১৬ বছর বয়স | পর্ব – ২৭

এটুকু বলেই আমি শাওনের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলাম।আর সাথে সাথে শাওন আমার এক হাত ধরে টেনে ওর কাছে নিয়ে আসলো।
আমি চোখ বড়সড় করে শাওনের দিকে তাকালাম। শাওন শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছুই হয়নি। আর আমি এখানে তোমার জন্য আসিনি। You are getting me wrong. So Don’t think so high about yourself.
আমার মুখের যে একফোঁটা হাসি ছিল সেটা সরে গিয়ে এখন চোখমুখ প্রশ্নসূচক আভা আসলো।
“মানে?!” আমি প্রশ্ন করলাম।
“মানে তোমার খুব ভাল করেই বুঝতে পারার কথা। So Don’t bother me.”
বলেই আমার হাত ছেড়ে দিয়ে শাওন রুম থেকে বের হয়ে গেল।
আমি ভ্রুকুচকে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারন হঠাৎ এরকম ব্যবহারটা ঠিক হজম করতে পারছিনা। কিছুক্ষণ আগেও ত সব ঠিকই ছিল!
আমার আবার কেমন যেন খারাপ লাগতে শুরু হয়ে গেল। কিছু কি করেছি আমি? আমি ওনার বিরক্তির কারণ? কেনো? কিছুই ত বুঝতে পারছি না।
একটা নিঃশ্বাস জোর করে বের করে দিয়ে বললাম, ধুর ভাল্লাগে না। ওনার আমাকে পছন্দ না এটা কি নতুন কথা?
বলেই আমি নিজে নিজেকে বুঝতে লাগলাম আর মুখে একটা হাসি নিয়ে আসলাম। কারন বেশি খারাপ লাগা আমি সহ্য করতে পারিনা। আর এটা কোনো বড় বিষয় না যে কেউই আমাকে সহ্য করতে পারেনা। তাই না? তাই ই ত।
যাই হোক এখন পুকুর পাড়ে গেলে হয়তো ভাল লাগবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। আমি পুকুর পাড়ে চলে এলাম। আর এসেই নামতে ইচ্ছে করল। তাই এই ভর দুপুরে জলে নেমে পরলাম। আর বার বার পাড়ের দিকে তাকাতে লাগলাম। কারন উনি কিনা এখনি এসে বলবে, “ওঠো এখন। এটা কোনো গোসলের সময় না।”
কিন্তু আজ উনি বিরক্ত করতে এলেন না।
অদ্ভুত ত! বিরক্ত করলে বিরক্ত লাগে। আবার বিরক্ত না করলেও বিরক্ত লাগে। সত্যিই অসহ্য।
আমি পানির মধ্যে ডুব দিয়ে দিলাম। আর ডুব দিয়ে উঠে মন থেকে সব অসস্তি ছেড়ে ফেললাম।
অনেকক্ষণ গোসলের পর ঘরে ফিরে এলাম। শাওন রুমে কিংবা বাড়ির মধ্যে কোথাও নেই! গেল কোথায়?
পরক্ষণেই নিজেকে নিজে ঝাড়ি মেরে বললাম, মিলা উনি যেখানে ইচ্ছা যাক তোর কি? আর উনি নেই মানে অশান্তিও নেই।
আমি বাথরুমে ঢুকে শাড়ি বদলে থ্রি-পিস পরে নিলাম। কারন এখন আমি গাছে উঠব। অনেক দিন ওঠা হয়না। বকুলটা যে গেল আর এলোও না। এলে গল্প করা যেত।
আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে হাটতে হাটতে অনেক দূর এলাম। আজ গাছে উঠব না। কারন আজ এভাবে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগছে। হেটে হেটে কখন যে মেইন রোডে চলে এলাম টেরই পেলাম না। এই সেই মেইন রোড। এখান থেকেই হয়ত শাওন খুজতে খুজতে…। এক মিনিট, এখান থেকে হোক বা যেখান থেকে হোক। উনি আমার জন্য আসেনি। স্নোবেলকে দিতে এসেছে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেই আমি রাস্তায় পা দিতেই একটা গাড়ির সামনে পরলাম। যদিও গাড়িটা ঠিক সময় মতই ব্রেক কষে থেমে গেছে তাও আমি ভয়ে রাস্তার উপর পরে গেলাম। পরেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম। একটু হলেই আজ উপরে চলে যেতাম হয়তো! আমি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে রইলাম।
আশেপাশের কয়েকজন মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ একটা ছেলে কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো।
“Are you ok?”
