১৬ বছর বয়স | পর্ব – ১৬

আমি ভয়ে একটা ঢোক গিয়ে বললাম,”আপনাকে আপনার মায়ের দিব্যি একদম ফেলবেন না।”
শাওন ভ্রুকুচকে বলল,”what!”
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম, আমাকে নামান।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই সুইটি এসে কেবিনে ঢুকল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম সাথে শাওনও তাকালো।
আমাদের এভাবে দেখেই সুইটি প্রথমে শাওনের দিকে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে রেগে তাকিয়ে রইল।
এই অবস্থায় আমার মনে হয় কোল থেকে নেমে পরাই উচিত। না জানি সতিন টাও কিনা আমাকে টর্চার শুরু করে। কারন গ্রামে একবার দুই মহিলার সেই পরিমাণে চুল টানাটানি হয়েছিল। দুই মহিলার এই চুল টানাটানির কারন ছিল এক পুরুষ। যিনি কিনা ওদের মধ্যকার একজনের স্বামী। আর অন্য মেয়েটার প্রেমিক। মারামারিতে যদিও বউ টাই জিতেছিল। তবে সেই মহিলার এক পা ল্যাংরা হয়ে গিয়েছিল আর অন্য মেয়েটার এক চোখ কানা হয়ে গিয়েছিল। আমি বাবা ল্যাংরা হয়ে এক পা নিয়ে বাঁচতে পারব না!
আমি নামার জন্য চেষ্টা করলাম কিন্তু শাওন সুইটির দিকে গম্ভীরভাবে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে ধরেই রইল।
আমি মনে মনে বললাম, এখন! এটা আবার কেমন বিপদ! গরিলাটা কি ওই মেয়েকে দিয়ে আমাকে ল্যাংরা বানিয়ে ছাড়বে নাকি!
আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই শাওন সুইটিকে বলল,”নক করে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে বলেছিলাম।”
তাই আমার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। সুইটি রেগে অনেক জোরে দরজা অফ করে দিয়ে চলে গেল।
আমি সুইটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে শাওনের দিকে তাকিয়ে কাদো কাদো বললাম, এখন আমার কি হবে! আমার পা থাকবে ত!
শাওন ভ্রুকুচকে তাকিয়ে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। আমি রাগে গজগজ করে বললাম, একটু আগে নামাতে বলেছিলাম তখন নামান নি কেন?
শাওন কিছু না বলে নিজের চেয়ারের দিকে যেতে লাগল।
আমি বলে উঠলাম, কি করতে চাচ্ছেন আপনি এখন?
শাওন চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মানে?
ইচ্ছা করল বলি যে আপনার বাপের মাথা। মানে মানে মানে করতেই থাকে। আবার আমাকে বলে গাধা। নিজেই ত গাধা।
আমি বইটা নিয়ে চেয়ার টেনে কাচের দেয়ালের সামনে বসলাম। রাগ লাগছে অনেক। তাই বই খুলে পড়তে বসে গেলাম।
লাঞ্চের সময় সুমনা আসলো। আজও তিনজন একসাথে খেতে বসলাম। সুমনা খেতে খেতে শাওনকে বলল, আমরা এইবার কোথায় ভ্যাকেশনে গেলে ভাল হবে?!
শাওন শুধু তাকালো কিছু বলল না। সুমনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জানো আমরা প্রতি বছরে একটা গেট টুগেদার করি। আমাদের সব ভার্সিটির ফ্রেন্ডরা মিলে। অনেক মজা হয়। কুয়াকাটা গেছি গতবার। অনেক অনেক মজা হয়েছিল জানো মিলা। জ্বলজ্বল চোখে কথাগুলো বলছে সুমনা। আমি শুধু সুমনার কথা শুনছি।
“এবার সাজেক যাব সিওর” সুমনা চামচ রেখে হাতে তালি দিয়ে বলে উঠল। তারপর শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কি বলিস?
