মা’য়ের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহিনুর। শারমিনের মুখে মুচকি হাসি থাকলেও কাজল কালো টানা টানা চোখদুটোতে রয়েছে প্রবল দৃঢ়তা। তার চোখের দৃঢ়তা,ওষ্ঠকোণে ফুটে ওঠা আশ্বস্ত হাসি,কণ্ঠধ্বনির সীমাহীন ক্রোধ’ই বুঝিয়ে দিচ্ছে এই মূহুর্তে বলা কথাগুলোতে ঠিক কতোখানি ক্ষোভ মেশানো রয়েছে। কি অদ্ভুত রূপ শারমিন বাইজির৷ শাহিনুরের এক অদ্ভুত সুন্দরী মা। এতো ত্যাজ,এতো ক্রোধের অধিকারিনী’কে কি আদেও বাইজি গৃহে মানায়? এ পৃথিবীতে সঠিক জিনিসের সঠিক স্থান দেওয়া হয় না। তাই তো আজ শারমিনের স্থান বাইজি গৃহে। লম্বা, ফর্সা, মাঝারি গড়নের শারমিন’কে এক নজরে দেখে অপছন্দ করার জো নেই। অত্যাধিক সুন্দরী মেয়ে’দের কপাল এতো মন্দ হয় কেন কে জানে।
শাহিনুর চেয়ে আছে মা’য়ের দিকে। মা’য়ের মুখ দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায় তার। বক্ষঃস্থলে প্রশান্তি লাগে খুব৷ কিন্তু তেজস্বী মায়ের ত্যাজি রূপ দেখলেই ভয়ে মুখটা চুপসে যায়৷ এ মূহুর্তে শারমিন’কে দেখে মিশ্রিত অনুভূতি হচ্ছে শাহিনুরের। তাই কিছুটা ভীতিগ্রস্থ হয়ে পড়লো সে। মাথা নিচু করে বারকয়েক ঢোকও গিললো। কিন্তু শারমিন মনস্থির করেছে এবার সে শাহিনুর’কে কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞাত করবে। আর বেশী সময় নেই। মেয়ে’কে নিজের কাছ ছাড়া করার পূর্বে এই কঠিন দুনিয়ার কাঠিন্যতা,নির্মম দুনিয়ার নির্মমতা, মানুষ তকমা পাওয়া অমানুষগুলো সম্পর্কে পুরোপুরিই জ্ঞান দান করতে হবে। কথিত আছে যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ। আজ সে শাহিনুর’কে নিরাপত্তা দিতে পারছে। কারণ আজ সে জীবিত রয়েছে। পরিচয় এক বাইজি হলেও জমিদার অলিওর চৌধুরী’কে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু কাল যদি তার মৃত্যু ঘটে তার এই ফুলের মতোন মেয়েটার কি হবে? আজ জমিদার অলিওর চৌধুরী শারমিন শায়লা’কে কিছুটা হলেও মান্য করে৷ কিন্তু কাল যদি শারমিনের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়? তখন অলিওর চৌধুরী নিজেই শাহিনুর শায়লা’কে ভোগের সামগ্রী বানাবে না তার নিশ্চয়তা কি? মানুষ মরণশীল। এই কঠিন সত্য জমিদার’রা ভুলে গেলেও সে তো ভুলে যায়নি। তাই আজ বেঁচে থাকা অবস্থায় আগামী ৫০ বছর শাহিনুর যেনো সঠিক ভাবে বাঁচতে পারে,সঠিক পথে চলতে পারে সেই পরিকল্পনা করে শাহিনুর’কে দীক্ষা দেবে। এই পরিকল্পনা যদি সফল না হয় তবে চারদিকের সব নরপশু’রা, হায়েনার দলেরা খুবলে খাবে তাকে। নরক বানিয়ে দেবে তার এক এক’টা রাত এক এক’টা দিন’কে। আর ভাবতে পারলো না শারমিন। বক্ষে যেনো আকস্মাৎ অগ্নি জ্বলতে শুরু করলো তার৷ মান্নাতের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। মান্নাত মাথা নিচু করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে দ্বারে খিল দিলো শারমিন। তারপর মেয়ের কাছে এসে হাত ধরে মেঝেতে পাড়া বিছানায় গিয়ে বসলো। যে যে জায়গায় আঘাত করেছিলো গতকাল প্রতিটি জায়গায় দৃষ্টি বুলিয়ে বললো,