আমি না তাকিয়েই হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। তারপর নিজের হাতের তালুর দিকে তাকালাম। পরে যাওয়ার সময় হাত দিয়ে ভর রাখতে গিয়ে তালুতে ব্যথা পেয়েছি। মানে হালকা ছিলে গেছে।
ছেলেটা আমার পাশে দুইপায়ের উপর বসে পরে বলল, “Did you get hurt?
আমি এবার মাথার চুলগুলো সরিয়ে পাশের ছেলেটার দিকে তাকাতে তাকাতে বললাম, না ঠিক আছি। কো…
এটুকু বলেই আমি ছেলেটাকে দেখে থেমে গেলাম। ছেলেটাও অনেক হকচকিয়ে গিয়ে নিজের চোখ থেকে সানগ্লাসটা সরালো।
আমি বলে উঠলাম, আপনি?
ছেলেটা একটা উজ্জ্বল হাসি দিয়ে বলল, yeah It’s me. Seems like we meet Again.
আমি কি বলব বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম।
“Well, It’s my bad. I didn’t see you. Sorry. ভাগ্যিস আপনি চেনা পরিচিত নাহলে কিনা কেস ই হয়ে যেত আজ আমার নামে।” বলেই ছেলেটা আবার একটা উজ্জ্বল হাসি দিল।
আমি এবার হালকা হেসে বললাম, আমার দোষ ছিল, না দেখেই রাস্তা পার হচ্ছিলাম।
ছেলেটা আশেপাশে তাকিয়ে বলল, সবাই দেখছে এভাবে বসে না থেকে উঠি?
আমি চোখ বড়সড় করে আশেপাশে তাকালাম। হায়রে আমিও না! রাস্তায় বসে ছিলাম এতসময়!
ছেলে উঠে দাড়ালো। আমিও হাত ঝেরে উঠে দাড়ালাম। তারপর গা ঝারতে লাগলাম।
“হাতে বেশি লেগেছে কি?” উনি জিজ্ঞেস করলেন।
আমি দুই হাত দিয়ে না সূচক হাত নাড়িয়ে বললাম, না, না, আমি ঠিক আছি।
উনি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, ঠিক নেই।
তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে বললেন, যতদুর আমি জানি এদিকে একটা হস্পিটাল আছে।
আমি চমকে উঠে বললাম, কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার আমার জন্য দেরি না করাই ভাল। আপনি হয়ত কোথাও যাচ্ছিলেন।
ছেলেটা একটা রহস্য ময় হাসি দিয়ে বলল, I am not in hurry. So just Don’t worry!
আমি কপালকুচকে হাসার চেষ্টা করে বললাম, আচ্ছা আমি তাহলে আসছি।
বলেই আবার গ্রামের রাস্তার দিকে পা বাড়াতে যেতেই মনে হলো পায়ের দিকে কিছু একটা ঠিক নেই। আমি মাথা নিচু করে পায়ের দিকে দেখলাম। একটা সেন্ডেল ছিড়ে গেছে। আমি আস্তে করে চোখ সরিয়ে পাশের ছেলেটার দিকে তাকালাম।
সে ইতিমধ্যে হেসে দিয়েছে। আমি ভ্রুকুচকে আবার পায়ের দিকে তাকালাম।
ছেলেটা হাসিমুখেই বলে উঠল, নট এগেইন!
