দু’জনে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল তাঁর ঠিকানা নেই। অভির চোখ খলে যখন কেউ ওর মাথার পেছনে সজোরে এক চাটি মারে। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে যে ইন্দ্রানি মাসি ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। পায়ের দিকে কিছু দুরেই মাটিতে পরে আছে সুব্রত।
ইন্দ্রানি মাসি ওদের দিকে রেগে বলে, “শূয়োর কোথাকার। তোদের কোন হুস জ্ঞান নেই? সবাই তোদের কে হন্যে হয়ে খুঁজছে আর তোরা এখানে পরে পরে ঘুমাচ্ছিস?”
অভি পা দিয়ে ঠ্যালা মেরে সুব্রত কে জাগিয়ে দেয়। সুব্রত মাথা চুলকাতে চুলকাতে চোখ খুলে দেখে যে ইন্দ্রানি মাসি ওর দিকে রেগে মেগে তাকিয়ে।
অভি, “সরি মাসি। মানে আমরা কাল রাতে একটু বেশি হয়ে গেছিল।”
চেয়ারে রাখা মদের বোতল আর গ্লাসের দিকে ইন্দ্রানি মাসির চোখ যায়। তাড়াতাড়ি গায়ের শালটা চেয়ারের ওপরে ফেলে দিয়ে ওগুলো ঢেকে দেয়। ওদিকে মন্ডপের দিকে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়, কেউ আসছ। ইন্দ্রানি মাসি জানিয়ে দেয়, “অভি আর সুব্রত সারা রাত প্যান্ডেলে রাত কাটিয়েছে।”
মা, দিদা, পরী, মৈথিলী সবাই প্যান্ডেলের দিকে দৌড়ে আসে। মা আর দিদা দু’জন কে বেশ ভাল বকুনি দেবার পরে চলে যায়। মৈথিলী সুব্রতকে টানতে টানতে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যায়।
পরী অভির কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “এই ঠাণ্ডার রাতে এখানে কি করছিলে তোমরা?”
সদ্যস্নাত পরীকে দেখতে ঠিক শিশিরে ভেজা জুঁই ফুলের মতন দেখাচ্ছে, সারা গা থেকে মন মাতান এক সুবাস বের হচ্ছে।
অভি, “না কিছু না, কাল রাতে একটু বেশি হয়ে গেছিল এই আর কি…”
আড় চোখে দেখল অভি, ইন্দ্রানি মাসি কাজের লোককে ডেকে বোতল আর গ্লাস পরিষ্কার করে নিতে বলল।
বাড়িতে ঢোকা মাত্রই যেন হাজার চোখ অভিকে খেয়ে ফেলার জন্য উদগ্রীব। বাবা আর সুমন্ত মামা যেন পারলে ওকে খেয়ে ফেলে।
পরী ওকে টানতে টানতে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। ঠেলে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াল। অভির এলোমেলো চুলে বিলি কাটতে থাকে পরী। ঘরের পর্দা যে দেওয়া নেই সেদিকে কারুর খেয়াল নেই। অভি ওর পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরে।
ক্ষমা চায় অভি, “সরি পরী। কাল রাতের জন্য ভেরি সরি।”
মমতা মাখান হাসি দিয়ে উত্তর দেয়, “ঠিক আছে, আমি ত কিছু বলিনি। ছেলেরা দুষ্টুমি করবে না ত কে করবে।”
অভি, “তুমি তাহলে আমার ওপরে রাগ করনি, আমার সুইট পরী।”
মায়ের দেওয়া হারটা অভির হাতে দিয় বলে, “এটা আমাকে পড়িয়ে দেবে কি?” এই বলে অভির দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড়ের ওপরে হাত খোঁপা টাকে আলতো করে ঘাড় থেকে সরিয়ে দিল অভি। মরালী গ্রিবার মতন ফর্সা ত্বক, অভির হাত কিঞ্চিত কেঁপে ওঠে। হার পরানোর আগে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় ওই ঘাড়ের ওপরে।
উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে ওঠে, “কি করছ? আবার দুষ্টুমি। কেউ এসে পরবে, এস টাকে ঠিক করে লক করে দাও।”
ঘাড়ের কাছে এস টাকে লক করে মসৃণ ত্বকের ওপরে হাত বুলিয়ে দিল অভি। বেড়াল ছানার মতন মিউ মিউ করে উঠল পরী। অভি আবার দু’হাতে ওকে জড়িয়ে ধরল।
জিজ্ঞেস করল, “রাতের বেলায় কি পড়ছ?”