শাওন বলল, ভাল। খারাপ না।
“জলদি ই যাব। মজা হবে! মিলা তোমাকেও নিয়ে যাব।”
শাওন আমার দিকে তাকালো। আমি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে গেলাম। আসলে আমি সাজেক এর বিষয়ে ভ্রমনকাহিনী খবরের কাগজে এমনকি বইয়েও পড়েছি। এছাড়া আরো অনেক জায়গার বিষয়েও পড়েছি। সাজেক অনেক সুন্দর জায়গা জানি। তাও আমি কি বলব বুঝতে না পেরে সুমনার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলাম।
অফিস শেষে ফেরার পথে প্রতিদিনের মত আজও গাড়িতে বসে বন্ধ জালানা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি। আজ আকাশে চাঁদ মামাকে দেখা যাচ্ছে না। তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। খানিক বাদেই জ্যামে পরলাম। ঢাকাতে এই একটাই সমস্যা। জ্যাম আর জ্যাম। বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ আমার রাস্তার পাশের একটা জিনিসে নজর পড়ল। আমি ফট করে নিজের সীট বেল্ট খুলে সজোরে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির দরজাটা খুললাম। যাক কুমড়ো খেয়ে গায়ে জোর বেড়েছে। শাওন ওর পাশে থাকা কাচের জালানার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমাকে ফট করে গাড়ির দরজা খুলতে দেখে চমকে আমার দিকে তাকালো। তারপর ভ্রুকুচকে বলল, কি সমস্যা তোমার! কোথায় যাচ্ছ?
আমি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললাম, এখনি আসছি।
শাওন বলল, হেই! কোনো রকম স্ট্রিট ফুড খাওয়া চলবে না এখন।
শাওনের কথায় শেষ হবার আগেই আমি ফুটপাতের কাছে চলে এসেছি। শাওন রেগে তাকিয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামতেও পারছে না।
আমি গিয়েই আবার কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরে এলাম। সাথে করে একটা ছোটো কুকুরের বাচ্চা নিয়ে আসলাম। বাচ্চাটা দেখতে সাদা তার উপর অনেক হালকা কমলা রঙ বয়ে গেছে। কমলাও না ঠিক, কেমন রঙ তা বর্ননার বাহিরে। কিন্তু অনেক সুন্দর। আমি গাড়িতে উঠে বসতে বসতে হাসিমুখে বললাম, সুন্দর না?
শাওন থমকে তাকিয়ে আছে। আমি কুকুরটাকে আদর করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। শাওন ভ্রুকুচকে বলল, রাস্তা থেকে এটাকে নিয়ে এসেছ, এটা কার না কার! জানো?
আমি বললাম, যার ই হোক এখন আমার। তার চেয়ে বড় কথা হলো রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা৷ কারো হবে বলে মনে হয় না।
আমি আমার মুখে একটা উজ্জ্বল হাসি নিয়ে পাপ্পিটাকে আদর করতে লাগলাম। পাপ্পিটাও আমাকে পেয়ে অনেক খুশি। শাওন একবার আমার আর একবার পাপ্পিটার দিকে তাকিয়ে বলল, এটাকে আমি আমার সাথে রাখব না।
আমি শাওনের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে উঠলাম, এটা এমনিও আপনার সাথে থাকবে না। এটা আমার সাথে থাকবে।
শাওন রেগে বলে উঠল, আমার বাসা আমি বুঝব।
আমি কুকুরটার দিকেই মনোযোগ দিয়ে বললাম, পিশামনি বলেছে বাসা অর্ধেক আমার অর্ধেক আপনার।
তারপর শাওনের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার এই নিরীহ প্রানীটাকে নিয়ে সমস্যা টা কোথায়?
“আমার পছন্দ না এসব। সো আমি যা বলেছি সেটাই তুমি শুনবে।”
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বললাম, ভালো কোন জিনিস টা আপনার পছন্দ? তার চেয়ে বড় কথা আমার ভালো লাগা কোন জিনিসটা আপনার পছন্দ?!
