৮৭. রাতের বেলা মেহমান দের কে সব নিচে ঘুমানোর ব্যাবস্থা করে দিয়ে ওরা ফ্যামিলির সবাই চলে এলো ছাদে। ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা বিছানা পাতা হলো। ফ্যামিলি ফ্যামিলি গেট টুগেদার। বিছানা বালিশ সব পাতা হলেও কেও সেখানে গা এলিয়ে দিলো না। সবাই গোল হয়ে বসে রইলো, সাফওয়ান আর রুমাইশা কে মধ্যেখানে রেখে। আজকের রাত টা ওরা সবাই মিলে ওদের দুজনের এতগুলো দিনের কাহিনী শুনবে৷
রুমাইশা কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে আয়েশা। তার চোখের কোণে পানির রেশ। মাঝে মাঝেই আচলের কোণা দিয়ে চোখের কোণ টা মুছে নিচ্ছেন তিনি। শামসুল আর ইশতিয়াক দুজনে এক জায়গায় বসে আছেন, ওনাদের কোলে সাদমান আর শাহমীর। ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু করলেও এখনো জেগে আছে দুইটাই। ইশতিয়াক আর শামসুল বার বার বাচ্চা দুটোর মুখের দিকে তাকাচ্ছে৷ সাফওয়ান ছোট বেলায় ঠিক এরকম ছিলো। শক্ত পোক্ত গাট্টা গোট্টা শরীর, মাথা ভর্তি মিশমিশে ঝাকড়া চুল, তেজীয়ান দুইটা চোখ যা সবসময় চারপাশ টা তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণে ব্যাস্ত থাকে। বাচ্চা দুটোকে দেখে সাফওয়ানের ছোটবেলাটাই আবার নিজেদের ভেতরে আলোচনা করছেন তারা, আর হাসছেন মাঝে মাঝে।
রুনিয়া শায়রী কে কোলে নিয়ে বসে আছেন, শায়রী ঘুমে কাদা, আট মাসে পড়েছে সে এবার। সাফওয়ান মায়ের কোলে নিজের মেয়েটাকে এইভাবে ঘুমাতে দেখে বলল,
— মা, রাশা কে তুমি রুমে শুইয়ে দিয়ে আসো। পাখা ফুল স্পিডে দিও, ও কিন্তু প্রচুর ঘামে, গরম সহ্য করতে পারে না একটুও। আর দরজা টা খোলা রেখো, যেন ঘুম থেকে উঠে পড়লে বোঝা যায়৷
রুনিয়া মাথা নাড়িয়ে শায়রী কে বুকের ওপর নিয়ে চিলেকোঠার কামরায় শুইয়ে দিতে গেলো। রাফসান আর আফসানা এখনো আসেনি, ওরা নিচেই আছে৷ মেহমান দের কে শোবার জায়গা গুলো ঠিক ঠাক করে দিয়ে, রান্না ঘর গুছিয়ে চলে আসবে, ওদের জন্যই বসে আছে সবাই। আফসানা এখনো জানে না সাফওয়ান আর রুমাইশার ব্যাপারে কিছু। তাকে ছাদে এনেই বলা হবে সব কিছু৷
সাদমান আর শাহমীরের চোখ ছোট হয়ে আসছে ঘুমে। শামসুল ওদের দুজন কে বললেন,
— নানু ভাই, তোমাদের তো ঘুম পাচ্ছে! ঘুমিয়ে পড়ো এখানে, কষ্ট করে জেগে থাকতে হবে না।
কিন্তু দুজনেই অসম্মতি জানালো, শাহমীর বলল,
— মাম্মাম ঘুমালে মাম্মামের সাথে ঘুমাবো
সাদমান ও ভাইয়ের সাথে সহমত পোষণ করে বলল,
— হ্যা, নইলে বাবা আমাদের কেও রাশার কাছে রেখে আসবে! আর নিজে মাম্মামের কাছে ঘুমাবে!
শাফিন ফিক করে হেসে উঠলো, বলল,
— খুব পেকেছে দুটো! বিকাল বেলা আমাকে বলছে যে, বাবা আমাদের থেকে মাম্মাম কে বেশি কোলে নেয়!
সাদমান শামসুলের কোলে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলো, শাফিনের কথায় উঠে সোজা হয়ে বসে ভ্রু কুটি করে শক্ত গলায় বলল,
— চাচ্চু, তোমার সাথে কি কথা হয়েছিলো! তুমি বলেছিলে আমাদের কথা আমাদের ভেতরেই থাকবে, কিন্তু তুমি প্রমিস রাখোনি, তোমার সাথে আমরা আর কোনো কথাই বলবো না!
শাফিন দাঁত চেপে ঠোঁট বাকালো, তারপর বাম হাত দিয়ে নিজের বা কান টা ধরে বলল,
— সর্যি, আর হবে না। আর কিছু বলবো না কাউকে প্রমিস!
শাহমীর এবার সোজা হয়ে বসে নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
— এখন সর্যি বলে আর লাভ হবে না চাচ্চু। আমরা মানুষ কে একবারের বেশি সুযোগ দেই না। তোমার সুযোগ তুমি হারিয়ে ফেলেছো। তোমার সাথে আমরা আর কোনো গোপন কথা বলবো না!
