অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ৫৩

84★

(১২৪)
রাতের দিকে একটু ইমপ্রুভ হলো আদওয়ার।সেন্স ফিরলো।একটু আধটু কথাও বলল।আরহামের জোরাজোরিতে তাকে কেবিনে শিফট করা হলো।আদওয়া যতক্ষণ আইসিইউ তে ছিলো,উনি প্রতিটা সেকেন্ড ছটফট করেছেন।

এ মুহুর্ত গ্লাসের বাইরে দৃষ্টি আদওয়ার।দূর আকাশের তেজি তারকা এতই ঝলমল করছে যে তাদের বড় এক অংশ এখান থেকেই গুণা যায়।একটা তারা হুট করেই মিলিয়ে গেলো।দৃষ্টি ঘুরিয়ে আরহামের দিকে তাকালো আদওয়া।আরহাম পাশে বসলে বুঝালো,তারাগুলো গুনে দিতে।সে তাঁরা গুনলো,আরহাম ঠায় তাকিয়েই রইলেন।আরহামের দূর্বল দৃষ্টি আদওয়ার চোখে আটকাতে বলল, ‘এমন অগোছালো হয়ে গেছেন কেন?আমাকে নয় আপনাকে পেশেন্ট বোঝা যাচ্ছে।’

আরহাম আদওয়ার হাত বুকে লাগিয়ে বললেন, ‘আমি বাড়ি যেতে চাই।আপনাকে নিয়ে বাড়ি যেতে চাই।এখানে দমবন্ধ লাগছে।’

‘যান।’

‘আপনাকে নিয়ে যাবো।’

‘আমি কি আর ফিরতে পারবো?’

আরহামের আঁখিদ্বয় জলে ভরে গেলো।’হুয়াট ননসেন্স আদওয়া।আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।এরকম বলবেন না।’

******
আব্বুকে বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন ভিসা রিনিউ করার।আব্বু খবর নিতে গিয়ে জানতে পারলেন, কেসের কাজ সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু হবে না।
আরহাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘সম্পূর্ণ বলতে?’

‘কাগজে কলমে তোমাদের ডির্ভোস হয়ে যাওয়ার পর।একটা সুযোগ আছে,তুমি যদি সাইন করে দাও তাহলে কিছু একটা করা যাবে।’

‘আর কোনো উপায় নেই?’

‘আপাতত নেই।’

‘আমি না গেলাম।আদওয়ার বাবা নিয়ে গেলে তো হবে।বা আপনি?’

‘তাঁর বাবা হলে সুবিধা হবে।আদওয়া যেতে চাইবে উনার সাথে?জিজ্ঞেস করে সিওর হয়ে নাও।’

‘জিজ্ঞেস করে আর কি হবে!সুস্থ হওয়াটাই তো বড় বিষয়।’

*****
এদিকে টেনশন করতে করতে আম্মুর অবস্থা খারাপ।হাফসা তাকে বারবার সামলাতে গিয়েও পারছে না।উনার কথা,আদওয়ার কি এমন হয়েছে তাকে নিয়ে এখনো বাসায় ফিরেন নি।সাথে দূভার্গ্যবশত একান ওকান থেকে শুনে ফেলেছেন,পুরো অর্ধদিন সে আইসিইউ তে ছিলো।এরপর থেকে কোনোভাবেই শান্ত হচ্ছেন না।রাতের দিকে হাফসা না পারতে আরহামের নাম্বারে কল দিয়ে বলল, ‘আম্মু বেশী আহাজারি করছেন।সেন্সলেস ও হয়েছেন দূই দূইবার।সাথে হাই ব্লাড প্রেসার।আমি কি করবো?’

‘আম্মুকে এসব কে বলল?’

‘তিনি নিজেই আদওয়ার আম্মুর নাম্বারে কল দিয়ে জেনেছেন।’

‘আচ্ছা দেখছি।’
আরহাম রেখে দিতে চাইলে হাফসা বলে উঠে, ‘শুনুন!’

