ফ্লোরেনসিয়া – ২৩

ফিটনগুলো বিপরীত দিকের রাস্তা ধরে কাস্ত্রোরুজের শেষ সীমানায় পৌঁছে যায়। জানালার পর্দা সরিয়ে রাস্তার দু’পাশে থাকা ঝোপঝাড়গুলোর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সিয়া। ততক্ষণে চারদিক ঝাপসা হতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে নেমে আসে অন্ধকার।

পাহাড়ি মেঠো পথ, অন্ধকার রাত। লন্ঠনের মৃদু আলোয় ছুটে চলে ঘোড়া। চারপাশের প্রকৃতি যেন সম্পূর্ণ ঝিমিয়ে পড়েছে হঠাৎ। অন্ধকার এতো গাঢ় হয়ে আসে যে, রাস্তার দু’পাশের কাঁটাগাছগুলোকে মনে হয় অসংখ্য, অশুভ প্রেতমূর্তির ছায়া। প্রতি পদে পদে ভয় আর বিপদ। দেখতে দেখতে ঘোড়াগুলো কাস্ত্রোরুজের সীমানা পেরিয়ে যায়। সিটের পেছনে গা এলিয়ে দিয়ে দু’চোখের পাতা বুঁজে নেয় সিয়া। ক্রিসক্রিংগলের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ইনায়া। সিয়া একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয়।

আমি ফ্লোরেনসিয়া,
জন্মেছিলাম এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। আমার আশৈশব কেটেছে কাস্ত্রোরুজের শান্তিপূর্ণ মনোরম পরিবেশে। গ্রামের মানুষগুলো খুব সহজ-সরল আর মিশুক প্রকৃতির ছিলো। কখনো নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা, কলহ বা হাঙ্গামায় জড়াতো না। দাদু উইজার্ড ডিয়েটস সবসময় কাস্ত্রোরুজের অধিবাসীদের সুরক্ষা নিয়ে ভাবতেন। সবগুলো মানুষের বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। গ্রামের মাথাল ব্যক্তি ছিলেন আমার বাবা। যিনি কিনা বিখ্যাত জাদুকর ফিদেল আলেকজান্দ্রো কাস্ত্রোরুজের শেষ বংশধর। আমাদের পূর্বপুরুষের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো কাস্ত্রোরুজ থর্প। সবাই কত মান্য করতো আমাদের। যেন মাথায় তুলে রাখতো সবসময়ই। আমার জীবন ছিলো নির্দিষ্ট একটা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ সময় বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতাম। মাঝে মাঝে এমিল পাহাড়ি জঙ্গলে শিকারে নিয়ে যেত।

আমি ছিলাম ঘুম কাতুরে অলস প্রকৃতির মেয়ে। আমার কামরায় ছিলো আমার স্বর্গ। ঘৌড়দৌড়, পাহাড়ে চড়া, তীর আর অসিচালনা, মার্শাল আর্ট এসব আমাকে বাধ্য হয়ে শিখতে হয়েছিলো। তবে নদীতে সাঁতার কাটতে আর কিচের সাথে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগতো। বাবা আর দাদু বলতেন, তোমাকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে। আমি বিরক্ত কন্ঠে প্রতিবাদ জানাতাম। বলতাম, ওসব আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু ইনায়া পারবে। ও সর্বগুনে গুণান্বিত মেয়ে। তখনো আমি এই পৃথিবীর নির্মম, নিষ্ঠুরতা বুঝিনি। কখনো ভাবিনি আমাদের এই সহজ সুন্দর জীবনেও শত্রুদের আগমন ঘটতে পারে। আমি কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি, বিপদ যেকোনো সময় যেকোন দিক থেকে ঘনিয়ে আসতে পারে। আমি জানতাম না, এই পৃথিবীর মানুষগুলো খুবই স্বার্থপর প্রকৃতির হয়। সুসময়ে পাশে থাকলেও, দুঃসময়ে কেউ কারো নয়। আমার অলসতা আর খামখেয়ালিপনায় একদিন বাবা বলেছিলেন, “আগুনে না পুড়লে আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা তুমি বুঝতে পারবে না” তার কথা সত্য। আমি পুড়ছি। ভয়াল অনল দহনে জ্বলছি। বুঝতে পারছি আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ। এই নির্মল বাতাস আমার কাছে তীব্র বিষাক্ত মনে হচ্ছে। বুকের গভীরে অথৈয় শূন্যতা অনুভব করছি। কেউ কি বাইরে থেকে বুঝতে পারছে আমার অভ্যন্তরে অনুভূত হওয়া সব অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি?