শাফিন হেসে বলল,
— কাম সেরেছে! দুইটা দেখি একজোট!
রুমাইশা নিজের মাথা টা সাফওয়ানের বাহুতে ঠেকিয়ে শাফিন আর বাচ্চাদের খুনশুটি দেখছিলো আর হাসছিলো। বাচ্চাদের এমন কথার ফুলঝুরি তে সাফওয়ানের দিকে এক পলক তাকালো ও। সাফওয়ানও রুমাইশার সে দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে চোখে চোখেই নিজেদের মনের ভাব বিনিময় করে নিলো। সাফওয়ান শাফিন কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— ওদের সাথে পেরে উঠবিনা শাফিন! জন্মের পরে থেকেই ওদের মাইন্ড এক প্রকার কানেক্টেড৷ দুজন একইসাথে একইভাবে চিন্তা করে৷ ইভেন ওরা দুজন দুজনের সাথে মনে মনে কথাও বলতে পারে, অনেক দূর থেকেও। আর সময়ের সাথে সাথে সেটা আর ও স্ট্রং হচ্ছে।
সাফওয়ানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো সবাই! বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো ওরা সাদমান আর শাহমীরের দিকে। সাদমান আর শাহমীর অস্বস্তিতে পড়লো সবার এমন তাকানো দেখে, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা।
এমন সময়ে ছাদে প্রবেশ করলো রাফসান আর আফসানা।
শব্দ শুনে সেদিকে তাকালো সবাই। কিছুদুর এগিয়ে আসার পর আফসানা সাফওয়ান আর রুমাইশা কে এইখানে দেখে রাফসানকে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি তো বলেছিলে আমরা এখানে শুধু পরিবারের লোকজন থাকবো, তাহলে এনারা এখানে কি করছেন?
রাফসান ওর দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
— ওরা আমাদের পরিবারেরই সদস্য, এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ধৈর্য ধরো, সবই জানতে পারবে৷
আফসানা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। আফসানা কে দেখে আয়েশা জিজ্ঞেস করলেন,
— বাচ্চারা কোথায় আফসানা?
আফসানা মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলল,
— ওরা নিচে ঘুমাচ্ছে মা, তাই আপনার ছেলে বলল ওদের কে ওইখানেই রেখে আসতে।
সবাই সরে সরে গিয়ে রাফসান দের বসার জন্য জায়গা করে দিলো৷ রুমাইশা মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে আফসানার হাত টা নিজের হাতে নিয়ে বলল,
— তুমি আমার পাশে এসে বসো ভাবি, তোমার সাথে দুটো কথা বলি!
আফসানা অপ্রস্তুত হেসে রুমাইশার পাশে, রুমাইশা আর আয়েশার মাঝে বসলো। রাফসান গিয়ে সাফওয়ানের পাশে দাড়ালো, তারপর সাফওয়ান কে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বলল,
— ভাই, আফসানা কে আমি এখনো তোমাদের আসল পরিচয় বলিনাই, তুমি চাইলে আমি তাকে বলবো। চিন্তা করো না, তাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই সে কোনো ক্ষতির কারণ হবে না ইন শা আল্লাহ। আমি তার সাথে গত আট বছর ধরে আছি। সে আমার দু সন্তানের মা, আর আমি এবং আমার পরিবারের লোকজন তাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করি৷ এখন তোমার কাছে ঠিক লাগলে আমি তাকে জানাবো তোমাদের ব্যাপার টা৷
সাফওয়ান মুচকি হেসে রাফসানের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,
— কবুল বলার সাথে সাথেই মেয়েটা এ পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে, আর সেখানে আটটি বিশ্বস্ত বছর তো অনেক বিশাল ব্যাপার! তুই তাকে জানাতে পারিস, অসুবিধা নেই৷ তার জানার অধিকার আছে নিজের পরিবারের মানুষ সম্পর্কে।
রাফসান খুশি হলো খুব। হাসি হাসি মুখ করে সাফওয়ানের পাশ থেকে সরে গিয়ে ও বসলো শাফিনের পাশে৷ সবাই গোছ গাছ করে বসার পর রাফসান আফসানা কে ডেকে বলল,
— আফসানা, তোমাকে বলেছিলাম আমাদের একটা বোন আছে, তোমাকে কখনোই আমি তার নাম বলিনি কিছু সঙ্গত কারণে। কিন্তু আজ আর তোমার থেকে লুকিয়ে রাখার মতো কিছু নেই। আমার বোন টার নাম রুমাইশা কাদের, সে এখন তোমার পাশেই বসে আছে। আর তার পাশে যাকে দেখছো সে আমাদের বিগ ব্রাদার, ইশতিয়াক আহমেদের বড় ছেলে সাফওয়ান আহমেদ, আমার বোনের স্বামী।
আফসানা চমকে তাকালো রুমাইশার দিকে। এই মেয়েটি তার ননদ! অথচ সে কত কিই না ভেবেছিলো! এই জন্যই তাহলে সবাই এত খুশি আজ! রাফসানের এই মেয়েটির দিকে ওইভাবে তাকানোর কারণ তাহলে এটাই!