‘হু?’

‘ছোটো কেমন আছে?’

‘আল্লাহ যেমন রেখেছেন।’

‘আ্ আপনি কেমন আছেন?’

তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘সুযোগ থাকলে আপনার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তি কুড়াতাম উমায়ের।’

_______
নির্জন নিশীথা প্রহর।স্বচ্ছ গ্লাস পেরিয়ে দেখা যায়, আকাশে আজ চাঁদ নেই।আধারি রাতের আকাশে গুটিকয়েক তাঁরা মিটমিট জ্বলছে।চারিদিকে কোথাও কেউ নেই।শুধু যানবাহনের ভারী শব্দ।আদওয়া মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে।রাতের জোনাকি পোকা চারিদিকে।সে প্রায় রাতে মুগ্ধ হয়ে দেখে জোনাকি পোকাদের।মনে হয় দল বেঁধে হারিকেন নিয়ে নাচছে তারা। তবে এই মুহুর্তে রাতের এই সৌন্দর্য তাঁর মনে ডুকতে পারছে না।সে ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে।চোখ দূটো জ্বলছে খুব।

শ্বাসগুলো যথাসম্ভব ধীরে ধীরে নিচ্ছে।কি জানি ওর শ্বাসকষ্টের ভারী শব্দে আরহামের ঘুম ভেঙে যায়।চাররাত অবধি নিজের খেয়াল নেই, ঘুম নেই।মুখটা কেমন শুকনো হয়ে গেছে।মুখ উঁচিয়ে তাকালে বুকে ব্যথা ধরে।আবারো হেলান দিয়ে পড়ে রইলো বেডে।
রুমে পিনপতন নীরবতা। সে নিজেকে সামলে নেয়।আরহামের মায়াবী মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ভাবে,
‘আর কি আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর সুযোগ হবে আমার!’

উনার পরনে টুপি।কি যে মায়া লাগছে।আদওয়া ঝাপসা চোখে তাঁর প্রিয়তমকে মন ভরে দেখলো।এ জনমে উনার থেকে শ্যামলাই থেকে গেলো!ইন শা আল্লাহ জান্নাতে সে শুভ্র সৌন্দর্য্য নিয়ে আরহামকে কেমন চমকে দেবে!

******
সকালে দেরিতে চোখ খুললো সে।উঠে বসাতেই বমিটিং হলো।সাথে নাকমুখ দিয়ে ব্লিডিং।একেবারেই দূর্বল হয়ে পড়ছিলো।বলল, খুব খিদে পেয়েছে।স্যালাইন চললেও সেটা কোনো কাজ করছে না।বরং প্রচুর ঘামছে।

স্যুপ খাইয়ে দেয়ার সময় সে ইশারায় বুঝালো, গিলতে অসুবিধা হচ্ছে।শ্বাস ফেলার সময় আরহাম পাশে থেকে ওর দীর্ঘ টান অনুভব করছেন।শ্বাসকষ্ট উঠলে যেমন শিসের মতো আওয়াজ হয়,আদওয়ার এরকমই হচ্ছিলো।ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলল, একটু উঠিয়ে হেলান দেওয়াতে।শুয়ে থাকতে থাকতে কাঁধে,বাহুতে ব্যথা করছে।
আরহাম তাকে তুলতে চাইলে নার্স এসে বাঁধা দিলো।আরহাম খুব করে অনুরোধ করলেন, নার্স অনুমতি দিলোই না।আরহামের রাগ উঠে গেলো।আদওয়ার কষ্ট হচ্ছে সেটা কেন নার্স বুঝছে না।বেডে বসে আদওয়াকে উনার বাহুতে শোয়ালেন।ক্যানেলায় টান পড়ছে দেখে আরেকটু এগোলেন।

ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হাতটা দিয়ে আরহামের হাত জড়িয়ে ধরলো।ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে ভাঙ্গা বুলিতে বলল,’আ আ্মার যদি কিছু হ্ হয়ে যায় আপনি আমাকে ভুলে যাবেন?’