আমি একটা ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
“আজীব না! প্রথম দিন দুই পা ই খালি আর আজ এক পা খালি। কিজানি পরের বার কি হবে!” ছেলেটা মজার ছলে বলে উঠল।
আমি ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বললাম, পরের বার মানে? পরের বার কেন দেখা হবে?
“আমার 6th sense বলছে আমাদের আবার দেখা হবে।” ছেলেটা মৃদুস্বরে বলল।
আমি ভ্রুকুচকেই তাকিয়ে রইলাম।
“ওকে যাই হোক এখন এভাবে ত থাকা যায় না তাই গাড়িতে উঠুন।” ছেলেটা গাড়ির দিকে ইশারা করে বলল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কোনো দরকার নেই। আমি সামলে নিতে পারব।
ছেলেটা বলে উঠল, আমার জন্য যেহেতু হয়েছে সো প্লিজ লেট মি সার্ভ ইউ।
বলেই ছেলেটা ঠোঁটের এক প্রান্তভাগ কামড়ে ধরে অনুরোধের চাহনিতে আমার উওরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, কি সেবা করতে চান?
“প্রথমত হাতের ড্রেসিং, দ্বিতীয়ত পায়ের জন্য পারফেক্ট এক জোড়া স্লিপার।” ছেলেটা খুশির সাথে বলল।
আমি দ্বিধার সাথে বললাম, দেখুন সত্যিই দরকার ছিল না। আপনি…
ছেলেটা আমার কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আর বলল, Please get in.
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে তারপর গাড়িতে উঠে বসলাম।
সারা রাস্তা আমরা চুপচাপই রইলাম। কিন্তু ছেলেটা সারা রাস্তাতেই একটা উজ্জ্বল হাসি মুখে টেনেই রেখেছে। হাসতে মনে হয় খুব পছন্দ করে। আর কুমড়োপটাশকে দেখো সবকিছুতেই গোমড়ামুখু। তার চেয়েও বড় কথা আমার সবকিছুতেই ওনার সমস্যা। দেখা যাবে যদি কোনোদিন মরে স্বর্গে যাই সেখানেও উনি বলবে, আমার পিছনে ঘুরঘুর না করে এখান থেকে যাও। যত্তসব।
কিন্তু উনি আছেন কোথায় এখন?
“Hey, What are you thinking?” ছেলেটা বলল।
আমি নড়েচড়ে বসে বললাম, কিছুই না।
“তাহলে নামুন এসে গেছি।” ছেলেটা হেসে বলল।
আমি তাকিয়ে দেখলাম একটা জুতার শোরুমের পাশে গাড়িটা দাড় করিয়েছেন উনি। আমি ক্লান্ত ভঙ্গীতে তাকিয়ে বললাম, এগুলো না করলেও হত।
ছেলেটা কিছু না বলে গাড়ি থেকে বের হয়ে আমার সাইডের দরজা খুলে দিল।
আমরা শো রুমে ঢুকতেই একটা মেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, Welcome sir, welcome ma’m.
ছেলেটাও একটা হাসি দিয়ে মেয়েটাকে বলল, Show her some pretty shoes please.
“Of course sir.”
মেয়েটা আমাকে বলল, “ম্যাম আপনার পছন্দ আমাকে বলুন আমি এনে দিচ্ছি।”
আমি ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকালাম তারপর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সরু গলায় বললাম, যা ইচ্ছা একটা দিয়ে দিন।
ছেলেটা নিঃশব্দে হেসে দিলো।
এই ছেড়া সেন্ডেলটা পা থেকে সরালেই হলো আর কি লাগে! মনে মনে বললাম আমি।
মেয়েটা হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে একটা হাই হিল নিয়ে এলো আর আমার সামনে রাখলো।
আমি বলে উঠলাম, এগুলো পরে পরের বার যদি উল্টিয়ে পরি তাহলে আমার পা সহ কোমড়ও যাবে।
ছেলেটা একটা সোফাতে বসে ছিল। আমার কথা শুনে হেসে উঠে দাড়িয়ে বলল, Well, Let me help then.
