অফিডিয়ান | পর্ব – ৭১

আফসানা কে বই গুলো দিয়ে রুমাইশা যখন রুমে এলো তখন সাফওয়ান বিছানায় বসে বালিশে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে কিছু মেইল দেখছিলো। রাশা বিছনায় খেলছে। সাদমান আর শাহমীর সকাল থেকেই নিচ তলায়৷ বর্তমানে তারা দুজন দাদিমা আর নানুমনির সাথে ভাতঘুম দিচ্ছে।

রুমাইশা রুমে ঢুকতেই সাফওয়ান তাকালো ওর দিকে। ওর থমথমে মুখ দেখে সাফওয়ান আন্দাজ করলো কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। কিন্তু কিছু আর জিজ্ঞেস করলো না। রুমাইশা সাফওয়ান কে পাশ কাটিয়ে বিছনায় উঠে বসলো। তারপর সাফওয়ানের দিকে পেছন ফিরে শুয়ে পড়ে রাশা কে বুকের ভেতর নিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো।

সাফওয়ান দেখলো ওকে কিছুক্ষণ। বোঝার চেষ্টা করলো তার বউয়ের মাথায় আসলেই কি চলছে। কিন্তু কিছুই মাথা এলো না ওর৷ একটুখানি বিরতি দিয়ে গলা খাকারি দিলো সাফওয়ান, তাতেও রুমাইশার কোনো হেলদোল দেখলো না ও৷ সাফওয়ান এবার জিজ্ঞেস করলো,
— না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ছো যে! শরীর খারাপ লাগছে?

রুমাইশা ছোট করর উত্তর দিলো,
— না! ঠিক আছি।

সাফওয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস৷ করল,
— শাফিন কে দিয়ে অতো গুলো ইসলামিক বুকস নিলে যে হঠাৎ! কিন্তু একটাও তো রুমে দেখছিনা!

— অগুলো একজন কে গিফট করেছি। খুব দরকার ছিলো তার৷

সাফওয়ান অবাক হলো কিছুটা। ল্যাপটপ টা বন্ধ করতে করতে বলল,
— কাকে গিফট দিলে? আমাকে তো কিছুই জানালে না!

রুমাইশা রাশা কে বুকের কাছে আর ও খানিক টেনে নিয়ে নির্বিকার কণ্ঠে বলে উঠলো,
— আফসানা কে।

সাফওয়ান সাথে সাথেই চমকে তাকালো তার দিকে পেছন ফেরানো রুমাইশার দিকে। রুমাইশা যে শুধু শুধু আফসানা কে ইসলামিক বই গিফট করবে না এটা বেশ ভালোভাবেই জানে সাফওয়ান। রুমাইশা যে কাল রাতের ঘটনা কোনো ভাবে জেনে গেছে সেটাও বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো ও৷
শুকনো একটা ঢোক গিললো সাফওয়ান। তারপর কোল থেকে ল্যাপটপ টা নামিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে নিজের বালিশে শুয়ে পড়লো ও৷ তারপর ধীর গতিতে একটু একটু করে একে বেকে এগিয়ে গেলো রুমাইশার দিকে৷ এরপর রুমাইশার একদম কাছে গিয়ে ওকে পেছনে থেকেই নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে জড়িয়ে ধরলো, তারপর রুমাইশার ডান হাতের নিচ দিয়ে নিজের ডান হাত টা গলিয়ে দিয়ে রুমাইশার পেটের ওপর রাখলো।
আধো ঘুমে থাকা রাশা সামনের ওপর হঠাৎ বাবার হাত দেখতে পেয়ে খলবলিয়ে উঠে রুমাইশার বুকের কাছ থেকে সরে পেটের কাছে চলে এসে বাবার হাত নিয়ে খেলতে শুরু করলো। রাশা জেগে যাওয়ায় চটে গেলো রুমাইশা। ধমকের সুরে ও বলল,
— দিলে তো মেয়েটার ঘুম ভেঙে! সরে গিয়ে ঘুমাও, মোটেও আমার গায়ের ওপর আসবানা! পিরিত দেখাতে আসছে!