আদওয়ার সুন্দর কন্ঠস্বর কেমন ভেঙ্গে গেছে।চোখগুলো হলুদ বর্ণ ধারন করেছে।কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে।আরহাম ওর হাতে আলগোছে চুমু দিয়ে বললেন, ‘কখনো সম্ভব না আদওয়া।আই প্রমিস নো ওয়ান উইল এভার টেইক ইউর প্লেইস মাই হার্ট।’

আরহামের চোখে চোখ রেখে আদওয়া কেঁদে ফেললো। ধীরে ধীরে বলল, ‘আমি আরেকটু বাঁচতে চাই আপনার সাথে।’

‘আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।’
আরহাম তাকে দূর্বল হতে দিলেন না। বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে রইলেন ক্ষনকাল।বুকের ভেতর ঝড় বইছে।অসহ্য রকম যন্ত্রণা যেনো চেপে রেখেছে উনাকে।একটু সুযোগ দিলেই অঝোর ঢেউ হয়ে বেরিয়ে আসবে।বারবার পলক ফেলে অশ্রুতে ভিজে আসা চোখ আড়াল করার খুব চেষ্টা করছেন।ঠোঁট কামড়ে আদওয়ার দিকে তাকালেন।কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে শ্যামাপাখিটা!সম্ভব হলে ওর পুরো কষ্টটুকু নিজে নিয়ে নিতেন।উনার ছটফটে শ্যামাপাখিকে এত কষ্ট পেতে দিতেন না!আদওয়ার গালে কপালে আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিলেন।তাঁর মলিন চেহারাটুকু আরহামের হৃদয়ে তীব্র বেগে রক্তক্ষরণ হওয়াচ্ছে।এত কাছে থেকে শ্যামাপাখি কি অনুভব করতে পারছে!

*******
ডক্টর আদওয়ার ফিটনেস প্রমাণপএ রিজেক্ট করে দিলেন।এখন ওর জার্নি করার এভিলিটি নেই।আরহামের সাথেই কথোপকথন হচ্ছিলো ডক্টরের।আরহামের অনুরোধ ফেলে তিনি বললেন, ‘সি ইজ ড্যাম ইল।একজন ক্যান্সারের রোগী।তার অবস্থা নিজের চোখেই দেখছেন, আমরা….

আচমকা আরহামের চোখ আটকালো দরজায়।আদওয়ার মা দু’হাতে ওরনা চেপে কেঁদে ফেললেন।আরহাম বুঝে ফেললেন, আদওয়ার রোগটা উনার কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।এবার তাদের কীভাবে সামলাবেন!

*****
যোহরের নামাজ আদায় করে আরহাম একটু বাসার দিকে এগোচ্ছিলেন।আম্মুকে কিছু একটা স্বান্তনা না দিলে একদম ভেঙে পড়বেন তিনি।

কিন্তু হুট করেই ভেতরটায় ধ্বক করে বাড়ি মেরে উঠলো।তখুনি ফোনটাও বেজে উঠলো।আরহামের সাহস হলো না আব্বুর ফোনটা তুলতে।ছুটে চলে গেলেন হসপিটালের দিকে।

ভেতরে আসতেই দেখলেন আদওয়া কেমন ছটফট করছে।ব্লিডিং হচ্ছে আবারো।একজন নার্স ছুটে গেলো ডক্টরের কেবিনের দিকে।

আরহামকে দেখে আদওয়ার মা বাবা সরে গেলেন।আরহাম হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে আলতো হাতে ঠোঁটের ব্লাড মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে আদওয়া?ব্রিদেনে কষ্ট হচ্ছে?’

সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বলল, ‘আমাকে একটু আপনার বুকে জড়িয়ে ধরবেন?’