বলেই প্যান্টের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে স্লিপার খুজতে লাগল।
আমি সরু চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে শো রুম টা দেখতে লাগলাম। তখনি ছেলেটা আমার সামনে একটা হ্যালো কিটি শু ধরে বলল, এটা।
আমি জুতার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুচকে ওনার দিকে তাকালাম। আমাকে কি উনি বাচ্চা মনে করেন!
পাশে দাড়ানো অই মেয়েটাও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
ছেলেটা রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলল, Just kidding.
তারপরই একটা কালো শু হাতে নিলো। সেটা দেখতে কালো কিন্তু চিকচিক করছে আর ঝলকাচ্ছে। খারাপ না! তাছাড়া অত কথা আমি বাড়াতে চাচ্ছিনা তাই যেটা দিচ্ছে ওটাই নিয়ে ফিরতে চাচ্ছি।
ছেলেটা ইশারায় ধরতে বলল জুতোটা। আমি হাতে নিলাম। তারপর এক পাশে একটা সোফাতে বসে জুতোটা পরে নিলাম। টাইট হচ্ছে। আমি তাও কিছু বললাম না। কিন্তু ছেলেটা ঠোঁটের কোনে একটা হাসি এনে মেয়েটাকে বলল, Show her another size.
“অহ! স্যার অবশ্যই।” বলেই মেয়েটা অন্য সাইজের একই জুতা নিয়ে এলো। এটা হয়ে গেল পায়ে একদম ঠিকঠাক।
আমি উঠে দাড়াতে দাড়াতে দ্বিধার সাথে বললাম, ধন্যবাদ। এখন আমাকে যেতে হবে।
ছেলেটার হাসিটা একটু হালকা হয়ে গেল। আর মাথা নাড়িয়ে বলল, well.
উনি রিসিপশনের কাছে এগিয়ে গেলেন পেমেন্ট করার জন্য। আমি জুতাটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে রইলাম।
“Three thousands only sir.” রিসিপশনের ছেলেটা বলল।
এটা শুনেই আমার চোখ গোলগোল হয়ে গেল।
“কি এই ছাতার জুতা তিন হাজার?” আমি বলে উঠলাম।
রিসিপশনের ছেলে আমার দিকে চমকে তাকালো। কিন্তু উনি আমার দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকে একটা শব্দছাড়া হাসি দিলেন।
আমি রিসিপশনের ছেলের বাংলার পাঁচের মত তাকানো দেখে বুঝলাম যে আমার এভাবে বলা ঠিক হয়নি।
উনি ঘুড়ে রিসিপশনের ছেলের দিকে তাকিয়ে মজার সুরে ধমকে বললেন, এই ছাতার জুতার এত দাম কেন? Drop the price to 300.
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, 300 ত পারফেক্ট না?
আমি বড়সড় চোখ করে ছেলেটার দিকে তাকালাম। উনি ৩০০০ টাকা বের করে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিলেন আর ঠোঁটের কোনে একটা হাসি এনে বললেন, ড্রপ ট্যা প্রাইজ, আই রিয়েলি মিন ইট!
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, Let’s go.
