ভোর সাড়ে চারটা।প্রথম আযানের ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঘুম ভেঙে যায় রেনুফা বেগমের।চটজলদি উঠে ওযু করে চলে যান নামাজ খানায়।আলমারি থেকে কুরআন শরীফ আর জায়নামাজ নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় জায়নামাজ বিছিয়ে সামনেই কুরআন শরীফটা রাখেন।নামাজ শেষ করেই কুরআন তিলাওয়াত করতে বসেন।এখনো চারপাশ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে।পৃথিবীর বুক থেকে পুরোপুরিভাবে অন্ধকার কেটে গেলেও এখনো ভোরের আলো ফুটে নি।ঘড়ির কাঁটা ছয়টার ঘরে যেতে এখনো দশ মিনিট বাকি।পড়ার মাঝেই রেনুফা বেগমের মেয়ের কথা মনে পরতেই নির্দিষ্ট জায়গায় এসে কুরআন শরীফটা বন্ধ করে দেন।কুরআন শরীফটা যত্নসহকারে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়ালেন।কুরআন শরীফ রেখে জায়নামাজ’টা সুন্দর করে ভাঁজ করে জায়গায় মতো গুছিয়ে রাখলেন।তারপর পা বাড়ালেন মেয়ের রুমের দিকে।
মেয়ের রুমে এসেই আগে জানালার পর্দা সড়িয়ে দিয়ে তারপর মেয়ের মাথার কাছে এসে বসলেন।মেহেনূর দু’হাত ভাঁজ করে ঘুমাচ্ছে।জানালার পর্দা ভেদ করে আসা আলতো পেলব রোদ্দুরের স্পর্শে মেহেনূরের মসৃণ পাতলা ঠোঁট আর ফর্সা ত্বক চিকচিক করছে।রেনুফা বেগম বিসমিল্লাহ বলে,তিনবার ফুঁ দেন মেয়ের শরীরে।মেয়ে কাছে থাকলে এটা উনার নিত্যকার জীবনের প্রথম এবং প্রধান কাজ।ঘুমন্ত মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে মেয়েকে আরেকটু ঘুমানোর সুযোগ দিয়ে রেনুফা বেগম রান্না ঘরে চলে যান।
মিনিট দশেক পরেই ফের মেয়ের রুমে আসেন।খুব মায়া লাগছে মেহেনূরের ঘুম ভাঙাতে।তবুও আদুরে গলায় ডাকলেন,
– নূর,নূর!এই নূর, উঠ মা।তোর বাবা কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।
মায়ের কোমল কন্ঠস্বর শোনে ঘুম ভাঙে মেহেনূরের।ঘুম থেকে উঠে মায়ের মুখটা চোখে পরতেই হাসি ফুটে উঠলো মেহেনূরের মুখে।আড়মোড়া ভেঙে মায়ের কোমড় জড়িয়ে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,
– গুড মর্নিং মা।
রেনুফা বেগম মেয়ের মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
– এই যে টেবিলে গরম পানি আর লবঙ্গ রেখে গেলাম যাওয়ার সময় মনে করে নিয়ে যাস।
রেনুফা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন।মা চলে যেতেই মেহেনূর একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।শত অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উঠতেই হবে।কারণ এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।বালিশের পাশ থেকে হাতরিয়ে চমশাটা হাতে নিয়ে উঠে বসে।চমশাটা পড়ে ঘুমঘুম চোখে ঘড়ির দিকে তাকাতেই ওর চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।ছয়টা বেজে গেছে আর ও এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।মেহেনূর তড়িঘড়ি করে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।চোখে মুখে একটু পানি ছিটিয়ে এসে টেবিলে রাখা গরম পানি আর লবঙ্গ নিয়ে দৌঁড় লাগায় ছাদের উদ্দেশ্যে।
– বাবা আসবো?
– ওহ্ আম্মাজান চলে এসেছেন?তা আপনার ঘুম হয়েছে ঠিক মতো?না হলেও সমস্যা ছিল না আরেকটু ঘুমিয়েই আসতে পারতেন!