আমি ফ্লোরেনসিয়া।
নিজের সমস্ত সুখময় স্মৃতি, স্বর্গীয় বাড়ি, নিজের গ্রাম আর প্রানপ্রিয় মা-দাদিনের সমাধি রেখে অজানা শহরের উদ্দেশ্যে ছুটে যাচ্ছি। একটা নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গায়। পুনরায় প্রিয়জন হারানোর ভয় থেকে বাধ্য হয়ে পালিয়ে যাচ্ছি। যদি ঈশ্বর চান, আমি ফিরে আসবো। নিজের প্রতীজ্ঞা রক্ষা করে বিজয়ী হয়ে পুনরায় ফিরে আসবো এই কাস্ত্রোরুজ থর্পে।

প্রথমে সিয়াদের ফিটন। মাঝখানের ফিটনটা আর্নিদের। পেছনেরটায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। হঠাৎই সিয়াদের ফিটন’টা থেমে গেল। সাথে পিছনের দু’টোও। ঘুম ভেঙ্গে গেল ইনায়ার। সিয়া চোখ মেলে তাকাল। সজাগ হয়ে উঠল ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।উৎকর্ণ কানে কিছু বোঝার চেষ্টা করল। সামনে থেকে কোচওয়ানের কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

– জনাব ক্রিসক্রিংগল। এখানে দু’টো রাস্তা। কোনদিকের রাস্তা ধরে শহরের দিকে যাবো?

– যেদিকের রাস্তা দিয়ে গেলে কম সময় লাগবে, সেইদিকের রাস্তা ধরে যান।____উত্তর দেন ক্রিসক্রিংগল।

সিয়ার পরনে ছিল কাঁধখোলা হালকা নীল রঙের গাউন। পিঠের পেছনে অবিনস্ত চুলগুলো উড়তে শুরু করল। সিয়ার অজান্তেই ওর কাঁধের উপরের ক্রুশ চিহ্নটা একবার জ্বলজ্বল করে উঠে নিভে গেল। ক্রিসক্রিংগল স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকালেন। যা দেখলেন তা কি সত্যি? নাকি তার চোখের ভ্রম? ডানদিকের রাস্তা থেকে শোনা যাচ্ছিল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। অথচ বামদিকের রাস্তাটা ভীষণ নিঃস্তব্ধ। সিয়া কোচওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– আপনি বামদিকের রাস্তা ধরে চলুন। সময় নষ্ট করবেন না। শীঘ্রই ঘোড়া ছুটান।

কোচওয়ান সশব্দে ঘোড়ার পিঠে চাবুক আঘাত করল। দ্রুতবেগে ছুটে চলল ফিটন। পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা সমতল ভূমিতে গিয়ে পৌঁছাল। তারপর জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দু’পাশে দানবাকৃতির গাছপালা। ফিটনের মধ্যে বিরাজিত কঠিন নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে প্রশ্ন করে উঠলেন ক্রিসক্রিংগল,

– ফিটন বামদিকের রাস্তায় ঘুরিয়ে নিতে বললে কেনো?

– সঠিক জানিনা। তবে মনে হলো ডানদিকের রাস্তাটা নিরাপদ নয়।____নিষ্প্রভ কন্ঠে প্রত্ত্যুতর দিলো সিয়া।

ক্রিসক্রিংগল আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। নির্জন, নিস্তব্ধ প্রকৃতির গহীন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে শুরু করল তিন তিনটে ফিটন। কি অদ্ভুত শুনশান নীরবতা! বুকের ভেতরটাও যেন হিম হয়ে এলো সবার। প্রত্যেকেই মনে মনে পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করছিলো। ইনায়া কিচকে সিয়ার কোলে দিয়ে পানির বোতল থেকে পানি পান করল। ভীষণ গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো ওর।