মাথা নাড়াল পরী, “জানি না, তুমি বলে দাও কি পড়ব।”
অভি, “তুমি অনেক সুন্দরী, তুমি যা পরবে তাতেই তোমাকে সুন্দরী দেখাবে। তুমি যে আমার সত্যিকারের পরী।”
পরী ঠেলে অভিকে বাথরুমের দিকে ঢুকিয়ে দেয়, “যাও তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আস। তোমার গা থেকে বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে।”
ঠিক সেই সময়ে ইন্দ্রানি মাসি ঘরের মধ্যে ঢোকে। ইন্দ্রানি মাসিকে দেখে দু’জনে একটি তফাত দাঁড়ায়। ইন্দ্রানি মাসি পরীকে বলে যে অভির মা নাকি ওকে খুঁজছে। পরী ইন্দ্রানি মাসি কে জিজ্ঞেস করল যে কেন ওর ছোটো মা ওকে ডেকেছে। মাথা নাড়িয়ে ইন্দ্রানি মাসি জানাল যে কারন জানেন না। পরী কিছু পরে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। বেড়িয়ে যাবার আগে, ঘাড় ঘুরিয়ে অভির দিকে তাকাল। ডান হাতের তর্জনী টা ঠোঁটের কাছে এনে, আঙ্গুলের ডগায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে, একটা ছোট্ট চুমু ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল।
ইন্দ্রানি মাসি, “দিদি জামাই বাবু তোমার ড্রিঙ্কসের কথা জানে?”
অভি সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, “না গো জানে না।” তারপরে বলে, “সরি মাসি, তবে থ্যাঙ্কু ওই সময়ে যা করেছ।”
ইন্দ্রানি মাসি, “যাও বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নাও।”
তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে পড়ল অভি। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিতে হবে। আজ একটা মাত্র দিন, পরীকে কাছে পাওয়ার, আজ বিকেল বেলায় অভিকে কোলকাতা ফিরে যেতে হবে। কোনো রকমে স্নান সেরে নিচে নেমে দেখে যে মা অথবা পরী কেউই নেই। বাড়ির লোকজন কে জিজ্ঞেস করে মায়ের কথা, একজন উত্তর দিল জানেনা। বারান্দার দিকে হেঁটে গিয়ে দেখে যে দিদা ইন্দ্রানি মাসি কে আর মেঘনা কে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে। পাশে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে অভি।
ওদের কথা শেষ হয়ে যাবার পরে দিদাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। ওর মন বলছে, মা যেখানে থাকবে পরীও সেখানেই থাকবে। পরীও চাইছে ওর বেশির ভাগ সময় ওর ছোটো মার কাছে কাটুক।
দিদা অভি কে বলল, “তোর মা পরীকে জিজ্ঞেস করেছিল যে পরী বিকেল বেলায় কি জামা কাপড় পরবে। পরী জানায় যে হয়ত শাড়ি বা সালোয়ার। তোর মায়ের ঠিক পছন্দ হয়নি তাই তোর মা আর বাবা পরীকে নিয়ে বারাসাত গেছে সপিং করতে। ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটে বেজে যাবে।”
অভির খুব রাগ হল, পরী ওকে না জানিয়ে চলে গেল? একবার হাতের কাছে পেলে হয়।
দিদা অভি কে পাশে বসতে বলে ওর ছোটো বেলার কথা শুনাতে লাগল, “তুই ছোটো বেলায় খুব দুষ্টু ছিলিস। সারা বাড়ি হামাগুরি দিয়ে বেরাতিস আর পরীও তখন অনেক ছোটো, ও তোর পেছন পেছন ঘুরে বেড়াত। সুব্রত তোদের থেকে কিছু বড়, তোকে নিয়ে সুব্রত বাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে মাছ ধরত। তোরা দু’জনে ছোটো ছোটো ছিপে মাছ ধরতিস আর তারপরে সেই মাছ গুলো আবার পুকুরের জলে ছেড়ে দিতিস। চল আমার সাথে তোকে কিছু দেখানর আছে আমার।”