বাবার আদুরে গলায় কথা বলাটা ঠিক হজম হলো না মেহেনূরের।ও বুঝতে পারছে না ওর বাবা রেগে আছে কিনা?কারণ মেহরাব সাহেব মেয়েকে তখনই আপনি বলে সম্মোধন করেন যখন উনি রেগে থাকেন।আজো তো তার ব্যতিক্রম হলো না।তবে কি উনি রেগে আছে?মেহেনূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির রেখে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিলো মেহরাব সাহেবকে।ভাবমূর্তি খুব একটা বুঝতে পারছে না।মেহেনূর ধীর কন্ঠে বললো,
– না বাবা আসলে রাতে একটু দেরি করে ঘুমিয়েছিলাম।তাই সকালে উঠতে…..
মেহেনূরকে বলতে না দিয়ে মেহরাব সাহেব সুর টেনে বললেন,
– কেন মা রাত জেগে কি আপনি বাড়ি পাহারা দিয়েছিলেন যে আপনাকে দেরি করে ঘুমাতে হয়েছিল?
– না বাবা আসলে…..
হাত উঁচিয়ে মেহেনূরকে থামিয়ে দেয় মেহরাব সাহেব।তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
– হয়েছে থাক আমাকে আর আসলে ফসলে বুঝাতে হবে না!কাল থেকে যেন আর দেরি না হয়।কথাটা যেন মাথায় থাকে।
শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে ছিল মেহেনূর।বাবার কথা শুনে এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।দেরি হওয়ায় ওর বাবা ততটাও রেগে নেই।কথাটা ভাবতেই হাসি ফুটে মেহেনূরের মুখে।তারপর চোখের চমশাটা ঠিক করে কোমড় ডিঙ্গানো বেনুনিটা সামনে এনে ঠিকঠাক হয়ে লম্বা একটা শ্বাস টেনে গিয়ে বাবার পাশে বসলো।মেহরাব সাহেব নরম গলায় বললো,
– গরম পানি আর লবঙ্গ এনেছিস?
– জ্বি বাবা!
গরম পানি আর লবঙ্গের উপযোগ নিঃশেষ করার পর বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে নেয় মেহেনূর। মেহরাব সাহেব হলেন মেহেনূরের গুরু।সেতার বাজানো আয়ত্ত্ব করতে পারলেও মেহরাব সাহেব গানটা ঠিক সেইভাবে রপ্ত করতে পারেন নি!তিনি পারেন নি বলে কি হয়েছে?মেয়ে একদিন দেশের নাম করা গায়িকা হবে এইটাই উনার স্বপ্ন।মেহরাব সাহেব মেয়ের দিকে সেতারটা এগিয়ে দেন।বাবার দিকে একটা কৃত্রিম হাসি ফেরত দিয়ে সেতারটা নিয়ে রেওয়াজে মন দেয় মেহেনূর।
জবে থেকে বিদেশ থেকে এসেছে মেহেরাব সাহেব মেয়েকে সেতারের তালিম দেওয়া শুরু করেছে।কিন্তু মেহেনূরের সেতারের প্রতি একদম কোনো আগ্রহ নেই।নেহাতই বাবাকে ভয় পায় বলে মানা করতে পারে না।শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতিদিন ভোরে উঠে রেওয়াজে বসতে হয়।আর মেহরাব সাহেব রোজ মেহেনূরের পাশে বসে সেতারের সাথে মেয়ের গলার সুর মিলান।তার দ্বারা গানটা হয়তো তেমন হয় নি কিন্তু সুরের তাল বৈতাল ঠিকই ধরতে পারেন।
_____________
– মা, ও মা!আজকেও কি তুমি তুলোটা দিতে ভুলে গেছো?