– বাবা আর কতদূর যেতে হবে?___ক্ষীনস্বরে জিজ্ঞেস করল আর্নি। ঘুমায়নি ও। ভয় পাচ্ছিল। এই গহীন জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ওকে আরও কাবু করে নিল। শুকনো একটা ঢোক গিলে বলল,

– ভীষণ ভয় করছে।

– ভয় পেয়ো না। এইতো আর কিছুক্ষণ। জঙ্গল পেরিয়ে গেলে লোকালয়ের দেখা মিলবে। তুমি বরং ঘুমানোর চেষ্টা করো।

মেয়েকে আশ্বস্ত করলেন স্ট্রিকল্যান্ড কুরী। ক্রিস্তিয়ান ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে জানতে চাইল,

– তোর কি ক্ষুধা লেগেছে? কিছু খাবি?

দু’দিকে মাথা নেড়ে না বোঝাল আর্নি। অতঃপর আলগোছে নিজের মাথাটা এলিয়ে দিলো স্ট্রিকল্যান্ডের কাঁধে। মায়ের কথা স্মরণ করে চোখ থেকে ঝরঝরিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলেন না স্ট্রিকল্যান্ড কুরী। ক্রিস্তিয়ান সন্তর্পণে নিজের দু’চোখের অশ্রু মুছে নিলো।

খারকিভ শহর থেকে কাস্ত্রোরুজ থর্পের দূরত্ব প্রায় দু’শো মাইল। যদি বিরতিহীনভাবে ফিটন ছুটে চলে তবুও বেশ কয়েক ঘন্টা সময় লাগবে খারকিভ শহরে পৌঁছাতে। ইম্যুভিল খারকিভের কাছে। গ্রামটা অসংখ্য পাহাড়-পর্বত আর জঙ্গলের পাশে। বছরের অধিকাংশ সময় ইম্যুভিলে শীতের প্রকোপ থাকে। ভূমিতে শক্ত বরফের গাঢ় আস্তরন আর আকাশ থেকে তুষার বৃষ্টি ঝড়ে।

_________★★_________

খারকিভ, ওয়াভেল কোট।

রাত আটটা। রাজসভায় পিনপতন নীরবতা। কারো নিঃস্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না। উপস্থিত সবাই নিশ্চুপ, নির্বাক। সুবিশাল কামরার চারকোণায় চারটে মশাল জ্বালানো ছিলো। রাজসিংহাসনে বুক টানটান করে সগর্বে বসে আছে এদুয়ার্দো। তার সামনে থাকা ভ্যাম্পায়ার সেনাগুলোর চোখে মুখে ভয়াল আতংক। সহসা হিংস্রাত্মক শীতল কন্ঠে গর্জে উঠে এদুয়ার্দো,

– শ্যারন কোথায়?

কিঞ্চিত কেঁপে উঠল সবাই। ভ্যাম্পায়ারদের মহারাজ বলেই কি তার কন্ঠস্বর এতোটা ভয়াবহ? এতোটা তেজ! তার করা প্রশ্নের কেউ কোনো উত্তর দিতে পারল না। একজন রক্তচোষাও জানে না শ্যারনের খোঁজ।

– সবগুলো অপদার্থ।

এদুয়ার্দো ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল। মাথা নত করে নিলো কামরায় উপস্থিত থাকা রক্তপিপাসুগুলো। এদুয়ার্দোর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। এমারেল্ড সবুজ চোখজোড়া রক্তবর্ণ হয়ে গেলো। লাল টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। এই বুঝি কারো রক্ত শুষে নিবে সে। এদুয়ার্দো ক্রুদ্ধ কন্ঠে ডাকল,

– অ্যাভোগ্রেডো।

অ্যাভোগ্রেডো দু’পা সামনে এগিয়ে গেল। মাথা নত করে দাঁড়াল। নিষ্পলক চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

– অনারেবল ওভারলর্ড। আদেশ করুন।

– শ্যারনকে খুঁজে বের করতে না পারলে তোমার গর্দান যাবে।

শুকনো একটা ঢোক গিলে নিল অ্যাভোগ্রেডো। ভীত ভীত কন্ঠস্বরে বলল,

– আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোথায়ও খুঁজে পাইনি।

– স্যামুয়েল নিভার্ড।

এদুয়ার্দোর ডাকে ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়ল স্যামুয়েল নিভার্ড। সদ্য নির্বাচিত সেনাধ্যক্ষ সে। এদুয়ার্দো থমাস কিম্বার্লির পদে নিযুক্ত করেছে তাকে।

