অফিডিয়ান | পর্ব – ৫৬

সাফওয়ান গর্জে উঠলো আবার ও। হিসহিসিয়ে বলল,
— রাখ তোদের উপায়, আমি মরি আর বাচি তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না৷ তবে, আমি যদি এইখান থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারি, তবে তোদের বাচার আর কোনো উপায় থাকবে না৷

সাফওয়ান যে কোনো কথাই শুনবে না সেটা বেশ ভালোভাবেই বুঝলো মাইকেল। তবুও দমে না গিয়ে ও বলল,
— দেখুন, মিস্টার আহমেদ, আমরা চাই আপনি বেচে থাকুন। আপনার মতো এমন রেয়ার আর ব্যাসিকালি ইম্পসিবল হাইব্রিড কে আমরা এইভাবে হারিয়ে ফেলতে চাই না। আপনি যদি আমাদের সাথে কো অপরেট করেন তবে আপনি ও বেচে থাকবেন, আমাদের ও লাভ হবে, আর হারভার্ট ও যা চায় সেটা পেয়ে যাবে৷
আর আপনি খুব ভালো করেই জানেন হারবার্ট কি চায়। কিন্তু তার জন্য আপনার বিষগ্রন্থি সহ আপনার বিষথলি কেটে ফেলতে হবে৷ কিন্তু ওগুলো আপনার শরীরে এমন ভাবে এটাচ করা, যে সেগুলো কেটে ফেললে আপনি আর বাচবেন না। তবে আপনি যদি স্বেচ্ছায় আপনার বিষ দাঁত দিয়ে বিষ বের করে আমাদের কে প্রোভাইড করেন, তবে আপনার বিষ গ্রন্থি আর কেটে ফেলার প্রয়োজন পড়বে না৷ আপনিও বেচে থাকবেন আর হারবার্ট ও যা চায় সেটা পাবে, বরং যা চাইতো তার থেকে অনেক বেশিই পাবে৷ আর…. আমরা ও আপনার ওপর রিসার্চ করতে পারবো।

সাফওয়ান দাঁত মেলে হিংস্র ভাবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। ওর ঝকঝকা ক্যানাইন দাঁতদ্বয় ঝলকে উঠলো ল্যাবের আলোতে৷ মাইকেল আর জর্জ অভিভূত চোখে তাকিয়ে দেখলো সাফওয়ান কে। সৃষ্টিজগতের এক অদ্ভুত বিস্ময় এখন ওদের সামনে। সাফওয়ান খোলস ছেড়েছে সদ্য, শরীরের খসখসে চামড়ার লেয়ার টা খুলে গেছে। ভেতরে এখন নতুন চামড়া। উজ্জ্বল শ্যামলা সে চামড়া যেন চকচক করছে। কঙ্কালসার শরীরেও অসম্ভব রকম সুন্দর দেখাচ্ছে সাফওয়ান কে৷ ওই জ্বলজ্বলে চোখ দুইটা যেন সব আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ওই চোখ দুইটার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে৷

সাফওয়ান হাসতে হাসতে হঠাৎ করেই হাসি থামিয়ে ইস্পাত কঠিন গলায় বলল,
— আমি বেচে থাকতে হারবার্ট যা চাইছে তা পাবে না৷ আর, বেচে থাকার জন্য কারো সাথে সমঝোতা করার মতো কাপুরুষোচিত কাজ আমার দ্বারা সম্ভব না। ওই হারবার্টের সাথে সমঝোতা করার চেয়ে আমি মৃত্যু কে বেশি পছন্দ করবো৷

তারপর আবার মুখে অদ্ভুত রকমের হাসি ফুটিয়ে, চোখ দুইটা বন্ধ করে সাফওয়ান বলল,
— কিন্তু তোরা চাইলেও আমাকে বাচিয়ে রাখতে পারবি না৷ কারণ আমার মেডিসিন আমার কাছে নেই। সুতরাং আমি এমনিতেও মারা পড়বো, এবং খুব দ্রুতই৷ তাই এসব, মৃত্যু, সমঝোতা, আমার কাছে নিছক কয়কে টা শব্দ ছাড়া আর কিছুই না৷

মাইকেল আর জর্জ চমকে একে অপরের দিকে তাকালো। ওরা জানে সাফওয়ান একজন কেমিস্ট। কিন্তু ও যে নিজের জন্য কিউর তৈরি করে ফেলতে পারবে তা ওরা ভাবেনি। চোখে চোখে দুজন কথা বলে নিয়ে সাফওয়ান কে আবার বলল,
— আপনি চাইলে আপনার মেড আমরা নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করবো। সেটা কোথায় পাওয়া যাবে, সেই স্থানের নাম বলে দিলে আমাদের লোকেরা গিয়ে খুজে নিয়ে আসবে৷ দেখুন মিস্টার আহমেদ, আমরা চাই আপনি বেচে থাকুন। আপনার মতো একজন হাইব্রিড ক্রিয়েচার কে আমরা কোনোমতেই হারাতে চাই না।