ব্যালকনিতে বসে মেহেনূরের রেওয়াজ শুনছিলেন আয়েশা বেগম।ছেলের ডাকে বেশ বিরক্ত হয়েই চলে আসতে হলো।
অর্ক আর মেহেনূরদের পাশাপাশি বাড়ি।দোঁতলা বিশিষ্ট ছিমছাম সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো মেহেনূরদের বাড়ি।অন্যদিকে অর্কদের বহুতল ভবন।বিশাল এই ভবনের তৃতীয় তলায় অর্ক ওর বাবা মাকে নিয়ে থাকে।বাকি তলা গুলো ভাড়া দেওয়া।মেহেনূরদের ছাদের কিনার ঘেষে অর্কের রুমের ব্যালকনি।ফলে মেহেনূরের রেওয়াজ আর সেতারের সুর অর্কের ব্যালকনি আর রুম থেকে খুব ভালোভাবেই শোনা যায়।রোজ ভোর বেলায় অর্কের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বলে মেহেনূরের রেওয়াজের সময়টুকু ও কানে তুলো গুঁজেই ঘুমায়।আজ আয়েশা বেগম অর্ককে তুলো দিতে ভুলে গিয়েছিল। তাই অর্ক বিরক্ত হয়।আয়েশা বেগম আজ ভোরে যখন দেখেন মেহেনূর এখনো রেওয়াজ করতে আসে নি তখন উনি ভেবে ছিলেন হয়তো আজকে রেওয়াজ করবে না।পরে রেওয়াজ শুনতে পেয়ে ব্যালকনিতে এসে অর্ককে তুলো দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যান।তবে আসল কাহিনী হলো গিয়ে ভুলে যাওয়া নয়!আয়েশা বেগম ইচ্ছে করেই ছেলেকে তুলো দেন না।অর্ককে জ্বালান যাতে ও রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে যায়।জবে থেকে মেহেনূর এখানে এসেছে তবে থেকেই ছেলের এই উন্নতি হয়েছে!সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যায়।হোক সেটা তিক্তায়।তবু ছেলে সকালে ঘুম থেকে উঠে এটাই উনার কাছে শান্তি লাগে।
আয়েশা বেগম ছেলের রুমে এসে বাজখাঁই গলায় বললেন,
– কি হয়েছে?হয়েছেটা কি তোর?ষাড়ের মতো ওমন চিল্লাছিস কেন?কি সুন্দর মেয়েটার রেওয়াজ শুনছিলাম।সেটাও তোর সহ্য হলো না?
অর্ক মায়ের কন্ঠ পেয়ে কম্বলের নিচ থেকে মাথাটা বের করে আধখোলা চোখে কপালে বিরক্তির ছাপ ফেলে বললো,
– উফফ মা!তোমায় শুনতে কে বারণ করেছে?আমাকে তুলোটা দিয়ে গেলেই তো হতো!
– রোজ রোজ তোর এই নাটক আমার মোটেই ভালো লাগে না অর্ক।মেয়েটার কি সুন্দর গলার স্বর।শুনলে মনে হয় শুনতেই থাকি, প্রানটা এক্কেবারে জুড়িয়ে যায়।আর তুই?ওর রেওয়াজ শুনতেই পারিস না।
আয়েশা বেগমের কথায় অর্ক চোখ গোলগোল অবুঝ মুখে বললো,
– কি সুন্দর স্বর?প্রান জুড়িয়ে যায়?
– হ্যাঁ।
অর্ক বিছানা ছেড়ে উঠে বসে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
– তা বেশ তো তুমিই শুনো না!বাপ-বেটির ওই ভজনগীত শোনার মতো রুচি আর সময় কোনাটাই আমার নেই।
ছেলের কথায় আয়েশা বেগমও তাচ্ছিল্যে হেসে বললেন,
– তোর আর রুচি!তোর রুচি তো ওই বিদেশী মেডামের হাউকাউ!
মায়ের কথায় অর্ক মুখ কালো করে বলল,
– এইসবের মাঝখানে ওকে টেনে আনার মানে কি মা?
আয়েশা বেগম সুর টেনে বললেন,
– কেন?তুই বলতে পারিস আর আমি বললেই দোষ?তোর যেমন ওই বিদেশি মেডামের গান ভালো লাগে,তেমন আমারো মেহেনূরের রেওয়াজ আর সেতারের সুর ভালো লাগে।
অর্ক মায়ের কথায় গলার স্বর উঁচু করে অভিমানী গলায় বললো,
– এই বাড়িতে সকালে যে একটু শান্তি মতো ঘুমাবো তারও তো উপায় নেই।ধ্যাৎ!এখন দেখছি এই বাপ মেয়ের জ্বালায় বাড়িতে আর থাকাই যাবে না।
– অর্ক তুই….