-‘ ব্যথা আছে? ‘
শাহিনুর আবেগান্বিত হয়ে মা’য়ের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললো। ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,
-‘ আম্মা তুমি আমাকে মাফ করে দাও। ‘
শারমিন শাহিনুরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-‘ আমি তোমাকে মাফ করে দিছি গো আম্মা। তুমি কেঁদো না। ‘
শাহিনুরের মাথায় হাত বুলিয়ে কথাটা বলে শেষ করতেই আবার বললো,
-‘ ইশ চুলগুলোর কি অবস্থা দেখি চিরুনি দাও আঁচড়ে বেনুনি গেঁথে দেই। ‘
শাহিনুরের কপোলদ্বয় মুছে ললাটে গাঢ় চুমু খেলো শারমিন৷ মায়ের স্নেহে সিক্ত হয়ে থেমে গেলো শাহিনুর৷ লক্ষ্মী মেয়ের মতোন তেল,চিরুনি, চুলবাঁধার ফিতা এনে দিলো মা’কে। তারপর মায়ের সামনে বসে পড়লো। শারমিন মুচকি হেসে চুলে বিলি কেটে তেল দিতে শুরু করলো। বললো,
-‘ তোমার কোন প্রশ্ন আছে নুর? থাকলে নির্দ্বিধায় করতে পারো। ‘
স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো শাহিনুর। কারণ সত্যি অনেক প্রশ্ন আছে তার। তার মনের কথা বুঝেই শারমিন অনুমতি দিয়েছে ভাবতেই প্রশান্তি লাগলো খুব। তাই চটপটে গলায় বলে ওঠলো,
-‘ আম্মা মানুষ কেন মানুষ’কে খুন করে? প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মালিক তো আল্লাহ। এই অধিকার তো মানুষের নেই। ‘
-‘ অনধিকার চর্চা করা মনুষ্য জাতির স্বভাব নুর৷ আর নাম মাত্র মানুষ’রাই তো অপর মানুষ’কে হত্যা করে। এদের মানুষ নয় অমানুষ বলা হয়। ‘
-‘ অমানুষ কি আম্মা? ‘
-‘ মানুষ হয়েও যারা অমানুষের মতো কাজ করে তারাই অমানুষ। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে নুর, যিনি মানুষের মুখে হাসি ফোটায়,যিনি মানুষ’কে বাঁচতে সাহায্য করে তিনিই মানুষ। আর যিনি মানুষ’কে কাঁদায়,নিজ কর্মের দ্বারা অগণিত মানুষের হৃদয়ে হাহাকার সৃষ্টি করে, অপরের প্রাণ কেড়ে নেয় তিনিই অমানুষ। ‘
-‘ আম্মা তাহলে জমিদারের সেই পুত্রও তো অমানুষ। মান্নাত বুবু’কে কাঁদায় যে!’
পলাশ’কে ইঙ্গিত করতেই চুপ থাকলো শারমিন। কিছু একটা ভেবে স্মিত হেসে বললো,
-‘ আমার মেয়ে তুমি নুর। আমার চেয়েও অধিক শক্তিশালী হতে হবে তোমায়। মানুষ পড়তে হবে তোমাকে। যেদিন তুমি মানুষ পড়তে জানবে সেদিনই তোমার মা নিশ্চিন্ত হতে পারবে। নয়তো মরেও শান্তি পাবে না তোমার আম্মা। ‘
আচমকাই শারমিনের দিকে ঘুরে শারমিন’কে জড়িয়ে ধরলো শাহিনুর। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বললো,
-‘ অমন কথা বলো না আম্মা তুমি অমন কথা বলো না। তোমার কিছু হবেনা তুমি কোথাও যাবে না। আমাকে ছেড়ে তুমি মরতেও পারবেনা৷ বাঁচলে আমাকে নিয়ে বাঁচবে মরলেও আমাকে নিয়ে মরবে। তুমি কিন্তু আম্মা আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। ‘
দু’চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করলো মা, মেয়ের। অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠলো শারমিনের। হায় হায়! এই মেয়ে’কে কি করে দূরে পাঠাবে সে? কি করে থাকবে তার বাচ্চা’টা?