কিন্তু সাফওয়ান ওদের কথার কোনো উত্তরই দিলো না। চোখ বন্ধ করে স্ট্রেচারেই শুয়ে রইলো। কথা বলে নিজের বেচে থাকা এনার্জি টুকু নষ্ট করতে ওর ইচ্ছা করছে না৷

মাইকেল আর জর্জ এতক্ষনে বুঝলো যে সাফওয়ান কে এত স্বাস্থ্যকর আর ক্যালরি যুক্ত খাবার দেওয়ার পর ও কেন সাফওয়ানের সাস্থের উন্নতি হচ্ছে না৷

কিছুক্ষণ সাফওয়ানের থেকে উত্তরের আসায় দাঁড়িয়ে থেকে যখন সাফওয়ানের কোনো হেলদোল দেখলো না, তখন সাফওয়ান কে একা ছেড়ে ওরা বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এসে জর্জ মাইকেল কে বলল,
— ছেলেটা যদি আমাদের কে ওর কিউর এর খোজ না দেয় তবে আমাদের হাতে আর কোনো উপায় থাকবে না৷ হারবার্ট এর কথামতোই আমাদের ছেলেটার বিষথলি টা কেটে ফেলতে হবে।

জর্জের কথায় মাইকেল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
— কিন্তু ওর বিষ থলিতে দুইশো পঞ্চাশ গ্রাম বিষ থাকার কথা ছিলো, সেটা এখন রিডিউস হয়ে একশো সত্তর গ্রামে পরিণত হয়েছে। এটা খুব সম্ভবত হচ্ছে ওর মেডিসিনের অভাবে, আমার যা ধারণা৷ আর এইভাবে চলতে থাকলে সেটা আর ও কমে যাবে। এই কথা হারবার্ট কে জানালে কি হবে ঝতে পারছো?

জর্জ হঠাৎ কিছু একটা ভেবে, চমকে বলে উঠল,
— আমরা যদি হারবার্ট কে বলি, যে সাফওয়ান আহমেদের তৈরি করা মেডিসিনের অভাবে তার বিষ শেষ হয়ে গেছে, বা খুব অল্প পরিমাণে আছে, তবে কি কোনো ভাবে সাফওয়ান কে বাচানো সম্ভব?

মাইকেল কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বলল,
— হ্যা, আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি, তবে এতে হিতে বিপরীত হতে পারে৷ কিন্তু, একবার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি নেই৷ যা কিছু হতে পারে৷

জর্জ মাইকেলের কথায় সায় জানালো। তারপর চোখে চোখে নিজেদের সিদ্ধান্ত টা পাকা পোক্ত করে ওরা ডিসিশন নিলো খুব দ্রুতই হারবার্টের সাথে কথা বলার।

৬৪. রুমাইশা ল্যাবের ভেতর বসে ব্যাগ গোছাচ্ছে। শাফিন দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সকাল বেলা গিয়ে রুমাইশার কথা মতো নির্দিষ্ট কিছু পোশাক বাড়ি থেকে এনে দিয়েছো ও৷ তারপর বোরখা পরে রুমাইশা শাফিনের সাথে বাজারে গিয়ে আর ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কেনাকাটা করে নিয়ে এসেছে৷

রুমাইশা যে সহিহ সালামতে আছে সেটা এখনি বাড়ির কাউকে জানাতে বারণ করেছে রুমাইশা৷ ও এই দেশ ছাড়ার পরই জানাতে বলেছে। নইলে আয়েশা বা রুনিয়া কেউই হউতো ওকে ছাড়তে চাইবে না৷ আর এখন এসব ইমোশনের কোনো জায়গা, সময় কিছুই নেই ওর কাছে৷

ব্যাগের চেইন আটকাতে আটকাতে রুমাইশা শাফিন কে জিজ্ঞেস করলো,
— রাফসান ভাইয়া কত দূর?

শাফিন উত্তরে বলল,
— প্রায় চলে এসেছে। আর দশ মিনিটের মাথায় মণিহারে পৌছে যাবে বলেছে। এতক্ষণ হয়তো আর ও কাছাকাছি চলে এসেছে৷

তারপর বিছানার ওপর এসে বসতে বসতে শাফিন জিজ্ঞেস করলো,
— এই অল্প কয়টা জিনিসে হবে? একটা ট্রলি ব্যাগ ও নিচ্ছো না! শুধু একটা ব্যাকপ্যাক নিচ্ছো। তুমি মেয়ে মানুষ, তোমার জিনিসপত্র বেশি লাগবে এটাই স্বাভাবিক। এখনো ভেবে দেখো৷ ট্রলি ব্যাগ লাগলে বলো, আমি আমার টা তোমাকে দিয়ে দেবো৷

রুমাইশা শাফিনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বলল,
— লাগবে না, এতেই হবে৷ আমি ট্যুরে যাচ্ছি না৷ তাই বেশি জিনিসের প্রয়োজন নেই। আর এটাই হয়তো তোদের সাথে আমার শেষ দেখা। আর কবে তোদের সাথে আমি দেখা করতে পারবো বলতে পারছি না৷ হয়তো আর কখনো দেখা হবে না, বা হলেও বহু বছর পর৷ তবে আমি সেইফলি সব কাজ শেষ করতে পারলে তোকে জানাবো অবশ্যই।

শাফিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সবাই ওদের কে ছেড়ে যাচ্ছে৷ কেউ থাকছে না। লুকাস নামের অসভ্য টার ওপর খুব রাগ হলো ওর৷ ওই শয়তান টার জন্যই এতকিছু হয়েছে ওদের সাথে৷ নইলে সবকিছুই ঠিকঠাক থাকতো। ওরাও আগের মতোই হেসে খেলে জীবন টা পার করে দিতে পারতো।

কিছুক্ষণ পর শাফিনের ফোন বেজে উঠলো। ও ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রাফসানের নাম দেখেই বলে উঠলো,
— ভাইয়া মণিহারে এসে গেছে হয়তো। তুমি এখানেই থাকো। আমি আমার বাইক টা নিয়ে ভাইয়া কে এগিয়ে নিয়ে আসি।

রুমাইশা ইশারায় সম্মতি জানালো। শাফিন বেরিয়ে গেলো ল্যাব থেকে। রুমাইশা সব গোছ গাছ শেষে নিজেও রেডি হতে শুরু করলো। কালো বোরখার ওপর কালো হিজাব নেকাব দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলো ও৷ রাফসান ফ্লাইটের ইমারজেন্সি টিকেট বুক করেছে আজ ভোর বেলাতেই। রাতের এগারোটায় ফ্লাইট ওর৷

রাফসান এসে পৌছালেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুলো নিয়ে ও ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিবে৷ বেশি দেরি হয়ে গেলে ওর সাফওয়ান কে হয়তো আর জীবিত পাবে না ও৷

খানিক্ষন পর রাফসান কে নিয়ে ল্যাবের ভেতর ঢুকলো শাফিন৷ রাফসান ভেতরে ঢুকেই দ্রুত পায়ে রুমাইশার কাছে এসে বোরখা আবৃত রুমাইশা কে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো শক্ত করে অনেক গুলো দিন পর বোন কে কাছে পেয়ে রাফসানের যেন হৃদয় টা জুড়িয়ে গেলো।
রুমাইশা ও ভাইয়ের বুকের ওপর শান্ত হয়ে পড়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর রুমাইশা কে ছেড়ে দিলো রাফসান। তারপর বোরখার ওপর দিয়েই ওর চোয়াল দুইটা দুহাতে আগলে নিয়ে বলল,
— আবার কবে তোর দেখা পাবো জানিনা৷ তুই যে সহিহ সালামতে আছিস তাতেই আমি খুশি। ওইখানে পৌছেই ফোন দিবি। আমার বা শাফিনের, যে কোনো এক জনের কাছে দিলেই হবে৷ আর প্রতেকদিন আপডেট জানাবি। সৃষ্টিকর্তার কাছে দুয়া করি, যেন তিনি তোকে জীবনের সবক্ষেত্রেই সফল করেন। আমিন৷

রুমাইশা ওপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে সায় মানলো। তারপর বলল,
— বাবা মায়ের খেয়াল রেখো ভাইয়া। আর আমি চলে যাওয়ার পরই তাদের জানাইয়ো যে আমি ঠিক আছে। তবে কোথায় আছি, কি করছি সে বিষয়ে কাউকে কিছুই জানানোর দরকার নেই এখন । আমি আমার কাজে সফল হলে তবেই তাদের কে জানাইয়ো। আর, আমি যদি সফল হতে না পারি তবে হয়তো আর কখনোই আমাদের দেখা হবে না৷ সাফওয়ানের সাথে সাথে হয়তো আমাকেও তোমরা হারাবে৷ তবে আমি সফল হবো বলেই আশা রাখি। বাকি টা আল্লাহ ভরসা!

রাফসান আর ও একবার রুমাইশাকে বুকে টেনে নিলো। তারপর নিজের থেকে রুমাইশা কে ছাড়িয়ে নিয়ে বোরখার ওপর দিয়েই ওর কপালে চুমু খেলো রাফসান৷ রুমাইশা রাফসানের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো শাফিনের সাথে৷
শাফিন রাফসান কে নিয়ে আসার সময় বাড়ির রাস্তা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে এসেছে। আবার ও রুমাইশা কে নিয়ে সেই রাস্তা দিয়েই বাইক নিয়ে ছুটে চলল শাফিন৷ মণিহারে গিয়ে রুমাইশা কে ঢাকাগামী বাসে তুলে দিলো ও৷

আর এরপর বাস ছেড়ে দিলে শাফিনের থেকে বিদায় নিয়ে রুমাইশা চলল এক কঠিন যুদ্ধের ভেতর নিজেকে সপে দিতে।

৬৫. মাইকেল আর জর্জ গাড়িতে করে আবার ল্যাবে ফিরছে। মুখ ভার দুজনেরই। কারণ সত্যিই হিতে বিপরীত হয়েছে।
হারবার্ট কে যখন বলা হলো যে সাফওয়ানের শরীরে বিষের পরিমান খুব কম, কারণ তার মেডিসিন টা তার সাথে নেই, তখন থেকেই হারবার্ট চটে গেছে ভিষণ। এত টাকা খরচ করে, এত লোক জন লাগিয়ে সাফওয়ান কে খুজে এনে কোনো প্রফিট সে পাবে না জানার পর থেকেই তার মাথায় কাজ করছে না।