শাওন ভ্রুকুচকে বলল, তোমার ফালতু পছন্দের সাথে আমার টার মিল থাকবেও না।
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে বললাম, নিন চলুন সামনের গাড়িগুলো ত যাচ্ছে চলে।
শাওন আরো কিছু ত বলতে চাচ্ছিল কিন্তু পিছনের গাড়িগুলো হর্ন বাজাচ্ছে। তাই রেগে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমেই শাওন বলল, আমি এটা আমার বাসাতে রাখব না। সো এটা বাহিরে ফেলে তারপর আসবা।
আমি কুকুরের বাচ্চাটাকে কোলের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললাম, মোটেও এটাকে আমি ফেলব না।
শাওন রেগে এক পা এগিয়ে আসতেই আমি জলদি হেটে চলে আসলাম। শাওনের কুকুরের বাচ্চাটাকে পছন্দ হচ্ছেনা কেন আমি বুঝতে পারছি না।
লিফটে উঠে আমার দিকে রেগে তাকালো। আমি বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে কুকুরের বাচ্চাটার দিকে মনোযোগ দিলাম।
যাক অনেক কষ্টে ঘর পর্যন্ত আনতে পারলাম। এনেই ওকে আমার সোফায় বসিয়ে দিলাম। শাওন বিরক্তির সাথে নিজের রুমে চলে গেল। এই ছোট্টো পাপ্পিটার একটা নাম ত দেওয়াই দরকার! কি নাম দেওয়া যায়?
এটা ছেলে নাকি মেয়ে তাও ত জানিনা। আপাতত ওর নাম স্নোবেল রাখি। হ্যা এটাই সুন্দর নাম। আমি ওর এক পা ধরে নাড়িয়ে বলে উঠলাম, তোর নাম স্নোবেল। বুঝলি? এই নামে ডাকলেই যে প্রান্তে থাকিস চলে আসবি।
স্নোবেল আমার হাত চাটতে লাগল। আমি খুশি হয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। শাওন ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে কিচেনের দিকে গেল। মনে হয় ডিনার রেডি করবে। আমি স্নোবেল কে নিয়ে ফ্রেস হতে চলে গেলাম। আমি ওকে বাথরুমের সামনে রেখে ফ্রেস হতে ঢুকলাম। স্নোবেল দরজার কাছে বসে লেজ নাড়তে লাগল। আমি বের হবার সাথে সাথে আমার কাছে দৌড়ে এলো। যাক এখন এই বাড়িতে আমার আর একা একা লাগবে না! এখন কেউ ত আছে আমার নিজের।
শাওন ডাইনিং এ খাবার রেডি করে বসে পড়ল। আমি ডাইনিং এ এসে বসেতে বসতে চিন্তা করতে লাগলাম যে স্নোবেল কে কিসে খেতে দেব। ভেবেই কিচেনের দিকে গেলাম। স্নোবেলও পিছন পিছন রওনা দিল। শাওন অতন্ত্য বিরক্তির সাথে কুকুরটার কার্যক্রম দেখছে। এমন মনে হচ্ছে যেন কুকুরটা ডেলি মেনুতে শাওনের কলিজা খেতে চেয়েছে।
আমি একটা বাটি নিয়ে ডাইনিং এ এলাম। শাওন ভ্রুকুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কিসের জন্য!
আমি বললাম, স্নোবেল খাবে এটাতে। বলেই আমার প্লেট থেকে ভাত নিয়ে মাছের ঝোল আর মাছ দিয়ে ভাত মাখতে লাগলাম।
“তোমাকে না বলেছি এটাকে বাহিরে ফেলতে।” শাওন বলে উঠল।
আমি বললাম, পারব না। এটা আমার সাথেই থাকবে।
স্নোবেল লেজ নাড়িয়েই যাচ্ছে। শাওন তুলনামূলক ভাবে একটু জোরে বলে উঠল, এটাকে বের করো না হলে আমি তোমাকে সহ ওকে বের করে দেব।
সাথে সাথে স্নোবেল শাওনের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করা শুরু করে দিল। শাওন রাগ মিশ্রিত চোখে স্নোবেলের দিকে তাকালো।
আর আমি হাস্য উজ্জ্বল অবাক চোখে স্নোবেলের দিকে তাকালাম।