রুমাইশার হাতের মুঠিতে আফসানার হাত টা ধরাই ছিলো। রুমাইশা সে হাতে আলতো করে চাপ দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
— আমাকে ননদ মনে করবে না ভাবি, আমাকে তোমার বোন ভাববে। আমি আসলে তেমন শয়তানি করতে জানিনা, তাই ননদ হলে ঝামেলায় পড়ে যাবো!
বলে খিল খিল করে হাসলো রুমাইশা। ওর সে হাসিতে যোগ দিলো অন্যরাও। আফসানাও নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠে বাকিদের সাথে তাল মেলালো। ও একবার রুমাইশা কে দেখছে আর একবার রাফসান কে, ভাই বোনের চেহারায় তেমন মিল পাচ্ছে না ও। রাফসান খুবই ফর্সা৷ ওর গায়ের রঙ কিছুটা বিদেশিদের মতো। চোখ দুইটা কাজল কালো, মুখ ভর্তি চাপা দাড়ি, মাথা ভর্তি ফুলে থাকা কালো রঙা চুল গুলো ঘাড়ের ওপর এসে পড়ছে৷ কিন্তু রুমাইশার এমন কিছুই নেই।
মুখের গঠন টা খুবই নজরকাড়া হলেও গায়ের রঙ টা উজ্জ্বল শ্যমলা, রাফসানের মতো ফর্সা নয়। মুখে বা শরীরে মেদের ছিটেফোটা নেই। আফসানা সেই আসার পর থেকেই রুমাইশা কে খেয়াল করছে। শরীর টা অসম্ভব রকমের আকর্ষণীয় রুমাইশার; বুক, কোমর, পেছন সবই অত্যান্ত সুডৌল, বোঝার উপায় নেই বাচ্চা আছে এতগুলো। মাথা ভর্তি কোমর ছাড়ানো মেরুন রঙা চুল, টানা টানা চোখ দুইটা নজরকাড়া না হলেও কেমন যেন নেশা ধরানো, সেদিকে তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে আফসানা।
রুমাইশা সহ অন্যরা আড্ডা দিয়ে যাচ্ছে সমানে। কিন্তু আফসানার সেদিকে খেয়াল নেই। ও সাফওয়ান কে দেখছে আড়চোখে। সাদা রঙা একটা আন্ডারশার্ট আর নেভি ব্লু রঙা একটা ট্রাউজার পরে বসে আছে সে৷ লোক টাকে প্রথম দেখেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ও! এত আকর্ষণীয় মানুষ কিভাবে হয়! লোক টার শরীরে সামান্যতম মেদ নেই, পুরোটাই যেন মাসলস। শ্যমলা রঙা শরীর টা অত্যাধিক আকর্ষণীয়। শক্ত চোয়াল দ্বয় আর কুঞ্চিত ভ্রুজোড়ার নিচের তীক্ষ্ণ চাহনির চোখ জোড়া জানান দেয় তার বিচক্ষণতার। তার পেশিবহুল বুকের মাঝখান টা কেমন যেন ছুয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। ভাবনাটা আর একটু গভীর হতেই সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলো আফসানা৷ ছিঃ! সে এসব কি ভাবছে! লোক টা তার ভাসুর, তার ননদের স্বামী! তাকে নিয়ে এইসব কল্পনা করা অসুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ ছাড়া আর কিছুইনা৷ নিজেকে সংযত করলো আফসানা৷ মন কে জোর করে ফিরিয়ে আনলো আড্ডার মাঝে৷
তখনই শাফিন নড়েচড়ে বসে সাফওয়ান কে জিজ্ঞেস করলো
— তোমার এত পরিবর্তন কিভাবে হলো ভাইয়া? তোমাকে তো পুরোপুরি ঠিকঠাক লাগছে। সব ঠিক হলেও চোখের রঙ কিভাবে বদলে গেলো ভাইয়া? চোখের সে উজ্জলতা টাও নেই। কিভাবে হলো এমন!
