অফিডিয়ান | পর্ব – ৬

—সা—সাফওয়ান ভাইয়া! তুমি!
রুমাইশা অবাক হলো। সাফওয়ান যে এত্ত লম্বা হবে ও ভাবতেই পারেনি! সাফওয়ান এর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে রুমাইশা বলল,
—ক্ষিদে পেয়েছে তোমার? কিছু করে দেবো?

সাফওয়ান তার গাম্ভীর্য বজায় রেখেই উত্তর দিলো,
—না,
তারপর কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
—কিন্তু তুই এত রাতে এখানে কি করছিস?

— পা-পানি শেষ হয়ে গেছিলো ভাইয়া, তাই নিতে এসেছিলাম! তুমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমি তো পুরো ভয় পেয়ে গেছি!

গলা নামিয়ে বলল রুমাইশা! রুমাইশার প্রশ্ন গুলোকে পুরো পুরি উপেক্ষা করে সাফওয়ান বিরক্তি নিয়ে বলল,
—পানি শেষ হয়ে গেছে সেটা ঘুমানোর সময়ে চোখে দেখিসনি? আর সাড়া শব্দ না দিয়ে ভুতের মতো এখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলি কেন? শুধু আকারেই বড় হয়েছিস? বোধ বুদ্ধি কিছু বাড়েনি তোর? ইডিয়ট কোথাকার! সময়ের কাজ সময়ে করে রাখতে পারিস না?

তারপর ধমক দিয়ে বলল,
—পানি নিয়ে এখনি নিজের রুমে যা!

সাফওয়ান এর এমন ব্যাবহার রুমাইশা একদমই আশা করেনি! এত্ত বছর পর দেখা হলো ওদের, আর সাফওয়ান এমন ব্যাবহার করলো ওর সাথে!
বোতলে পানি ভরে মাথা নিচু করে সিড়ির দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো রুমাইশা। তখনই সাফওয়ান কে পেছন থেকে দাতে দাত চেপে বলতে শুনলো,
—গাধা ছিলো, আর গাধাই রয়ে গেছে।

আর একটা মুহুর্ত ও সেখানে দাড়ালো না রুমাইশা, ছুটে চলে এলো নিজের ঘরে!এত খারাপ ব্যবহার করার মতো কি করেছে ও? চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো ওর। মন খারাপের বস্তা নিয়েই আবার বিছানায় গেলো এ৷ ঘুমিয়ে যাওয়া পর্যন্ত শুধু সাফওয়ানের বলা কথা গুলোই মাথায় ঘুরতে থাকলো ওর।

১০. সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে বসে রুমাইশা রুনিয়া কে বলল,
—ফুপ্পি, আমার একটু কলেজ যেতে হবে৷ পোয়েট্রির কিছু নোটস দিয়েছে স্যার, সেগুলো আনতে যাবো৷

রুনিয়া গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
—একা একা যাবি? শাফিন কে পাঠাবো তোর সাথে?

— না ফুপ্পি, আমি একাই যেতে পারবো। সমস্যা হবে না।

রুনিয়া বললেন
—আজ কিন্তু রিকশা ওয়ালারা ধর্মঘট করেছে, তোর ফুপ্পা বলছিলো৷ রাস্তায় রিকশা পাওয়া খুব কষ্টকর হয়ে যাবে৷

রুমাইশা খেতে খেতে বলল,
—তাহলে শাফিন কে বল আমাকে দিয়ে আসতে।

শাফিন তখন সেজেগুজে ব্যাগ নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো, রুমাইশার কথা কানে যেতেই ও নামতে নামতেই বলল,
—আমার আজ সময় হবে না, আমার এক্সাম আছে ১০ টায়, আমি ফিরে এসে খাবো মা।

বলেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো ও। ওকে এমন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে দেখে রুনিয়া রুমাইশা কে বললেন,
—তাহলে তোর ফুপ্পা কে বলি, বাইকে করে দিয়ে আসবে তোকে৷

রুমাইশা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রুনিয়া সাফওয়ান এর জন্য নাস্তা রেডি করে নিয়ে সেটা দিতে ছাদের দিকে এগোলেন। মিনিট দুয়েক পরেই ফিরে এসে বললেন,
—সাফওয়ান আজ কলেজে যাচ্ছে, আজ নাকি কলেজে গাজীপুর থেকে কিছু লোকজন আসবে, তাই সব শিক্ষক কে বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকতে হবে, তাহলে তুই ওর সাথেই যা, নাকি?