যাক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ত হয়নি কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে এটাই যে আগে শাওন আমার উপর চিল্লাত আমি তার উপর চিল্লাতাম। কিন্তু এখন শাওন আমার উপর চিল্লালে আমি সহ স্নোবেলও এখন চিল্লায়। তাছাড়া আরেকটা বিষয় হলো শাওন আমার দিকে রেগে তাকালে আমি না হয় চুপ হয়ে যাই কিন্তু স্নোবেল উলটা দ্বিগুল চিল্লায় মানে ঘেউ ঘেউ করে। বাহ! কি জোস একটা জিনিস বাসায় এনেছি! ভেবেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে।
রাতে ঘুমানোর সময় টি-টেবিলটা টেনে নিয়ে স্নোবেলকে সেখানে ঘুমাতে দিলাম।
পরের দিন সকালে আর শাওনের সাথে অফিসে গেলাম না। যাবার আর প্রয়োজনও নেই। কারন আমি আমার সঙ্গী পেয়েই গিয়েছি। সকালে ব্রেকফাস্ট করার সময় একটু ঝামেলা হয়েছিল। স্নোবেলও কুমড়ো পছন্দ করেনা। উফ এই গরিলাটা সত্যিই একটা অসহ্য।
কষ্ট করে আমি ত খেলাম কিন্তু স্নোবেল খেল না। কি আর করার! পরে ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে দিলাম। শাওন তার মত অফিসে চলে গেল। সে যদিও এখনো বিরক্ত। তাতে আমার অবশ্য কিছু যায় আসে না।
আমি ত স্নোবেলকে নিয়ে সারাদিন মজাতেই কাটিয়ে দিলাম। স্নোবেল কে অনেক জিনিস শিখলাম। যেমন আমি আঙুল ঘুরালে, ও ঘুরবে। হাত দিয়ে ইশারা করলে কাছে আসবে। আর যে কোনো রুমে বসে হাতে তূরী বাজাতেই সাথে সাথে আমাকে খুঁজে আমার কাছে আসবে। এমন অনেক কিছু।
আর একটা খুশির বিষয় হচ্ছে পুরো বাসা হাতিয়ে শেষে শাওনের জিম করার রুমের ডাস্টবিনেই হলুদ ও নীল পাখি দুইটা পেলাম।
সন্ধ্যার দিকে টেলিফোন বেজে উঠল। আমি ফোন তুলে কানে দিলাম।
সুমনা ফোন করেছে।
– মিলা।
– হ্যা।
– আমি আসছি তোমাকে নিতে বুঝলে। জলদি রেডি হও।
আমি বুঝতে না পেরে বললাম, মানে?
সুমনা বলল, আরে বলেছিলাম না আমাদের কোম্পানির anniversary party?”
– ওওও। হ্যা।
– এজন্যই আমি তোমাকে নিয়ে একবারে পার্টিতে ঢুকব। শাওন বিজি আজ অনেক।
আমি বিব্রত বোধ করে বললাম, আমার যাওয়া কি ঠিক হবে?
সুমনা বলল, কেন ঠিক হবে না! নিজের ওয়াইফ দের সবাই ই আনতে পারবে। তারচেয়ে বড় কথা এই পুরো কোম্পানিই চালায় শাওন, তোমার হাসবেন্ড। তুমি যাবা না ত কে যাবে?
আমি মনে মনে বললাম, হাসবেন্ড না ফাসবেন্ড সেটা ত আমিও বুঝিনা।
“কি হলো চুপ কেন?” সুমনা বলল।
– আচ্ছা আমি রেডি হচ্ছি।
কলিং বেল বাজতেই আমি এসে দরজা খুলে দিলাম। সুমনা এসেছে। সুমনাকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। ও আজ কালো একটা সুন্দর ড্রেস পরেছে। যেটার হাতার দুই পাশে গোল করে ছেড়া টাইপ ডিজাইন। সুমনা আমাকে দেখে বলল, এমা!রেডি হতে বলেছিলাম না?
আমি নিজের দিকে তাকিয়ে বললাম, রেডি ই ত।
আমার পরনের হালকা গোলাপি শাড়ির দিকে তাকিয়ে সুমনা বলল, তোমার কাছে হট কিছু নেই?
আমি না বুঝতে পেরে বললাম, হট কিছু মানে?
সুমনা মুখটা একটু বাকিয়ে কি যেন চিন্তা করতে লাগল। তারপর বলল, চলো আগে দেখি তোমার কাছে আছে টা কি!
