অগোচরে তুমি | পর্ব – ১৩

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো মেহেনূর।অর্ক মেহেনূরের চলে যাওয়া পথের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।দ্রুত পায়ে এগিয়ে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে অর্ক।সীট বেল্ট লাগাতে লাগাতে আঁড় চোখে তাকায় মেহেনূরের দিকে।হাত পা ছেড়ে দিয়ে সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে মেহেনূর।মুখটা মলিন হয়ে আছে।অথচ একটু আগেই দিব্যি আয়েশ করে বসে ফুচকা খেয়েছে।তাহলে মুখটা এত মলিন দেখাচ্ছে কেন?আর ওকে এত ক্লান্তই বা দেখাচ্ছে কেন?
– আজ আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত!
চমকে উঠলো অর্ক।কপাল কুঁচকে আসে ওর।মেহেনূর আগের মতোই বসে আছে চোখ বুজে।কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছে অর্ক।ওর মনের কথাগুলো শুনে ফেললো নাকি মেয়েটা?সেটা কি করে সম্ভব?
– বাসায় নিয়ে চলুন তাড়াতাড়ি।আমার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন।
এবারো চোখ খুললো না মেহেনূর।আগের মতোই নির্বিকার চিত্তে বসে আছে।ওকে দেখে সত্যি অনেক ক্লান্ত লাগছে।মেহেনূরের উপর থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে অর্ক কোনো শব্দ ছাড়াই ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়।অর্কের মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।হঠাৎ এত রাতে এই নীল চত্ত্বরে মেহেনূর আর রোশনি কি করতে এসেছিল?তখন রোশনি কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু মেহেনূর রোশনিকে বলতে না দিয়ে ওই বলেছে।যেটা অর্কের কাছে একটু খটকা লেগেছে।তখন রোশনি কি বলতে চাচ্ছিলো?মেহেনূরেরই বা এত ক্লান্তির কারণ কি?এইসব প্রশ্নের উত্তর অর্কের জানা নেই।ক্রস করে যাওয়া গাড়ির শব্দে হুশ ফিরে অর্কের।নিজের মন মস্তিষ্কের উপর কি ওর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে নাকি?হঠাৎ করে মেহেনূরকে নিয়ে ও এত ভাবছেই না কেন?ওকে নিয়ে এত ভাবার কি আছে?অর্ক আর কোনো ভাবনা ওর মাথায় আসতে দেয় নি।চোখ বন্ধ করে মাথা ঝেড়ে ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে ড্রাইভ করছে অর্ক।ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে এক পলক তাকাচ্ছে মেহেনূরের দিকে।মেহেনূর অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে গেছে।ঘুমের ঘোরে কাত হয়ে পড়ে যেতে নিলেই অর্ক ওর বাম হাত দিয়ে ধরে নেয়।মেহেনূরের মাথাটা আস্তে করে ওর কাঁধে রাখে।তা না হলে ঘুমের ঘোরে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেতে পারে।আগের তুলনায় গাড়ির স্পীড অনেক কমিয়ে দিয়েছে অর্ক।নয়তো মেহেনূরের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সম্ভাবনা আছে।অর্ক মুচকি হেসে মেহেনূরের চোখ থেকে চশমাটা খুলে গাড়ির সামনে রাখে।কারণ এই চশমাটা ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।চশমার ফ্রেমের নড়াচড়ার জন্য ঘুমের মধ্যেই মেহেনূরের অস্বস্তি হচ্ছিলো।তাই ওটা সড়িয়ে দিয়েছে অর্ক।
মেহেনূরদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায় অর্ক।সামনে তাকিয়ে দেখে রাওনাফ আর রোশনি এখনো গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।ওরা বাসার ভেতরে যায় নি।অর্ক বুঝতে পেরেছে মেহেনূরের জন্যই ওরা ওয়েট করছে।আর এইদিকে গাড়ি থামার কয়েক সেকেন্ড পড়েই মেহেনূরের ঘুম ভেঙে যায়।চোখ খুলে নিজেকে অর্কের কাঁধে শুয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে।চটজলদি মাথা তুলে নেয় মেহেনূর।অর্কের সামনে অস্বস্তিতে পড়ে যায় ও।মাথার চুল আর ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে গাড়ির সামনে রাখা চশমাটা চোখে পড়ে নিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
– সরি!