আরহাম আর এক মুহূর্তও দেরি করলেন না।আদওয়ার কাছে গিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন৷ভেঙ্গে আসা স্বরে বললেন,
‘ভালোবাসি আদওয়া।ভালোবাসি আপনাকে।আমাকে এভাবে ছেড়ে যাবেন না৷ আমি যে একদম একা হয়ে যাবো আমার শ্যামাপাখিকে ছাড়া।’

আরহামের কোলের মধ্যে আদওয়ার মুখ।একহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে অন্যহাতে গালে হাত রেখে বললেন,’কষ্ট হচ্ছে তাই না?

আদওয়া জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো।মুখ দিয়ে কিছু একটা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।ঠোঁট ইশারায় কিছু রিপিট করতে করতে আচমকাই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। থেমে গেলো তার হৃৎস্পন্দন, তার নিঃশ্বাস। শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলো মুহুর্তেই কিন্তু আঙ্গুলের অগ্রাংশ তখনও নড়ছিলো।আরহাম গালে হাত চাপড়ে কোনো রেসপন্স না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেলেন।নার্স তাকে পুনরায় শুইয়ে ইলেকট্রিক হিটশক দিতেই আদওয়ার শরীরখানা হালকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।দ্বিতীয়বার আর নড়লো না পর্যন্ত।আরহাম নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।স্মৃতি ফিরে আসতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন ওর নিথর দেহটা।উনার চোখের অবিরাম অশ্রুফোঁটা আদওয়ার গ্রীবা স্পর্শ করে কান বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।

প্রিয়জনেরা এসে হামলে পড়লো তাকে নিয়ে।কান্নার শব্দে ভারী হলো চারপাশ।বুকফাঁটা আর্তনাদ,আর্তচিৎকার,কান্না আহাজারির মধ্যে হাফসা বুঝলো না,তাঁর প্রিয়তমকে এবার কীভাবে সামলাবে!

*****
আসরের পরক্ষণ~
হাফসা ছুটে গেল করিডোরের দিকে, করিডোর শূন্য। সেখানে কেউ নেই। করিডোরের এক প্রান্তে রাখা টুলে আরহাম বসেছিলেন।হাফসা উনার কাছে গেল। শান্ত স্বরে বলল, ‘এইভাবে চুপচাপ বসে থাকবেন না।’

আরহাম উঠে হাফসাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।অভিমানী ছোট্ট মেয়েটি জানলও না-এই পৃথিবীতে তার জন্যে কত ভালবাসাই না জমা ছিল ।

ছোট্ট আদওয়া,শ্যামাপাখি। তোমার প্রসঙ্গ অপেক্ষা উপন্যাসে আর আসবে না। কারণ তোমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না। মৃত মানুষদের জন্যে আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্যে। এই চরম সত্যটি না জেনেই তুমি হারিয়ে গেলে!(এই অংশটি ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসের)

*****
আরহাম,আব্বু,আয়বীর সাহেব,সায়হান মাএ চারজন মাহরাম পুরুষের উপস্থিতিতে ইশার নামাজের পর আদওয়ার শেষ আয়োজন সম্পন্ন হয়।

জ্যোৎস্না প্লাবিত নিশুতিরাত।রাত গভীর হলে যেমন,পঙ্কীকুল নীরব হয়ে যায়, পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তাজওয়ার মহলও নীরব।সেই নীরবতায় অন্ধকার ঘরে একজনের পৃথিবী কেঁপে উঠলো,হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে এলোমেলো হয়ে অশান্তি সৃষ্টি হলো।শান্তির খুঁজে স্থান নেওয়া সেই জায়নামাজে,নিদারুণ কঠিন কলুষিত যন্ত্রণায় অশ্রুকণা ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ঝরতে থাকলো।

(কারো কি চোখে পানি আসছে?🥺অবশ্য আদওয়াটার জন্য কারো মায়া নেই,আমি ছাড়া)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।