সাফওয়ান বাবু দিয়ে বসে দুই হাটুর ওপর হাতের কনুইয়ের নিচের অংশ ঠেকিয়ে বসে বসে রুমাইশাকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। শাফিনের প্রশ্ন শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমাদের দুজনের চোখেই এক বিশেষ ধরনের লেন্স লাগানো। সাধারণ লেন্সে আমার চোখের উজ্জলতা টা বোঝা যেত, কিন্তু এটাতে যায়না। আমার একজন ল্যাব পার্টনার স্পেশাল ভাবে এগুলো তৈরি করে দিয়েছে আমাদের জন্য৷ আর আমার বা রিমুর, কারো শরীরেরই কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু আমার ঠোঁটের রঙটা চেইঞ্জ হয়েছে, আর আমার শরীরের চামড়াটা। আগের মতো আর খোলশ বদলায়না! আর আমার জিহবায় এক ধরণের আর্টিফিশিয়াল টাং সেট করা, মুখোশ লাগানো বলা যেতে পারে! কারণ সেটা আমি যেকোনো সময়েই খুলে ফেলতে পারি। এই জিহবায় আমি কোনো স্বাদ বুঝতে পারি না, এটা জাস্ট মানুষ কে দেখানোর জন্য। বাইরে বের হলে আমি আমার জিহবায় এটা সেট করে বের হই৷
সাফওয়ানের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলোনা আফসানা, অবুঝের মতো সবার মুখের দিকে একবার একবার করে তাকাতে লাগলো। রুমাইশা আফসানার এমন অবুঝ দৃষ্টি দেখে মিষ্টি হেসে বলল,
— চিন্তা করোনা ভাবি, রাফসান ভাইয়া তোমাকে পরে সব বুঝিয়ে বলবে, এখন একটু হাসো তো। এখানে আসার পর থেকেই দেখছি তুমি কেমন মন খারাপ করে আছো! হাসো, হাসো, আমাদের সাথে আড্ডা দাও মন খুলে, দেখবা মন ভালো হয়ে গেছে!
আফসানা রুমাইশার কথাতে মুখে হাসি ফুটালো জোর করে। না চাইতেও হিংসা হচ্ছে ওর! বয়সে বছর দুয়েকের বড়ো হবে ও রুমাইশার থেকে। আর দেখতেও ও রুমাইশার থেকে সুন্দর। গায়ের রঙ ওর রুমাইশার থেকে অনেক খানিই উজ্জ্বল। চোখ মুখ ও সুন্দর৷ শুধু রুমাইশার মতো ও অমন সুন্দর দেহের অধিকারি নয়, শরীর টা ওর একটু ভারী! কিন্তু রুমাইশার ভেতর কিছু একটা ব্যাপার আছে, যার জন্য মানুষ ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়, এমনকি সে নিজেও রুমাইশার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, ওর চাল চলন, কথা বার্তা, আচার ব্যাবহার, সবকিছু দিয়েই যেন ও ওর আশেপাশের মানুষ গুলোকে বশ করে নিচ্ছে!
এই জন্যই হয়তো রুমাইশা ওর থেকে ভালো টা পেয়েছে! মনের মতো একটা শ্বশুর বাড়ি! বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ী তে কোনো তফাত নেই ওর বেলায়! শাফিনের মতো একজন দেবর পেয়েছে সে! এতদিন শাফিন কে নিজের দেবরের মতোই মনে হতো, কিন্তু আজ রুমাইশার আগমনের পর হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে যেন শাফিন আর তার দেবর নেই। রুমাইশার দেবর হয়ে গেছে! রুমাইশা আসার পর থেকে ওকে চোখে হারাচ্ছে শাফিন। গোসল করবে না করবে না করছিলো, অথচ রুমাইশা আসার পর ঠিকই করলো, তাও খুশি মনে!
আয়েশা তার শাশুড়ী হিসেবে খারাপ না, কিন্তু রুনিয়া বেশি ভালো যেন! রুমাইশা আসার পর থেকে কত শত ভাবেই না যত্ন নিচ্ছে ওর! আয়েশার থেকেও বেশি, যেন নিজেরই মেয়ে! এরকম একটা শাশুড়ী কি ও ডিজার্ভ করতো না! আর সবশেষে ওর স্বামী! রাফসান দেখতে সুন্দর, অনেক! কিন্তু সাফওয়ান! সাফওয়ান হয়তো রঙে ফর্সা না, কিন্তু এত্ত আকর্ষণীয় পুরুষ ও সামনে থেকে কখনোই দেখেনি! সাফওয়ান কে দেখলেই ওর হেনরি ক্যাভিলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, ওই পেশিবহুল দেহটা দেখলেই শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে, ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওই বাহু জোড়া! আর ও কতশত কিছু ইচ্ছে করছে ওর! রুমাইশার প্রতি ওই লোকটার কেয়ার চোখে বাধছে আফসানার! তার স্বামী যে তার যত্ন নেয়না সেটা নয়, কিন্তু কেন যেন ওই যত্ন টা আফসানার চোখ থেকে সরছে না!
রুমাইশার জীবন এতটা পারফেক্ট কেন হলো! রুমাইশার মুখে কোনো বিরক্তির ছাপ নেই, নেই কোনো অসন্তোষের ছাপ! অসন্তুষ্ট ও হবেই বা কেন! যার এমন পরিবার, এমন বাবা মা, এমন ভাই, এমন শ্বশুর শাশুড়ী, এমন দেবর, এমন স্বামী থাকে, তার কিসের অসন্তোষ!
কিন্তু তার নিজের জীবন এমন হলো কেন? রুমাইশার জায়গায় কি সে থাকতে পারতো না! ওই পেশিবহুল বাহুটাতে আবেশে মাথা ঠেকিয়ে কি আজ সে নিজে বসে থাকতে পারতো না! ওই প্রেমপূর্ণ চাহনি কি তার মুখেই নিবদ্ধ হতে পারতো না!