বলেই রাশা কে পেটের কাছ থেকে টেনে নিয়ে বিছানার অন্য কোণায় সরে গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে রাশা কে নিজের বুকের ওপর উপুড় করে শুইয়ে দিলো। বাবার হাত টা হাতছাড়া হওয়ায়, আর মায়ের বাবাকে ধমক দেওয়ায় রাশা মন খারাপ করে বাবার দিকে মাথা ঘুরিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো। সাফওয়ান মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের তর্জনি টা ঠোঁটে ছুইয়ে ইশারা করলো চুপ যাইতে, কিন্তু মেয়ে তো বাবার ইশারার আগা মাথা বুঝলোই না, উলটো ফুপিয়ে কেদে উঠলো, আর মুখে বলল,
— পাপ্পা!

রুমাইশা চোখজোড়া বন্ধ করে ছিলো, রাশার কান্না শুনে চোখ মেলে তাকালো। মেয়ের মুখ থেকে বাবার কথা শুনে নিজের বুকের ওপর থেকে রাশা কে নামিয়ে বিছানার ওপর ছেড়ে দিয়ে সাফওয়ানের দিকে পেছন ফিরিয়ে অন্য দিকে ফিরলো৷ তারপর মুখে বলল,
— পাপা ওয়ালা হয়েছে সব!

মায়ের থেকে ছাড়া পেয়ে রাশা বিছানার ওপর পেছন ঘষতে ঘষতে বাবার কাছে গিয়ে বাবার পেটের ওপর ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো৷ সাফওয়ান মেয়েকে টেনে নিজের বুকের ওপর নিয়ে একটা চুমু খেয়ে বলল,
— আমার আম্মাজান! আমার আম্মাজান ছাড়া আমাকে আর কেউ ভালোবাসে না! সবাই খারাপ! আমি আর আমার আম্মাজান ভালো! তাই না আম্মা?

রুমাইশা ওইভাবে শোয়া অবস্থাতেই বলে উঠলো,
— হু! ভালোবাসার মানুষের তো অভাব দেখছি না! যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকেই মানুষের ভালোবাসার মানুষের জ্বালায় অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছিনা! ভালোবাসার ছড়াছড়ি হয়ে যাচ্ছে চারদিকে! তারপরও মানুষের আরাম হচ্ছে না!

সাফওয়ান রুমাইশার কথার কোনো উত্তর দিলো না। বউ রেগে থাকলে সে কখনোই সরাসরি তার কথার কোনো উত্তরই দেয়না, কারণ দিলেই তার বউ এর মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়! সাফওয়ান রাশার সাথে নিজে নিজেই কথা বলতে লাগলো,
— তোমার মাম্মামের একটু গরম গরম আদরের প্রয়োজন। কিন্তু এইখানে সেটা হচ্ছে না, এই জন্য তোমার মাম্মাম একটু চেতে আছে! একটু না, অনেক খানি! আজকেই কিছু একটা ব্যাবস্থা করতে হবে, নইলে তোমার মাম্মাম পুরাই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়ে আমার সাথে লাভা লাভা খেলবে, তখন আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাবো। তাই আজ তুমি তোমার দাদিমা আর নানুমনির সাথে ঘুমাবে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিনা আম্মা! ডিল?

বলে রাশার ডান হাত টা মুঠি করে নিজের মুঠি করা হাত টা মেয়ের ডান হাতের মুঠিতে ছোয়ালো। তারপর মুখে বলল,
— এই তো, ডিল ডান! আমার সোনা আম্মা!

রাশা বাবার এই হাতে হাত ছোয়ানোয় বেশ মজা পেলো। খিলখিল করে হেসে উঠলোও৷ মেয়ের হাসি তে ফিদা হয়ে সাফওয়ান আর ও কতকগুলো চুমু খেলো ওর মুখে। আর রুমাইশা ওদিক ফেরা অবস্থাতেই দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
— বুড়ো হয়ে যাচ্ছে তাও লজ্জা শরম হলো না শালার শয়তান বেডার!

