৮২. গাড়ির ভেতরে আরও একবার বমি করে দিয়েছে রুমাইশা। এত ছোটাছুটির ফলে ওর শরীর টা একেবারে যেন নেতিয়ে গেছে৷ পেটের বাচ্চা টা না থাকলে হয়তো এত টা অসুবিধা হতো না। সেই ছোট্ট মাংসপিণ্ড টা হয়তো মায়ের এমন ছোটাছুটির কারণে মোটেই ভালো নেই।
গাড়ির ভেতরে কোনো পানি নেই, তাই গাড়ি থামিয়ে রুমাইশার জন্য পানির ব্যাবস্থা করতে গেলো সাফওয়ান। রুমাইশা কে গাড়িতেই রেখে গেলো। কিন্ত গাড়ি থেকে নামার সময় ওর মনে হচ্ছিলো যেন কলিজার আধখানা গাড়িতেই রেখে যাচ্ছে সে৷
পেছন থেকে হারবার্টের ছেলেরা এসে কতদূর পৌছেছে তা জানে না সাফওয়ান। কখন না জানি ওরা নাগাল পেয়ে যায় ওর আর ওর প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর!
সাফওয়ান খুবই দ্রুততার সাথে আশেপাশে গিয়ে কোনো এক জায়গা থেকে এক বোতল পানি নিয়ে এক প্রকার ছুটে এলো আবার গাড়ির কাছে। তারপর গাড়ির ভেতরে ঢুকেই লোকটাকে বলল,
— দাড়ানোর প্রয়োজন নেই ক্রিস্টোফার, আপনি গাড়ি চালানো চালু রাখুন।
ক্রিস্টোফার সাফওয়ানের কথা মতো গাড়ি চালানো জারি রাখলো। আর সাফওয়ান গাড়ির ভেতরেই রুমাইশার চোখে মুখে পানি দিয়ে খানিক টা পানি ওকে খাইয়ে নিজেও খেলো, তারপর ক্রিস্টোফার কে দিলো।
সাফওয়ানের শরীরের ওপর নিজের শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে রুমাইশা নিশ্চিন্তে চোখ দুইটা বন্ধ করে পড়ে রইলো। ক্লান্ত ও অনেক। সাফওয়ান ওকে দুহাতে আগলে নিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রইলো। দৃষ্টি ওর বাইরের দিকে আর কখনো কখনো গাড়ির পেছনে। সতর্ক দৃষ্টিতে ও পেছন দিকে নজর রাখছে যেন কোনো ভাবেই হারবার্টের ছেলে গুলো ওদের কে ধরে না ফেলে।
.
ঘড়িতে এখন সকাল আটটার কিছুটা বেশি বেশি বাজে। বেশ খানিকক্ষন পথ সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালানোর পর ক্রিস্টোফার বলে উঠলো,
— আমরা প্রায় আমাজনের কাছাকাছি চলে এসেছি। আপনাদের বাসা টা কোথায়, ঠিকানা দিন, সেখানেই নামিয়ে দিয়ে আসবো৷
সাফওয়ান এতক্ষন চুপচাপ পড়ে ছিলো রুমাইশাকে কোলের ভেতরে নিয়ে। ক্রিস্টোফারের কথার উত্তরে ও বলল,
— প্রয়োজন নেই ক্রিস্টোফার, আপনি আর ও কিছুটা সামনে গিয়েই আমাদের কে নামিয়ে দিন, আমরা এইখান থেকেই নিজেদের গন্তব্যে পৌছে যাবো।
ক্রিস্টোফার সম্মতি জানিয়ে গাড়ি চালানো জারি রাখলো। সে প্রথম থেকেই সাফওয়ান আর রুমাইশা কে দেখছে। রুমাইশার প্রতি সাফওয়ানের এমন যত্ন আর ভালোবাসা দেখে তার শুধুই নিজের স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে৷ সেও তার স্ত্রী কে এভাবেই ভালোবাসতো, কিন্তু সৃষ্টি কর্তা তাকে আর ভালোবাসার সুযোগ দেননি। গতবছর ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী পরপারে পাড়ি জমায়। এখন সে শুধুই স্মৃতি।
ক্রিস্টোফার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা৷
ঠিক তখনই সাফওয়ানের বুকের ওপর থেকে নিজের নেতানো মাথাটা হঠাৎ করেই উঠিয়ে ফেললো রুমাইশা৷ ওর কান দুটো খাড়া হয়ে গেলো। ভ্রুকুটি করে ও আরও ভালো করে শোনার চেষ্টা করলো কিছু একটা। আর তারপরই সাফওয়ান কে বলল,
— এদিকে অনেক উচ্চ স্পিডে কয়েকটা গাড়ি আসছে মনে হচ্ছে। আমি শুনতে পাচ্ছি সেগুলোর শব্দ। শো শো করে আসছে সেগুলো।
সাফওয়ান চকিতে তাকালো একবার রুমাইশার দিকে। তারপর ক্রিস্টোফার কে জিজ্ঞেস করলো,
— এইখান থেকে আমাজনের ভেতর যেতে কত সময় লাগতে পারে ক্রিস্টোফার?