– অনারেবল ওভারলর্ড। কোনো ভুল হয়েছে কি আমার দ্বারা?___কম্পিত কন্ঠে কথাটা বলল স্যামুয়েল নিভার্ড।

– আমার অধীনস্থ সেনাধ্যক্ষ আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার দুঃসাহস দেখায়। আমার দুর্গ থেকে একজন ভ্যাম্পায়ার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এই অপরাধগুলো ক্ষমার অযোগ্য। আপনারা সবাই কি আমার বিধ্বংসী রূপ দেখতে চান? নিমেষেই সবাইকে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। আপনাদের মতো কোনো সাধারণ ভ্যাম্পায়ার নই আমি। ভ্যাম্পায়ারদের ওভারলর্ড ক্লিভল্যান্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন। আমার অনুমতি ব্যতীত নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকার কারো নেই। কথাটা মনে রাখবেন।

হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়ল এদুয়ার্দো। সাথে সাথে বুকের কাছে একহাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নত করে নিল সবাই। দৃষ্টি তাদের মেঝের দিকে সীমাবদ্ধ। এদুয়ার্দো কঠিন কন্ঠে আদেশ করে বলল,

– কালকের মধ্যে শ্যারনকে আমার সামনে উপস্থিত দেখতে চাই।

এদুয়ার্দো থমথমে পায়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে গেল। স্যামুয়েল আঁড়চোখে দেখল। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

– ভয়াবহ হিংস্র সিংহ। তার দু’চোখের দৃষ্টি কতটা তীক্ষ্ণ। শুধু ওভারলর্ডই নন, প্রতিটা ভ্যাম্পায়ারের জন্য জলজ্যান্ত আতংক।

তার কথা শুনে হেসে ফেলল অ্যাভোগ্রেডো। স্যামুয়েলের পাশ ঘেষে দাঁড়ালো। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

– প্রসংশা করলেন? নাকি নিজের মধ্যে বিদ্যমান থাকা ভীতি প্রকাশ করলেন। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

থতমত খেলো স্যামুয়েল। আমতাআমতা করে বলল,

– দু’টোই।

– প্রতিটা শাসকের হৃদয়ে একটা হিংস্র সিংহ বাস করে।____অ্যাভোগ্রেডো সহাস্যে বলল।

– কিন্তু আমিতো জানতাম প্রতিটা শাসকের হৃদয়ে একজন সুন্দরী নারী বসবাস বসে। আপনি ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন। সবগুলো শাসক কোনো না কোনো নারীর প্রতি ভীষণ দুর্বল ছিলেন।

– এখানেই সাধারণ মানুষ আর ভ্যাম্পায়ারের মধ্যে পার্থক্য। বিশেষ করে আমাদের ওভারলর্ড। তার হৃদয়ে নারীর বসবাস অভাবনীয়। কল্পনাও করবেন না। ভুলে যান এসব।

– হুম।

আশাহত মুখাবয়বে সম্মতি জানাল স্যামুয়েল। অ্যাভোগ্রেডো হাসল। হেসে হেসেই কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সে। তার মতই একজন বিশ্বস্ত সেবক স্যামুয়েল। বয়স অল্প। অথচ সেনাদের নেতৃত্বদানে বেশ দক্ষ।

________★★_______

কাস্ত্রোরুজ থর্প।

রাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে সিয়াদের বাড়ি। একটা লন্ঠন পর্যন্ত জ্বালানো নেই কোথাও। বাড়ির পেছনে কতগুলো পায়ের শব্দ শোনা যায়। আলগা নরম মাটি দেখতে পেয়ে খুঁড়তে শুরু করে ওরা। কিন্তু কতগুলো প্রাণীর মৃতদেহ ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। অধৈর্য হয়ে উঠেন পিদর্কা স্যাভেরিন। কপট রাগমিশ্রিত কন্ঠস্বরে বলেন,