ছিঃ এসব কি ভাবছে সে! সে তো তার স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলো, তাহলে এখন এমন হচ্ছে কেন? হঠাৎ করে শয়তান তার মনে কু প্ররোচনা দিচ্ছে কেনি! এই কলুষিত মন নিয়ে ও কোথায় যাবে!
আফসানাকে মেঝের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুমাইশা চিন্তিত মুখে আফসানার বাহু স্পর্শ করে নাড়া দিলো, চমকে উঠলো আফসানা৷ রুমাইশা আফসানার মুখ খানা ভালীভাবে দেখে নিয়ে বলল,
— কি ব্যাপার ভাবি? তোমার মুখ টা এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
আফসান জোর করে হেসে বলল,
— না, না! এমনিতেই, আজ অনেক ধকল গেলো তো, একটু ক্লান্ত লাগছে, এই আর কি!
রুমাইশা বলল,
— তাহলে তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো না হয়! কাল ও তো অনেক কাজ বাকি, পরে শরীর খারাপ হলে বিয়ের মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে তোমার! একটা ঝাড়া ঘুম দিলে ক্লান্তি চলে যাবে সব৷
আফসানা ইতস্তত করে বলল,
— থাকুক, আর একটু বসি, অসুবিধা নেই। এখানে সবাই কত গল্প করছে তা রেখে ঘুমাতে গেলে আমার ঘুম আসবে না!
রুমাইশা মিষ্টি হেসে বলল,
— ঠিক আছে বসো, খারাপ লাগলেই বলবে কিন্তু, চুপ করে থাকলে কিন্তু কেউই বুঝতে পারবো না!
আফসানা সায় মেনে বসে রইলো চুপচাপ। এবার একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো সবার কথা৷ রুমাইশা সাফওয়ান কে বলল,
— আফসানা ভাবির শরীর ভালো লাগছে না, তোমরা শর্টে শেষ করো, গল্প শেষ না হলে ভাবি ঘুমাতে পারছে না!
তখন রাফসান সাফওয়ান যে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি বলছো ওইখানেই একটা ল্যাব ক্রিয়েট করেছো! জঙ্গলের অতো গভীরে কিভাবে কি করলে? কিভাবে সব কিছু ম্যানেজ করলে?
সাফওয়ান রুমাইশার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
— বউ যখন বলেছে শর্টে শেষ করতে, তখন শর্টেই শেষ করি। আমার সিঙ্গাপুরের সমস্ত প্রোপার্টি আমার এক বন্ধুর সাহায্যে বিক্রি করে দিয়েছি। সিঙ্গাপুরে এখন আর আমার কিছুই নেই৷ প্রোপার্টি বিক্রির সব ডলার আমার হাতে আসার পর সিঙ্গাপুর সহ অন্যান্য জায়গায় আমার যত ল্যাব পার্টনার ছিলো সবাইকে ডেকে নিয়ে আমি গোপনে একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করি৷ সেখানে ডিসিশন নেওয়া হয় যে আমরা আবার আমাদের ল্যাব রিক্রিয়েট করবো। আবার আগের বিজনেসে ফিরে যাবো। আর ল্যাব টা হবে জঙ্গলেরই ভেতরে এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে। এরপর আমরা বাইরের দেশ থেকে দক্ষ ওয়ার্কার্স দের নিয়ে আসি। আমেরিকান কোনো ওয়ার্কার্স দের আমরা নেই না! আমি আর আমার দুজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু মিলে ল্যাবের ডিজাইন করি৷ এরপর জঙ্গলের ভেতরেই কাজ শুরু হয়ে যায়। একটা ফুটবল মাঠের সমান এরিয়া নিয়ে মাটির বেশ খানিক টা গভীরে আমাদের ল্যাব টার কাজ শুরু করা হয়। ওয়ার্কার্স দের কে চোখ বেধে নিয়ে আসা হয়। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওদের কে জঙ্গলেই থাকতে দেওয়া হয়৷ এরপর সমস্ত কাচামালের একটা আনুমানিক হিসাব করে সব একবারে কিনে রাখা হয় আমাদের অন্য এক বন্ধুর ফার্মহাউজে। তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী সেখান থেকে ঠেলা গাড়িতে করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো লোকচক্ষুর আড়ালে।
ল্যাবের সাথে সাথে আমি জঙ্গলের ভেতরেই রিমু কে নিয়ে থাকার জন্য বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে দিই। দোতলা বাড়ি টা চার বছরের মাথায় কমপ্লিট হয়, আর ল্যাব ছয়। আমার অন্যান্য ল্যাব পার্টনার আর সাধারণ কর্মি দের যাতায়াতের সুবিধার্থে ল্যাব থেকে জঙ্গলের বাহির পর্যন্ত লোকালয় শূন্য কিছু এলাকায় মাটির নিচ দিয়ে টানেল তৈরি করি। এরপর ওয়ার্কার্স দের কে আবার চোখ বেধে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যার যার জায়গায়।