ক্রিস্টোফার কিছুক্ষণ ভেবে চিনতে উত্তর দিলো,
— গাড়ি ফুল স্পিডে চালালে আধা ঘন্টার ভেতর পৌছে যাবেন৷ কিন্তু আপনারা ফরেস্টের ভেতর কেন যাবেন?
সাফওয়ান তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই বলল
— আমাদের কে এখানেই নামিয়ে দিন ক্রিস্টোফার৷ বাকি টুকু আমরা নিজেরাই চলে যাবো।
ক্রিস্টোফার সাথে সাথেই গাড়ি থামিয়ে দিলো৷ সাফওয়ান রুমাইশা কে মিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নামলো রাস্তায়। তারপর ক্রিস্টোফার কে বলল
— আপনার এ উপকার আমরা কখনোই ভুলবো না ক্রিস্টোফার। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।
রুমাইশা নিজের গলা থেকে শামসুলের দেওয়া স্বর্ণের সরু চেইন টা খুলে ক্রিস্টোফারের হাতে দিয়ে বলল,
— আপনার এ উপকারের কোনো মূল্য হয়না। কিন্তু তবুও আপনি এটা রেখে দিন। আপনি শুধু মাত্র আমাদের জন্য এত খানি রাস্তা পাড়ি দিয়েছেন৷ আপনর যা খরচ হয়েছে সেটা এর থেকে রেখে দিয়ে বাকি টা উপহার হিসেবে গ্রহন করবেন, খুশি হিবো অনেক। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ৷
ক্রিস্টফার চেইন টা নিতে চাইলো না। রুমাইশা কে ফিরিয়ে দিতে গেলো কয়েকবার। কিন্তু রুমাইশা নিলো না, বলে দিলো যে এটা তার প্রাপ্য। আর তারপর ওরা ক্রিস্টোফার এর থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তা বাদ দিয়ে বাসা বাড়ির ভেতর দিয়ে সামনে আগাতে থাকলো যেন ওদের কে কেউ দেখে না ফেলে।
.