ঘরে ঢুকে স্নোবেলকে দেখে সুমনা অবাক হয়ে গেল। আর প্রশ্ন করল, এটা কার?
আমি হাসি মুখে বলেলাম, আমার। কাল পেয়েছি।
সুমনা চোখ কপালে তুলে বলল, শাওন রাখতে দিয়েছে? ও ত কোনো কিছু পোষা পছন্দই করেনা। আমার বাসার বিড়ালটাকেও পছন্দ করে না।
আমি বললাম, মোটামুটি যুদ্ধ করে রেখেছি।
সুমনা বলল, যাক ভাল। চলো, তোমার জামাকাপড় কই দেখি।
আমি ল্যাগেজ বের করলাম। সুমনা আমার জামাকাপড় ল্যাগেজে দেখে প্রশ্ন করে উঠল, তুমি এখনো ল্যাগেজেই সব রাখো?
আমার উওরের অপেক্ষা না করেই ল্যাগেজ থেকে শাড়ি বের করে করে দেখতে লাগল সুমনা।
“সেই পিংক জামাটা কোথায়?” সুমনা প্রশ্ন করল।
আমি বলে উঠলাম, ওটা আমি পরব না।
সুমনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আগে জানলে আমি নিজই নিয়ে আসতাম জোস জোস ড্রেস। But It’s my bad. যাই হোক এই লাল শাড়িটা পরো আর সাথে এই লাল ব্লাউজ। নেও।”
বলেই সুমনা আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
আমি বললাম, কেন! এই পিংক টাতে কি সমস্যা?
সুমনা আমাকে বলল,সেটা তুমি বুঝবে না জলদি করে যাও বাথরুমে আর চেঞ্জ করে আসো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি শাড়ি পরে বের হলাম। তারপর সুমনা আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে দিল। ওর হাত ব্যাগে থাকা কি কি সব দিয়ে আমাকে সাজিয়ে দিল। শেষে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়ে আমাকে আয়নার সামনে এনে দাড় করিয়ে দিয়ে বলল, Here you go! কেমন?
আমি নিজেই নিজেকে দেখে অবাক।
সুমনা বলল, এটাকে বলে হট। আর তুমি ত এমনিতেই বিউটিফুল।
আমি সুমনার দিকে তাকিয়ে বললাম, কেমন কেমন যেন লাগছে!
সুমনা চোখ বড়সড় করে বলল, কি! পছন্দ হয়নি?
আমি সাথে সাথে বলে উঠলাম, না না। পছন্দ অবশ্যই হয়েছে। আসলে আমি এভাবে কোনদিন সাজিনি।
সুমনা হেসে বলল, “কিন্তু এখন সাজেছ। তাই চুপ চাপ কোনো কথা না বলে চলো। সময় হয়ে যাচ্ছে।”
আমরা রওনা হলাম। সুমনা একটা বড় হোটেলে এসে গাড়ি পার্ক করল। আমরা নেমে হোটেলে ঢুকলাম। বিশাল হোটেল। এটার আট নাম্বার ফ্লোরে পার্টি। অনেক বিশাল একটা হল রুম। রুমের মধ্যে লাল নীল সবুজ এমন আলো। বেশি কেউ এখনো আসেনি। সুমনা বলল, “আমরা জলদিই আসতে পেরেছি। এখনো আধা ঘন্টার বেশি সময় আছে।”
তখনি সুমনার ফোন বেজে উঠল। সুমনা বলল, শাওন ফোন করেছে। মেবি চলে এসেছে।
সুমনা ফোন তুলে বলল, হ্যা এসেছিস? ওকে। আমরাও চলে এসেছি।
সুমনা ফোন রেখে বলল, তুমি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকো। আমি ড্রিংকস নিয়ে আসি।
আমি শুধু মাথা নাড়লাম।
এই চক্করমক্কর লাইট আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমি এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম। এখন অনেকেই এসে পরছে। সুমনা আমাকে এত গুলো অচেনা মানুষের মধ্যে রেখে কই যে গেল।
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে সুমনাকে খুঁজতে লাগলাম। কোথায় গেল কে জানে! আমি হেটে এক পাশে সরে এলাম। কারন অনেকেই আমার দিকে তাকাচ্ছে। নিজেকে এলিয়েন মনে হচ্ছে।
হঠাৎ মনে হল সামনের ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। আমি একটু থমকে গেলাম।
ছেলেটা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কিছু একটু চিন্তা করেই ভ্রুকুচকে বলে উঠল, তুমি শাওনের ওয়াইফ?