গল্পের মাঝে অভি লক্ষ করল যে একটা গড়ি এসে উঠানে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থেকে বেশ কিছু মহিলারা নামলেন। দিদা আর অভি ওদের কে লক্ষ না করে বাড়ির পেছন দিকে হাটা দিল। বহু বছর পরে অভি সেই বাল্যকালের খেলার জায়গায় ফিরে এসেছে। দু’পাসে আম কাঁঠালের বাগান, তার মাঝে পায়ে হাঁটার সরু রাস্তা এঁকে বেকে এগিয়ে চলেছে।
কিছু দূর যাবার পরে দিদা ওকে পুকুর দেখিয়ে বলে, “এই সেই পুকুর, তোর হয়ত কিছুই মনে নেই।”
মাথা নাড়ায় অভি, “না গো দিদা, আমার কিছুই মনে নেই।”
অভির হাত ধরে পুকুরের এক কোনায় নিয়ে যায়। একটা আমের গাছ দেখিয়ে অভিকে ছুঁতে বলে গাছের গুরি।
দিদা, “এই গাছটা দেখছিস। তুই তখন কথা বলতে শিখেছিস। একদিন সকাল বেলা আমি পুজো সেরে উঠেছি আর তুই দৌড়াতে দৌড়াতে আমার কাছে এসে আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসিস এখানে। গাছ দেখিয়ে বলিস যে তুই একটা আমের গাছ পুঁতেছিস।”
দিদা অভির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ছুঁয়ে দ্যাখ, কত বড় হয়ে গেছে তোর পোঁতা আম গাছ। আজও আমার বাগানের সেরা আম গাছ এটা।”
অশ্রু ভরা চোখে অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “আমারও বয়েস হয়েছে, তোর মায়েরও বয়স হয়েছে। তোর মা এতদিন কি করে এই সব বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিল জানিনা।”
পুকুর পাড়ে বসে পরে দিদা আর অভিকে পাশে বসতে বলে, “উলুপি আমাদের জন্য অনেক করেছে। আমরাই ওকে ভুল বুঝলাম রে।”
অভি দিদকে জড়িয়ে ধরে বলে, “দিদা, আবার কেন ওই সব কথা শুরু করছ?”
কান্না ভেজা চোখে দিদা বলল, “নাঃ রে। একটি মেয়ে, দুই মায়ের মাঝে, সময়ের ব্যাবধানে দূর হয়ে গেল।”
ঠিক সেই সময়ে ইন্দ্রানি মাসি এসে পড়ল। ওদের দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। দিদা ইন্দ্রানি মাসিকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে? উত্তর ইন্দ্রানি মাসি বলল যে মেয়ের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে আর দিদাকে খুঁজছে।
বাড়ি পৌঁছাতেই দিদাকে সব আত্মীয় সজ্জনেরা ঘিরে ধরল। অভি আবার সেই ভিড়ে একা হয়ে পড়ল।
নতুন মুখ
অভির খুব একা একা লাগছিল, থেকে থকে রাগ হচ্ছিল মায়ের ওপরে, কেন পরীকে নিয়ে শপিংএ চলে গেছে, কেন একবার ওকে জানাল না। শপিং ওর ভাল লাগে না, তবুও পরীর সঙ্গ ত পেত। ঠিক সেই সময়ে দুষ্টু ডাক দেয়, বলে যে সুব্রত ওকে ওর ঘরে ডাকছে।
ঘরে ঢুকে দেখে যে একটি নতুন মুখ। একটি তন্বী তরুণী মৈথিলীর পাশে বসে। সুব্রত ওকে দেখে কাছে ডেকে মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়েটি ওর খুড়তুত শালি, অরুণিমা। অরুণিমা দক্ষিণ কোলকাতায় থাকে, বি.এ ফার্স্ট ইয়ার পড়ছে। কথাবার্তা শুনে মনে হল যেন, অভির সাথে অরুনিমার পরিচয় কোন এক গুড় কারনে করতে চাইছে ওরা।
অরুনিমার দিকে তাকাল অভি, সবে মাত্র গোলাপের কুঁড়ি, বয়স আন্দাজ এই উনিশ কি কুড়ি, দেখতেও ভাল। ওর দিকে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকাল। অভি সুব্রতর কাঁধে হাত রেখে বলল, “মামা আমার এখন ঠিক ভাল লাগছে না, আমি একটু একা থাকতে চাই।”