– ভালো করে খুঁজে দেখো। এখানেই থাকার কথা ছিলো।

তন্ন তন্ন করে বাকিরা সম্পূর্ণ জায়গাটুকু খুঁজতে আরম্ভ করে। ধূলোবালি আর নোংরা আবর্জনায় ওদের হাত পা, শরীর মাখামাখি হয়ে যায়। বিরক্ত হয় অ্যালিস। ভিক্টোরিয়া নাক কুঁচকে ফেলে বলে,

– মা, এখানে কিছুই নেই। অহেতুক পরিশ্রম করছি আমরা।

– চলো। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করি। ডিয়েটসের ছেলে নিশ্চয়ই জানে ওগুলো কোথায় আছে।

সদলবলে সিয়াদের বাড়িতে প্রবেশ করেন পিদর্কা স্যাভেরিন। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে উঠে প্রত্যেকের দু’চোখের মনি। ক্রোধিত চিত্তে বারান্দায় প্রবেশ করতেই বিস্মিত হন পিদর্কা স্যাভেরিন। সিঁড়ির সম্মুখে থাকা দরজায় লোহার তালা ঝুলছে। কারোর ক্ষমতা নেই যে সেই লোহার তালা স্পর্শ করবে।

– একজন তালা ভাঙ্গো। বাকিরা অন্যান্য কামরাগুলো খুঁজে দেখো।

আদেশ পেয়ে তালা ভাঙ্গার জন্য কিছু একটা খুঁজতে শুরু করে উড্রো উইলসন। ক্যারলোয়েন, ব্রাংকো আর স্যান্ড্রি অন্যান্য কামরাগুলো দেখে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। জ্যাসন মিকারলি ফিরে গেছে স্লোভাকিয়ায়। খুঁজতে খুঁজতে একটা কাঠের হাতলযুক্ত কুড়ুল দেখতে পায় উড্রো উইলসন। সেটা হাতে তুলে নিয়ে পরপর কয়েকবার সজোরে আঘাত করে তালাটার উপর।

একসময় ভেঙ্গে যায় তালা। কাঠের দরজা খুলে দোতলার দিকে ছুটে যায় তারা। কিন্তু হায়! নিরাশ হয় প্রত্যেকে। সবগুলো কামরা বাইরে থেকে আঁটকে রাখা আছে। সম্পূর্ণ বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো একজন মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়না। ক্রোধিত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠেন পিদর্কা স্যাভেরিন,

– ধোঁকা! আমাকে বোকা বানিয়েছে ডিয়েটস। তালা ঝুলানো দেখে আমার প্রথমেই বোঝা উচিত ছিলো এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে ওরা।

– এখন কি হবে মা?___শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ক্যারলোয়েন।

– খুঁজে বের করতে হবে ওদের। চলো সবাই।

পিদর্কা স্যাভেরিন ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে হাওয়াই মিলিয়ে যান। বাকিরাও তাকে অনুসরন করে সিয়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

________★★________

ওডেসা, দুভিল কোট।

দুর্গের বিশাল লনে জমেছে আড্ডার আসর। রঙ বেরঙের বাতিদানে চারপাশটা দিনের আলোর মতো ঝলমল করছে যেন। সবুজ ঘাসের উপর কার্পেট বিছানো ছিলো। তার উপর সামান্য উঁচু গোলাকৃতির কাঠ বসিয়ে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন খাবারের বহর। সবার মাঝে অন্য মনস্ক হয়ে বসে আছে আব্রাহাম। তার হালকা নীলাভ নেত্রগুলো ভীষন অস্থির। শিরশিরে বাতাসে মৃদুমন্দ দোল খাচ্ছিলো সামনের সোনালী চুলগুলো। আব্রাহাম নিজের শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া ভেজাতে ওয়ানের গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিলো। পাশ থেকে কথা বললো স্টুয়ার্ড,

– তোকে খুব উদাসীন মনে হচ্ছে। ঘটনা কি? কারো প্রেমে টেমে পড়ে যাসনি তো?