তারপর সব কমপ্লিট হলে বাড়ি আর ল্যাবের ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হলো, প্রয়োজনীয় ইক্যুয়িপমেন্ট জোগাড় করে ল্যাবের কাজও শুরু করে দিলাম৷ সেই সেইম ওয়ার্ক! ফার্মাসিউটিক্যালস। পার্টনার রা মিলে নিজেদের কোম্পানির একটা স্বতন্ত্র লোগো ক্রিয়েট করলাম। এরপর শুরু করে দিলাম ড্রাগস তৈরির কাজ৷
আমাজনে রিসোর্স এর অভাব নেই। মেডিসিনের জন্য খুব কম জিনিসই বাইরে থেকে আনতে হলো, এ ছাড়া আর সবকিছুই আমাজন প্রোভাইড করলো আমাদের৷ আমরা অ্যানোনিমাসলি বিজনেস শুরু করলাম, আর খুব দ্রুতই প্রোফিট পেতে শুরু করলাম। সাদমান আর শাহমীর কে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য আমাদের কে লোকালয়ের দিকে আসতে হচ্ছিলো, তাই আমরা দুজনেই নিজেদের নেইম আর সারনেইম বদলে ফেললাম, তারপর ফেইক আইডেন্টিটি তৈরি করে লোকালয়ের দিকে চলে এলাম, আমাজনের আমরা যেখান টাতে ছিলাম, সে জায়গা থেকে ফ্রেঞ্চ গিয়ানা জায়গা টা সবচেয়ে কাছে ছিলো। তাই সেখানেই চলে গেলাম বাচ্চাদের নিয়ে। তারপর ওইখানে ছোটখাটো একটা থাকার মতো জায়গা কিনে বাচ্চাদের কে স্কুলে ভর্তি করলাম। দিনের বেলা টা এদিক টাতেই থাকতাম, আর রাতের বেলাটা ল্যাবে৷ আর এরপর বাচ্চা রা আর একটু বড়ো হলে ওদের কে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিলাম, আর আমরা দুজন আবার চলে এলাম ফরেস্টে, আমাদের বাড়িতে৷ বিজনেস পুরোদমে চলতে লাগলো। এরই ভেতরে হারবার্ট আর একবার চেষ্টা করেছিলো আমাদের ওপর আক্রমণ করার, আর তার মেইন টার্গেট ছিলো রিমু কে পাওয়া। কিন্তু বেচারা দুনিয়া ছাড়লো আমার হাতে। এরপর আমরা আমাদের ল্যাবের একটা শাখা ল্যাব ক্রিয়েট করলাম ওকলাহোমা শহরে৷ আমাদের মেইন কাজ চলতো আমাজনে, আর সেখান থেকে সমস্ত মেডিসিন আর ড্রাগস গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হতো ওকলাহোমা তে৷ তারপর আমাদের বিজনেস আরও এক্সপ্যান্ড হলো, ডলারের বন্যা বয়ে গেলো, আর আমি সহ আমার বাকি পাঁচ জন ল্যাব পার্টনার নিজেদের লাইফ সেট করে নিলাম, আর এখনও সেভাবেই চলছে! আর সামনেও সেভাবেই চলবে ইন শা আল্লাহ!
এতক্ষণ ছাদের ওপর পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিলো। সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সাফওয়ানের কথা। আফসানা তো হা হয়ে গেছে শুনতে শুনতে। নিরবতা ভেঙে রুনিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন একটা, তারপর বললেন,
— আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন! আমার ফুলের মতো দুই সন্তান কে আমি হারিয়ে ফেলতে বসেছিলাম! আল্লাহ মৃত্যুর মুখ থেকে তাদের কে ফিরিয়ে আবার আমার কোলে ফেরত দিয়েছেন, আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুক্রিয়া!
পাশে বসা ইশতিয়াক রুনিয়ার কথার সুর ধরে সাফওয়ান কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— তোমার মা, সমস্ত রাত ধরে জায়নামাজে বসে বসে কান্নাকাটি করতো, তুমি নেই, রুমি নেই, কেউ নেই! বাড়ি টাতে কেউ আর হই হুল্লোড় করতো না! শ্মশানের মতো মনে হতো যেন! আমার শাফিন টাও কারো সাথে কথা বলতো না, মন মরা হয়ে থাকতো সারাক্ষণ। বাইরে বের হলেই মানুষ জিজ্ঞেস করতো, যে তোর বড় ভাই নাকি জংলি! রোজ রোজ এসব কথা শুনে এসে রুনিয়া কে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাদতো সে! আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে গেলো সে যন্ত্রনা, মানুষ জন ও সব ভুলতে শুরু করলো! এখন হয়তো সেসব আর কারো মনেই নেই!
তোমরা যে আবার আমাদের জাছে ফিরে এসেছো তাতেই আমরা খুশি! তোমাদের কাছে এ ছাড়া আমাদের কোনো চাওয়া নেই! তোমরা দুজন সুখে থাকো সারাজীবন এই দুয়া করি!
পাশ থেকে রুনিয়া আমিন বলে উঠলেন, তার দেখা দেখি বাকিরাও আমিন বলে উঠলো । আয়েশা শাড়ির কোণা দিয়ে চোখ মুছলেন৷ শাফিন অপলকে তাকিয়ে রইলো কোনো এক শূন্যের দিকে! ওর সামনে ভেসে উঠলো সেই বারো বছর আগেকার বিভীষিকা ময় দিন গুলো।
আর সাফওয়ান তাকিয়ে রইলো মেরুণ রঙা চুল ওয়ালা রুমাইশার মুখপানে!