রাস্তায় দলে ফলে মানুষ বের হতে শুরু করেছে। সবাই যার যার কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে ছুটে চলেছে রাস্তায়। বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। ভোরের থেকে এখন লোকসমাগম একটু বেশি হয়েছে। আর এসবের ভেতর দিয়ে দ্রুত গতিয়ে পা চালিয়ে হেটে চলেছে সাফওয়ান আর রুমাইশা। দৌড়াচ্ছে না, দৌড়ালে সাধারণ মানুষ ওদের সন্দেহ করবে৷ সোজা পূর্ব দিকে হাটছে ওরা৷ মাঝে মাঝে রাস্তার মানুষ জনের কাছে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হচ্ছে যে তারা আসলেই সঠিক রাস্তায় এগোচ্ছে কিনা।
একবার আমাজনে পৌছে গেলে সাফওয়ানের আর চিন্তা থাকবে না। কারণ আমাজনের অধিকাংশ এলাকাই ওর নখদর্পনে। রুমাইশা কে নিয়ে ও সবচেয়ে সেইফেস্ট জায়গাতে চলে যাবে, যেখানে ওদের কে কেউ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুজে পাবে না। আর সেখানে কেউ জংলি জানোয়ারের ভয়ে যাবেও না৷
সআফওয়ানের পায়ের চোট লাগা জায়গাটাতে ব্যাথা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ তবুও নিজের সর্বশক্তি দিয়ে হেটে চলেছে ও। ওর বা হাতে শক্ত করে ধরা রুমাইশার ডান হাত। রুয়ামাইশা হাটতে হাটতে নিজের তলপেট টাতে মাঝে মাঝেই হাত বুলাচ্ছে। থেকে থেকে ব্যাথায় মুচড়ে উঠছে সেখান টা। কিন্তু সাফওয়ান কে কিছুই বলছে না। বললেই সাফওয়ান ওকে নির্ঘাত কোলে তুলে নিবে। মানুষ টা নিজেই পায়ের ব্যাথাতে নড়তে পারছে না। পা টা মচকে গেছে, খানিক টা কেটেও গেছে। ফুলে গেছে সে জায়গাটা। এই অবস্থায় রুমাইশা কোন মুখে নিজের সমস্যার কথা বলবে?
সাফওয়ান কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে ওকে যে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, কিন্তু রুমাইশা প্রতিবারই মাথা নাড়িয়ে না বলেছে৷ কিন্তু ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে ও৷
ওরা খুব দ্রুত গতিতে হাটছে। যে জায়গাটাতেই লোকজন শূন্য পাচ্ছে সেইখান টা তেই হাটার গতি আর ও অনেকটাই বাড়িয়ে দিচ্ছে ওরা৷ এইভাবে বসত বাড়ির অলিগলি দিয়ে হাটতে হাটতে এক সময় বসতি শেষ হয়ে এলো। ওদের সামনে এখন পুরোপুরি ফাকা জায়গা৷ ওদের থেকে প্রায় কিলো খানেক দূরে আমাজনের সূচনা রেখা দেখা যাচ্ছে৷
গাছের সারি গুলো চোখে পড়তেই রুমাইশা উচ্ছসিত হয়ে উঠলো। মুহুর্তেই নিজের পেটের যন্ত্রণা ভুলে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো ও। চোখে মুখে ওর আনন্দের ঝিলিক দেখা গেলো।
সাফওয়ান নিজের বামে তাকিয়ে দেখলো রুমাইশার ওই উচ্ছ্বসিত মুখ খানা। জঙ্গল টাকে দূর থেকে দেখেই তার বউয়ের এমন অবস্থা, তাহলে যখন জঙ্গলের ভেতরকার সেই চোখ ধাধানো সৌন্দর্য সে দেখবে তখন না জানি কি করবে! রুমাইশার হাসি মাখা মুখ টা দেখতে দেখতে নিজের ঠোঁট দুটোও চওড়া হয়ে এলো সাফওয়ানের৷
রুমাইশা আনন্দের চোটে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে সামনে। সাফওয়ান মানা করেছে কয়েকবার এমন ব্যাঙাচির মতো না লাফাতে, কিন্তু রুমাইশা শোনেনি। রুমাইশা শুধু ভাবছে!
ওই জঙ্গলের ভেতরেই এক সম্পূর্ণ নতুন জীবিনের সূচনা হতে চলেছে ওদের৷ পুরোপুরি অ্যাডভেঞ্চারাস একটা লাইফ লিড করতে চলেছে ওরা।
সেখানে গিয়ে কি ওরা আদিম মানব সমাজের মতো পশু শিকার করে খাবে? জঙ্গলের হিংস্র জানোয়ার দের সাথে লড়াই করে টিকে থাকবে? কিন্তু তার তো বাচ্চা পেটে সে কিভাবে কি করবে?