– জানিনা। কিন্তু খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমার দুষ্ট আত্মা আমাকে বলছে, ওকে তুলে নিয়ে এসো। আমি জানি, এটা অনুচিত। তবুও মন সায় দিচ্ছে তাতে।

– মানে? কি বললি? কিছুই বুঝতে পারলাম না।

সম্বিত ফিরে পেলো আব্রাহাম। এতক্ষণ বেখেয়ালে কি বলছিলো বুঝতে পারল সে। কথা ঘুরিয়ে বলে,

– বসে থাক এখানেই। আমি ফিরে আসবো একটু পরে।

স্টুয়ার্ড বোকার মতো অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। আব্রাহামের রাগ হয়। ভীষণ রাগ হয়। কেনো এমন হচ্ছে তার সাথে? উত্তর খুঁজে পায়না সে। অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটে। হাটতে হাটতে পৌঁছে যায় কামরার কাছে। হঠাৎই ছুটে এসে কেউ জড়িয়ে ধরে তাকে।

আব্রাহাম চমকায়। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়, ইনায়া লেপ্টে আছে তার বুকে। কিন্তু সেই অদ্ভুত সুন্দর সুবাসটা খুঁজে পায়না। আব্রাহাম মেয়েটার দু’কাধে হাত রাখে। সরিয়ে দেয় নিজের কাছ থেকে। রাগমিশ্রিত কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে,

– অলিভার! দিন দিন তোমার স্পর্ধা বেড়ে যাচ্ছে। আমার অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয়বার আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখাবে না।

পামেলার দু’চোখ ছলছল করে উঠে। কান্নারা দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে আসে। ব্যথাতুর কন্ঠে বলে,

– এস্টীম রুলার। আমি কি অপরাধ করেছি? কেনো এভাবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন?

– আমি তোমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম কবে?

– ভুলে গেছেন সেই স্বর্গীয় দু’রাত্রির কথা? আমার মাঝে আপনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সৌভাগ্যবতী। আপনার সাথে থাকার সুযোগ পেয়েছি। দয়া করে আমাকে আমার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করবেন না।

পামেলার কাতর কন্ঠস্বর। আব্রাহাম শান্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,

– সেসময় দু’জনের সম্মতি ছিলো। এখন আমার সম্মতি নেই। আমার থেকে দূরে থাকো। নতুবা আমি বাধ্য হবো তোমাকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে।

চমকে যায় পামেলা। কতটা নিষ্ঠুর ছিলো কথাগুলো। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আব্রাহামের দিকে। আব্রাহাম ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সশব্দে দরজা খুলে নিজের কামরায় প্রবেশ করে।

______★★______

গভীর রাত। নিভৃত গহীন জঙ্গলের চারদিকে ঘোর অমানিশা। শুকনো পাতার মরমর শব্দ। অজানা ভয়ে দু’চোখের পল্লব এক করতে পারে না কেউ। ক্ষণকাল সময় গড়ায়।আচম্বিতে থেমে যায় সিয়াদের ফিটন। শোনা যায় ঘোড়া দু’টোর হ্রেষাধ্বনি।

– কোচওয়ান, ফিটন থামালে কেনো?___শঙ্কিত গলায় ডেকে উঠেন ক্রিসক্রিংগল।

– রাস্তার মাঝখানে প্রকান্ড একটা গাছের গুড়ি পড়ে আছে জনাব।

দুরু দুরু বুক কাঁপে ইনায়ার। শিরদাঁড়া বেয়ে অজানা ভয়ের শীতল স্রোত গড়িয়ে যায়। আতংকিত হন ক্রিসক্রিংগল। ঠান্ডা আবহাওয়াতেও কেমন দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করেন।

সিয়া নড়চড়ে বসল। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। ওর চোখে মুখে বিন্দুমাত্র ভয়ের ছিটেফোঁটা নেই। উৎকর্ণ কানে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুললো। ওর চোখ দু’টো ভয়াবহ নিষ্প্রাণ। ক্রিস্তিয়ান ফিটন থেকে নেমে দাঁড়াতে চাইলো।

– ফিটনের বাইরে বের হবেনা কেউ।___সতর্ক করে বললেন ক্রিসক্রিংগল। ক্রিস্তিয়ান বাধ্য ছেলের মতো নিশ্চুপ বসে রইল।