আয়েশা বেগম কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু অর্ক ওর মায়ের কথা না শুনেই ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।শাওয়ার নিয়ে এসে দেখে আয়েশা বেগম এখনো ওর রুমেই বসে আছে।অর্ক স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাস করলো,
– কিছু বলবে?
আয়েশা বেগম মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন।ছেলের কথায় শীতল কণ্ঠে বললেন,
– মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয় সেটা সামনে হোক বা আড়ালে।কারো ব্যাপারে ওই ভাবে কথা বলা উচিৎ না।
মায়ের কথার মানে বুঝতে না পেরে অর্ক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাস করলো,
– মানে?
– তুই মেহরাব ভাইজান আর মেহেনূরকে অপমান করার জন্য এমন করিস না?
মায়ের প্রশ্নের প্রতিউত্তরে অর্ক কড়া গলায় বললো,
– অপমান নয় মা,যা সত্যি তাই বলেছি!যেটা ওরা পারে না সেটা করতে যায় কেন বলো তো?আচ্ছা তুমিই বলো,মেহরাব আঙ্কেলকে সেই ছোট বেলা থেকেই দেখছি সেতার নিয়ে শুধু রেওয়াজই করে গেছেন।জীবনে কিছু করতে পেরেছেন কি?
অর্ক তাচ্ছিল্যের সুরে ফের বললো,
– পুরাতন পাগলেরই ভাত নাই এখন আবার নতুন পাগলের আমদানি করছে।মেয়েকেও নিয়ে এসে নিজের সাথে যোগ করেছে!
আয়েশা বেগম চোখ রাঙিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন,
– অর্ক মুখ সামলে কথা বল।মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছিস।আমি কিন্তু……
মাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অর্ক বাইকের চাবি নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।ছেলের এই আচারণ আয়েশা বেগমের মোটেও পছন্দ হয় নি।দরজার দিকে হতাশ চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ান।
•
অর্কের ব্যবসা বানিজ্য বা চাকরী বাকরীর প্রতি বরাবরই অনিহা।এইসবে ওর কোনো কালেই বিন্দুমাত্র আগ্রহও ছিল না।নিজের বাবার বিজনেসেও জয়েন করে নি।আকাশ সাহেব কত বলেছেন।কিন্তু কোনো লাভ হয় নি।সমাজসেবা করবে বলে পড়াশোনা কমপ্লিট করে নিজের একটা এনজিও গড়ে তুলেছে।এইমুহূর্তে উদাস মনে এনজিওর পাশে পুকুর পাড়ে থাকা বড় কাঁঠগোলাপ গাছটার নিচে বাইকটায় হেলান দিয়ে বসে আছে।মায়ের সাথে অভিমান করে বাসা থেকে না খেয়েই বেড়িয়ে এসেছে।
– অর্ক!
– হুম!
– কতক্ষণ ধরে এইখানে বসে আছিস?
– অনেকক্ষণ!
– আন্টি ফোন করে বললো বাসা থেকে নাকি কিছু খেয়ে আসিস নি?চল কিছু খেয়ে নিবি।
– আমার ভালো লাগছে না কলি।
গম্ভীর কণ্ঠে বললো অর্ক।অর্কের যে মুড ভালো নেই সেটা কলি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।তবে এটাও বুঝতে পারছে মায়ের সাথে অহেতুক ঝগড়া করে এসে এখানে মুড অফ করে বসে আছে।ও বরাবরই এমন করে।মৃদু হাসে কলি।অর্কের বাহু ধরে বললো,
– পেটে খাবার পরলেই ভালো লাগবে।
– প্লিজ জোর করিস না আমায়।
অর্কের সব বন্ধুই ওর এনজিওর সদস্য।অর্ক ওর বন্ধুদের নিয়েই পুরো এনজিওটা পরিচালনা করে।কলি ওদের মধ্যেই একজন।
– আমরাও এখনো কিছু খাই নি!