কিন্তু এত সহজে হার মানার পাত্র হারবার্ট নয়। সে তখনি মাইকেল আর জর্জ কে আদেশ করেছে, যেভাবেই হোক সাফওয়ানের মেডিসিনের খবর যেন ওরা সাফওয়ানের মুখ থেকে বের করে৷ আর তারা যদি ব্যর্থ হয় তবে সে নিজের ছেলেদের লাগাবে সাফওয়ানের মুখ থেকে কথা বের করতে৷ আর তার ছেলেরা যে সাফওয়ান কে কমের ওপর ছেড়ে দেবে না সেটাও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে হারবার্ট৷

ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে মাইকেল আর জর্জ। তারা এখন শুধু ভাবছে সাফওয়ান এর থেকে কিভাবে মেডিসিনের খোজ বের করা যায়৷ এই তথ্য জানতে না পারলে তাদের আম ও যাবে ছালাও যাবে৷

এদিকে ল্যাবে থাকা সাফওয়ানের শরীর আরও খারাপের দিকে এগোচ্ছে৷ এখন আর নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আগের মতো অস্থির হয়ে ছটফট করে না৷ স্থীর হয়ে শুয়ে থাকে সারাদিন৷ খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। ওকে দেখাশোনা করার জন্য নিযুক্ত নার্স মেয়েটি হাজার চেষ্টা করেও ওকে কিছুই খাওয়াতে পারছে না৷
চুল দাড়ি সব লম্বা হয়ে বন মানুষের মতো দেখাচ্ছে ওকে৷ জর্জ কয়েকবার চেষ্টা করেছে সাফওয়ানের চুল দাড়ি কাটার ব্যাবস্থা করার৷ কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি, সাফওয়ানের চুল দাড়িতে কেউ স্পর্শ করতে পারেনি৷

জর্জ আর মাইকেল ফিরে এলে, ওদের সাথের অন্যান্য ডাক্তার আর গবেষক দের ছোটখাটো একটা মিটিং হলো সাফওয়ান কে নিয়ে৷ এরপর মিটিং শেষে ওরা সবাই মিলে এলো সাফওয়ানের রুমে।

কিন্তু ওদের উপস্থিতি তে সাফওয়ান কোনো নড়াচড়া করলো না। আগের মতো করেই বিছানায় পড়ে রইলো। নার্স মেয়েটা ওদের খবর দিলো যে সাফওয়ান গতকাল সকাল থেকে কিছুই খায়নি। অনেক জোর করা সত্বেও সাফওয়ান কে সে কিছুই খাওয়াতে পারেনি৷

মাইকেল সহ অন্যান্য রা নিজেদের ভেতর কিছু কথা বলে নিলো। তারপর মাইকেল ইশারা করলো সবাইকে বাইরে বেরয়ে যেতে৷ নার্স মেয়েটি সহ অন্য রাও বেরিয়ে গেলো মাইকেলের ইশারায়।

মাইকেল পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে স্ট্রেচারের পাশে বসে নরম গলায় বলল,
— দেখুন সাফওয়ান আহমেদ, আপনি এইভাবে ভেঙে পড়বেন না৷ আমরা আপনাকে বাচিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি৷ আমাদের পক্ষে যত যা করা সম্ভব সবকিছু করতেই আমরা প্রস্তুত আছি। কিন্তু যার জন্য আমরা এত কিছু করছি সে নিজেই যদি আশা হারিয়ে ফেলে তাহলে কিভাবে হবে বলুন!

সাফওয়ান আগের মতো করে চোখ বন্ধ রেখেই ঝাঝালো গলায় বলল,
— আপনার কাছে আমি জ্ঞান চাইনি। আপনি আমাকে ডিস্টার্ব না করে আমাকে একা ছেড়ে দিলেই আমি বেশি খুশি হবো৷ আর পারলে আমার বাধন গুলো খুলে দিয়ে এখান থেকে কেটে পড়ুন। আমি স্বাভাবিক ভাবে একটু হাটাচলা করতে চাই।

মাইকেল চিন্তা করলো, সাফওয়ান কে জোর জবরদস্তি করে কিছু হবে না৷ মেডিসিনের খবর টা জানতে তাকে ধীর স্থীর ভাবে সামনে আগাতে হবে৷ তাই আর জোরাজোরি না করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে জোরে হাক ছাড়লো,
— অ্যাশলি!