আমার পুরাতন সেন্ডেলটা ওই শোরুমের ডাস্টবিনে রয়ে গেল আর আমি এই তিন হাজারের জুতা পরে বেরিয়ে এলাম। এখনো হজম হচ্ছেনা যে এটা তিন হাজার। এত টাকা ত নেই আমার কাছে যে ওনাকে দিয়ে দিব।
আমি গাড়িতে বসে বাংলার পাচের মত মুখ করে ওনার দিকে তাকালাম। উনি সিট বেল্ট পরতে পরতে আমার দিকে একটা সেভলন ক্রিম দিলেন।
সেভলন ক্রিম দেখে আমার শাওনের কথা মনে পরে গেল।
“কি?” ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
“না কিছুনা।” মৃদু হাসি দিয়ে বললাম তারপর হাতে লাগিয়ে নিলাম। যদিও তেমন কিছুই হয়নি।
তারপর আমি ঠোঁটটা জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে জুতোর দিকে ইশারা করে বললাম, আমাদের গ্রামের মধ্যে দুইশোতেও এরকম পাওয়া যেত। আপনি শুধু শুধু… এত গুলো টাকা। আমি চেষ্টা করব পরিশোধ করে দিতে।
ছেলেটা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, অহ শীট। ওদের প্রাইজ ড্রপ করে দুইশো বানাতে বলতে হবে তাহলে। ওয়েট।
বলেই ছেলেটা সীট বেল্ট খুলতে লাগল। আমি চমকে ফট করে বলে উঠলাম, না থামুন।
“কেনো?”
“যথেষ্ট হয়েছে। এখন চলুন।” আমি ভ্রুকুচকে বললাম।
ছেলেটা একটু ভ্রুকুচকে হাসি মুখে বলল, আর পরিশোধের বিষয়টা পরের দেখাতে বুঝে নেওয়া যাবে।
আমি চোখ বড়সড় করে নিলাম। আর বললাম, অতগুলো টাকা নেই আমার কাছে এখন। আপনি প্লিজ জুতো নিয়ে যান। লাগবেনা আমার।
ছেলেটা হাসতে হাসতে নিজের কপাল চুলকে বলল, ওই পরিশোধ না, A cup of tea will be enough!
আমি শুনে শান্তি পেলাম। তারপরে অল্প হাসার চেষ্টা করলাম।
উনি আমাকে আবার আগের জায়গায় নামিয়ে দিলেন। আমি নামতে নামতে হাসিমুখে ধন্যবাদ দিলাম।
ছেলেটা মুচকি হেসে আমাকে টাটা দিলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো। আমি গ্রামের রাস্তায় নেমে এলাম।
এখনো সন্ধ্যে ত হয়নি কিন্তু যেতে যেতে হয়ে যাবে। সমস্যার বিষয় হলো ওই মিশু যদি আবার কিছু করে? চিন্তিত হয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য জায়গায় দাড়িয়ে রইলাম। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়াতেই একটা ছেলে বলে উঠল, wait.
আমি অনেক চমকে পিছনে তাকালাম।
সেই ছেলেটাই হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ সরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলাম ওনার গাড়িটা পার্ক করা।
আমি হা হয়ে বললাম, “আ… আপনি যান নি?”
ছেলেটা এগিয়ে এসে আমার দিকে একটা টর্চ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, You will need this.
আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। ছেলেটা সিরিয়াস হয়ে তাকিয়ে বলল, And if you don’t mind, আমি আপনাকে এগিয়ে দিতে চাই।
আমি চোখ বড়সড় করে তাকালাম। উনি হেসে দিয়ে বললেন, সমস্যা নেই বাসার ভিতরে যাব না। একটু দূর থেকেই চলে আসব।
আমি ‘না’ বললাম না। কারন আমার এমনিও ভয় লাগছে।
উনি ইশারায় টর্চটা ধরতে বললেন। আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম।
উনি হাসিমুখে আমাকে আগে এগিয়ে যেতে ইশারা করে বললেন, “After you.”
আমি একটু দ্বিধায় পরলেও টর্চটা জ্বলিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। উনি ওনার দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমার পিছনে আসতে লাগলেন। আর মাঝে মাঝে আশে পাশে তাকাতে লাগলেন। আমি শুধু হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে পিছনে তাকালাম।
শেষ পর্যন্ত বাড়ির অনেক কাছ পর্যন্ত এসে গেলাম। এখান থেকে অনেক বাড়িঘর আছে। তাই এখান থেকে আর ভয় নেই। আমি হাসিমুখে পিছনে ঘুরলাম। আর মুখ হা করে কিছু বলার আগেই দেখলাম কেউ নেই।
গেল কই উনি? আমি আশেপাশে টর্চ মারলাম কিন্তু কাউকে দেখলাম না। ঠোঁট উলটে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম, চলে গেছে হয়ত!