খাওয়া থেমে গেলো রুমাইশার। মুখ শুকনো করে রুনিয়া কে জিজ্ঞেস করলো,
— ভাইয়া আমাকে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে?

— না, আমি বলিনি ওকে তোর ব্যাপারে এখনো, ও যখন নিচে নামবে তখনই বলব, তাহলে আর না করার সুযোগ পাবে না। তুই দ্রুত খেয়ে নিয়ে রেডি হ।

রুমাইশা অসহায় কণ্ঠে বলল,
— ভাইয়া আমাকে নিয়ে যেতে রাজি হবে না ফুপ্পি, তুমি ফুপ্পা কে বলো৷

— আরে বলেই তো দেখি না! ও না নিয়ে গেলে তখন তোর ফুপ্পা কে বলব দিয়ে আসতে৷

রাতের কথা কিছু বলল না রুমাইশা তার ফুপ্পিকে। দ্রুত খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গেলো রেডি হতে। ব্যাগ গুছিয়ে বোরখা পরে নিলো। ওর হওয়া শেষ না হতেই ছাদের সিড়িতে জুতার খট খট শব্দ শুনতে পেলো রুমাইশা। দ্রুত গোছানো শেষ করে ব্যাগ টা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বের হলো ও। ততক্ষণে সাফওয়ান হলরুমে চলে গেছে।

সাফওয়ান কে হলরুম পার হয়ে চলে যেতে দেখে রুনিয়া দ্রুত সাফওয়ান কে ডাক দিলো। মায়ের ডাকে দাঁড়িয়ে গেলো সাফওয়ান৷ তারপর দাড়িয়েই ঘাড় ঘুড়িয়ে ফিরে তাকালো রুনিয়ার দিকে। চোখে ওর গগলস, মুখে কালো রঙা মাস্ক, গগলস আর মাস্কের মাঝখানে চোয়ালের কিছু অংশ দৃশ্যমান। পরণে একটা নীল রঙা ব্লেজার আর কালো রঙা প্যান্ট, হাতে ওর গ্লভস। মাথার ঝাকড়া চুল গুলো পেছনের দিকে এলিয়ে দেওয়া। স্যুটেড বুটেড হয়ে সাহেবিয়ানা ভঙ্গিতে প্যান্টের পকেটে এক হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুঠামদেহী সাফওয়ান৷ রুমাইশা দোতলা থেকেই সাফওয়ান কে এক মনে পর্যবেক্ষণ করছে৷

ব্লু স্যুটের নিচে ব্লাক কালারের ফুল স্লিভ টি শার্ট শরীরে আটসাট ভাবে লেগে আছে। শরীরের প্রতিটি পেশীর ভাজ তাতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে৷ চুলগুলো কুইফ স্টাইলে মাথায় সেট হয়ে আছে। কপালের ওপর তীক্ষ্ণ ভ্রু জোড়া কুচকে আছে কোনো এক অজানা বিরক্তিতে।

‘ইনি কি সবসময় হট মেজাজে থাকেন নাকি!’ ভাবলো রুমাইশা।

— রুমির কলেজে একটু কাজ আছে, তুই ওকে একটু সাথে করে নিয়ে যেতে পারবি? আজ রিকশা ওয়ালা দের ধর্মঘট চলছে আর শাফিন ও কলেজ চলে গেছে, ওর এক্সাম আছে তাই,

রুনিয়া থেমে থেমে বললেন সাফওয়ান কে। রুমাইশা চোখ বন্ধ করে আছে! হয়তো এখনি ভাইয়া বলবে ‘পারবোনা, বা বলবে, ‘নিজে নিজে যেতে বল। রুমাইশা একটা কড়া করে ‘না’ শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। মায়ের কথা শোনার পর সাফওয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দোতলার দিকে তাকালো, রুমাইশা চোখ বন্ধ করে অন্য দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। সাফওয়ান তীর্যক দৃষ্টিতে দেখলো ওকে কিয়ৎক্ষণ। তারপর আবার রুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—আসতে বলো, আমি গ্যারাজে যাচ্ছি।