শব্দটা উচ্চারণ করেই গাড়ি থেকে দ্রুতগতিতে নেমে চলে যায় মেহেনূর।অর্ক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে মেহেনূরের দিকে।মেহেনূর আর রোশনি বাড়ির ভিতরে চলে যায়।রাওনাফ এগিয়ে এসে অর্ক কাছে দাঁড়ালো।অর্ক কথা না বাড়িয়ে রাওনাফকে গুড নাইট জানিয়েই চলে আসে।রাওনাফও হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
________________
আজকে একটু সকাল সকালই ঘুম ভেঙে যায় মেহেনূরের।রাতে মা বাবা কারোর সাথেই দেখা হয় নি।বাসায় ঢুকে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।যা হবে সকালে দেখা যাবে এটা ভেবেই মেহেনূর শুয়ে পড়েছিল।কিন্তু এখন তো সকাল হয় গেছে।এখন কি হবে?বাবা মাকে কিভাবে ফেইস করবে?মেহেনূর ওর ভাবনা মধ্যেই রেনুফা বেগমের ডাক শুনতে পেলো।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে।পাশে তাকিয়ে দেখে রোশনি বিছানায় নেই।তারমানে রোশনি আরো আগেই উঠে গেছে।মেহেনূর আর একমুহূর্তও দেরি না করে ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায়।ডাইনিং টেবিলে বসে খবরের কাগজে মুখ গুজে বসে আছেন মেহরাব সাহেব।মেহরাব সাহেব চেয়ার টানার শব্দ পেয়ে মাথা উপরে তুলে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
– শুনলাম আপনি নাকি নতুন গাড়ি কিনেছেন?
চমকে উঠে মেহেনূর।বাবার দিকে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে আসছে ওর।কিন্তু সেটা বাবাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।মনে মনে ভয় পেলেও মেহরাব সাহেবের সামনে সেটা প্রকাশ করার কোনো লক্ষণ মেহেনূরের মধ্যে দেখা যায় নি।চেয়ার টেনে বসে স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– গাড়িটা আমাদের প্রয়োজন ছিল বাবা।তুমি বেশির ভাগ সময়ই পায়ে হেটে মেইন রাস্তা অব্দি যাও।কি ভেবেছিলে তুমি?আমরা এখানে থাকি না বলে এইসব আমাদের চোখে পড়ে না?মেইন রাস্তাটা একটু দূরে তাই আমাদের বাসা থেকে কোথাও যেতে নিলে এখানে সহজে কোনো গাড়ি পাওয়া যায় না।আমাদের আশেপাশে যারা থাকে সবাই নিজেদের গাড়ি নিয়ে চলা ফেরা করে।আর বাবা পায়ে হেটে যাবে!তোমাদের বয়স হয়েছে বাবা।তোমাদের এতো সাফার করার কোনো প্রশ্নই আসে না।আমাদের নিজেদের একটা গাড়ি থাকলে ক্ষতি কি।তাছাড়া আমাদের প্রয়োজনীয় কাজ করতে অন্যদের গাড়ি চাওয়াটা কেমন দেখায় না বাবা?
– আসতে পারি?
আঁতকে উঠে মেহেনূর।গলার স্বরটা পরিচিত মানুষের।কাল রাতের কথা মনে পড়তেই মেহেনূরের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো।অর্ক মেহরাব সাহেবের পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– আন্টি খুব খিদে পেয়েছে খেতে দাও তাড়াতাড়ি।
অর্কের গলার আওয়াজ শুনে রাওনাফও ওর ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।রোশনি আর রেনুফা বেগম টেবিলে খারাব পরিবেশন করে দেয়।তারপর সবাই একসাথে খেতে বসে।
– বাই দ্যা ওয়ে আঙ্কেল,তুমি ড্রাইভ করতে পারো?
খাওয়ার মাঝেই প্রশ্নটা করে বসে অর্ক।মেহরাব সাহেব উত্তর দেওয়ার আগেই মেহেনূর ধীর কন্ঠে বললো,
– বাবা আমি চলে যাওয়ার আগে একজন ড্রাইভার ঠিক করে রেখে যাবো।তোমাদের কোনো সমস্যা হবে না।
মেহরাব সাহেব এতক্ষণ কোনো কথা না বললেও এখন মেহেনূরের কথায় শীতল কন্ঠে বললেন,
– তা না হয় বুঝলাম।কিন্তু আমাকে একটা কথা বল তো,
– কি কথা বাবা?
– তুই এত টাকা দিয়ে গাড়ি কিনতে গেলি কেন?আর তুই এত টাকা বা কোথায় পেলি?
থতমত খেয়ে যায় মেহেনূর।বাবার সামনে যে ও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে সেটা তো ওর মাথায়ই আসে নি।এখন কি উত্তর দিবে?মাথা নিচু করে চুপচাপ খাবার খাচ্ছে আর চোখ এদিক সেদিক ঘোরাচ্ছে।
– কি হলো কথা বলছিস না কেন?
– কিস্তিতে নিয়েছি বাবা!আমার কিছু সেভিংস ছিল ওটা দিয়েছি আর বাকি টাকাটা একবছরে পরিশোধ করলে হবে।
কথাটা মিনমিনে স্বরে বললো মেহেনূর।রোশনি আর রাওনাফ বাদে বাকি সবাই অবাক হয়ে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছে।এই মেয়ে কি বলছে এইসব এত দামী গাড়ি নাকি কিস্তিতে নিয়েছে।তাও আবার এক বছরের ভেতরে পরিশোধ করতে হবে। মেহরাব সাহেব কড়া গলায় বললেন,
– এত টাকা তুই পাবি কোথায় শুনি?
