ইট পাটকেল | পর্ব – ১৪

ইট পাটকেল পর্ব ১৪
সানজিদা বিনতে সফি
ছাদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আশমিন।সব সময় গোছানো ছেলেটা আজ প্রচন্ড অগোছালো হয়ে নিজের জীবনের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। অনুভূতিহীন চোখ গুলো আজ পরাজিত সৈনিকের মতো নত হয়ে আছে।আমজাদ চৌধুরী এসে সন্তপর্ণে ছেলের পাসে বসলো।আশমিন বাবার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমজাদ চৌধুরী তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আশমিনের কাধে হাত রাখলো।দুজনের সম্পর্ক সাপে নেউলে হলেও এক জন আরেকজনের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত। দুজনের সম্পর্ক অনেকটা বাচ্চা কালের বন্ধুদের মতো। সারাক্ষণ একজন আআরেকজনের পিছনে লেগে থাকতে মজা পায় তারা।কিন্তু একজনের মনের আকাশে মেঘ জমলে আরেক জন অস্থির হয়ে উঠে।
— কিছু বলবে আব্বু?
— কি হয়েছে বাবা।সকাল থেকেই লক্ষ্য করছি।এমন উদ্ভট বিহেইভ করছো কেন?
আশমিন শান্ত চোখে তাকালো তার বাবার দিকে।বাবার সহজ সরল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুক টা হু হু করে উঠল।এমন একজন মানুষ কে কেউ কিভাবে ঠকাতে পারে! সেই মানুষ টা যদি হয় নিজের গর্ভধারিণী মা এটা জানার পর এই মানুষ টা পারবে তো নিজেকে সামলাতে?
— আমাকে খুলে বলো বাবা।
আমজাদ চৌধুরীর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো আশমিন। বাবার চোখের দিকে তাকালে কষ্ট হয় খুব।বাবা কে ভালোবাসে।প্রচন্ড ভালোবাসে। সেই বাবা কে এভাবে কেন ঠকাল কামিনী চৌধুরী! চোখ বন্ধ করে ফেললো আশমিন। রাগ হচ্ছে তার। সব কিছু ধ্বংস করে দেয়ার মতো রাগ।
— ছবি গুলো দেখেছো আব্বু?
আমজাদ চৌধুরী হতাশ হলেন।ছেলের মুখ দেখে কখনোই তার মনের খবর বোঝা যায় না।তাই সে সরাসরি জানতে চেয়েছিল।কিন্তু ছেলে তার মুখ খুলছে না।

— এসব কি ধরনের কথা আশমিন? আমি কেন আবার বিয়ে করতে যাবো? তুমি জানো তোমার এই আচরণের জন্য তোমার আম্মু কতটা কষ্ট পেয়েছে? তোমার কাছে এমন কথা আশা করি নি।
আমজাদ চৌধুরীর গলায় তীব্র হতাশা আর ক্ষোভ। আশমিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। ছেলের দৃষ্টি দেখে থমকে গেলো আমজাদ চৌধুরী।দুই হাতে ঝাপটে ধরে কেদে উঠলেন।
— কি হয়েছে বাবা? আমাকে বলো?তুমি এখনো আমার কাছে সেই ছোট্ট আশু।যাকে আমি কাধে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি। দুই হাতে যাকে আমি প্রথম কোলে তুলে নিয়েছি।হাটা শিখিয়েছি, কথা বলা শিখিয়েছি।তুমি আমার কাছে এখনো সেই আধো আধো বুলিতে আব্বু ডাকা আশমিন ই আছো।আগে যেভাবে আব্বুর কাছে নিজের সমস্ত অভিযোগ অভিমান খুলে বলতে তেমন এখনো বলো বাবা।
আশমিন তার বাবাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। ছেলের চোখের পানি দেখে দিশেহারা হয়ে গেলো আমজাদ চৌধুরী।আজ পর্যন্ত ছেলে কে সে কাদতে দেখে নি। এমন কি নূর চলে যাওয়ার পরে যখন মাইনর এট্যাকের জন্য হসপিটালাইজ হলো তখন ও আশমিন কাদে নি।রক্তিম চোখে শুধু তাকিয়ে থাকতো।
আজ কি এমন হয়েছে যার জন্য তার ছেলের চোখের পানি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে?