মৈথিলীর দিকে তাকাল অভি, মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানাল। মৈথিলী ওর এই আচরনে হেসে ফেলল। অভি মজা করে বলল, “চুর্নি, তোমাকে দারুন দেখতে। তোমার সাথে আমার আগে দেখা হওয়ার দরকার ছিল।”
ওর কথা শুনে মৈথিলীর লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল, রেগে মেগে সুব্রতর দিকে তাকাল। চুর্নি নামে শুধু মাত্র সুব্রতই ওকে ডাকে। অভি সুব্রত কে আসস্থ করে বলল, “ভায়া তোমার বউয়ের দিকে আমি নজর দিচ্ছি না চিন্তা নেই।”
অভি ঘর থেকে বেড়িয়ে নিচে নেমে গেল। এক কাপ কফি নিয়ে আবার ছাদে উঠে গেল। খালি ছাদে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের দিকে চেয়ে থাকল অভি। এক কোনায় দাঁড়িয়ে দু’হাত ছড়িয়ে বুক ভরে গ্রামের শুদ্ধ বাতাস ভরে নিল বুকের ভেতরে।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকে ওর আর পরীর সম্পর্ক। পরী ওর কে হয়? মায়ের দুর সম্পর্কের বোন। হ্যাঁ, সত্যি, কিন্তু রক্তের ত কোন সম্পর্ক নেই, মায়ের নিজের বা কাছের বোনও নয়। মায়ের ছোটো দাদুর, ছোটো মেয়ের, ছোটো মেয়ে হচ্ছে পরী। কেনই বা ওদের প্রেম এই সমাজ বা ওর বাবা মা মেনে নেবে না? শুধু মাত্র এই কারনে যে পরী ওর থেকে দু’বছরের বড় বলে? বয়সের ব্যাবধান কি এতই বড় যে ওর বাবা মা ওদের সম্পর্ক মেনে নেবে না?
কিছুতেই মনকে শান্তনা দিতে পারলনা অভি, এই ভালবাসা অবৈধ হতে পারেনা। ওরা দু’জনেই প্রাপ্ত বয়স্ক, দু’জনের বুকের মাঝে একটি হদপিন্ড আছে। কেই বা বুঝবে? মা না দিদা? এ ভালবাসা যে বড় মুধুর। ভালবাসা মানুষের মনে কি দরজায় টোকা মেরে আসে? না জানিয়ে আসে। প্রেমে মন মজে গেলে, বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়, রাতে ঘুম আসে না, সবসময়ে খোলা চোখের সামনে শুধু প্রেমিকার কাজল কালো দু’নয়ন খেলে বেড়ায়। এইসব ভাবনা চিন্তায় ডুবে যায় অভি।
ওর চিন্তনের রেশ কাটল এক মিষ্টি আওয়াজ শুনে, “তোমাকে নিচে খেতে ডেকেছে।” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অভি, পেছনে অরুনিমা দাঁড়িয়ে।
অভি, “হুম চল, আমি ত খাবার কথা একদম ভুলে গেছিলাম। ত কে তোমাকে পাঠাল আমাকে ডাকতে? তোমার দিদি না জামাইবাবু?”
অরুনিমা, “দিদি জামাইবাবু খেতে বসবে তাই তোমাকে ডাকতে বলল।”
নিচে নামতে নামতে অরুনিমা ওকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কলকাতার কোথায় থাক?”
অভি, “আমি উত্তর কোলকাতায় থাকি, তুমি ত মনে হয় দক্ষিণ কোলকাতায় থাক, তাই না?”
অরুনিমা, “হ্যাঁ, ঢাকুরিয়া।”
অভি একনজর দেখল অরুনিমাকে, পাতল গঠন গায়ের রঙ ফর্সা। পোশাক আসাক বেশ রুচিশীল। টকটকে লাল রঙের শাড়ি পড়েছে, পিঠ বিহীন ব্লাউস গায়ে, পিঠের ওপরে দুটি সুতা দিয়ে বাঁধা।
অরুনিমা, “তুমি কলেজের ফাইনাল ইয়ারে?”
অভি, “হ্যাঁ।”
অরুনিমা, “তারপরে?”
অভি, “তারপরে মানে?”
অরুনিমা, “না মানে কলেজের পরে কি? হাইয়ার স্টাডিস করবে না চাকরি করবে?”
মাথা চুলকায় অভি, এই মেয়েটা ওকে এতসত প্রশ্ন কেন করছে। উত্তর দিল, “আমাকে চাকরি করতে হবে। আমি একটা প্রাইভেট সংস্থা থেকে কম্পিউটার শিখছি।”
অভি অরুনিমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ভবিষ্যতে কি করতে চাও?”
