, আমার সমস্তটায় শুধুমাত্র তোমার অধিকার প্রণয়৷ তোমার সেই অধিকার অন্য কেউ কেড়ে নেবে এমনটা আমি কল্পনাও করতে পারি না৷ তাহলে বাস্তবে এমনটা ঘটলে মেনে নিই কী করে বলো? সেই ছোট্টবেলা থেকে তোমার বউ হবার স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নটা পূরণ হতে নিয়েও হবে না। এমন অধর্ম কী সহ্য হয় বলো? আমি জানি তুমি আমায় মেনে নেবে৷ তোমার বউ হওয়ার সম্ভাবনা এখনো রয়েছে। কিন্তু ভালোতো বাসবে না৷ তোমার ভালোবাসাহীন আর কত বাঁচবো আমি? আর তো পারি না.. আজকের পর যদি একটা দিনও বাঁচতে হয় তবে তোমার ভালোবাসা পেয়েই বাঁচবো নয়তো না.. আমি জানি এটা আর সম্ভব না। আমি কোনোদিন তোমার ভালোবাসা পাব না। আর না তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারব। আমার এই শরীর’টায় যে কলঙ্কের দাগ লেগেছে তা কোনোদিন মুছতেও পারব না। তোমার মতো সম্মানীয় একজন পুরুষের বউ এমন কলঙ্কময়ী হতে পারে না। আমি যদি তোমার বউ না হই তাহলে আর কারো বউ হতে চাই না। আমি যদি তোমার ভালোবাসা না পাই তাহলে এ পৃথিবীর কারো ভালোবাসা পেতে চাই না। এত প্রতীক্ষার পরও যখন তোমার ভালোবাসা পেলাম না। কী লাভ অন্যকারো ভালোবাসা পেয়ে? যা চেয়েছি তা যখন পাইনি, যা চাইনি তাও পেতে চাই না। আমি তোমার ভালোবাসার মানুষ হইনি করুণার মানুষও হতে চাই না। তোমার ভালোবাসার মূল্য কতটুকু আমার কাছে বুঝতে চাও? তোমার ভালোবাসা পেলাম না বলে শেষ অবধি সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসাও হারালাম প্রণয়! আমার লাশ দেখার পর তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে তোমার ভালোবাসার অভাবে কতবড়ো সর্বনাশ ঘটে গেল!
।
শেষবেলায় বলতে পারলাম না, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি প্রণয়৷ সেই ছোট্ট থেকেই তোমাকে মন,প্রাণ দিয়ে চেয়েছি। বিশ্বাস করো, আমি কখনো কোন পাপ করিনি, কারো সাথে কোন অন্যায় করিনি৷ কারো দিকে কড়া চোখে তাকাইনি, কড়া ভাষায় কথা বলিনি। তবুও শেষে ভয়ংকর পাপী হয়ে গেলাম।
।
আমার বুকের ভিতর’টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল প্রণয়। আমার মস্তিষ্ক এলোমেলো লাগছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি নিজেকে সহ্য করতে পারছি না। আমার এই শরীর’টা’কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।
।
সেই ছোট্টবেলা মা’কে হারালাম। অবুঝ শিশু ছিলাম, কোন অপরাধে সৃষ্টিকর্তা মাতৃহারা করলেন জানি না। বাবা থেকেও ছিলেন না। সেই তখন থেকেই তো ভালোবাসার কাঙাল ছিলাম। শেষ পর্যন্ত তোমার ভালোবাসার কাঙালিনী হয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে আমাকে।
।
আমি তোমার বউ হতে পারলাম না, আমি তোমার ভালোবাসা পেলাম না। একটু ভালো কেন বাসলে না প্রণয়? আমার লাশের পাশে বসে একবারের জন্যও কী বলবে, ভালোবাসি তোমায় রোমানা…এটুকু শোনার জন্য হলেও আমি মরব। মৃত মানুষের কদর অনেক বেশি হয়। জীবিত হয়ে কদর না পাই মৃত হয়ে তোমার কদর পেলেও শান্তি..