বাবা যে রেগে যাচ্ছে তা আন্দাজ করতে পারছে মেহেনূর।মুচকি হেসে বললো,
– আমি কেন টাকা দিতে যাবো?আমার মনে হয়েছিল এই মুহুর্তে আমাদের একটা গাড়ির প্রয়োজন তাই গাড়ি কিনেছি!শো-রুমের মালিক তো আমাকে আর এমনি এমনি গাড়িটা দিয়ে দিতো না,তাই কিছু টাকা দিয়েছে আরকি।আর বাবা তোমার যে একটা ছেলে আছে সেই কথা কি তুমি ভুলে গেছো নাকি?টাকা তো ভাইয়াই দিবে তুমি চিন্তা করো না।
মেহরাব সাহেব রাগী চোখে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ বাবার চাহনি দেখে মেকি হেসে শুধু মাথা নাড়িয়ে মেহেনূরের কথার সাথে সায় দেয়।বাবার হাত থেকে বাঁচতে ভাইকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে মেহেনূর।রোশনি আর মেহেনূর দুজনেই ঠোঁট টিপে হাসছে।মেহরাব সাহেব যে মেয়ের এহেন কাজে মন থেকে বেশ প্রশান্তি পাচ্ছেন তা খুব ভালোই আন্দাজ করতে পারছেন রেনুফা বেগম।শুধু উনাদের একটু যাতায়াতের জন্য এত দামী একটা গাড়ির কিনার কি দরকার ছিল না,এই যা।প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে রেনুফা বেগম ধীর কন্ঠে বললো,
– খাওয়ার সময় এত কথা বলতে নেই।
সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিয়েছে।মেহরাব সাহেব কোথাও বেড়িয়েছেন।অর্ক আর রাওনাফ ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
– মা আমি আর ভাবী একটু বের হচ্ছি।
মেহেনূরের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে অর্ক আর রাওনাফ মেহেনূরের দিকে তাকায়।রেনুফা বেগম রান্নাঘর থেকে ট্রে-তে করে দুটো কফির মগ নিয়ে এসে অর্ক আর রাওনাফের সামনে রাখেন।তারপর মেহেনূর আর রোশনির সামনে এসে দাঁড়িয়ে কঠোরভাবে জিজ্ঞাস করেন,
– আজকে আবার কোথায় যাচ্ছিস?
কালকে দেরি হওয়ার জন্য যে রেনুফা বেগম ওদের কিছুই বলে নি তার জন্য মেহেনূর আর রোশনি দুজনেই একটু অবাক হয়েছিল।আসলে রেনুফা বেগমকে রাওনাফই সামলে নিয়েছিল।আর রেনুফা বেগম ওদের দেরি হওয়া নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না।ফোন রিসিভ না করায় দুঃচিন্তা করছিলেন।হুট করেই রেনুফা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো মেহেনূর।মায়ের গালে চুমো দিয়ে আহ্লাদী গলায় বললো,
– মা আমরা শপিং করতে যাচ্ছি।শপিংয়ে যাওয়ার আগে একটু ঘুরাঘুরি করবো।সন্ধ্যার আগেই বাসায় চলে আসবো প্রমিজ।
– ঠিক আছে মনে থাকে যেনো।
– ওকে!
বাসা থেকে বেরুনোর জন্য পা বাড়াতেই মেহেনূরের ফোনে মেসেজ আসে।ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।ফোনটা আবার ব্যাগে রেখে দিয়ে রাওনাফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ভাইয়া বিকালে আঙ্কেল আন্টি আর রোশান আসছে।তাদেরকে রিসিভ করতে তুই যাবি নাকি আমরা যাবো?
– ওই যাবে।তোদের আর এয়ারপোর্টে যেতে হবে না।তোরা যেখানে যাচ্ছিলি ওইখানেই যা।আর সন্ধ্যার আগেই যেনো তোমাদের আমি বাসায় দেখি। মনে থাকবে?
কড়া গলায় কথাগুলো বললেন রেনুফা বেগম।রোশনি শাশুড়িকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
– মনে থাকবে মা।আমরা এখন আসি কেমন।
– ঠিক আছে,সাবধানে যেও।
ওরা চলে যেতেই অর্কও উঠে এসে বললো,
– আন্টি আমিও যাই।আমাকেও একটু বেরুতে হবে।এনজিওর বাচ্চাদের জন্য কিছু কেনা কাটা করতে হবে।আন্টি গেলাম তাহলে।
– তুমিও শপিংয়ে যাবে?তাহলে তো মেহেনূরদের সাথেই যেতে পারতে।
অর্ক ওর পায়ের নিচে কিছু একটার উপস্থিতি টের পেয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে একটা কাগজ পড়ে আছে।নত হয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে দেখেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে কাগজটা পকেটে রেখে দিয়ে বললো,
– সমস্যা নেই আন্টি।আমি বাইক নিয়ে যাবো।আসি এখন।
রাওনাফ গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– বিকালে কি তুই ফ্রী আছিস?
– তোর জন্য আমি অলওয়েজ ফ্রী।বিকালে বাসায় থাকিস তুই।আমি বাসা থেকেই তোকে পিক করে নিবো।এখন আসছি আমি।

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।