মাইকেলের ডাকে নার্স মেয়েটি রুমের ভেতর এসে মাইকেলের পাশে দাড়ালো আদেশের অপেক্ষায়৷ মাইকেল তাকে বলল,
— মিস্টার সাফওয়ান আহমেদের বাধন গুলো খুলে দাও৷ আর সে যদি কোনো ধরনের প্লেজার চায় তবে তাকে কোনো কিছুতে বাধা দিও না৷

নার্স মেয়েটি মাইকেলের ইশারা বুঝলো। তাকে বাইরে থেকে আগেই বলে দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে৷ গাড় লাল লিপস্টিক দেওয়া ঠোটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার৷ মাইকেল কে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলো সে।

কিন্তু তখনি স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা সাফওয়ান চোখ বন্ধ অবস্থাতেই গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো,
— আমার ওসবে রুচি নেই। আমাকে যেন কেউ কোনো ভাবে বিরক্ত না করে। নইলে কিন্তু মোটেই ভালো হবে না৷ ওপরে পাঠানোর সময় আমি নারী পুরুষ মানিনা, কথাটা মাথায় গেথে রাখবেন৷

নার্স মেয়েটা সাফওয়ানের কথা কিছুটা ভয় পেলো, সে শুনেছে যে সাফওয়ান একজন হিটম্যান। কিন্তু তার মতো সুন্দরী কে সাফওয়ান মারতে পারবে বিলে তার মনে হলো না৷ তাই নিজের ভয় কে পাশ কাটিয়ে সাফওয়ানের কাছে গিয়ে ওর হাত পায়ের বাধন গুলো খুলে দিলো।

কঙ্কালসার শরীর টা নিয়ে উঠে বসল সাফওয়ান৷ হাত পায়ের যে জায়গা গুলোতে মেটালিক বন্ধন গুলো ছিলো সে জায়গা গুলো ছিলে গেছে, সাফওয়ানের এতদিন নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে। ছিলে যাওয়া জায়গা গুলোর অনেকাংশে নতুন চামড়া উঠতে শুরু করেছে৷

সাফওয়ান কে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার জন্য মাইকেল চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,
— আপনি চাইলে আপনার হেয়ার এন্ড বিয়ার্ড ট্রিম করার জন্য আমি লোক পাঠাবো। আপনার হ্যান্ডসাম ফেইস টা ঠিক চাবে দর্শন হচ্ছে না, তাতে আমিই বেশি কষ্ট পাচ্ছি যেন।

সাফওয়ান আজ রাজি হলো চুল দাড়ি গুলো ট্রিম করাতে। ও মাইকেল কে ইশারায় বলল পাঠাতে৷ সাফওয়ানের সম্মতি পেয়েই মাইকেল ল্যাব ছেড়ে বাইরে চলে গেলো। দরজা ঠেলে বেরোনোর আগে অ্যাশলি মেয়েটাকে ধৈর্য ধরে আগাতে ইশারা করলো সে। নার্স মেয়েটা আবার ও মাইকেল কে মাথা নাড়িয়ে আস্বস্ত করলো৷

মাইকেল ল্যাব থেকে চলে গেলে সাফওয়ান স্ট্রেচার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। তারপর হাত পা গুলোর অসাড়তা কাটাতে রুম ময় হাটা শুরু করলো। নার্স মেয়েটা অসভ্যের মতো ড্যাব ড্যাব চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সাফওয়ান ধমক দিয়ে বলল,
— আই নিড সাম প্রাইভেসি, গেইট ইয়োরসেল্ফ আউট ফ্রম দিজ রুম।

মেয়েটা ধমক খেয়ে চুপসে গেলো। সাথে সাথেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ও। মেয়েটা বেরিয়ে গেলে সাফওয়ান একটু সহজ হলো। ওয়াশ রুমে ঢুকে প্রাকৃতিক কাজ গুলো সারলো৷ তারপর ওয়াশ রুমের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো ও৷
পরণে ওর ল্যাব থেকে দেওয়া একটা সাদা রঙা ট্রাউজার৷ শরীরের উর্ধাংশ নগ্ন। বুকের পাজর গুলো স্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান। কালো রঙা ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে তা থেকে চামড়া উঠছে। দাড়ি গোফের ঠেলায় সে ঠোঁট জোড়া দেখা যাচ্ছে না৷ মাথার চুল গুলো ঘাড় ছাড়িয়েছে। সেগুলো জট পাকিয়ে গেছে বেশ খানিক টা।

নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে করতেই রুমের দরজায় টোকা পড়লো। সাফওয়ান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরের নক দেওয়া মানুষ টাকে উদ্দ্যেশ্য করে ভেতরে আসতে বলল ও৷

ওর অনুমতি পেয়ে ভেতরে ঢুকলো একটা ছেলে, তার হাতে একটা বক্স৷ ছেলেটার পেছন পেছন অ্যাশলি মেয়েটা ছাড়াও আর ও কয়েক জন মেয়ে নার্স ঢুকলো৷ অ্যাশলি মুলত সাফওয়ান কে দেখা শোনার দায়িত্বে আছে।
আর ওর অন্য ফেলো নার্স গুলো এতদিন আ্যাশলির মুখে সাফওয়ানের কথা শুনে শুনে কৌতুহল বসত সাফওয়ান কে দেখতে এসেছে৷ যদিও তার জন্য মাইকেলের কাছে খুব কাকুতি মিনতি করা লেগেছে, তারপর অনুমতি পেয়েছে ওরা৷