বউয়ের মুখে এমন গালাগাল শুনে সাফওয়ান ফিক করে হেসে দিলো। তারপর আবার রাশার সাথে কুস্তি করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

৯৪. শেষ বিকালের দিকে সাফওয়ান এক প্রকার জোর করেই রুমাইশা কে ড্রেসআপ করালো৷ তার রিমুর সাথে তার দেশে আসার পর থেকে সেভাবে সময় কাটানো হচ্ছে না। তার ওপর বউ এখন রেগে যাওয়ার মতো বেশ কয়েকটা ইস্যু পেয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে সে ফুলছে। এটাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না, দিলেই বিপদ৷

রিমুর পাগলামি সম্পর্কে সাফওয়ান বেশ ভালোভাবেই অবগত। দেখা যাবে রাগের চোটে তিন চার দিন একধারে কোনো খাবারই খাচ্ছে না! চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকছে ঘন্টার পর ঘন্টা, গোসল দিচ্ছে না সময় মতো, জেগে থাকছে সারারাত, দুম দাম করে কান্না করছে!
এত গুলো বছর ধরে বউয়ের এসব কীর্তি সে ঠেকে ঠেকে আবিষ্কার করেছে।
বেশি রাগ হলে তার রিমু কারো ওপরেই সেটা দেখায় না, একা একা কষ্ট পায়। বাচ্চা গুলোরেও তাদের মতো করে ছেড়ে দেয়। ওই কয়টা দিন রিমু কখন কি করে তা সে নিজেও জানে না। সাফওয়ান রুমাইশার রেগে থাকার ওই দিন গুলোর নাম দিয়েছে মহাজাগতিক ফেজ। কারণ তার মতে ওইসময় টায় রুমাইশা এই পৃথিবীতে থাকে না, ভিন্ন কোনো গ্রহে বাস করে৷

রুমাইশা কে একটা পার্ল রঙা ট্রাউজারের সাথে প্রাসিয়ান রঙা ওভারসাইজ টি শার্ট পরিয়ে দিয়েছে সাফওয়ান৷ মেরুণ রঙা চুল গুলো নিযের হাতে ক্লাচার দিয়ে সুন্দর করে বেধে দিয়েছে। আর নিজে পরেছে একটা কালো রঙা প্যান্ট আর তার সাথে ছাই রঙা শার্ট৷

গোছ গাছ করে রাশা কে কোলে নিয়ে রুমাইশা আর সাফওয়ান রুম থেকে বেরোলো। রাশা কে আয়েশার কাছে রেখে যাবে। দোতলায় নামতেই শাফিনের সাথে দেখা হলো। সে এই মাত্র ঘুম থেকে উঠলো। শাফিন কে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো সাফওয়ান। রুমাইশা কে বলল রাশা কে নিয়ে নিচে যেতে, সে শাফিনের সাথে কয়েক টা কথা বলে আসছে৷ রুমাইশা চলে যেতেই শাফিন বলল,
— তোমার কথা মতো আমি আফসানা ভাবির সাথে ওই ব্যাপারে কথা বলতে গেছিলাম, ভেবেছিলাম তাকে জনমের একটা শিক্ষা দিয়ে দিবো। বিশ্বাস করো ভাইয়া, আফসানা ভাবি যে এরকম করতে পারে তা আমি কখনো কল্পনাও করিনি, শুধু আমি কেন, কেউই করেনি! রাফসান ভাইয়া ব্যাপার টা জানলে যে কতটা কষ্ট পাবে সেটা চাবলেই আমার কষ্ট লাগছে। তবে আমি শিক্ষা দিতে গিয়ে দেখি সে অলরেডি শিক্ষা পেয়ে গেছে। আমি গিয়ে যখন ভাবিকে এই বিষয়ে জেরা করলাম তখন দেখি ভাবি ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না শুরু করেছে, আর বলছে তার ভুল হয়েছে, এরকম আর সে করবেনা, রুমি আপু যেন তাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেয়। পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, যে কি ব্যাপার! রুমি আপু এর ভেতরে কই থেকে আসলো, তখন সে আমাকে বলল যে রুমি আপু নাকি তাকে দুপুর বেলা খতম করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গেছে এক প্রকার, আর ভাবির চরিত্রের উন্নতির জন্য কয়েক গাছি ইসলামিক বই দিয়ে গেছে, আমাকে দিয়ে যেগুলো কিনিয়েছিলো আপু, সেগুলো। ভাবতে পারো! কিন্তু রুমি আপু এ কথা কিভাবে জানলো সেটাই আমার মাথায় আসছে না, তুমি তো বলেছিলে রুমি আপু আর ও ঘন্টা খানেক পর রুমে এসেছিলো!

