সাদাফ রেগে প্লেট রেখে নেমে গেলো বিছানা থেকে। চোখ মুখ যেন লাল হয়ে এসেছে তার। শ্রাবণ হুট করে হাত ধরে ফেললো এবং বললো,
“কোথায় যাচ্ছেন, ভাত খেয়ে যান।”
সাদাফের যেন এদিকে কোনো ধ্যানই নেই। সে হাত হেচকা টানে ছাড়িয়ে নিয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে গেলো। লোকটা সংবাদ দিয়েই দৌড়ে চলে গেছে। সাদাফ বাথরুমে এসে হাত ধুয়ে আবার রুমে এলো হাত মুছতে এবং জুতা পড়তে। শ্রাবণের ভীষণ ভয় হচ্ছিলো তার লাল মুখখানা দেখে৷ সে নিশ্চিত বড় কোনো গণ্ডগোল বাধবে সেখানে। তাই সাদাফ ঘরে প্রবেশ করতেই সে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো। সাদাফের হাত ধরে বললো,
“আপনার শরীর ভালো নেই, আপনি যাবেন না সেখানে।”
“শ্রাবণ সরো।”
শ্রাবণ শক্ত করে দুহাতে তার একটা হাত ধরে রেখে বললো,
“না, যাবেন না আপনি। আমার ভয় হচ্ছে আপনাকে নিয়ে।”
“শ্রাবণ সরতে বলছি। ছাড়ো!”
ধমকে উঠলো সাদাফ। কিন্তু শ্রাবণ তার হাত ছাড়তে রাজি না। আরও দুইবার তাকে ছাড়িয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু শ্রাবণ বাধা দিয়েই যাচ্ছে। সে তার শার্ট টেনে ধরে রেখেছে। সাদাফ পেছনে ফিরে উল্টো হাতে জোরেশোরে এক থাপ্পড় দিতেই শ্রাবণের পুরো মাথা যেন প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠলো। একটা দিয়েই সাদাফ থেমে নেই। এতো বার বলার পরেও বাধা দিচ্ছিলো বলে শ্রাবণের প্রতি রেগে উঠেছে সে। এলোপাথারি আরও দুতিনটা থাপ্পড় দিতেই মেঝেতে পড়ে গেলো শ্রাবণ। সাদাফ পা দিয়েই তার শরীরে আঘাত করে বসলো। কয়েক ঘা লাথি মেরে পানি ভর্তি বোতলটা নিয়ে জোরেশোরে আঘাত করলো কাঁধ বরাবর। চুলের মুঠি ধরে নাকমুখ বরাবর উল্টো হাতে আরও একটা আঘাত করে বললো,
“হারামির বাচ্চা, ছাড়তে বলিনি তোকে!”
ধাক্কা মেরে মাথাটা ফ্লোরে ফেলে চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে জোরেশোরে দরজা খুলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। এতোটা গতিবেগে দরজাটা খুলেছে যে, দরজার পার্ট দুটো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পুনরায় চেপে গেছে। শান্ত মানুষ হঠাৎ রেগে গেলে হিংস্র রূপ ধারণ করে। এমনটাই করে গেছে সাদাফ। ফ্লোরে আধশোয়া অবস্থায় পড়ে কাঁদছে শ্রাবণ। অস্থিরতার কান্নার সাথে ডাকছে আল্লাহকে। সাদাফ যখন পা দিয়ে কোমড়ে, পেটে, উরুতে আঘাত করছিলো তখন থেকেই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে সে। কিন্তু থামেনি সাদাফ। পানি ভর্তি বোতল দিয়ে আঘাত করার পর তো পুরো শরীরই অবশ হয়ে এসেছে। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তেমন। তারউপর আবারও নাকে মুখে মাথায় দেওয়া আঘাতে একেবারে নিস্তেজ। একটু নড়াচড়ার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। কাঁধের আঘাতটা এতোটা তীব্রতর হয়েছে যে মাথাটাও সোজা করতে পারছে না। অস্পষ্ট স্বরে কাঁদছে সে। কেউ আসেনি তার চিৎকার শুনে। কেউ শুনেইনি হয়তো তার চিৎকার। কেননা সাদাফের রুমটা একবারে এবাড়ির শেষ দিকে। তাছাড়া শ্রাবণের কণ্ঠস্বরও এতোটা উঁচু নয়। আবার