কথা টা মাথায় আসতেই নিজের ডান দিকে দাঁড়ানো তার থেকে দেড় ফুট লম্বা বিশালদেহী সাফওয়ানের সুদর্শন মুখ টার দিকে তাকালো ও৷ চোখ বন্ধ করে ভরসা করার মতো একটা চেহারা, যার বুকে মাথা রাখলে পৃথিবীর সমস্ত দুঃশ্চিন্তা পোটলা গুছিয়ে রুমাইশার মস্তিষ্ক ত্যাগ করে। এই মানুষ টা থাকতে তার কিসের চিন্তা! যে মানুষ টা চাইলে তার স্ত্রী আর সন্তানের জন্য পুরো বিশ্বকে নিজের হাতের থাবা দিয়ে রুখে দিতে পারবে, সে মানুষ টা পাশে থাকলে আর কি চাই! রুমাইশা মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকলো বড়বড় পা ফেলে সদর্পে সামনে হেটে চলা সাফওয়ানকে, যার সাথে ও পা মিলিয়ে হাটতে পারছে না, পেছনে পড়ে যাচ্ছে বার বার, আর মানুষ টা নিজের বাম হাতে রুমাইশা কে এক প্রকার টেনে নিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
রুমাইশা কল্পনার চোখে দেখতে পেলো একজন খুবই যত্নশীল পিতা কে, যে তার ছোট্ট তুলতুলে বাচ্চা কে পরম যত্নে নিজের বুকের ওপর ঠেকিয়ে রেখেছে এক হাতে, আর অন্য হাতে আগলে রেখেছে নিজের স্ত্রীকে৷ চারপাশে ঘন জঙ্গল, সেখানে কতরকমের প্রাণী, ছোট, বড়ো; শান্ত, হিংস্র; বড় বড় দাঁত ওয়ালা মাংসাশী প্রাণী, সাপ, বিচ্ছু, কিন্তু কোনোকিছুই এই মানুষ টির উপস্থিতির কারণে তাদের আশেপাশে ঘেষছে না! একটা নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে উৎসুক চোখে সে প্রাণী গুলো দেখছে তাদের অভয়ারণ্যে নতুন আগত এই সদস্য গুলোকে।
নিজের অজান্তেই রুমাইশার মুখে এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো যেন।
রুমাইশা তার দিকে তাকিয়ে আছে অনুভব করেই সাফওয়ান নিজের বামে তাকালো। রুমাইশার চোখে চোখ পড়লো ওর। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কেন তাকিয়ে আছে?
সাফওয়ানের ইশারার প্রশ্নের উত্তরে রুমাইশা মাথা নাড়িয়ে বুঝালো যে, কোনো কারণ নেই, এমনিতেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওর চোখ দুইটা স্পষ্ট জানান দিলো, যে আপনাকে পেয়ে আমি ভাগ্যবান!
সাফওয়ান যেন ওর চোখের ভাষা বইয়ের লেখার মতোই পড়ে ফেললো। প্রেমময় হাসি হেসে ও রুমাইশার গাল টেনে দিলো আদর দিয়ে।
কিন্তু হঠাৎ করেই রুমাইশার মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেলো। চকিতে একবার পেছন ফিরে তাকালো ও। রাস্তা শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই, জঙ্গলের শুরু পর্যন্ত পুরাটাই খোলা মাঠ। কিন্তু পেছন দিকের সেই রাস্তার দিক থেকেই গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ আসছে। রুমাইশা উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে সাফওয়ানের দিকে তাকালো আর একবার। তারপর হঠাৎ করেই আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— সাফওয়ান, দৌড়ান!