কয়েক মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিলো আশমিন। চোখের পানি মুছে আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালো।তার কান্না ভেজা চোখ দেখে সেও কেদে দিয়েছে। ভিতর থেকে কান্না গুলো আবার দলা পাকিয়ে এলো। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— আমার কথা মেনে নাও বাবা।
— পাগল হয়ে গেছো?নিজের মায়ের সংসার ভাঙ্গতে চাইছো!আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমার কথা শুনে। (হতভম্ব গলায়)
— আমি চাই সে কষ্ট পাক আব্বু।আপনজন হারালে কেমন লাগে তার বোঝা উচিত। কাছের মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করলে কতটা কষ্ট হয় তা হাড়ে হাড়ে বুঝবে এবার।তার লোভ তাকে কোথায় নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে আমি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই আব্বু। আর তাকে তার সম্রাজ্য থেকে টেনে নামাবো আমি।
আমজাদ চৌধুরী এবার ঘামতে লাগলো। কি করেছে কামিনী? এই প্রশ্ন টা করতে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে এমন কিছু শুনতে চায় না যা শুনলে সে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে।
— তুমি সহ্য করতে পারবে না আব্বু।তার মৃ*ত্যু অবধারিত। তার লোভ তাকে খু*ন করবে। আগামী সপ্তাহে তোমার বিয়ে। এখন গিয়ে ঘুমাও।মেয়ে আমি নিজেই পছন্দ করে নিবো।
— আমি ওকে ভালোবাসি আশমিন।
আমজাদ চৌধুরীর গলা টা হালকা কেপে উঠলো।
— সে তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়।
আশমিনের গলা নির্লিপ্ত। আমজাদ চৌধুরী টলমল পায়ে চলে গেলেন ছাদ থেকে।
নূর তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু দেখলো।এতক্ষণ সে ছাদের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল।পরিস্কার ভাবে কিছু না বুঝলে ও এটা ঠিক বুঝলো যে আশমিনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।সকালে সব কিছু মজা ভেবে উড়িয়ে দিলেও এখন বিষয় টা খুব ভাবাচ্ছে তাকে।হঠাৎ হেচকা টানে তাল সামলাতে না পেরে কারোর শক্ত বুকের সাথে তার মাথার সংঘর্ষ হয়ে গেলো। ব্যথা পেলেও কিছু বললো না সে। এটা আশমিন ছাড়া কেউ না সে জানে।
— প্রেম পাচ্ছে?
বিরক্ত চোখে তাকালো নূর।প্রেম কেন পাবে আজব? এখানে প্রেম পাওয়ার মতো কি হয়েছে এখানে?একদিন নিজের মন মীরজাফরি করেছে বলে কি প্রতিদিন ই সে পিছলে যাবে নাকি।
— ছারুন।সব সময় এভাবে গা ঘেষাঘেসি করেন কেন?