আমি কি বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। ছেলেটা আবার বলে উঠল,”Yeah, I am right. তুমিই।”
তারপর একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, age কত তোমার? দেখে ত অনেক কম মনে হয়।
আমি কোনো উওর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইতেই ছেলেটা এসে আবার আমার সামনে দাঁড়িয়ে পরল। আমি হকচকিয়ে গেলাম। ছেলেটা আবার সেই হাসি দিয়ে বলল, আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। আমিও একটু দেখি শাওন শেষ পর্যন্ত সুইটিকে রেখে কাকে বিয়ে করে নিল। বাট দেখতে কিন্তু মন্দ না।
সুইটি নাম শুনেই আমি চমকে উঠলাম। এখন এই ছেলে আবার কে!
ছেলেটা বলে যেতে লাগল, আরে ভয় পেও না। আমি তোমাকে খেয়ে ফেলব না। কথা হচ্ছে তুমি এখানে একা কেন? শাওন কোথায়?
আমার বিরক্ত লাগছে এখন। কি গায়ে পরা ছেলে রে বাবা! দেখছে কথা বলতে চাই না তাও জ্বালাচ্ছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে সুমনাকে খুঁজতে লাগলাম।
ছেলেটা আমাকে বলল, তোমার গালে কি হয়েছে!
আমি ভ্রুকুচকে ছেলেটার দিকে তাকালাম।
ছেলেটা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই আমি একটু পিছিয়ে গেলাম। তখনি শাওন এসে ছেলেটার হাত ধরে মুচড়ে দিল। আমি হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আশেপাশের কয়েকজন ও তাকালো।
ছেলেটা “What the…” বলেই শাওনকে দেখে চুপ হয়ে গেল।
শাওন ছেলেটার হাত ছিটকে ছেড়ে দিল। ছেলেটা অন্য হাত দিয়ে নিজের হাতটা চেপে ধরে রেগে বলল, What the hell are you doing?
শাওন একটা ব্যঙ্গ হাসি দিয়ে বলল, এটা আমার প্রশ্ন হওয়া উচিত যে what the hell were you doing?
এখনো চরিত্র ঠিক করতে পারোনি!
ছেলেটা রেগে কিছু বলতে গিয়েও আশেপাশে তাকিয়ে আর কিছু না বলেই চলে গেল।
শাওন এবার আমার দিকে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি গাধা? নিজেকে কিভাবে প্রটেক্ট করতে হয় জানোনা?
আমি ভ্রুকুচকে তাকিয়ে রইলাম।
“এমনি ত অতিরিক্ত কথা বলো জায়গা মত এসে মুখের কথা কই যায়?” শাওন বলল।
“কি! আমি অতিরিক্ত কথা বলি?” আমি বলে উঠলাম।
শাওন আর কিছু না বলে চলে যেতে লাগল। আমি হেটে এসে শাওনের গায়ের কোটের এক কোনা চেপে ধরলাম। শাওন দাঁড়িয়ে আমার দিকে ঘাড় ঘুরালো।
আমি ছেড়ে দিয়ে ভ্রুকুচকে বললাম, “আমিও যাব আপনার সাথে।”
তারপর শাওনের পিছু পিছু একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। টেবিলটায় ফল সাজানো। একটা ওয়েটার এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ড্রিংকস নেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। আমি খুশি মনে একটা গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে টেবিলে রাখতেই শাওন নিয়ে গেল সেটা। আমি চোখ মুখ কুচকে বললাম, কি করলেন এটা! নিজের টা নিজে নিতে পারেন না? আমার টা এদিক দিন। বলেই হাত বাড়াতেই শাওন ড্রিংকস টা অন্য হাতে নিয়ে নিল। আর কপাল কুচকে বলল, হ্যা, এগুলা খেয়ে পরে আমার মাথা খাও! সামনে ফল আছে ওগুলো খাও।
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি গ্লাসটা অন্য একটা ওয়েটারের হাতে ধরিয়ে দিলেন।
সুমনা ড্রিংকস আনতে গিয়ে কোথায় গুম হয়ে গেল কে জানে? ভাবতে ভাবতেই সুমনা এসে আমাদের টেবিলেই বসল।
আমি বলে উঠলাম, এত ক্ষন কোথায় ছিলে?