একের অধিক কন্ঠ পেয়ে অর্ক কপাল কুঁচকে পিছনে তাকায়।তনিমা আর অয়ন দাঁড়িয়ে আছে।দুজনের হাতে দুটো করে চারটি প্যাকেট।তনিমা আর অয়ন অসহায় মুখ করে করুন গলায় বললো,
– প্লিজ চল,খুব খিদে পেয়েছে।
অর্ক জানে ওদের মোটেও খিদে লাগে নি।ওকে খাওয়ানো জন্য ওরা শুধু শুধু নাটক করছে।অর্ক যখনই বাসা থেকে না খেয়ে চলে আসে বা রাগ করে থাকে তখন ওরা সবাই ঠিক কোনো না কোনো বাহানা বানিয়ে হাজির হয়।তবে এখানে অনেকটা ভূমিকা ওর মায়েরো থাকে।কারণ হামেশাই নিউজটা তো উনিই লিক করে থাকেন।আয়েশা বেগমের কল লিস্ট চেক করলে অর্কের বন্ধুদের নাম্বার গুলোই আগে পাওয়া যাবে।স্মিত হাসে অর্ক।কথা না বাড়িয়ে একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বাধ্য ছেলের মতো ওদের নিয়ে আসা খাবার গুলো এইখানে বসেই সবাই মিলে খেয়ে নেয়।
– দোস্ত,একটা তাজা খবর নিয়ে এসেছি!
চমকে উঠল অর্ক।খাওয়া শেষ করে উঠতেই অর্কের একটা কল আসে।সবাইকে ভেতরে যেতে বলে ও কলটা রিসিভ করে কথা বলছিল।তখনই দিহাদ এসে হাঁফাতে হাঁফাতে কথাটা বলল।দেখে মনে হচ্ছে রীতিমতো দৌঁড়ে এসেছে ও।তাই তো ওমন হাঁফাচ্ছে।অর্ক দিহাদের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে। কলটা কেটে দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে কপালে আংশিক ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞাস করলো,
– তাজা খবর?
– হুম,
– কি?
– ট্রিট দিবি তো?
দিহাদের কথায় অর্ক বিরক্ত স্বরে বললো,
– আশ্চর্য!আগে বল কি হয়েছে?না শুনেই তোকে ট্রিট দিবো কিভাবে?
– না না আগে তুই বল ট্রিট দিবি কিনা?
অর্ক বুঝতে পারছে দিহাদ হয়তো সত্যিই কোনো ভালো খবর নিয়ে এসেছে।নয়তো ট্রিট চাওয়ার মতো ছেলে দিহাদ নয়!অর্ক দিহাদের হাত ধরে বললো,
– আচ্ছা এদিকে আয়।বস এখানে!তুই আগে একটু শান্ত হও।তারপর না হয় তোর কথা শুনবো!
কাঁঠগোলাপ গাছটার নিচে ইট পাথর দিয়ে সুন্দর করে বানিয়ে রাখা ব্যাঞ্চটায় অর্ক দিহাদকে নিয়ে বসালো।তারপর বলল,
– নে এবার বল কি হয়েছে?
– লাখো তরুণের হার্ট বিট থামিয়ে দেওয়া সেই মানবী আসছে!
দিহাদের কথা বুঝতে না পেরে অর্ক ভ্রু কুঁচকে বললো,
– দিহাদ!হেয়ালি না করে ক্লিয়ারলি বল।
– আজকে কিরণ চৌধুরীর লাইভ কনসার্ট আছে।
দিহাদের কথা শুনে অর্ক মুখ চেপে রেখেও হাসি আটকাতে পারলো না।অর্ক ফিক করে হেসে দেয়। দিহাদ অর্কের হাসির কারণ বুঝতে না পেরে কপাল সংকুচিত করে বললো,
– আজব তো!এই ভাবে হাসছিস কেন?