বক্স হাতে নেওয়া ছেলেটা এসে সাফওয়ান কে বলল যে সে সাফওয়ানের হেয়ার ট্রিম করতে এসেছে৷
সাফওয়ান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ওকে এগিয়ে আসতে বলল, আর তারপর তাকালো ছেলেটার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোর দিকে। সাফওয়ানের চোখে মেয়েগুলোর দৃষ্টি পড়তেই মেয়েগুলো অদ্ভুত ভাবে মুচকি হাসলো। কিন্তু সাফওয়ানের কড়া চাহনিতে ওরা দ্রুত পায়ে আবার যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে গেলো।

৬৬. দীর্ঘ ২১ ঘন্টার ফ্লাইটের পর দুপুরের কিছুক্ষণ আগে আমেরিকার বস্টন শহরের বস্টন লোগান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে নামলো রুমাইশা৷ পরণে ওর ছাই রঙা ট্রাউজার, সাথে সাদা রঙা লং স্লিভ শার্ট৷ ঢোলাঢালা শার্ট টাতে রুমাইশার দৈহিক সৌন্দর্য পুরোপুরি আড়াল হয়ে আছে৷ মাথায় ওর সান ক্যাপ দেওয়া, ঘাড় বাবরি চুলের নিম্নাংশ ক্যাপের নিচ দিয়ে বেরিয়ে আছে। পায়ে ওর একজোড়া সাদা আর গোলাপি মিশেলের লাইটওয়েট শু।

মুখে কালো রঙা মাস্ক পরে পিঠে ব্যাক প্যাক নিয়ে বেরিয়ে এলো ও এয়ারপোর্ট এর ভেতর থেকে৷ কিছুদুর সামনে যাওয়ার পর ই ও দেখলো বড় বড় করে ‘আর কাদের’ লেখা একটা কাগজ উচু করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ, ত্রিশের ওপর বয়স হবে তার। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটা প্রায় পঁচিশ বছর বয়সী মেয়ে৷

রুমাইশা এগিয়ে গেলো ওদের দিকে। তার পর ওদের কাছে পৌঁছে ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজি তে বলল,
— আমিই রুমাইশা কাদের, আপনি নিশ্চয় জোনাস অ্যান্ডারসন!

জোনাস ছেলেটার মুখ খানা হাসি হাসি হয়ে গেলো। ও অবাক হলে বলল,
— আরে, তুমি তো পিচ্চি মেয়ে, তোমার সাথে এতদিন কথা বলে আমি বুঝিইনি যে তুমি এত ছোট হবে! সাফওয়ান আহমেদ এমন বুড়ো হয়ে তোমার মতো একটা বাচ্চা মেয়ে কে বিয়ে করেছে! শেষমেশ ও পেডো* হয়ে গেলো!

জোনাসের এমন রসিকতা রুমাইশার পছন্দ হলো না। যেখানে জোনাসের বাচ্চা জোনাস নিজেই পঁচিশ বছর বয়সি মেয়ে বিয়ে করেছে সাফওয়ানের বয়সি হয়ে, সেখানে সাফওয়ান কে পেডো বলছে! আর রুমাইশা কি অত ছোট? জোনাসের বউ এর থেকে হয়তো বছর তিনেকের ছোট হবে৷

রুমাইশা কে নিজের কথায় হাসতে না দেখে জোনাস একটু দমে গেলো। তারপর ওয়াকওয়ার্ডনেস কাটাতে পাশে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল,
— মিট মাই ওয়াইফ, সেরেনা অ্যান্ডারসন। তোমার আসার কথা শুনে সবচেয়ে বেশি এক্সাইটেড হয়তো সে৷

সেরেনা এগিয়ে এসে রুমাইশা কে হাগ করলো৷ এরপর প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পর রুমাইশা জোনাস আর সেরেনার সাথে তাদের বাসার উদ্দ্যেশ্যে রওনা হলো।

বেশ বড় পরিসরের দোতলা একটা বাসায় থাকে জোনাস আর সেরেনা৷ জোনাস সিঙ্গাপুরিয়ান, কিন্তু সেরেনা আমেরিকান৷ দুজনের লাভ ম্যারিয়েজ। বিয়ের যদিও বেশি দিন হয়নি। চার কি পাঁচ মাসের মতো হয়েছে৷

বাড়ির গেইটে দিয়ে ভেতরে ঢুকলো ওরা। এরপর গাড়ি থেকে নেমে পড়লো রুমাইশা আর সেরেনা৷ জোনাস গাড়িটাকে গ্যারাজে রাখতে গেলো। আর সেরেনা রুমাইশা কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো৷ তারপর রুমাইশাকে ওর জন্য বরাদ্দকৃত রুম টা দেখিয়ে ফ্রেস হতে বলল।

.

দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় সেরেনা ডাকতে গেলো রুমাইশা কে। রুমাইশা ফ্রেস হয়ে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। দীর্ঘ ফ্লাইটের কারণে শরীরে ওর ক্লান্তি। প্লেনের ভেতর ভালো ভাবে ঘুমাতে পারেনি৷ এখন সেটারই কিছু অংশ পুষিয়ে নিচ্ছে ও৷

সেরেনা ডাকার পর রুমাইশা উঠে হাত মুখ ধুয়ে খেতে এলো৷ চেয়ার টেনে টেবিলে বসেই ও জোনাসের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
— আমি আজ রাতেই সাফওয়ানের সাথে দেখা করতে চাই৷ আপনার কিছুই করা লাগবে না, শুধু সাফওয়ান যেখানে আছে সেখানে আমাকে একটু কষ্ট করে পৌছে দেবেন, আর সেই জায়গাটার একটা ম্যাপ আমাকে দিবেন, যেন সাফওয়ান কে খুজে পেতে আমার সুবিধা হয়৷

জোনাস খাওয়া শুরু করতে করতে বলল,
— ম্যাপের ব্যাবস্থা আমি করে রেখেছি, কিন্তু তাতে একটা সমস্যা আছে। সাফওয়ানের দেওয়া তথ্য মতে ওকে কোনো সিক্রেট রুমে রাখা আছে, যার কোনো চিহ্নও আমি ম্যাপের ভেতর খুজে পায়নি। তাই ওকে আসলেই কোথায় রাখা আছে সেটা তোমাকেই নিজে নিজে মাথা খাটিয়ে বের করতে হবে৷
এবং ভুল করেও ধরা পড়া যাবে না। যদি ধরা পড়ো তো তোমার সাথে কি হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ ওইখানের সিকিউরিটি খুবই কড়া৷ তাই ভেতরে ঢুকতে হবে খুব সাবধানে৷ আর লেজার দেওয়া স্পট গুলো ম্যাপে আমি মার্ক করে দিয়েছি। ভুলেও লেজারের সাথে নিজের শরীরের একটা পশম ও স্পর্শ করা যাবে না৷ টাচ লাগলেই সাইরেন বেজে উঠবে। আর সাথে সাথেই সবাই সজাগ হয়ে যাবে৷

রুমাইশা মনোযোগ দিয়ে জোনাসের কথা শুনতে লাগলো। খাওয়া শেষ করে হাভার্ড এর ল্যাব বিল্ডিং সম্পর্কে যতখানি পারা যায় ধারণা নিলো ও৷ এরপর জোনাসের সাথে বসে নিজের অভিযান নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ করে নিজেকে ও প্রস্তুত করলো সাফওয়ানের কাছে যাওয়ার জন্য৷

৬৭. রাতের বেলা সাফওয়ান স্ট্রেচারে, বালিশে হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছিলো। চুল দাড়ি গুলো ট্রিম করার পর থেকে ওকে অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছে। বুনো বুনো ভাবটা কেটে গেছে একদম। আজ বেশ ভালো ভাবে শরীরটা রগরে রগরে গোসল দিয়েছে ও। প্রচুর ময়লা জমেছিলো গায়ে। সেগুলো সব শাওয়ার গ্লাভস দিয়ে উঠিয়েছে৷ গোসলের পর থেকে খুব ফ্রেস লাগছে ওর। মন টা একটু ফুরফুরে লাগছে।

ওকে এখানে এরা অকারণে কেন এখনো আটকে রেখেছে সেটাই ওর মাথায় আসছে না৷ ওর ভেনম লেভেল এখন অনেক নিচে নেমে গেছে, সেটা জানা সত্বেও এরা ওকে ছাড়ছে না৷
সময় কাটছিলো না ওর, বার বার শুধু রুমাইশার কথা মনে পড়ছিলো, তাই রুমে রাখা আলমিরার ভেতর পাওয়া একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করেছে ও৷

কিছুক্ষন পর রুমের দরজা দিয়ে অ্যাশলি নামের মেয়ে টা ঢুকলো। সাফওয়ান সেদিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। মেয়ে টার ড্রেস সেন্স খুবই বাজে৷ অলটাইম ছোট ছোট পোষাক পরে ক্লিভেজের বেশ খানিক টা শো করে ঘুরে বেড়ায় অসভ্য মেয়েটা।
আর আজ কয়েকদিন ধরে সাফওয়ানের আশে পাশে একটু বেশিই খোলামেলা ভাবে ঘুর ঘুর করছে মেয়েটা৷ সাফওয়ান অনেক বার মাইকেল কে বলা সত্বেও মেয়ে টাকে চেঞ্জ করেনি মাইকেল। তার ধারণা সাফওয়ান প্লেজার পেলে হয়তো মন নরম করে মেডিসিনের কথা টা বলে দিবে।

কিন্তু আজ সাফওয়ান কে দেখে অ্যাশলি মেয়েটার চোয়াল নেমে গেলো৷ ওই জঙ্গলের মতো গোফ দাড়ির আড়ালে যে এমন অসম্ভব সুন্দর, সুনিপুণ কাঠামোর পুরুষালি চেহারা লুকিয়ে থাকতে পারে, তা সে কল্পনাতেও ভাবেনি।
অবাক হয়ে এগিয়ে এলো ও সাফওয়ানের দিকে। মুখ টা ওর কিঞ্চিত হা হয়ে আছে। সাফওয়ানের একদম কাছে কাছে এসে দাঁড়িয়ে শরীর টা দুলিয়ে মোহনীয় কণ্ঠে বলে উঠলো,
— আপনার রাতের খাবার দিবো?