সুমনা বসতে বসতে বলল, আর বলো না এক ওয়েটারের সাথে ধাক্কা লেগে পুরো ড্রিংকস আমার গায়ে। এজন্য শাওনকে বললাম তোমার কাছে দাঁড়াতে।
আমি বললাম, ওওও।
আমি শাওনের দিকে তাকালাম। উনি টেবিলে এক হাত ভাজ করে রেখে কপাল ধরে আছেন।
সুমনা শাওনকে বলল, তোর কি বেশি মাথা ধরেছে? তাহলে বাসায় যা।
আমি সুমনার দিকে তাকিয়ে আবার শাওনের দিকে তাকালাম। ওনার মাথা ব্যাথা? অবশ্য সারাদিন কপাল আর ভ্রু কুচকে থাকলে ত হবেই।
শাওন ওভাবে কপালে হাত রেখেই বলল, আমি ঠিক আছি।
সুমনা আমাকে কানে কানে বলল, ড্রিংক করবা? অনেক মজা।
আমি কি বলব বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম।
সুমনা আমাকে বলল, কি হলো?
শাওন সুমনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,”ও কোনো রকম ড্রিংক করবে না।
সুমনা বিড়বিড় করে বলল, শুনে নিল কিভাবে?
আমি নিজেও হা হয়ে গেলাম। সুমনা বলল, তাইলে আর কি! এভাবে বসে থেকে ত লাভ নাই! আসো ঘুরে বেড়াই।
আমার যদিও ইচ্ছে নেই। কারন লোকজন কাউকেই চিনিনা তার উপর বখাটের শেষ নেই ঢাকাতে।
তাই কি বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় খুজতে লাগলাম। সামনে পরে থাকা ফলগুলো দেখে বলে উঠলাম, “আমি কমলালেবু খাব।”
তারপর সামনে থেকে কমলা লেবু নিয়ে খোসা ছাড়াতে লাগলাম।
সুমনা বলল, তাহলে থাকো আমি আসছি।
শাওন এখন টেবিলের উপর দুই হাত রেখে সামনে তাকিয়ে আছে।
আমি কয়েকটা কমলা খুলে নিয়ে ওনার সামনে ধরে বললাম, নিন।
শাওন আমার হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে তাকালো। আর বলল, No need.
আমি বললাম, নিন নিন। এটা কুমড়োর ছোট ভাই। একটু টক সহ মিষ্টি। মাথা ব্যাথাও ভালো হয়ে যাবে।
শাওন আমার দিকে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে শুধু “Shut…” কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই আমি কমলা লেবু খানিকটা শাওনের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, “হ্যা জানি Shut up.”
শাওন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি ততক্ষণে কমলা খেতে ব্যস্ত। খানিক বাদেই এক জন ইংলিশ এ বক বক শুরু করে দিল। আরকি এই কোম্পানির চৌদ্দ গুষ্টির কাহিনী বর্ননা করল যা বুঝলাম। বর্ননার শেষে হালকা মিউজিক ছেড়ে দিল। এমন বোরিং সেলিব্রেশন ত আমি বাপের জন্মে প্রথম দেখছি। অবশ্য কোম্পানির দায়িত্ব কার কাছে দেখতে হবে না! গরিলা একটা!