একেবারে নিচুও নয়। আর স্পষ্টস্বরে চিৎকার তো করেছিলো কয়েক সেকেন্ড। এখন কান্নার যে শব্দ হচ্ছে তা তো রুমের বাইরে যাচ্ছে কি না সন্দেহ! শ্রাবণ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। কোনমতো দাঁড়াতেই যেন চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। হাত বাড়িয়ে বিছানায় ভর দিয়ে ধীরে ধীরে আবার বসে পড়লো সে। সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানো। হাটাচলা তো দুরেই! সর্বাঙ্গ পাকড়ে ধরেছে অসহ্যকর ব্যাথা। কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে ভীষন।
সাদাফ দৌড়ে দৌড়ে পথ পেরিয়ে দাবাঘরের কাছে এলো। এখনো আগুন জ্বলছে, পাশের দোকানটাও পুরছে। ফায়ার সার্ভিসের লোক আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন আইনের লোক। ঘন্টাখানেক আগেও সে সব ঠিকঠাক দেখে এখান থেকে বেরিয়েছে। অথচ ঘন্টাখানেক পরেই তার এই দশা! আইনের লোক দেখে সাদাফ আর সামনে এগিয়ে যায়নি। কিছুটা দূর থেকেই স্থির দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছে সবটা। লোকজনের মুখে শুনছে আইনের লোক আগুন লাগার উৎস খুঁজে পাচ্ছে না। কেউ ইচ্ছে করে লাগিয়ে দিয়েছে, সেই সন্দেহও করতে পারছে না। কিংবা কোনো কিছু বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে কি না সেটাও নিশ্চিত করতে পারছে না। জনবহুল বাজার, এসময়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার দুঃসাহস কে করতে আসবে! পাশের দোকানের লোকটার প্রায় কান্না করার অবস্থা। একপাশে আগুন লাগতেই কতগুলো জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। আপাতত সেই দোকানের আগুন নেভানো হয়ে গেছে। পুলিশ দাবাঘর সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করছে। এঘরে এসে যারা সময় কাটায় তাদের অনেকেই এখানে দাঁড়িয়ে। তাদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কিছুক্ষণ দূরে থেকে দেখার পর সাদাফ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। তাদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করলো,
“আগুন কিভাবে লাগলো?”
“জানি না ভাই। একটু আগে মাত্র লাইট অফ করে তালা দিয়ে বেরিয়েছি। হোটেলে গিয়ে বসলাম, পাঁচ মিনিটও গেলো না, হৈচৈ শুনে দৌড়ে এলাম।”
ফাঁকা দোকান, খেলার কিছু আসবাব ছাড়া আর কিছুই ছিলো না জেনে পুলিশ নির্ধারণ করলো শর্টসার্কিট থেকে লেগেছে হয়তো। এছাড়া আর কোনো উৎস সামনে আসছে না আপাতত। ঘন্টাখানেক এখানে থেকে সাদাফ বাড়ির দিকে রওনা হলো। আসার সময় যতটাই না উত্তেজিত ছিলো, যাওয়ার সময় ঠিক ততটাই শান্ত সে। কিভাবে আগুন লাগলো, কিংবা ইচ্ছে করে লাগালে কারা লাগাতে পারে তা ভাবতে ভাবতেই পুরো রাস্তা অতিক্রম করলো। বাড়ির গেইটের ভেতর পা রাখতেই মনে পড়লো শ্রাবণের কথা। মেয়েটা তখন প্রচুর রাগিয়ে দিয়েছিলো তাকে। এখন সে কি করছে? ব্যাথা কি বেশি পেয়েছে? তার সাথে একবার দেখা করা দরকার। ভাবতে ভাবতে ঠান্ডা মাথায় শ্রাবণের রুমের দিকে গেলো। দরজা খোলাই আছে। তবুও তাকে দেখতে না পেয়ে ডাকলো,
“শ্রাবণ?”