আমি মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। যেতে গিয়ে প্রথমে বকুলের বাড়িতে গেলাম গল্প করার জন্য। কিন্তু বকুল নেই। বকুল কেনো, বকুলের পরিবারের কেউই নেই। আশেপাশেও কোনো সারাশব্দ নেই। আজ গ্রামটা অনেক ফাকা ফাকা লাগছে। আমি বাড়ি ফিরে এলাম।
নিজের রুমে ঢোকার আগে একটা দ্বিধা বোধ কাজ করতে লাগল। উনি কি ভিতরে আছেন? নাকি নেই? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন হলো উনি কি ফিরে গেছেন?
যেতেই পারেন।
আমার বাড়ি আসাই উচিৎ হয় নি। বাহিরেই ভালো ছিলাম। মনের ভিতরকার এই কেমন একটা খারাপ লাগা সহ্য হচ্ছেই না।
আমি আস্তে করে এগিয়ে রুমের দরজার কাছে দাড়ালাম। তারপর চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম। না, শাওন নেই। একটা নিঃশ্বাস ফেলে রুমের ভিতরে এলাম। স্নোবেল আমাকে দেখে খুশিতে আটখানা। ওর দিকে তাকিয়ে শব্দ ছাড়া হাসলাম। তারপর বিছানার দিকে তাকালাম। এখন শুয়ে পরে একটা বড় ঘুম দিলে হয়ত ভালো লাগবে। কিন্তু ঘুম ত নেই চোখে। এদিকে বাড়িতে কাকা কাকি প্রভাতী কেউই নেই! গেল কোথায় সবাই?
একেই মনে হয় বলে যে যখন মরে সব একসাথে মরে। অসহ্য!
আমি এগিয়ে গিয়ে স্নোবেলকে ওর বিছানায় তুলে দিলাম। তারপর উঠে দাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান একটা হাসি হাসলাম। স্নোবেল কিছু একটা বুঝতে পেরে আমার দিকে অন্যভাবে তাকিয়ে রইল।
“কোথায় ছিলে এতসময় তুমি?!”
শাওনের গলা শুনে আমি থমকে গেলাম। উনি যান নি তারমানে?
আমি আস্তেধীরে শাওনের দিকে ঘুরলাম। শাওন গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি ওনাকে দেখে মনে মনে খুশি হলাম। যাক, না বলে চলে যায়নি তাহলে।
উনি উওরের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে বললাম, কেনো? আমি যতক্ষণ যেখানেই থাকি তাতে আপনার ত কিছু না! বরং আমি না থাকলেই ত আপনার সুবিধা। যেহেতু আমি আপনাকে বিরক্ত করি!
শাওন শক্ত মুখ করে বলল, Don’t think too much. কালই ব্যাক করব আমি। তার আগে তোমাকে আমার বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে যাব। আজই ব্যাক করার কথা ছিল আমার। তোমার জন্য হলো না।
উনি কাল ই ব্যাক করবেন এটা শুনেই আমার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। কিন্তু কেনো? উনি ব্যাক করলেও কি না করলেও কি!
উনি ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বললেন, what?
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কোনো দরকার নেই। আমি একাই চলে যেতে পারব।
“Yeah, whatever!” বলেই শাওন বিছানার উপর নিজের ফোনটা রেখে বাথরুমে ঢুকে গেল। আমি সাথে সাথে বাহিরে চলে এলাম। আর রুমে গেলাম না। বাড়ির দুইপাশে বসার জন্য জায়গা বানানো আছে। তার একটাতে বসে দুইহাটু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আজ চারিদিকে ভালই অন্ধকার। এর মধ্যে বাড়ির সবাই গেল কই সেটাই বুঝতে পারছি না!
