ভোর ছয়টায় ঘুম ভাঙল নিনির। চোখ ডলতে ডলতে পাশে ফিরে তাকালো সাথে সাথে কেঁপে উঠলো ভয়ে। এনোন নিজের মাথা তার পিঠে ঠেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকালো নিনি। উঠতে চেয়েও উঠতে পারছেনা। সেভাবে শুয়ে রইল নিনি। আস্তে আস্তে তার দিকে ফিরলো নিনি।
নিনি হালকা মাথা ঝুঁকিয়ে তার চেহারা দেখে নিল। গভীর ঘুমেই আছে। চোখ পাকিয়ে কিছুক্ষণ সেভাবে তাকিয়ে রইল নিনি। সুন্দর লাগছে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায়। নিনি ঠোঁট কামড়ে হাসলো তারপর পাশ থেকে মোবাইল হাতরিয়ে নিয়ে সেল্ফির মুড অন করলো। সুন্দর করে পোজ দিয়ে তাকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই ছবি তুলে নিল। ছবি তুলে ভালোভাবে দেখতে লাগল তারপর সেই আগের জায়গায় মোবাইল টা রেখে ফিরতেই চমকে উঠলো। এনোন ওর দিকে সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চোখ বড়বড় করলো নিনি কিছুক্ষণ আগেই বিড়ালের মত ঘুমাচ্ছিল সে। নিনি অবাক হয়ে বলল,,
“ঘুমান নি নাকি ঘুমের ভান ধরে ছিলেন?”
“মাছের মত লাফাতে থাকলে কার ঘুম টিকে থাকবে?” বিরক্ত হয়ে বলল এনোন। চুপ করে গেল নিনি অনেকক্ষণ যাবত সে এপাশ ওপাশ করছিল বলে এনোনের ঘুমের মার্ডার হয়ে গিয়েছিল। নিনি বেশি কথা না বলে এতটুকু বলল,,
“ঘুমান তাহলে।” বলে উঠতে নিলে হাত ধরে নিলো এনোন। বলল,,
“কোলবালিশ না থাকলে ঘুমাবো কেমনে!”
কপাল কুঁচকালো নিনি। কথাটি বুঝতে সময় নিল সে। সেকেন্ডের মধ্যে মাথায় আসলো উক্ত কথাটির অর্থ কি! হা হয়ে গেল নিনি তার দিকে তাকাতেই দেখে সে ঠোঁট কামড়ে হাসছে। এনোন তাকে আবারো জড়িয়ে ধরল পুরোপুরি। নিনি অভিমান নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,,
“আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি কেন আপনি আমাকে এভাবে অপমান করবেন?”
মাথা উঁচিয়ে তাকালো এনোন। কান্নার আভা ওর চোখে মুখে ঘাবড়িয়ে গেল এনোন। সামান্য কথা বললেই তার কান্না পেয়ে যায়। এনোন হয়রানির স্বরে বলল,,
“কি বউ পেয়েছিস তুই! সামান্য কথাই কান্নার রাজ্য নিয়ে আসে এই নারী, উফফ্ জীবন মনে হয় আমার তার কান্না সামলাতে সামলাতেই যাবে।”
চোখের পানি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। কিন্তু পাপড়ি গুলো ভেজা। নিনি বলল,,
“আপনি ঠাট্টা করছেন!?”
“মোটেও না আমি তোমার তারিফ করছি।”
অন্য পাশে ফিরে গেল নিনি তার চেহারা আপাতত দেখতে চাইছে না সে। এনোন তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গালে হাত রেখে বলল,,
“নিরামিষ ভালো লাগে না আমার।”
“আমি একদমও নিরামিষ না।”
“হুম তাই তো কথা কথাই চোখের পানি ভাসাতে থাকো।”
হঠাৎ করেই ফিক করে হেসে দিল নিনি। চোখের পানি মুছেই হাসলো এনোন কপাল কুঁচকালো। কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,
“আমি তোমার সাথে আমার প্রতিটা মুহূর্ত স্পেশাল করতে চাই।”
বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইল নিনি। কোন কিছু তাড়াতাড়ি বুঝতে সময় লাগে তার। এনোন বুঝলো যে সে কিছুই বুঝেনি। সে বাঁকা হেঁসে মুখ এগিয়ে আনল তার কানের কাছে। পরের কথাগুলো শুনে কান লাল হওয়া উপক্রম। নাক গাল লাল রক্তিম বর্ণ ছেয়ে গেছে। মানুষ কত বড় নির্লজ্জ হলে এমন কথা বলতে পারে। নিনি হুড়মুড় করে উঠে বসে আঁচল চেপে ধরে বলল,, ছিঃ, অসভ্য!”