অরুনিমা একটু ভাবুক হয়ে বলল, “আমি কিছু করতে চাই না।”
পরীর একদম উলটো স্বভাবের মেয়ে অরুনিমা।
খাবার টেবিলে শুধু মাত্র দুটি চেয়ার খালি, অগত্যা অভিকে অরুনিমার পাশেই বসতে হল। মৈথিলী আর সুব্রত ওদের উলটো দিকে বসে। ওদেরকে পাশাপাশি বসতে দেখে, মৈথিলী সুব্রতর কানেকানে কিছু বলল, সুব্রত একবার অভির দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। ওই হাসি দেখে অভি বুঝতে পারল যে ওরা কি করতে চাইছে। নিজের মনে হেসে ফেলল অভি, “কি অদ্ভুত প্রস্তাব।”
খাবার সময়ে খুব চুপচাপ ছিল অভি, ওর মনটা পরে আছে কখন পরী আসবে সেই চিন্তায়।
খাবার পরে সুব্রত অভিকে ডেকে এক কোনায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল যে ওর কি হয়েছে, ও এত চুপচাপ কেন। অভি চেপে গেল যে, পরীকে খুব মনে পড়ছে, উত্তর দিল যে, দিদা ওকে ওর ছোটো বেলার কথা মনে করিয়ে দেওয়াতে ওর মন খারাপ লাগছে।
সুব্রত, “তুমি অরুনিমাকে নিয়ে একবার বাগানে বা পুকুর পাড় থেকে ঘুরে আসতে পারত? অরুনিমা বেশ সুন্দরী মেয়ে, হয়ত তোমার মনে ভাল লেগে যেতে পারে।”
অভি ম্লান হেসে উত্তর দিল, “কেন চেষ্টা করছ?”
সুব্রত, “কেন কি হল? এইরকম একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখে তোমার মনের ভেতরে কিছু হচ্ছে না? আমি যদি েই কথা আমার কোন বন্ধুকে বলতাম ওরা ত হুমড়ি খেয়ে পড়ত অরুনিমার ওপরে। এক কাজ কর, তুমি ছাদে যাও আমি ওকে ছাদে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
বিস্ময়
ছাদে উঠে অভি চেয়ে থাকে দুরের মাথের দিকে, ধানের খেতের ওপরে নির্মল বাতাসে কচি কচি ধান হাওয়াতে মাথা দোলাচ্ছে। মাথার ওপরে শীতকালের সূর্যি, ধিরে ধিরে পশ্চিম আকাশের দিকে পা এগিয়ে দিয়েছে। পরীর কোন দেখা নেই। বুকের মাঝে এক অনির্বচনীয় ব্যাথা জেগে উঠল, গত তিনদিন ওর জীবনের সব অঙ্ক গুলিয়ে দিয়েছে। খালি হাতে এসেছিল এই বিয়ে বাড়িতে, কিন্তু ফিরে যাবার সময়ে নিয়ে যাচ্ছে বুক ভরা ভালবাসা। ভগবানের কাছে এর থেকে বেশি আর কিছু চাওয়ার নেই ওর।
কিছু পরে বিয়ে বাড়ি আবার আত্মীয় সজ্জনের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠবে। কোলকাতা ফিরে যাবার আগে হয়ত পরীর সাথে আর একা একা দেখা করা যাবেনা। রাতের খাবার পরে, ওরা ফিরে যাবে কোলকাতা। কেন মরতে রাতে রাম খেতে গেল। যদি না খেত তাহলে ও পরীর সাথে, মায়ের সাথে শপিঙে যেতে পারত। এই সব ভাবতে ভাবতে এক সময়ে চোখে জল চলে আসে অভির। ঝনঝন করে উঠল মাথা, মনে হল যেন কানের কাছে কেউ কাঁচের গ্লাস ভেঙ্গে দিয়েছে।
“কি হয়েছে তোর?”
মনে হল যেন অনেক দূর থেকে কেউ ডাক দিচ্ছে অভিকে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাকিয়ে দেখল যে মা ওকে ডাকছে। চোখের জল লুকিয়ে তাকাল মায়ের দিকে, লক্ষ্য করল পরী মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মা অভির কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে আবার জিজ্ঞেস করল, “তোর কি হয়েছে?”
কোন উত্তর দিতে পারল না অভি। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে পরীর দিকে। ওই চোখ দেখে পরীর চোখ ফেটে জল চলে আসে, ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নেয়। বুঝতে পারে অভির মনের বেদনা। মা বললেন, “নিচে সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে যে কি হয়েছে তোর?”