সাফওয়ান চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে বলল,
— আমিও দুপুরেই জানতে পেরেছি যে রিমু জেনে গেছে সব! ও কিভাবে জানলো এ প্রশ্ন আমারও, কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিনা, এমনিতেই রিমু রেগে আছে আমার ওপর, এখন আবার এসব জিজ্ঞেস করলে যা একটু মানাতে পেরেছি তার সব পানিতে যাবে৷

শাফিন কিটিকিটি করে হেসে বলল,
— বউয়ের কাছে সব বাঘই বেড়াল! তা তোমরা কোথায় যাচ্ছো? যেখানেই যাও, বেশি রাত কোরোনা কিন্তু। সকালে গুম হয়ে যাওয়ার বিষয়ে যা বলেছিলাম তা তো মনে আছে তোমার! দোকান পাট কেউ রাত দশটার পর খোলা রাখছে না, কে কখন কোন দিক দিয়ে উধাও হয়ে যাবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই! আর এমন একটা অবস্থা, যে গুম হওয়া ব্যাক্তির টিকিপাত্তা ও পাওয়া যাচ্ছে না! আমরা তো চার পাঁচ জনের দল ও বের হচ্ছিনা ভয়ে, বের হওয়ার হলে পনেরো ষোল জন এক সাথে বের হচ্ছি। আর সেখানে তোমরা দুজন। তাই সকাল সকাল ফিরে এসো। যদিও তোমরা আবার হাইব্রিডের বংশধর, তোমাদের কে তারা কিছু নাও করতে পারে।

সাফওয়ান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
— চিন্তা করিস না, গাড়িতে সেইফটি ব্যাগ আছে আমাদের দুজনেরই। আর রিমুর রাগ পড়ে গেলেই বাড়িতে চলে আসবো। দুয়া কর যেন একটু দ্রুত রাগ পড়ে! যে জিনিস বানাইছে শামসুল মামা!

শাফিন হেসে উঠলো সাফওয়ানের বলার ভঙ্গি দেখে। সাফওয়ান ও যোগ দিলো ওর হাসিতে। তখনই সাফওয়ানের চোখ গেলো নিচের দিকে। বউ তার হলরুমে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকেই কটমট করে তাকিয়ে আছে। সাফওয়ান তাড়াতাড়ি শাফিনের থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নামলো। তারপর কিচেনের দিকে একটু উকি মেরে রুনিয়া কে বলে আসলো যে সে রিমু কে নিয়ে বেরোচ্ছে একটু, দ্রুতই চলে আসবে৷

মায়ের সাথে কথা বলা শেষ করে সাফওয়ান রিমু কে নিয়ে মেইন ডোর দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তারপর তার ল্যামবরগিনি তে করে রিমু কে নিয়ে চলল ঠিকানাহীন গন্তব্যে।

৯৫. রাত প্রায় দেড় টা। সাফওয়ান রিমু কে নিয়ে এখনো গাড়িতে। কোথায় যাচ্ছে সেটা ও নিজেও জানে না। যেখানে যেভাবে রাস্তা পেয়েছে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছে। ফিরে যেতে অসুবিধা হবে না, কারণ গাড়িতে জিপিএস সেট করা আছে। কিন্তু রিমু কে নিয়ে ঘোরার সময়ে সেদিকে তাকায়নি সাফওয়ান।
রুমাইশার ভালো লাগছে অনেক। গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে ও বাইরে। ফিরফিরে বাতাসে ওর মাথার সামনের বেবি হেয়ার গুলো উড়াউড়ি করছে। সেগুলো পরম যত্নে কানের পাশে গুজে দিচ্ছে ও। সাফওয়ান ড্রাইভ করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে! রুমাইশা এক সময় অধৈর্য হয়ে বলল,
— কি ব্যাপার বলো তো! তুমি কি বাড়িতে যাবে না, না কি! দুইটা বাজতে চলল। শাফিন কল দিয়ে খোজ নিয়েছে কয়েকবার। আর কতক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে তুমি?