______________
ডাক্তার সোহানা সাবার কেবিনে বসে আছে এনোন ও নিনি। তিনি দৃঢ় দৃষ্টিতে ফাইল দেখছেন। কিছুক্ষণ আগেই টেস্ট করানো হয়েছে নিনির। সোহানা সাবা ফাইল বন্ধ করে চোখ জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলেন,,
“নিজেদের ফিলিংস একটু কন্ট্রোল করুন, বাচ্চা গর্ভে বেড়ে উঠছে।”
শ্রবণ হতেই থতমত খেয়ে গেল দুজন। এক বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেল। এনোন এক নাগাড়ে তর্জনী দিয়ে কপাল ঘষে চলছে নিনি এক দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। তা খেয়াল করল সোহানা সাবা। তাদের স্বাভাবিক করতেই তিনি বলে উঠেন,,
“বেবি পুরোপুরি ঠিক আছে।”
দুজনেই তাকালো। তারপর ফাইল নিয়ে উঠে বেরিয়ে গেল।
এনোন ড্রাইভ করতে করতে ফাঁকে ফাঁকে তাকাচ্ছে নিনির দিকে। সে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না কাঁচের গ্লাসের মধ্য দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এনোন তাকে আরো বিব্রত অবস্থায় ফেলতে বলল,,
“জানো, তোমাকে দেখলে আমার ফিলিংস কন্ট্রোল হয় না।”
কর্ণকুহরে ঝংকার তুলে দিল কথাটি। শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যেতেই মৃদু কেঁপে উঠলো সে।
এক নাগাড়ে অনেকবার চোখের পলক ফেলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হালকা শাসনের সুরে বলল,,
“নির্লজ্জের মত কথা না বলে মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করুন।”
হালকা শব্দ তুলে হাসলো এনোন। বলল,,
“তোমাকেও আমার মত নির্লজ্জ বানিয়ে ছাড়বো, শুধু সময় আসুক!”
চোখ বড়বড় করে তাকালো নিনি। এনোন ঠোঁটের কোণা কামড়ে ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে। নিনি চোখ সরিয়ে বিড়বিড় করে মনে ইচ্ছামত শায়েস্তা করলো তাকে।
______________
এক ফালি রোদের অস্তিত্ব দেখা দিচ্ছে। হিম হাওয়ায় ভেসে চলছে অজস্র ফুলের মন মাতানো সুবাস। সোনালী রোদে নিমজ্জিত পুরো নগরী।
নতুন ঘরের নতুন ছাদে দাঁড়িয়ে মিষ্টি রোদ গায়ে মাখিয়ে নিচ্ছে নিনি। ঘরের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছে এনোন তিন দিন আগে। হঠাৎ করেই তার চোখ গেল দোলনার দিকে। সে একবার বলেছিল তার দোলনায় দুলতে ভালো লাগে তাই নতুন ঘরে দোলনা কিনে ছাদে লাগিয়েছে এনোন। গিয়ে বসলো নিনি আর আস্তে আস্তে দুলতে লাগলো। কিছু সময় যেতেই পেছন থেকে কানের পাশে চুলে ফুল গুঁজে দিল কেউ। চমকে উঠলো নিনি। পেছনে ফিরতেই দেখে এনোন তাকে আস্তে আস্তে করে ঝুলাচ্ছে মুখে এক চিলতে হাসি। সে ফুলে হাত দিতেই এনোন বলে উঠলো,,
“কাঠগোলাপ।”
মুখে হাসি ফুটে উঠল নিনির। এনোন বলল,,
“আমার কাঠগোলাপের সাদা মোহ তুমি!”
পাশে এসে বসল সে নিনির মুখে হাসি ফুটে উঠল। এনোন তার হাসি দেখে মনে মনে বলল,,
“আচ্ছা, তার এই হাসি এতো মোহনীয় কেন? এই হাসি দেখার জন্য আমি কেন প্রতিনিয়ত কাতরায়?”
বোধহয় ভালোবাসার মানুষটির সবকিছুই সুন্দর লাগে, মোহনীয় লাগে!”
এনোন পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার ছবি তুলে নিল। নিনি আরো হাসলো। নিনি চুল থেকে ফুলটি সরিয়ে হাতে নিয়ে বলল,,
“কাঠগোলাপ আমার পছন্দ।”
“আমার কাঠগোলাপ আমার পছন্দ।”
নিনি হাসি মাখা মুখ নিয়ে এক পলক তাকালো তারপর ফুলটি আঙুল দ্বারা ঘুড়াতে ঘুড়াতে বলল,,
“জানেন, আমার জীবন কতটা খারাপ কতটা দূদর্শ।”
বলে তার হাসি মুখখানা থেমে যায়। বিষাদে ভরে যায় মুখশ্রী। চোখ যেন ছলছলে ভরে গেল। এনোন তাকালো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে শুধু জানতে চাইছে তার কথাগুলো।
“আপনার কাছে বিক্রি করার আমাকে আরো তিনজনের কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিল আব্বা! আপনি কি ভেবেছিলেন আমি কখনো জানব না?
কিন্তু সব জানি সব যখন আপনি অর্সা মাসিকে অর্ধেকেই থামিয়ে দিয়েছিলেন।”
থমকালো এনোন। নিনি কিছুক্ষণ থেমে আরো বলল,,
“আমি আমার সেই জীবন কে একটা নাম দিয়েছি
“১৬ পৃষ্ঠা” যেটা শুধু জঘন্য ও কুৎসিত এ ভরা।”
বলে সে চোখের পানি ছেড়ে দিল। তাকে আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এনোন বলল,,
“সেই সময় কাল ঘনিয়ে এসেছে…আর তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, ১৬ পৃষ্ঠার দিন শেষ তোমার জীবনে এখন নতুন অধ্যায় শুরু হবে প্রেমের অধ্যায় যেখানে এই প্রেমিক পুরুষ তার কিছু জুড়িয়ে দিবে শুধু তার প্রেয়সীকে ভালোবাসতে।”
ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে নিনি। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। নাক টেনে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,,
“ভালোবাসেন যখন তো প্রকাশ করেন না কেন?”
“কারণ প্রকাশ্য ভালোবাসার মূল্য চেয়ে অপ্রকাশ্য ভালোবাসার মূল্য বেশি…তাই ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই!!”
(সমাপ্ত)