[১৮]
পুরো একটা রাত,পুরো একটা দিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটলো রঙ্গনের। দিনশেষে কোয়াটারে ফিরে প্রণয় দেখলো রঙ্গন গোসল সেরে তয়ালে গলায় ঝুলিয়ে রুমজুড়ে পায়চারি করছে। প্রণয় ঘরে ঢোকা মাত্রই রঙ্গন প্রশস্ত হেসে বললো,
-‘ ভাই তুমি এসেছো? তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ‘
-‘ তাই নাকি তা বাঁশিওয়ালা হঠাৎ আমার অপেক্ষা’তে যে! ‘
প্রণয়ের ব্যঙ্গাত্মক বাক্যটি শুনে ভীমড়ি খেয়ে গেলো রঙ্গন। চোখ দু’টো রসগোল্লার মতো গোল গোল করে বললো,
-‘ এ ভাই তুমি নুরের মুখে এই ডাক শুনেছো তাইনা? ‘
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রণয়। কয়েকপল নীরবতা পালন করে ডিভানে গিয়ে বসলো। বললো,
-‘ এক বাইজি কন্যা’কে নিয়ে এতো মাতামাতি কি ঠিক হচ্ছে রঙ্গন? ‘
মাথা চুলকে বিছানায় বসলো রঙ্গন। আমতা আমতা করে বললো,
-‘ মাইয়া বেশ সুন্দরী ভাই। হতে পারে সে বাইজি কন্যা কিন্তু সে বাইজি নয়। এমন রূপবতী দু’একটা জমিদার বাড়ি আসলে ক্ষতি নেই তো…’
-‘ আর ইউ সিরিয়াস? ‘
-‘ ইয়েসস। ‘
-‘ পুরে পরিবারের সঙ্গে যুদ্ধ করবি? যুদ্ধ করবি পলাশ চৌধুরী’র সঙ্গে? ‘
-‘ না ভাই পরিবারের সঙ্গে নয় তবে পলাশ চৌধুরী’র সঙ্গে যুদ্ধ হবে। সময় এবার আমার। ‘
-‘ তার মানে ভালোবাসা নয় শুধুই প্রতিশোধের জন্য? রঙ্গন চৌধুরী পলাশ চৌধুরী’র ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এক বাইজি কন্যা’কে ব্যবহার করবে! ‘
কিছুটা ঘৃণার সুরে কথাটি বললো প্রণয়। রঙ্গন মুচকি হেসে ওঠে দাঁড়ালো। ঘাড়ে জড়ানো তয়ালেটা দু’কাধ বরাবর নিচ থেকে টেনে ধরে শরীর টান টান করে দাঁড়ালো। বেশ আয়েশি কন্ঠে বললো,
-‘ অমন রূপবতী’কে এতো তুচ্ছ করোনা ভাই৷ অমন জিনিস’কে হেলাফেলা করতে নেই। তাছাড়া ইউ নো হোয়াট? পলাশ চৌধুরী’কে পাটকেল মারার সময় এসে গেছে। ভয় নেই কোন ভাই’কে বিন্দু অসম্মানও করবো না৷ শুধু একটু নিয়ম ভঙ্গ করবো। ‘
-‘ মুনতাহা’র সামনে তুই এটা পারবি? ‘
-‘ যদি মুনতাহা কষ্ট পেতো পারতাম না ভাই। কিন্তু যে আগুনে এতোকাল জ্বলছি আমি সে আগুনে পলাশ চৌধুরী’কে জ্বালিয়ে ছাড়বো। ‘
নিঃশব্দে শ্বাস ছাড়লো প্রণয়। রঙ্গন গিয়ে তার পাশে বসলো। তারপর ধীরসুরে বললো,
-‘ ভাই আঙুর গাছে আঙুর ধরেছিলো। পাকার অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু তার আগেই পলাশ চৌধুরী সুযোগ পেয়ে টোপ করে তা খেয়ে নিয়েছে। ঠিক এমনই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে আবার। ‘
দু’হাত শক্ত মুঠ করে ফেললো প্রণয়। রঙ্গন তার কথার ইতি টেনে গতরাতের ঘটনা শুনতে চাইলে প্রণয় অত্যন্ত কৌশলে তাকে বুঝিয়ে বিদায় করলো। রঙ্গন চলে যেতেই ঠাশ করে দরজা আঁটকে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে নিজের চুলগুলো খামচে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো প্রণয়। শরীর কাঁপিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-‘ তোর উদ্দেশ্য সঠিক হলে আমি চুপ হয়ে যেতাম কিন্তু তোর উদ্দেশ্য সঠিক নয় রঙ্গন। আই এম সরি। ‘