সবাই সবার মত ব্যস্ত। কিন্তু কয়েকটা মেয়ে বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। বুঝলাম না কেন! শাওনের মনে হয় মাথা ব্যাথা করছে তাই সে চুপচাপ চেয়ারে বসে টেবিলে হাত রেখে কপাল ধরে আছে। আমি কিছু বললে ত আবার ক্ষেপে যাবে। তাই আমি আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছি কিন্তু মুখে কিছু বলছি না।
যে মেয়েগুলো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল তারা সুইটির কলিগ আর ফ্রেন্ড ছিল। ফ্রেন্ডদের মধ্যে দুই একজন এমন থাকে যারা সর্বদা খোটা মেরে কথা বলতে ভালোবাসে। তেমন ই একজন হলো লিলি। সে সুইটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল, শাওনের সাথে ওই মেয়েটা কে রে?
লিলি খুব ভালো করেই সব জানে। তাও এই প্রশ্ন করল। সুইটি মুখে একটা হাসি দিয়ে বলল, মানে?
লিলি মুচকি হেসে বলল, না আর কি দেখছি মেয়েটাকে। সত্যিই মেয়েটা অনেক সুন্দর। তোর জায়গা নিয়ে নিয়েছে মনে হয়।
টিটকারি মারার জন্য যে এই কথা গুলো লিলি বলছে তা সুইটি বুঝল। মুখের হাসি উবে গেল সুইটির। রীতিমতো রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ওর।
লিলি বলল, যাক, নেভার মাইন্ড।
একটু পরেই ডিনার নিয়ে সবাই বসল। তখন সুমনা এসে বসতে বসতে বলল, তুমি ত সারাক্ষণ বসেই রইলে।
আমি নিঃশব্দে হাসলাম। ডিনার করার টাইমে শাওনের ফোন বাজল। শাওন ফোন বের করে দেখে পুরো বন্ধ করে রেখে দিল। সুমনা বিষয় টা বুঝে কিছু বলল না। আমি শুধু আড়চোখে তাকালাম।
ডিনার শেষে সবাই যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়েকজন এখন আবার একটু ড্রিংক করছে। আমি আর সুমনা ওয়াসরুমে গেলাম।
ওয়াসরুম থেকে আমি আগেই বেরিয়ে এলাম। আমাদের টেবিলের একটু দূরে দাড়িয়ে পরলাম। কারন সুইটি শাওনের সাথে কথা বলছে। আমি শাওনের সোজা পিছনে একটু দূরে দাঁড়ানো। সুইটির থেকে কিছু দূরে সেই মেয়েগুলো দাড়িয়ে কাহিনী দেখছে। আমি কি হচ্ছে বুঝতে পারলাম না।
আমি এসে শুধু এটুকুই শুনলাম শাওন সুইটিকে বলল, Get the hell out of my sight and never show up again.
আমি চোখ বড়সড় করে চিন্তা করলাম আমার জন্য বেধে গেল নাকি! এখন কি করব! আমার পা থাকবে ত?
হঠাৎ সুইটি টেবিলে রাখা এক গ্লাস পানি নিয়ে শাওনের মুখে মারল। সুমনা সেই মূহুর্তে আমার পিছনে এসে দাড়িয়ে হা করে থেকে গেল। আর আমি অবাক হয়ে ভ্রুকুচকে তাকালাম। আশেপাশে যারা যারা ছিল সবাই হা হয়ে গেল। ওইপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোর কয়েকজন মুখ ঢেকে হাসছে আর কয়েকজন হা করে তাকিয়ে আছে। শাওন মুখটা হালকা ঘুড়িয়ে নিয়েছিল। পরে আস্তে করে সুইটির দিকে ফিরল। অবশ্যই রেগে গেছে উনি আমি জানি। আমিও ত একদিন মেরেছিলাম। কিন্তু এভাবে ওনার অপমান করা সুইটির ঠিক হচ্ছেনা। তাই আমি এগিয়ে গিয়ে অন্য এক টেবিল থেকে একটা মদের গ্লাস তুলে নিয়ে শাওনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সুইটির মুখে মেরে দিলাম। সুইটি অনেক চমকে গেল আর পরোক্ষনেই রাগে জ্বলে আমার দিকে তাকালো। আশেপাশের মানুষদের এখন মুখের হা আরো বড় হয়ে গেল। লিলি ফিক করে নিঃশব্দে হাসল।
আমি আবেগে কাজটা করে ত ফেললাম। কিন্তু এখন চোখ এদিক ওদিক করে চিন্তা করতে লাগলাম, “এখন!”

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।