আশমিন অবাক হওয়ার ভান করে আর্তনাদ করে বললো,
— মিথ্যা কথা! আমি সারাক্ষণ তোমার গা ঘেসাঘেসি করি না নূর। আমার কতো কাজ জানো তুমি? আমি শুধু মাঝে মধ্যে হালকা ঘেষাঘেসি করি।তাতেই তুমি দু দিন রুম থেকে বের হতে পারো না(শয়তানি হেসে)।
নূর হা করে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে চিৎকার করে বললো, চুপ করুন। আপনি একটা অশ্লিল গিরগিটি।
আশমিন নূরের মুখভঙ্গি কে পাত্তা না দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
— আমার কি মনে হয় জানো?আমরা যখন জেনারেশন বাড়ানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে ট্রায় করবো তখন আর তোমাকে খুজেই পাওয়া যাবে না। দেখা গেলো তুমি কোন সাইন্স ল্যাবে অসহায় হয়ে ঝুলছো।তাই তোমার এতো বড় একটা টাস্কে ইনভলভ হওয়ার আগে উচিত নিয়মিত একটু একটু করে প্র‍্যাকটিস করা। আসো আমরা বরং সময় টাকে কাজে লাগাই।আমি থাকতে তোমার কোন চিন্তা নেই।মিনিষ্টার আশমিন জায়িনের বউ হয়ে তুমি কোন ল্যাবে কংকাল হয়ে ঝুলবে এটা মেনে নেয়া যায় না। ব্যপার টা লজ্জাজনক।
নূর হতভম্ব হতেও ভুলে গেলো। আশমিনের কথা গুলো মাথায় তাল গোল পাকিয়ে খিচুড়ি হয়ে গেলো। সে শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। এদিকে আশমিনের কয়েকদফা চুমু খাওয়া শেষ। নূর সম্ভতি ফিরে পেতেই চিৎকার দিয়ে আশমিন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো।মনে মনে কয়েকবার আউড়ালো,
— নির্লিজ্জ নির্লজ্জ নির্লজ্জ।
নূর যেতেই আশমিন আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পরলো। আপাতত তার কাজ শেষ। এখন নূর যা শুনেছে তা নিয়ে না ভেবে আশমিন কে গালি দিতে ব্যস্ত থাকবে।সব কিছু তারাতাড়ি করতে হবে। নাহ,আর কয়েকটা চুমু খেতে পারলে ভালো হতো। মেয়ে বিয়ে করেছে না চিংড়ি মাছ দ্বিধায় আছে আশমিন। সারাক্ষণ তিড়িংতিড়িং করতে থাকে।কালকেই বাজার থেকে ভালো দেখে একটা দড়ি কিনে আনাবে সে।আদরের সময় নো তিড়িংতিড়িং। ভোতা মুখ নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো সে।এখন একটা ঘুম দরকার।
কামিনী চৌধুরী ফ্যাচফ্যাচ করে কেদেই যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরীর সেদিকে হুস নেই। ছাদ থেকে নেমে অস্থির ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে সে।কামিনী কি এমন করছে ভাবতে ভাবতে চুল ছেড়ার জোগাড়। কামিনী চৌধুরীর নাক টানার শব্দে বিরক্তিতে মুখ কুচকে ফেললো আমজাদ চৌধুরী।রুক্ষ গলায় বলল,
— কি সমস্যা তোমার কামিনী? এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কেদে আমার মাথা ব্যথা আর বাড়িয়ে দিয় না।বিরক্ত লাগছে।দয়া করে কান্না বন্ধ করে বলো কি এমন করেছো যার জন্য ছেলে এমন ধ্বংসের খেলায় নেমেছে।নিজের পেটের ছেলেকে তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না কামিনী। সে যা বলে তাই করে।বুড়ো বয়সে সতিনের সংসার না করতে চাইলে সত্যি টা আমাকে বলো।
কান্না বন্ধ করে ভয়ার্ত চোখে তাকালো কামিনী চৌধুরী। এতো বছরের পাপ কি তবে ছেলের সামনে চলে এসেছে!কাপা কাপা গলায় বলল,
— আ আমি ক কিছু করি নি আমজাদ। তোমার ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চলো আমরা কানাডা ফিরে যাই।ওখানে আমাদের যা আছে তা দিয়ে আমাদের চলে যাবে।
আমজাদ চৌধুরী শান্ত চোখে তাকালো কামিনী চৌধুরীর দিকে। হীম গলায় বলল,
— আমাদের কিছু নেই কামিনী। আমি আজ সকালে সব কিছু আশমিনের নামে করে দিয়েছি।

(কিছু কথা না বললেই নয়।আমি কয়েকদিন যাবত গল্প একটু লেট করে দিচ্ছি। আমার নিজের ও ভালো লাগছে না। কিন্তু আমি অপারগ। হাত আজ আবার ফুলে গেছে। ইনফেকশন হয়েছে। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন। আমি নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছি আমি। দয়া করে কষ্টদায়ক কিছু বলবেন না।)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।