অন্ধকারে মাথা নিচু করে বসে ছিলো শাহিনুর। আচমকা বাঁশির সুর কানে ভাসতেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো তার। ধড়ফড়িয়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। দ্রুত পায়ে ছুটে গেলো জানালার কাছে। জানালার কাছে আবছা ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়েই মুচকি হাসলো রঙ্গন৷ বাঁশির সুর থামিয়ে এক পা,দু’পা করে এগুতে লাগলো। মাথায় গামছা বেঁধে লুঙ্গির সাথে ঢিলেঢালা ফতুয়া পড়েছে রঙ্গন। হাতে তার বাঁশি। আজ তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে জমিদার পুত্র। এইরূপে আবছাভাবে রঙ্গন’কে দেখে বিস্মিত হলো শাহিনুর। তাকে আরো একটু চমকে দেওয়ার জন্য রঙ্গন তেঁতুল গাছের আড়ালে থাকা মইটা নিয়ে জানালায় ঠেকালো তারপর অর্ধেক মই অবদি ওঠে হাত বাড়িয়ে বললো,
-‘ নুর এসো। ‘
শাহিনুরের সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো। বক্ষঃস্থলে তীব্র কম্পন শুরু হয়ে গেলো। গণ্ডস্থল থেকে বক্ষঃস্থল অবদি শুকিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা হলো। কোনক্রমে সে মৃদুসুরে বললো,
-‘ তুমি আমায় ডেকো না বাঁশিওয়ালা। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারবোনা। ‘
রঙ্গন মুচকি হেসে বললো,
-‘ আমার বাঁশির সুরও শুনবে না? ‘
এ প্রশ্নের জবাবে মন খারাপ হয়ে গেলো শাহিনুরের। রঙ্গন বললো,
-‘ এই এই মন খারাপ করছো কেন? তুমি আমার সঙ্গে না গেলেও আমি তোমায় বাঁশির সুর শোনাবো।’
এটুকু বলে এক লাফে নিচে নেমে পড়লো রঙ্গন। আতঁকে ওঠলো শাহিনুর। স্বাভাবিক হলো তখন যখন রঙ্গন তেঁতুল গাছের শেকড়ে বসে বাঁশি বাজাতে লাগলো। শাহিনুর ক্ষণকাল অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলো। তারপর ভাবলো মায়ের বলা কথা গুলো। চাঁদের আলোতে যতোটুকু রঙ্গনের হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল মুখটুকু দেখতে পেলো ততোটুকুতেই সে প্রবল বিশ্বাসী হলো। বিরবির করে বললো,
-‘ মানুষ তো এমনই হওয়া উচিৎ। জমিদারের এই পুত্রই কি তবে মানুষ আর বাকিগুলো সব অমানুষ। ‘ সকলের প্রতি একরাশ ঘৃণায় তিক্ত হয়ে ওঠলো শাহিনুর। আবার যখনি কর্ণে বাঁশির সুর ভেসে এলো, চক্ষে রঙ্গনের প্রাণোচ্ছল প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠলো সমস্ত তিক্ততা ভুলে একরাশ ভালোলাগায় সিক্ত হয়ে ওঠলো তার বুক। ইশ পৃথিবী’টা কতো সুন্দর! প্রেমে পড়ার প্রথম ধাপে যদি পৃথিবী’টা সুন্দরই না লাগে সে প্রেমে পড়ে লাভ কী? শাহিনুর প্রেমে পড়েছে। ভীষণ একটা প্রেমের টান অনুভব করছে সে। তাইতো পৃথিবী’টা সুন্দর লাগছে তার৷ এই রাত,এই ক্ষণ,এই মানুষ, ঐ চাঁদ সবটাই আজ ভীষণ সুন্দর।