এরপর আবার আগের মতো করে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড হয়েই বাইরে বেরিয়ে গেলো সাফওয়ান। রুনিয়া রুমাইশার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন নিচে নেমে দ্রুত যাওয়ার জন্য। রুমাইশা দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে বাইরে চলে গেলো। সাফওয়ান তখনও গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করছে। গাড়ি বের করে নিয়ে এসে মেইন গেটের সামনে সাফওয়ান তার ডার্ক পিচ ব্লাক মারসিডিজ বেঞ্জ টা এনে দাড় করিয়ে, ড্রাইভিং সিটে বসে রুমাইশার ওঠার অপেক্ষা করতে লাগলো।
কিন্তু রুমাইশা এখনো আসছে না দেখে গাড়ির উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো ও। গাড়ির থেকে কিছুটা দূরে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়েই ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে রুমাইশা। ওকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাফওয়ান ভ্রু কুচকে ধমক দিয়ে বলল,
—তোকে কি এখন কোলে করে গাড়িতে তুলতে হবে?

থতমত খেয়ে গেলো রুমাইশা, ও এতক্ষন সাফওয়ান এর কারটাকে দেখছিলো!
‘ভাইয়া মারসিডিজ কিনেছে! ফুপ্পি, শাফিন কেউ তো এ কথা কখনো বলেনি! বাবাহ! বড়োলোক্স!’ এসব ভাবতে ভাবতে গাড়িতে ওঠার কথা ও ভুলেই গেছিলো।
তাড়াতাড়ি এসে গাড়ির দরজা খোলার জন্য দরজার হাতল ধরে টান দিলো ও, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত খুলতে পারলোনা। ভীষণ অস্বস্তি তে পড়লো রুমাইশা! সাফওয়ান হয়ত ওকে এখন আনাড়ি ভাববে। আবারও চেষ্টা করলো রুমাইশা। পরপর আর ও দুবার চেষ্টা করার পর ও যখন দরজা টা খুলতে পারলো না তখন সাফওয়ান ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খুলে নেমে এলো গাড়ি থেকে। চরম বিরক্তি নিয়ে তাকালো ও রুমাইশার দিকে, তারপর গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বিরক্তির কন্ঠে বলল,
—এই কারণেই আমি এসব উটকো ঝামেলা ঘাড়ে করতে চাই না৷ আর আমার মা সেসবই আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়!

খুব লাগলো কথাটা রুমাইশার মনে, ও তাহলে উটকো ঝামেলা! চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইলো ওর। দাঁত চেপে সেটা কোনোরকমে আটকালো ও। প্রাণ থাকতে আর এই লোকের সাথে যাবে না ও কোথাও৷ চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল রুমাইশা। ও গাড়িতে উঠে বসলে সাফওয়ান গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। তারপর বেরিয়ে পড়লো কলেজের উদ্দ্যেশ্যে। সারাটা রাস্তা কেউ আর কোনো কথা বলল না৷

১১. সাফওয়ান দের বাসা থেকে এম এম কলেজ এর দুরত্ব ৬ কিলো। রিকশায় যেতে ত্রিশ মিনিটের মতো সময় লাগে। কলেজের কিছুটা কাছাকাছি আসার পর ফাকা রাস্তা দেখে গাড়ি থামিয়ে দিলো সাফওয়ান। তারপর ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে নিচে নেমে গিয়ে রুমাইশার পাশের দরজা খুলে দিয়ে রুমাইশা কে নামতে বলল ও। হঠাৎ নেমে যেতে বলায় রুমাইশা প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর গাড়ি থেকে নামলো।
সাফওয়ান রুমাইশার সে দৃষ্টির কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো, তারপর সামনে তাকানো অবস্থাতেই বলল
—এখান থেকে হেটে চলে যা, আমি চাইনা তোকে আমার সাথে দেখে কলেজে কোনো রিউমার এর সৃষ্টি হোক।

আর তারপর গাড়ি নিয়ে রুমাইশার সামনে থেকে শা করে চলে গেলো। সাফওয়ানের এমন ব্যাবহারে প্রচুর কষ্ট পেলো রুমাইশা, মুখ টা চুপসে গেলো ওর। ওখান থেকে হেটে হেটেই কলেজে পৌছালো ও…….

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।