সাফওয়ান রাস্তার দিকে তাকিয়েই বলল,
— একটা নির্জন প্লাস সেইফেস্ট প্লেইস খুজছি। গাড়ি দাড় করানোর জন্য।

রুমাইশা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— নির্জন প্লাস সেইফেস্ট প্লেইস দিয়ে তুমি কি করবা?

সাফওয়ান রুমাইশার দিকে তাকিয়ে ডান ভ্রু টা উচু করে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
— আমার বউ কে আদর করবো! কারণ তার বাড়ির আদরে পোষাচ্ছে না।

রুমাইশা মুখ বেকিয়ে আবার জানালার দিকে ফিরলো, চাপা গলায় বলল,
— ঢং দেখে আর বাচিনা!

সাফওয়ান সেটা শুনতে পেলো। কিঞ্চিৎ শব্দ করে হেসে উঠলো ও৷ আর ও কিছুদূর এগোতেই একটা জঙ্গল চোখে পড়লো ওদের৷ রাস্তার দুপাশ দিয়ে জঙ্গল টা চলে গেছে বেশ খানিক টা৷ সাফওয়ান গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। জঙ্গলের ভেতর ঢুকতেই ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগলো রুমাইশার চোখে মুখে৷ দারুন লাগলো ওর৷ কিন্তু জঙ্গল টা বেশ ঘন, জানালা দিয়ে জঙ্গলের মিশমিশে অন্ধকারের দিকে তাকালে কেমন যেন গা ছমছমে একটা ভাব আসছে। তাই রুমাইশা জানালার থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকালো।

কিছুদূর যেতেই ওদের দুজনের চোখে পড়লো তিনটা পুলিশের গাড়ি। সাফওয়ান ভ্রু কুচকে তাকালো। এত রাতে এই ঘন জঙ্গলের ভেতর পুলিশের গাড়ি দেখে ও কিছুটা অবাকই হলো। রুমাইশাও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।
সাফওয়ান রিমুর দিকে এক পলক তাকিয়ে পুলিশের গাড়ির থেকে কিছুটা দুরত্বে নিজের গাড়ি টা দাড় করালো। আর সাথে সাথেই রুমাইশার নাকে ভেসে এলো এক উৎকট গন্ধ। রুমাইশা সাথে সাথে নাক চেপে ধরলো হাত দিয়ে। সাফওয়ান ওকে হঠাৎ এভাবে নাক চেপে ধরতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— কিসের গন্ধ পাচ্ছো তুমি? খুব খারাপ নাকি?

রুমাইশা নাক মুখ কুচকে বলল,
— খুবই জঘন্য। তোমার মনে আছে? আমরা একবার ফরেস্টের অনেক ভেতরের দিকে গিয়ে একটা ট্রাইব পেয়েছিলাম, যারা গায়ে কিছু পরতো না! সেইখানে গিয়ে আমরা এক অদ্ভুত গন্ধ পেয়েছিলাম, কেমন যেন পোড়া পোড়া, ঠিক তেমনই একটা বিশ্রী গন্ধ!

সাফওয়ান কিছু একটা বলতে গেলো কিন্তু রুমাইশা সাথে সাথেই হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিলো ওকে৷ তারপর কান খাড়া করে রইলো ওদের ডান পাশে থাকা জঙ্গলের দিকে। কিছুক্ষন কান খাড়া করে শুনে ও বাইরে তাকানো অবস্থাতেই বলল,
— এদিকে কেউ দৌড়ে আসছে। তার পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি আমি। অনেক মানুষের চিৎকার টাইপ কিছু একটা হচ্ছে ওদিকে। ধারালো অস্ত্রের ঘষাঘষির শব্দ ও শোনা যাচ্ছে৷

তারপর সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমার মনে হয় এখানে কিছু একটা হচ্ছে। গিয়ে একবার দেখবে?