এই মেয়েটা না থাকলে আজ তার কি হতো! সে উচ্ছন্নে চলে যেতো পুরা! এ জীবনে তার আর ভালোবাসা, স্ত্রী, সন্তান, পরিবার, সংসার, কিছুই পাওয়া হতো না! চারদিক শুধু শূন্যতায় পরিপূর্ণ থাকতো! এই মুখ টার দিকে তাকালে পৃথিবীর কোনো বাধাই আর বাধা মনে হয় না৷ এই হাতের স্পর্শ সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়! ওই চোখ দুটোর চাহনি অন্তর কে শীতল করে দেয়, ওই ঠোঁটের স্পর্শ সমস্ত ক্ষত কে সারিয়ে দেয়! শুধু মাত্র এই একটা মানুষের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা তার জীবন কে পরিবর্তন করে দিলো এ মাথা থেকে ওমাথা!
নিঃশব্দে রুমাইশার মাথা টা নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে কপালে আলতো করে একটা চুমু খেলো ও, সময় নিয়ে। সবাই দেখলো সেটা, কিন্তু আড়ষ্টতার পরিবর্তে সবার মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি, এ ভালোবাসা যেন চোখে দেখে ও শান্তি!
সাদমান আর শাহমীর বাবা মায়ের এমন ছোটখাটো আদর দেখে অভ্যস্ত। সাদমান শাহমীর কে বলল,
— মীর, অবস্থা ভালো না, বাবা মাম্মাম কে দখল করার আগেই আমাদের কে মাম্মাম কে দখল করতে হবে। নইলে পরে আমাদের কে আলাদা ঘুমাতে হবে, উঠ!
গুটি গুটি পায়ে দুজন এগিয়ে গেলো রুমির দিকে। গিয়েই রুমির কোলের ভেতরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো দুজনেই। ফটকা দুটোর চালাকি টের পেয়ে সাফওয়ান রুমাইশার দিকে আহত চোখে তাকালো। রুমাইশা মজা পেলো খুব, দুষ্টি হাসি হেসে ও সাফওয়ান কে ইশারায় বোঝালো যে তোমার আর জায়গা নেই! দখলদার রা দখল করে নিয়েছে!
এমন সময়ে রুনিয়া বললেন,
— অনেক গল্প হয়েছে, এবার সবাই শুয়ে পড়ো। কাল অনেক কাজ বাকি। বউ আনতে যেতে হবে তোমাদের। কাল আত্মীয় স্বজন এসে বাড়ি ভর্তি করে ফেলবে, দম ফেলার ও সময় পাবে না কেউ৷
রুনিয়ার কথা তে সবাই বিছানা গোছাতে লেগে গেলো। শায়রী কেদে উঠলো এমন সময়ে। রুমাইশা সাফওয়ান কে বলল শায়রী কে নিয়ে আসতে বাইরে।
আর এতসব কোলাহলের ভেতরেই ঠাই বসে রইলো আফসানা। সাফওয়ান যে এত টা রীচ হবে তা ও স্বপ্নেও ভাবেনি৷ তখন কথার মাঝখানে শাফিন যখন সাফওয়ান এর নতুন কেনা গাড়িটির নাম জিজ্ঞেস করেছিলো তখন ও গুগল করে দেখে নিয়েছিলো গাড়ি টার দাম। আফসানার চোখ কপালে উঠে গিয়েছে পুরো, এত দাম দিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা ভাবতেই ওর গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। আর নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মালো ওর! এতটা পারফেক্ট জীবন ও শুধু সিনেমাতেই দেখেছে!
হ্যা, রুমাইশা দের জীবনেও ফাড়া গিয়েছে এক সময়, কিন্তু এখন তো ওরা অনেক অনেক সুখে আছে! সব দিক থেকেই ওরা বিশাল ভাবে পরিপূর্ণ! সৃষ্টিকর্তা যেনি ওদের কে সব কিছু ঢেলে ঢেলে দিয়েছে!
সাফওয়ান যখন রুমাইশার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিচ্ছিলো তখন সাফওয়ানের ওই চোখ জোড়ায় সে দেখেছে রুমাইশার জন্য এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা, আর এক রাশ মুগ্ধতা! এই চাহনি কি ওর দিকে আসতে পারতো না!
নাহ, আর পারছে না ও! চরম বিরক্তিতে ছেয়ে উঠছে ওর মনের ভেতর টা! নিজের ভাগ্য কে নিজেই অভিশাপ দিতে থাকলো ও! এমন সময়ে রাফসান এসে বসলো ওর পাশে, তারপর বলল,
— আফসানা, ঘুমাবে না তুমি? তোমার শরীর খারাপ লাগছে বলছিলে!