কোনো সাড়া না পেয়ে ভেতরে এসে রুম খালি দেখে নিজের ভেতরটা একটু চেপে গেলো। মেয়েটা চলে গেলো নাকি? কিন্তু তার কাপড়চোপড় তো এখানেই আছে। সাদাফ বেরিয়ে এসে বাথরুমে, রান্নাঘরে উঁকি দিয়েও তাকে পেলো না। নিজের রুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো মেঝেতে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে এলোমেলো শ্রাবণ। সাদাফ দ্রুত পায়ে কাছে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে ডাকলো,
“শ্রাবণ… শ্রাবণ…”
শ্রাবণ নিভু নিভু চোখে তাকাতেই সাদাফ বললো,
“এখানে ঘুমাচ্ছো কেন? রুমে যাও।”
শ্রাবণ মাথা তুলে উঠতে গেলেই সাদাফ দেখলো বেড কভারে রক্ত লেগে আছে! শ্রাবণ হেলেদুলে উঠতে চেষ্টা করলে সাদাফ তাকে ধরে ফেললো। রক্ত দেখার পর তার নিজের শরীরই হঠাৎ কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে, যার কিছুই বুঝতে পারছে না সাদাফ। মাথায় ভনভন করে ঘুরছে, রক্ত কোথা থেকে এলো! শ্রাবণ ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না কেন! সে এতোটা জঘন্য হাল করে গেছে তার! সাদাফ দুই বাহুতে ধরতেই শ্রাবণ ছোটখাটো চিৎকার করে ডান হাতে নিজের বাম হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। সাদাফ তার চিৎকারে বুঝতে পেরেছে সে ধরাতে শ্রাবণ ব্যাথা পেয়েছে৷ যা সহ্য করতে পারছে না, তাই সরিয়ে দিয়েছে। তাকিয়ে দেখলো গলা থেকে কাঁধে জামার বাইরের অংশটুকুই নীল দেখাচ্ছে। সাদাফ হাত তুলে এবার গালসহ কানের উপর দিয়ে তার মাথার একপাশে রেখে ভীত গলায় বললো,
“খুব ব্যাথা পেয়েছো?”
মাথায় ধরতেও যেন ব্যাথায় কেঁপে উঠলো সে। তাই “উফফ” শব্দ করে উঠেছে। সাদাফ হাত সরিয়ে নিতেই দেখলো তার হাতে রক্ত। তারমানে মাথা থেকে রক্ত পড়ছে! এটাও কি সেইই করেছে! শ্রাবণও বুঝতে পারেনি মেঝেতে লেগে যে তার মাথা কেটে গেছে! সাদাফ তার মাথা টেনে এনে দেখতে লাগলো চুলের ফাঁকে রক্ত দেখা যাচ্ছে। তাহলে মাথা থেকেই বেড কভারে রক্ত লেগেছে। সাদাফ কি করবে ভেবে না পেয়ে শ্রাবণের ওড়নার কোণা টেনেই রক্ত মুছতে লাগল। শ্রাবণ যেন সহ্য করতে পারছে না এতো ব্যাথা। সাদাফ তাকে খাটে বসিয়ে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আলমারি থেকে কিছু টাকা নিয়ে তাকে বললো,
“চলো, ডাক্তার দেখাতে হবে।”
এ নিয়ে শ্রাবণের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। সে অসহ্যকর ব্যাথা নিয়ে বসে আছে চুপচাপ। সাদাফ দরজায় তালা লাগিয়ে ডিসপেনসারি উপেক্ষা করে তাকে নিয়ে সোজা হসপিটালে চলে এলো। ভালো ভিজিটে বড় ডাক্তার দেখালো। ডাক্তার চেকাপের সময় সাদাফ পাশে ছিলো। শ্রাবণের কাধের ফোলা এবং নীলচে রঙ সরাসরি তার হৃদয়ে গিয়ে বিঁধেছে। ডাক্তারের জিজ্ঞাসায় শ্রাবণ ধীরে ধীরে বলার চেষ্টা করলো কোথায় কোথায় ব্যাথা পাচ্ছে। মাথায় অল্প একটু ই কেটেছে। নার্সকে দিয়ে সেটুকু ব্যান্ডেজ করালো। কিন্তু কাঁধের আঘাতটা তীব্রতর। এক্সরে করে দেখলো মাংসপেশিতে চাপ পড়ে থিতলে গেছে। তার জন্য ওষুধপত্র লিখে দিলো। সব ওষুধ কিনেই তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে সাদাফ।