অর্ক কোনো মতে ওর হাসি সংবরণ করে বললো,
– হাসবো না তো কি করবো?এই খবর নিয়ে এসে তুই আমার কাছে ট্রিট চাইছিলি!এটা তোর তাজা খবর?কিরণ চৌধুরীর কনসার্ট,সে তো রোজই থাকে!এটা কোনো আহামরি খবর হলো?
দিহাদ এবার বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,
– আগে আমার পুরো কথাটা তো শুনবি!
– কি আরো কোনো তাজা খবর দিবি নাকি?
অর্ক কথাটা বলেই আবার হাসতে শুরু করলো।এবার দিহাদের ভীষণ রাগ হচ্ছে।কর্কশ গলায় বলল,
– কিরণ চৌধুরীর কনসার্ট আজকে আমাদের স্টেডিয়াম মাঠে হবে।
মুহূর্তেই অর্কের মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়।চকিত দৃষ্টিতে দিহাদের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করল,
– কি বললি তুই?
দিহাদ বিরক্তিকর একটা চাহনি দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
– যা শুনতে পেয়েছিস তাই বলেছি!
দিহাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে উঠে চলে যেতে নিলেই অর্ক ওর পথ আগলে দাঁড়িয়ে অবাক সুরে জিজ্ঞাস করলো,
– কিরণ চৌধুরী বিডিতে?
– অর্ক আমার সামনে থেকে সর।
দিহাদ গাল ফুলিয়ে কথাটা বলল।অর্ক বুঝতে পারছে তখন পুরো কথা না শোনে ওইভাবে হেসেছে বলে এখন তার অভিমান হয়েছে।দিহাদের মুখ দেখে অর্ক মুখ টিপে হাসলো।দিহাদের গাল টিপে আহ্লাদী সুরে বললো,
– এই কথাটা এতক্ষণ বলিস নি কেন?
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল দিহাদ।অর্কের হাতটা ঝাড়া মেরে ফেলে দিয়ে কর্কশ গলায় বললো,
– আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছিস তুই?পুরো কথা না শুনেই তো দাঁতকপাটি বের করে হাসতে শুরু করে দিয়েছিস!
– সরি ইয়ার!রাগ করিস না।
মিনমিনে সুরে বললো অর্ক।দিহাদ আঁড়চোখে অর্কের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললো,
– ইটস ওকে।
অর্কের কপালে চিন্তার ছাপ ফেলে বললো,
– কিরণ চৌধুরী বিডিতে আর আমিই জানি না।
– কেউই জানতো না।নিউজটা গোপনই ছিল।খবর নিয়ে জানতে পারলাম সপ্তাহ দু’এক আগেই নাকি এসেছে ও।
অর্ক চোখ গোলগোল করে দিহাদের দিকে তাকায়।কপালে তিন আঙুলে স্লাইড করে বিড়বিড় করে বলল,“পনেরো দিন হয়ে গেছে আর আমি জানতেই পারলাম না।অদ্ভুত!”
– কি বিড়বিড় করছিস?
– দিহাদ তুই সিউর তো?
দিহাদ অর্কের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
অর্কের কথা বুঝতে পারে নি ঈ।অর্ক উৎকন্ঠিত স্বরে ফের বললো,
– আজকে কি সত্যি কিরণ চৌধুরীর কনসার্ট আছে?
– হেরে বাবা!এই দেখ কত্ত বড় পোস্টার টাঙানো হয়েছে।
দিহাদ ওর হাতে থাকা ফোনটা অর্কের দিকে এগিয়ে দিয়ে আবার বলল,
– তোকে আমি চিনি না!মুখের কথা তুই বিশ্বাস করবি না বলেই আমি প্রমাণ সাথে নিয়ে এসেছি!ফোনে ছবি তুলে নিয়ে এসেছি।অনেক বড় কনসার্ট হবে মনে হচ্ছে!প্রথম বারের মতো বিডিতে এসেছে এই কিরণ চৌধুরী।ধামাকা তো হবেই!
অর্ক ফোনটা দিহাদের হাতে দিয়ে স্মিত হেসে বললো,
– চল আমার সাথে!
– কোথায়?
– আমাদের এলাকায় অতিথি আসছে তাকে আপ্যায়ন করতে হবে না?তারই ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি!
চলবে…