সাফওয়ান রুমাইশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
— আমি গিয়ে দেখছি, তুমি গাড়িতেই থাকো। গুরুতর কিছু হলে তোমাকে জানাবো। তখন তুমি চলে এসো।

রুমাইশা মাথা নেড়ে সায় দিলো। সাফওয়ান রুমাইশার সামনে থাকা গাড়ির স্টোরেজ কম্পার্টমেন্ট টা খুলে ভেতর থেকে একটা ব্যাগ বের করলো। তারপর সেই ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙা পোশাক বের করলো। এরপর নিজের গায়ের পোশাক টা খুলে ব্যাগ থেকে বের করা কালো রঙা পোশাক টা পরে নিলো। নিজেদের সেইফটির জন্য এই পোশাক বানিয়ে নিয়েছে ওরা দুজিনেই৷ পোশাকটি বেশ পুরু। ইলাস্টিসিটি ও বিদ্যমান যেন দৌড়াতে কোনো সমস্যা না হয়। পোশাকটি ওদের ল্যাবে বিশেষ ভাবে তৈরি করা। এটা একাধারে বুলেট প্রুফ, কাট প্রুফ, ফায়ার আর ওয়াটার প্রুফ।

সাফওয়ানের শরীরে পুরোপুরি লেগে আছে কালোর ওপর ধুসর রঙের সামান্য কারুকাজ করা পোশাকটি। শরীরের পেশিগুলো দৃশ্যমান হয়ে আছে সে পোশাকের ওপর দিয়ে৷ শুধুমাত্র মুখ আর মাথা উন্মুক্ত ওর। আর বাকি সমস্ত শরীরই পোশাকে ঢাকা৷ সাফওয়ান গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হলো। তারপর জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রুমাইশা কে বলল,
— গাড়ির ভেতরের লাইট টা অফ করে দাও, আর জানালার গ্লাস তুলে দাও। কেউ যেন বুঝতে না পারে যে এর ভেতর কোনো মানুষ আছে৷ আমি যদি সেখানে গিয়ে কোনো বিপদের আভাস পায়, তবে তোমাকে জানাবো। তার আগে তুমি গাড়ি থেকে নামবে না কোনো ভাবেই। গট ইট?

রুমাইশা ওপরে নিচে মাথা নাড়ালো? তারপর গাড়ির ভেতরের লাইট টা অফ করে দিলো। সাফওয়ান গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে ডান দিকের জঙ্গলের ভেতর ঢুকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। সাফওয়ান চোখের আড়াল হতেই রুমাইশা গাড়ির জানালার গ্লাস তুলে দিলো।

.

দ্রুত গতিতে পা চালাচ্ছে সাফওয়ান৷ এখানে কি হচ্ছে সেটা দেখে দ্রুতই আবার ফিরতে হবে রিমুর কাছে। যদিও তার রিমু তাকে ছাড়াই একশোতে একশো, তারপর ও তাকে বেশিক্ষণ একা রাখতে সাফওয়ানের মন সায় দিচ্ছে না।

বেশ কিছুদূর এগোতেই সাফওয়ানের চোখে পড়লো কেউ একজন উর্ধশ্বাসে ছুটে আসছে তারই দিকে৷ সাফওয়ান নিজেও এগিয়ে গেলো সে দিকে। লোকটা অন্ধকারের ভেতর সাফওয়ানকে দেখতে পায়নি। সে পালাতে ব্যাস্ত, অন্ধকারের ভেতরেই একটা গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো লোকটা। সাফওয়ান এবার স্পষ্ট দেখলো লোকটার গায়ে পুলিশের পোশাক।

সাফওয়ান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে টেনে তোলার জন্য লোকটার শরীর স্পর্শ করতেই লোকটা আতঙ্কিত হয়ে হাউমাউ করে কেদে উঠে বলল,
— আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে মারবেন না, ছেড়ে দিন! আমি কাউকে বলবো না আপনাদের কথা! ছেড়ে দিন আমাকে!