সাফওয়ানের চোখে মুখে বিরক্তি দেখা দিলো, ভ্রু দুইটা কুচকে গেলো ওর। বইয়ের দিকে চোখ রেখেই ও ছোট করে উত্তর দিলো,
— জ্বি৷ দিন।

মেয়েটা উত্তর পাওয়ার পর ও সাফওয়ানের পাশ থেকে সরলো না। সেখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। সাফওয়ান অস্বস্তি তে পড়লো। মেয়েটা নিজের সুডৌল বক্ষ সাফওয়ানের চেহারার সোজাসুজি রেখে দাঁড়িয়ে আছে, সাফওয়ানের মনোযোগ আকর্ষণের আশায়।
সাফওয়ান সোজা হয়ে বালিশে ঠেস দিয়ে বসে ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু মেয়েটার এমন বেহায়াপনার জন্য মেয়েটা যেদিকে আছে তার উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিলো ও৷

কিন্তু মেয়েটা দমে গেলো না৷ ধীরে ধীরে মেয়েটা নিজেও স্ট্রেচারের ওপর উঠে বসলো। মেয়েটা স্ট্রেচারে উঠছে টের পেয়ে সাথে সাথেই সাফওয়ান ঘুরে বসলো, কিন্তু মেয়েটাকে কিছু বলার আগেই মেয়েটা সাফওয়ানের চোয়াল স্পর্শ করে ওর ঠোঁটের উদ্দেশ্যে মুখ বাড়ালো।

ব্যাপার টা টের পাওয়া মাত্রই সাফওয়ান এক ঝটকায় মেয়েটার থেকে দূরে সরে গেলো৷ তারপর নিজের বাম হাত টা দিয়ে স্ট্রেচারের ওপর রাখা বালিশ টা ধরে মেয়েটার গায়ে ঠেকিয়ে বালিশের ওপর দিয়েই ধাক্কা দিলো একটা।
মেয়েটা ধাক্কা খেয়ে স্ট্রেচারের ওপর থেকে দড়াম দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। মাথায় আঘাত পেয়ে মেয়েটা আর্তনাদ করে উঠলো।

সাফওয়ান রক্তচক্ষু নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলো,
— নেক্সট টাইম এমন দুঃসাহস দেখালে আর ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলবো না, সোজা ওপরে পাঠিয়ে দেবো৷ এটাই আপনার লাস্ট ওয়ার্নিং। এরপর আমার সাথে কোনো অসভ্যতামি কর‍তে এলে আর জানে বেচে ফিরবেন না। কথা টা মনে রাখবেন।

মেয়েটা অসহায় চোখ তাকালো একবার সাফওয়ান এর দিকে। ডান হাত টা ওর এখনো নিজের মাথার নিচের আঘাত পাওয়া স্থানে। তাড়াতাড়ি করে মেয়েটা মেঝে থেকে উঠে বসলো। তারপর অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

সাফওয়ানের মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেলো। মেয়েটা চলে যেতেই বেড থেকে উঠে গিয়ে রুমের দরজা টা ভেতর থেকে লক করে দিলো ও৷ এরপর আবার বেডের কাছে ফিরে এসে মেজাজ হারিয়ে যে বইটা পড়ছিলো এতক্ষণ সেটা দুই হাত দিয়ে ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেললো।
রাগের চোটে ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে ওর৷ ইচ্ছা করছে সব কিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। পেয়েছে কি এরা সব! যা ইচ্ছা তাই করছে ওর সাথে! আর এখন কিনা কোথাকার কোন অসভ্য মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছে ওর পেছনে!

সময় নিয়ে নিজের গরম মাথা ঠান্ডা করলো সাফওয়ান৷ নেহাত মেয়েটা এদের কর্মচারী, নইলে আজই মেয়েটাকে ভোগে পাঠিয়ে দিতো৷
মাথা কিছুটা ঠান্ডা হলে স্থীর হয়ে ও বসলো গিয়ে রুমে রাখা চেয়ারে৷ তারপর টেবিলের ওপর দুই হাতের কনুই ঠেকিয়ে দুই হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো মুঠি করে ধরলো ও৷ অসহ্য লাগছে ওর সবকিছু।

এমন সময় দরজায় নক পড়লো রুমের৷ কিন্তু এতে সাফওয়ানের সামান্য ঠান্ডা হওয়া মাথা আবার গরম হয়ে গেলো। নক পড়া সত্বেও দরজা খুলতে উঠলো না ও৷ আগের মতো করেই বসে রইলো চেয়ারে।
কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার নক পড়লো দরজায়, আগের থেকে জোরে৷ এবার সাফওয়ান উঠলো, মনে মনে ভেবে নিলো দরজার ওপাশের মানুষ টা যদি ওই অসভ্য অ্যাশলি মেয়েটা হয় তাহলে আর দ্বিতীয় বার ভাববে না ও, এক বারেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিবে৷

চরম বিরক্তি নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে লক খুলে দরজা টা টেনে খুললো ও। আর খুলেই শক খেলো সাফওয়ান৷

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।