আর বলতে না বলতেই দূর থেকে দুইটা কালো গাড়ির ওদের দিকে ধেয়ে আসার দৃশ্য দেখতে পেলো ওরা। সাফওয়ান ব্যাপার টা বুঝে ওঠার সাথে সাথেই কোনো কিছু না ভেবেই রুমাইশার হাত টা নিজের হাতের মুঠির ভেতর নিয়ে ছুট লাগালো। পায়ের ব্যাথাটার কথা ওর আর মাথায় এলো না। রুমাইশা সাফওয়ানের হাত টা শক্ত করে ধরে রইলো, যেন এ হাত ছাড়া মাত্রই ওরা একে অপরকে হারিয়ে ফেলবে চিরতরে।
সাফওয়ান নিজের সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়াচ্ছে, ওর পাশা পাশি রুমাইশাও। পেটের ব্যাথাটা দৌড়ানোর কারণে তরতর করে বেড়ে চলেছে। চোখ দুইটা ঝাপসা হয়ে আসছে ওর। তারপর ও প্রাণপণে ছুটে চলেছে।
কিন্তু গাড়ি গুলো প্রচন্ড দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে ওদের দিকে৷
ওরা প্রায় আমাজনের কিনারায় পৌছে গেলো। সাফওয়ান নিরাপত্তার জন্য রুমাইশা কে নিজের সামনে টেনে আনলো, যেন ওরা কোনো আক্রমণ করলে সে আঘাত টা আগে তার শরীরে এসে লাগে, তার স্ত্রীর শরীর যেন স্পর্শ না করে৷
আর তার এ ভাবনাই সত্যি হলো। গাড়ির ভেতর থেকে একজন গার্ড সাফওয়ান কে লক্ষ্য করেই বুলেট ছুড়লো। আর সেটা এসে বিধলো সাফওয়ানের বা হাতের বাহুতে। যন্ত্রণায় দাঁত মুখ কুচকে ফেললো ও। কিন্তু দৌড়ানো থামালো না৷
বুলেটের শব্দে চমকে উঠে চিৎকার দিলো রুমাইশা। আর বুলেট টা যে সাফওয়ানের শরীরে এসে বিধেছে সেটা বুঝতে পারার পরই ও অসহায় চোখে সাফওয়ানের দিকে তাকালো একবার। যন্ত্রণায় মুখটা কালো হয়ে আছে সাফওয়ানের। ঘন ঘন দম ফেলছে ও। ওর এক হাতে এখনো রুমাইশার হাত টা মুঠি করে ধরে রাখা। এক দৌড়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেলো ওরা। শুরুর দিকে জঙ্গল টা অনেকটাই পাতলা। দুরত্বের সাথে সাথে ঘনত্বও বেড়েছে এটার।
গাড়ি দুটো জঙ্গলের কিনারায় থেমে গেলো, গাছ পালার কারণে গাড়ি নিয়ে সামনে আগানো আর সম্ভব না। গাড়ি থামিয়েই গাড়ির ভেতর থেকে লাফিয়ে বের হলো প্রায় জনা তিরিশ বন্দুকধারী গার্ড৷ ওরা বের হয়েই সাফওয়ান দের পালিয়ে যাওয়া রাস্তা অনুসরণ করে ওদের পিছু নিলো।
ছুটতে ছুটতেই সাফওয়ান একবার পেছন দিকে তাকালো। দূর থেকে গার্ড গুলোকে গাড়ি রেখে ওদের পিছু নিতে দেখে সাফওয়ান দাঁড়িয়ে গেলো। ওকে হঠাৎ করেই এভাবে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে রুমাইশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।
সাফওয়ান রুমাইশা কে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ওর কপালে একটা চুম্বন বসিয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
— ওদের কে থামাতে হবে রিমু, নইলে ওরা আমাদের পিছু ছাড়বে না। আমরা যতদুর যাবো ওরাও যাবে! এখন আমি যা বলবো তাই শুনবি। এইখান থেকে সোজা দৌড়ে যাবি। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় দেখবি একটা প্রচুর লম্বা, আর অনেক অনেক প্রশস্ত একটা লাল পাতা ওয়ালা গাছ৷ ওই গাছের কাছে পৌছে নিজের ডান দিকে দৌড়াবি। সেইখানে একটা পানির ছোট্ট ঝর্ণা আছে, আর তার পাশেই অনেক গুলো গুহা, পরপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ওইখানে গিয়ে লিন্ডা বলে ডাক দিবি।