আমি পিছনের দিকে মাথা হেলিয়ে দিলাম। আর খুব জলদিই ক্লান্তির কারনে ঘুম চলে এলো। আর আমি ওখানেই ঘুমিয়ে পরলাম।
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কারনে ভোরের দিকেই ঘুম ভেঙে গেল। আমি চোখ খুলে তাকালাম। তাতে আমার চোখের সামনে খোলা জালানাটা দেখতে পেলাম। একটু ঘুরে অন্যদিকে ফিরতে গিয়ে আর ফিরতে পারলাম না। কারন কেউ শক্ত করে পিছন থেকে আমাকে ধরে আছে।
শাওন? এভাবে ধরেছে কেনো আমাকে?
এক মিনিট, আমি ত বাহিরে ছিলাম। এখানে কিভাবে এলাম! উনি নিয়ে এসেছেন? কখন?
নিয়ে এসেছেন ভালো কথা কিন্তু এখন এমনভাবে ধরে আছে শক্ত করে যে নড়তেও পারছিনা। উনি আমার ঘাড়ের নিচ দিয়ে এক হাত রেখে আমার হাত ধরেছেন আর অন্য হাত দিয়ে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আছে। ওনার কারনে আমার হার্ট ত এখনি ফেটে যাবে।
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু নড়ার চেষ্টা করতেই শাওন পিছন থেকে আমার আরো কাছে চলে এলো। এখন ওর নিঃশ্বাস আমার কাধে এসে পরছে। আমি চোখ বন্ধ করে নিয়ে বললাম, আমাকে কি ভরতা বানাতে চাচ্ছেন আপনি?
শাওন তাও ছাড়লো না। তিনি দিব্যি ঘুমাচ্ছেন শান্তিতে। তাই কোনো কথাই কানে যাচ্ছে না তার।
কিছুক্ষণ ওভাবে পরে থেকে আমি আবার নড়াচড়া করতে শুরু করলাম।
এবার শাওন নড়েচড়ে চোখ খুলল। আর বিষয়টা বুঝতে পেরে অবাক হয়ে সাথে সাথে হালকা মাথা তুলে তাকালো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। চোখে চোখ পরতেই উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলেন। আমিও উঠে বসলাম। উনি আমার দিকে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে তারপর বিছানা থেকে নেমে গেলেন।
“দেখো একবার! যেনো কিছুই জানেনা!” মনে মনে বললাম আমি।
ফ্রেস হয়ে আমরা নাস্তা করতে টেবিলে বসলাম। উনি ওনার কুমড়ো দিয়েই খাচ্ছেন।
হঠাৎ ই মনে পড়ল যে উনি আজ চলে যাবেন। আমি ওনার দিকে তাকালাম। উনি তাকালেন না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে খেতে শুরু করলাম।
খাবার পর শাওন রুম থেকে রেডি হয়ে বের হলো। কাকা এগিয়ে গিয়ে শাওনের সাথে কথা বলতে লাগল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম।
আজ বকুলকে বাড়িতে পাওয়া গেল। আমাকে দেখে অনেক খুশির সাথে বকুল এগিয়ে আসলো।
“কি রে! হঠাৎ আমাকে মনে পরলো!”
আমি হালকা হেসে বললাম, কালই এসেছিলাম তুই ছিলি না।
বকুল অবাক হয়ে বলল, কখন?
“সন্ধ্যার দিকে।”
বকুল বলে উঠল, অহহহহ…। আর বলিস না অনেক বড়ো কাহিনী হয়ে গেছে। তোর কাকা, কাকি আর প্রভাতীও ছিলো।
আমি ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বললাম, কি হয়েছে?
বকুল বলল, ওই পারার মিশু আছে না?
আমি হকচকিয়ে বকুলের দিকে তাকালাম।
বকুল বলতে লাগল, গত দিন সন্ধ্যার পর মনে হয়, পাগোল হয়ে গেছে।
আমি অবাক হয়ে বকুলের দিকে তাকালাম আর বললাম, মানে?