আফসানা রাফসানের দিকে তাকালো, কিন্তু সে তাকানোতে কোনো অনুভূতি ফুটে উঠলো না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ও বলল,
— তুমি এখানেই ঘুমাও, আমি নিচে বাচ্চাদের কাছ গিয়ে ঘুমাচ্ছি, রুহানি ঘুম থেকে উঠে গেলে কাউকে পাশে না পেলে কান্না করবে।
রাফসান বিষয় টা চিন্তা করে বলল,
— তুমি না হয় ওদের কে নিয়ে এখানেই চলে আসো। এতদিন পর একসাথে হয়েছি আমরা পরিবারের সবাই, সেখানে তুমি না থাকলে হয় বলো!
আফসানা যেন বিরক্ত হলো খুব! এদের এত সুখ ওর আর ভালো লাগছে না! অসহ্য লাগছে ওর সবকিছু! রুমাইশা কে দেখলেই ওর বুকের ভেতর অদ্ভুত এক যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে হচ্ছে এই মেয়েটি এসে ওর সব প্রাপ্য ওর থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে! আফসানা রাফসানের দিকে না তাকিয়েই বলল,
— থাকুক, আমি নিচে যাচ্ছি। তোমরা গল্প করো।
রাফসান উপায় না পেয়ে বলল,
— ঠিক আছে যাও, আমি তাহলে এখানেই থাকছি। কোনো অসুবিধা হলে মেসেজ দিও, আর আমার রেস্পন্স না পেলে সরাসরি কল দিও, আমি চলে আসবো।
আফসানা কোনো রকমে মাথা নাড়িয়ে উঠে চলে যেতে নিলো নিচে। আর উঠে দুই কদম যাওয়ার সাথে সাথেই মাথা ঘুরে উঠলো ওর৷
রুমাইশা শায়রী কে কোলে নিয়ে বাচ্চাদের আর সাফওয়ান এর ঘুমাবার জায়গা ঠিক করে দিচ্ছিলো। সাফওয়ান অলরেডি শুয়ে পড়েছে তার জায়গায়। হঠাৎ দিড়িম শব্দে চমকে উঠে শব্দের উৎসের দিকে তাকালো ওরা! আর আফসানা কে এইভাবে পড়ে যেতে দেখেই সবার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।
রাফসান ছুটে গেলো আফসানার কাছে, ওর চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে রুমাইশা ছুটে চিলেকোঠার কামরা থেকে পানির বোতল টা নিয়ে এসে তা থেকে কিছুটা পানি নিয়ে আফসানার মুখের ওপির ছিটিয়ে দিলো। সাফওয়ান আর শাফিন শোয়া থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে দাড়ালো। সাফওয়ান বললো,
— ওকে ফ্যানের নিচে নিতে হবে এখনি। রাফসান, তুই ওকে নিয়ে এখনি আমার কামরায় চলে যা।
সাফওয়ানের কথায় উদভ্রান্ত রাফসান দ্রুত আফসানা কে কোলে তুলতে গেলো। কিন্তু আফসানার ভারী শরীর টা উচু করতে ওর খুব বেগ পেতে হচ্ছে। আফসানা চোখ মেলেছে, কিন্তু কথা বলতে পারছে না, শরীর টাও নাড়াতে পারছে না! আশেপাশের সবার চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাচ্ছে ও! তাকে কোলে নেওয়ার চেষ্টারত রাফসানের মুখ টার দিকে তাকিয়ে দেখছে ও।
রাফসান পারছে না দেখে রুমাইশা উদ্বিগ্ন কন্ঠে সাফওয়ান কে বলল,
— তুমি একটু ধরে দিয়ে আস, ভাইয়া পারছে না, তাড়াতাড়ি করো!
সাফওয়ান একটু ইতস্তত করে তাড়াতাড়ি এসে রাফসান কে সরে যেতে বলে নিজেই পাজাকোলে তুলে নিলো আফসানা কে। তারপর দ্রুত গতিতে চিলেকোঠার কামরায় নিয়ে চলল। আর সাফওয়ানের ইস্পাত কঠিন হাতের স্পর্শে আফসানার নিস্তেজ হয়ে যাওয়া শরীর টা শিউরে উঠলো। আর এরপর সাফওয়ানের বুকের কাছ টাতে যখন ওর মাথা টা স্পর্শ করলো তখন ও চরম আবেশে চোখ বুজে নিলো।
সাফওয়ান গিয়ে শুইয়ে দিলো ওকে বিছানার ওপর৷ রুমাইশা এসে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলো। তারপর আফসানার কাছে গিয়ে ওর হাত আর পায়ে ম্যাসাজ করে দিতে লাগলো। ওর দেখা দেখি শাফিন আর রাফসান ও এগিয়ে এসে আফসানার হাত পা মালিশ করে দিতে লাগলো। রুমাইশা কয়েকবার আফসানাকে ডাকলো ভাবি ভাবি বলে, আফসানা কোনো রকমে সাড়া দিলো। শাফিন এক দিকে সরে এসে ওদের ফ্যামিলি ডাক্তারের নাম্বারে কল দিতে লাগলো।
আর সাফওয়ান ওদের থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে, চোয়াল শক্ত করে, তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে থাকলো আফসানাকে।