অন্ধকার রাতে গহীন জঙ্গলে যাত্রা করা কি এতোটাই সহজ?পদে পদে উৎ পেতে থাকে ভয়ংকর সব বিপদ। হিংস্র জানোয়ার আর জংলীদের ভয়। অধিকাংশ সময় ডাকাতের কবলে পড়তে হয়। রক্ত হিম হয়ে আসা নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে হঠাৎই শোনা যায় হুতুম পেঁচার ডাক। শুষ্ক মরুভূমির মতো গলা শুকিয়ে আসে সবার। সামনের কোচওয়ান ঠকঠকিয়ে কাঁপতে শুরু করে। নেমে দাঁড়ানোর সাহস পায়না সে।

ফিটন থেকে নেমে দাঁড়ান ক্রিসক্রিংগল। সিয়া তার একহাত শক্ত করে ধরে। চোখের ইশারায় বারণ করে তাকে। ক্রিসক্রিংগল ওকে আশ্বস্ত করলেন। সিয়ার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কোচওয়ানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

– চলুন গাছের গুড়িটা রাস্তার মাঝখান থেকে সরিয়ে দিই।

কোচওয়ান ভয় পায়। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে। কম্পিত পায়ে নেমে দাঁড়ায় আসন থেকে। আর্নি ঘুমিয়ে গেছে। ওকে আগলে ধরে বসে আছেন স্ট্রিকল্যান্ড কুরী। পেছনের ফিটন থেকে নেমে আসে ক্রিস্তিয়ান। নির্ভীক চিত্তে ক্রিসক্রিংগলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

– তুমি কেনো বাইরে বেরিয়ে এলে?__ক্রিসক্রিংগল শাসনের স্বরে বলেন।

– ক্ষমা করবেন মাস্টার। আমি কোনো অবলা নারী নই যে বিপদ বুঝে ফিটনে লুকিয়ে থাকবো।

ক্রিস্তিয়ানের দৃঢ় কন্ঠস্বর। ক্রিসক্রিংগল মনে মনে বেশ খুশি হলেন। কথা বাড়িয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করা যাবে না। দ্রুত সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। পেছনের কোচওয়ান দু’টো নিশ্চুপ বসে রইলো। মনে মনে বিপদ বুঝে পালিয়ে যাওয়ার মতলব আটলো। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ক্রিস্তিয়ান, ক্রিসক্রিংগল আর প্রথম কোচওয়ান পায়ে পায়ে এগিয়ে চললো গাছের গুঁড়িটার দিকে। অদ্ভুত রকম শব্দ করে উঠলো কিচ। হয়তো কোনো বিপদের আভাস পেয়েছে ও। ফিটনের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতে পারলো না সিয়া। মনে মনে বলল,

– আমাকে ক্ষমা করুন বাবা।

দু’পাশের লম্বা গাউন খামচে ধরে নেমে দাঁড়ালো ও। কিচকে আসনে বসিয়ে দিয়ে ইনায়াও নেমে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে পা ফেলে এগোতে লাগলো ওরা। ততক্ষণে বাকি তিনজন গাছের গুঁড়িটার কাছে পৌঁছে গেছে। কোচওয়ান আর ক্রিস্তিয়ান গুঁড়ি টার দু’পাশে ধরে। মাঝখানে ক্রিসক্রিংগল। মাত্রই গুঁড়িটাকে কিঞ্চিৎ উপরে তুলেছেন। এরই মাঝে অকস্মাৎ তীব্র বেগে একটা তীর ছুটে আসে। উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠে সিয়া,

– বাবা!

পিছন দিকে তাকালেন ক্রিসক্রিংগল। নিজের দিকে ছুটে আসা তীরটা একহাতে ধরে আছেন তিনি। গুড়িটাকে ছেড়ে দিয়ে তিনজনেই নিরাপদ দুরত্বে সরে দাঁড়ালেন। তাদের সামনে কিছুটা দূরে ধারালো অস্ত্র আর তীর ধনুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। যাদের আদি-অন্ত কুচকুচে কালো পোশাকে ঢাকা। শুধুমাত্র চোখ দু’টো খোলা। যেন শিকারী বাজের মতো হিংস্র ওদের দু’চোখের চাহনি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।