“সেটাই ত রহস্য। সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। অনেক গুলো গুন্ডা মিলে মেবি দিয়েছে জব্বর দেওয়া। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কি জানিস?”
আমি কপাল কুচকে বললাম, কি?
বকুল বলল, গুন্ডারা মিশুর ‘ওইটা’ নাই করে দিয়ে গেছে।
আমি ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বললাম, ওইটা মানে?
বকুল নিজের মাথায় বারি মেরে বলল, হায়রে গাধা। এদিকে আয় কানে কানে বলি।
আমি বকুলের কথা শুনে চোখ মুখ বড়সড় করে ফেললাম। তারপর হা করা মুখটার উপর একটা হাত দিলাম।
বকুল সরু চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।
“এসব কি…! এগুলো….শাওন এগুলো করিয়েছে?” বিড়বিড় করে বলে উঠলাম আমি।
বকুল বুঝতে না পেরে বলল, কি?
আমি বকুলকে বললাম, আমাকে এখনি যেতে হবে।
বলেই আমি উঠে বাড়ির দিকে দৌড়ালাম। বাড়িতে ঢুকেই হাপাতে লাগলাম। কাকি আমাকে দেখে বলল, কি রে, কি হয়েছে?
আমি হাপাতে হাপাতে বললাম, উ…উনি কই?
কাকি কয়েক সেকেন্ড কপাল কুচকে থেকে তারপর বুঝলো আমি শাওনের কথা বলছি।
“ও ত চলে গেছে।” কাকি বলল।
“চলে গেছে?” আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করেই আবার বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেলাম।
আমি খুজতে খুজতে মেইন রোড পর্যন্ত গেলাম। কিন্তু ওনাকে কোথাও পেলাম না। চলে গেছে তাহলে? এখন? আমি ‘থ’ মেরে ওখানে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে যেন আমি আর এখানে থাকতেই পারব না। খুবই কষ্ট হচ্ছে।
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে তারপর আস্তে আস্তে ফিরে এলাম। আর পুকুরের পাড়ের কাছে এসে থামলাম। কিছুই ভালো লাগছে না। আমি মাথা নিচু করে কিছু সময় পাড়ে বসে থেকে তারপর পানিতে নেমে পরলাম। এতক্ষণে এখন চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো। ওভাবেই চুপচাপ পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে নিরবে কাদতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পরে চোখের জল মুছে, চোখে মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। মনে হচ্ছে যেন আমার একটা অংশ আমার সাথে নেই।
হঠাৎ ই আমার ওড়নাটা এসে আমার মাথার উপর পরলো আর নাম মুখ ঢেকে গেল। আমি অবাক হলাম। এটা ত পাড়ে রেখে এসেছিলাম, এভাবে উড়ে আসবে কিভাবে?
“Hey, Get up. We need to go.”
আমি সাথে সাথে পিছন ফিরে তাকালাম। ওড়নাটা মাথার উপর থাকলেও আমি সেই পাতলা ওড়নার মধ্যে দিয়েই ওনাকে দেখতে পেলাম।
উনি সিরিয়াস মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার মুখে সাথে সাথে একটা উজ্জ্বল হাসি চলে এলো। এখন সব কিছু ভালো লাগছে। সবকিছু।
আমি ওড়নাটা মাথা থেকে নামিয়ে নিয়ে জলদিই পাড়ে উঠে এলাম।
আমি উঠে আসতে আসতে শাওন গম্ভীর মুখ করে বলল, Don’t get me wrong. I didn’t come for…
ওনার কথা শেষ হবার আগেই আমি ওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিলাম। আর বললাম, “হ্যা জানি, আপনি আমার জন্য আসেন নি। একদমই আমার জন্য আসেন নি।”
শাওন স্তম্ভিত হয়ে গেল। আর আমি ওনাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে শুধু নিঃশব্দে হাসতেই লাগলাম। কারন আমি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া অংশটুকু খুঁজে পেয়ে গেছি।

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।