এরপ্র সাফওয়ান নিজের শরীরের ওপরাংশ থেকে নিজের পোশাক টা খুলে রুমাইশার হাতে দিয়ে বলল,
— ডাক দিয়েই এই টা গুহার মুখের কাছে ছুড়ে ফেলবি। ফেলে সাথে সাথেই সেখান থেকে সরে পড়বি। ভুলেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকবি না৷ যেখানে পারিস চলে যাবি। আর শোনার চেষ্টা করবি কোথাও নদীর পানির স্রোতের শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা। যেদিকেই শব্দ শুনবি সেদিকেই চলে যাবি। আমি বেচে থাকলে তোকে অবশ্যই খুজে বের করবো, তাই তুই পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকিস না কেন! আর যদি আমি বেচে না থাকি, তাহলে আমার সন্তান কে সুস্থ সবল ভাবে এই পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব তোর ওপর।
রুমাইশা হা হয়ে শুধু শুনলো সাফওয়ানের কথা। বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। সাফওয়ান কি বলছে এসব! ও বেচে থাকবে না মানে কি! ও কেন বেচে থাকবে না। রুমাইশা সাথে সাথেই সাফওয়ানের কথার বিরোধিতা করে জড়ানো গলায় বলল,
— আমি আপনাকে এইখানে একা ফেলে রেখে কোথাও যাবো না৷ আপনার কিছু হলে কি হবে আমার! আমার সন্তানের কি হবে! আমি আপনাকে ছাড়া এখানে বেচে থাকবো কিভাবে! মোটেই আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি এখানেই থাকবো, আপনার সাথে!
বলতে বলতে রুমাইশার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো,। সাফওয়ান অধৈর্য হয়ে উঠলো, গার্ড গুলো ছুটে আসছে ওদের দিকে। সময় নেই হাতে বেশি। রুমাইশার গাল দুইটা দুহাতে আগলে নিয়ে ও বলল,
— এখন এসবের সময় নয় রিমু! আবেগে জীবন চলবে না! আমি যা বলছি সেটা শুনবি তুই। যেভাবে যে ডিরেকশনে যেতে বলেছি যাবি, যা করতে বলেছি করবি। এখনি, আর এক মুহুর্ত ও দেরি নয়।
বলে রুমাইশা কে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো সাফওয়ান৷ তারপর রুমাইশার দিকে তাকিয়েই নিজের পেছন দিকে হাটতে শুরু করলো ও হারবার্টের গার্ড দের উদ্দ্যেশ্যে।
আর সেদিকে আহত চোখে তাকিয়ে উচ্চস্বরে কেদে উঠলো রুমাইশা। তারপর চিৎকার দিয়ে কাদতে কাদতেই ও ছুটে চলল সাফওয়ানের বলে দেওয়া স্থানে যাওয়া উদ্দ্যেশ্যে৷
৮৩. উর্ধশ্বাসে সামনে ছুটে চলেছে রুমাইশা৷ ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ হচ্ছে না। হাপাচ্ছে ও। পেটের ভেতর টা নিদারুণ যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছে যেন৷ ছুটতে ছুটতে চারদিকে নজর বুলিয়ে যাচ্ছে ও, সেই প্রশস্ত লাল রঙা পাতা ওয়ালা গাছ টার উদ্দ্যেশ্যে।