সাফওয়ান সাথে সাথেই তার মুখ চেপে ধরে চাপা গলায় বলল,
— ভয় পাবেন না, আপনি যাদের কে ভাবছেন আমি তাদের কেউ নই। স্থীর হোন, চিৎকার করবেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।

লোকটা যেন প্রাণ ফিরে পেলো সাফওয়ানের কথায়। তার চোখে মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। বাম পাশের চোখ টার নিচে কালশিটে পড়ে গেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ জব্বর একটা ঘুষি দিয়েছে সেখানে৷ লোকটা সাফওয়ান কে জাপটে ধরে হড়বড় করে বলতে লাগলো,
— আমাকে বাচান ভাই, আমাকে বাচান! ওরা সবাইকে বেধে রেখেছে! আমি কোনো রকমে পালিয়ে এসেছি! কিন্তু ওরা আমার পিছু নিয়েছে, ধরতে পারলেই সাথে সাথে গলা নামিয়ে দেবে! ভাই বাচান আমাকে! এখনি চলুন এখান থেকে! ওরা ধরতে পারলে কাউকে বাচিয়ে রাখবে না ভাই!

সাফওয়ান লোকটার হাত দুইটা ধরে একটা ঝটকা দিয়ে বলল,
— স্থীর হোন, ওখানে কি হচ্ছে বলুন আমাকে। কারা আছে ওখানে? আর কতজন? ওরা আপনাদের কে বেধে রেখেছে কেন? আর আপনারাই বা এখানে কি করছেন?

লোকটা ফুপিয়ে কেদে উঠলো, তারপর বলল,
— আমরা গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিলাম যে, যে গ্রুপ টা এই মানুষজনের গুম হওয়ার পেছনে জড়িত তারা যশোরের ভেতরে এসেছে আজই, আর এই জঙ্গলের দিকেই এসেছে। খবর পেয়ে আমার টিম তিন গাড়ি পুলিশ নিয়ে এসেছে। তারা যে সংখ্যায় বেশি সেটা আমরা জানিতাম, কিন্তু এতটা বেশি সেটা জানতাম না। আমরা ত্রিশ জনের মতো আর ওরা প্রায় পঞ্চাশ ষাট জনের কাছাকাছি। আর ওদের সবার কাছেই ভারী ভারী, ধারালো অস্ত্রপাতি। আমরা এখানে এসে গাড়ি থেকে নেমে বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে নেমে পড়ি সবাই। আমরা পৃথক পৃথক কয়েকটি দলে বিভক্ত ছিলাম। কিন্তু ওরা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই ফাঁদ পেতে আমাদের সবাই কে ধরে ফেলে! সেখানে আমরা ছাড়াও আর ও কিছু লোক আছে ভাই, যাদের কে ওরা ধরে রেখেছে।

সাফওয়ান জিজ্ঞেস করলো,
— কিন্তু ওরা মানুষ জন ধরে কি করছে? বাইরে পাচার করছে? নাকি মেরে ফেলছে?

লোকটা আবার ফুপিয়ে কেদে উঠে বলল,
— খেয়ে ফেলছে ভাই! ওরা নরখাদক! ওইখানে বিশাল এক আগুন জ্বালিয়েছে ওরা। সেখানে অলরেডি আমাদের দুইজন কলিগ কে ঝলসানো হচ্ছে ভাই! সে দৃশ্য দেখার মতো না ভাই!

বলতে বলতে লোকটা কেদে উঠলো আবার ও। সাফওয়ান এতক্ষনে বুঝলো কেন রিমু ওই ট্রাইবের ওইখানের গন্ধ পাচ্ছিলো, কারণ ওরাও মানুষের মাংস খেতো, যা রিমু কে ও বলেনি সেদিন। এখনো বলেনি!
সাফওয়ান লোক্টাকে শান্ত হতে বলে বলল,
— চুপচাপ হেটে রাস্তায় উঠবেন। কোনো সাউন্ড করবেন না। আপনারা যেখানে গাড়ি রেখেছিলেন তার পেছনে, খানিক টা দূরে একটা কালো গাড়ি রাখা। সেখানে গিয়ে গাড়ির জানালায় নক দিবেন। ভেতরে আমার ওয়াইফ আছে, সে আপনাকে সেইফটি দিবে। ঠিক আছে?