কতক্ষণ ধরে ও ছুটছে তার হিসাব নেই কোনো। ওদিকে সাফওয়ান কি করছে সেই চিন্তায় মাথার ভেতর টা ওর ঘুলিয়ে যাচ্ছে। সাফওয়ানের খারাপ কিছু হয়ে যাবে এই ভাবনা মাথায় আসছে শুধু, আর বুকের ভেতর টা যেন ফেটে যাচ্ছে।
রুমাইশার দৌড় থামানো প্রয়োজন, পা দুইটা আর পেরে দিচ্ছে না, শরীর ও সায় দিচ্ছে না। কিন্তু এখন কোনো ভাবেই আর থামা যাবে না। একবার থামলেই আর দৌড়াতে পারবে না ও। ওর শরীর হাল ছেড়ে দিবে পুরোপুরি।
ছুটতে ছুটতে হাতে ধরে রাখা সাফওয়ানের পোশাক টা বুকে জড়িয়ে ধরলো রুমাইশা। আর তারপরই হাউমাউ করে কেদে উঠলো ও আবার। সে কান্নার শব্দে সচকিত হয়ে উঠলো এতক্ষনের নিরব হয়ে থাকা জঙ্গলের ভেতর টা৷ আশ পাশ থেকে ঝোপঝাড়ের ভেতর লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট প্রাণী গুলো ছুটে পালালো রুমাইশার কান্নার শব্দে৷ গাছের ডালে থাকা পাখি গুলো এমন হঠাৎ শব্দে সচকিত হয়ে ভয় পেয়ে উড়ে পালিয়ে গেলো৷
আরও অনেক অনেক ক্ষণ ছুটে চলার পর সেই কাঙ্খিত লাল পাতা ওয়ালা গাছ টার দেখা পেলো রুমাইশা। গাছ টাকে দেখা মাত্রই নিজের ভেতর যেন এক আশার আলো দেখতে পেলো ও। তারপর সাফওয়ানের কথা মতো নিজের ডান দিকে মোড় নিয়ে ছুটলো ও, বড় বড় গাছ আর লতা পাতার ভেতর দিয়ে। পায়ের হাইকিং শু এর নিচে মাড়িয়ে গেলো কত শত স্যাতস্যাতে পরিবেশে থাকা পোকা মাকড়।
এদিক টায় জঙ্গল অনেক ঘন। উঁচু উঁচু গাছের পাতার ফাক দিয়ে কোনো রকমে সূর্যের আলো এসে পৌছাচ্ছে মাটিতে। হাটু পর্যন্ত ঝোপঝাড় গজিয়ে আছে সবখানে। এখানে যে মানুষের পা পড়ে না সেটা এর হুলিয়া দেখলেই বোঝা যাচ্ছে৷
ছুটতে ছুটতে একসময় রুমাইশার চোখে পড়লো সেই ছোট্ট ঝর্ণা, আর তার পাশে থাকা এক ঝাক বড় বড় আকৃতির গুহা।
রুমাইশা দৌড় থামিয়ে দিলো। হাটুতে দুই হাত ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ও হাপাতে লাগলো। এরপর আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঝর্ণার কাছে এগিয়ে গিয়ে সেখান থেকে কোষ করে পানি খেলো ও। তারপর হাতে মুখে খানিক টা পানি ছিটিয়ে দিয়ে সাফওয়ানের কথা মতো গুহার কাছাকাছি এলো ও।
তারপর কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে উচ্চস্বরে লিন্ডা বলে ডাক দিলো৷ এরপর সাফওয়ানের গায়ের পোশাক টা দলা পাকিয়ে ছূড়ে মারলো ও গুহার সামনে।
কিন্তু সাফওয়ান ওকে গুহার সামনে থেকে পালিয়ে যেতে বলেছিলো, সেটা না করে ও ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো কি হয় সেটা দেখার জন্য। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না দেখে ও আর ও একবার উচ্চস্বরে ডাক দিলো লিন্ডা বলে৷ আর তখনি গুহার ভেতর থেকে জঙ্গলের নির্জনতা ভেদ করে ওর কানে এলো এক হিংস্র ফোস ফোস শব্দ। যার নড়াচড়ার ভারী শব্দ বলে দিচ্ছে যে সে গুহার ভেতর থেকে এদিকেই আসছে।
আর শব্দ টা শোনা মাত্রই নিজের পেছন দিকে এক পা এক পা করে পেছাতে শুরু করলো রুমাইশা।