লোকটি কান্না চোখে মাথা নাড়ালো। তারপর সাফওয়ান ওকে পাঠিয়ে দিলো রাস্তার দিকে। এরপর নিজের কানের ব্লুটুথ ডিভাইস টা রুমাইশার সাথে কানেক্ট করে বলল,
— রিমু, একটা হ্যাংলা পাতলা, পুলিশের পোশাক পরা লোক যাচ্ছে সামনের দিকে। সে গিয়ে গাড়ির জানালায় নক দিলে তুমি তাকে ভেতরে নিয়ে নেবে। আর হ্যা, আমি যতক্ষণ না বলবো ততক্ষণ ভুলেও গাড়ি থেকে নামবে না, ভুলেও না।

রুমাইশা চিন্তিত হয়ে বলল,
— ওদিকে কি হচ্ছে? গুরুতর কিছু হয়েছে?

সাফওয়ান চাপা গলায় বলল,
— এখন কিছুই বলতে পারবো না রিমু, আমার হাতে সময় নেই। পরে তোমাকে সব বলবো, আর যে লোকটা যাচ্ছে তার কাছে শুনলেও তুমি পেয়ে যাবে। তবে কেউ যেন না বুঝতে পারে যে গাড়ির ভেতর কেউ আছে, গট ইট?

রুমাইশা বলল,
— হুম, কিন্তু তুমি ব্লুটুথ ডিভাইস টা আমার সাথে কানেক্ট করে রাখো, ডিসকানেক্টেড হইয়ো না৷

সাফওয়ান ওকে’ বলে সামনে পা চালালো।

.

রুমাইশা গাড়িতে বসে আছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। অনেক ক্ষন হওয়ার পরও সে পুলিশের লোকটা এসে পৌছায়নি। গাড়ির গ্লাস টা নামিয়ে যে একটু দেখবে সেটাও পারছে না! ওদিকে কি হচ্ছে সেটা জানার জন্য ওর মনের ভেতর আকুপাকু করছে।

কিছুক্ষণ পরেই কারো পদশব্দ কানে এলো ওর। জানালার গ্লাসের ভেতর দিয়ে ও দেখতে পেলো সাফওয়ানের বিবরণ দেওয়া সেই পুলিশের পোশাক পরা লোকটা এদিকেই আসছে। কিন্তু রুমাইশা বের হলো না। লোকটার জানালায় এসে নক দেওয়ার অপেক্ষায় বসে রইলো। লোকটা রাস্তায় উঠে এদিক ওদিক কিছুক্ষণ সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে নজর বুলালো। তারপর রুমাইশাদের গাড়ির দিকে সন্তর্পণে পা ফেলে এগোলো।
গাড়ির কাছে এসে লোকটা আবার ও চারদিকে একবার নজর বুলালো। রুমাইশা লোকটাকেই পরখ করছে দেখতে পাওয়ার পর থেকে। লোকটার হাব ভাব বোঝার চেষ্টা করছে। লোকটা এদিক ওদিক তাকানো শেষ করে মৃদু গতিতে জানালার গ্লাসে টোকা দিলো। রুমাইশা খট করে গাড়ির দরজা খুলে নেমে এলো। রুমাইশা কে দেখে দু কদম পিছিয়ে গেলো লোকটা। রুমাইশা গাড়ির পেছনের সিটের দরজা খুলে দিলো লোকটার জন্য। লোকটা কৃতজ্ঞতার হাসি দিলো। এরপর যখন লোকটা গাড়িতে উঠতে যাবে, ঠিক তখনি জঙ্গলের ভেতর থেকে সপাং করে একটা ধারালো তীর এসে খচ করে লোকটার পিঠ ভেদ করে বুক চিরে সামনে বেরিয়ে এলো।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।