পরী ধিরে ধিরে মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল, “ছোটোমা তুমি নিচে যাও, আমি ওকে দেখছি।”
মা, “হ্যাঁ দ্যাখ কি হয়েছে ওর, আর তাড়াতাড়ি নিচে চলে আয় তোরা।”
অভি জিজ্ঞেস করল মাকে, “তোমরা শপিঙে গেলে আমাকে বলে যেতে পারতেত?”
পরী বুঝতে পারে যে প্রশ্নটা ওর ছোটো মাকে নয়, অভি প্রশ্নটা ওকে করেছে। মা উত্তর দিলেন, “তুইত কোনদিন শপিঙে জাস না তাই তোকে বলা বৃথা। যাই হক, পরীর জন্য কিছু কেনা হয়েছে আর পরীও তোর জন্য কিছু কিনেছে, নিচে এসে একবার দেখিস। হয়ত তোর ভাল লাগবে।”
মা নিচে যাবার আগে জিজ্ঞেস করলেন, “রাতে কি আবার ধুতি পাঞ্জাবী পরবি না স্যুট?”
পরী ওর কানে কানে বলল, “রেমন্ডের সুট টা পর, আমি তোমার জন্য একটা টাই কিনে এনেছি।”
মা চলে যাবার পরেই, পরী ওর মুখখানি আঁজলা করে নিয়ে বলল, “সরি বাবা, আমি কি বুঝেছিলাম যে তোমার এত কষ্ট হবে?” কপালে চুমু খেয়ে বলল, “বাচ্চা ছেলের মতন কাঁদে। শক্ত কবে হবে? তুমি এইরকম হলে আমার কি হবে? একবারও ভেবে দেখেছ?” হাত ধরে নিচে টেনে নিয়ে গেল পরী, “একদম সেই ছোট্ট বাচ্চার মতন, এতদিনে একদম বড় হওনি। চোখ মোছও আর তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পরে নাও। খুব বড় সারপ্রাইস দেব তোমাকে।”
অভি ওর দেওয়া সেই সিল্কের রুমাল টা বের করে চোখ মুছে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সারপ্রাইস টা কি?”
পরী, “বাঃ রে, বলে দিলে কি আর সারপ্রাইস থাকে! বলব না যাও, যখন দেব তখন দেখে নিও।”
নিচে নেমে দেখল যে বাড়ির সবাই সাজতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। মায়ের ঘরে দু’জনে ঢুকে গেল। ওর মা আগে থেকেই বিছানার ওপরে ধুসর রঙের সুট টা বের করে রেখেছিল, আর তার ওপরে একটা নীল স্ট্রাইপ দেওয়া টাই রাখা। নীল রঙ অভির পছন্দের রঙ, টাই দেখে খুব পছন্দ হল অভির। মনে হল একবার পরীকে জড়িয়ে ধরে ওর টোপাটোপা গালে চুমু খায়, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে মা ঘরে এসে পরাতে ওর আর চুমু খাওয়া হল না। মা পরীকে বললেন মৈথিলীর ঘরে যেতে ওকে সাজাতে লোক এসেছে, তাঁর তদারকি করতে।
ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার আগে পরী ওকে একটা চোরা চুমু ছুঁড়ে দিয়ে যায়, চোখের ভাষায় যেন বলে গেল, “আমার জন্য নিচে অপেক্ষা কোরও।”
সন্ধ্যে নেমে এসেছে, সানাই বাজতে শুরু করেছে। বউভাতের বাড়িতে সাজ সাজ রব, আলোয় আলোকিত বাড়ি। সুট পরে কিছুক্ষণের মধ্যে বেড়িয়ে পরে অভি। অনেক লোকের চোখ আবার ওর দিকে। সুব্রত কাছে এসে কানে কানে বলে, “গুরু আবার কি দিয়েছ।” সুব্রতকে খুব বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল ওর কালো পাঞ্জাবীতে।
অভি সুব্রতর কাধ চাপড়ে বলে, “মামা, আজ রাত তোমার রাত কিন্তু চুরনির ওপরে যেন বেশি চাপ দিও না। বেস্ট উইসেস ফর হানিমুন। আমি সত্যি ভাগ্যবান যে তোমার বিয়ে এটেন্ড করতে পেরেছি।”
সুব্রত, “না, আমি সত্যি ভাগ্যবান যে তোমরা আমার বিয়েতে এসেছ।”
অভি, “এই তিন দিনে, এখানে এসে অনেক কিছু ফিরে পেলাম আর অনেক কিছু নতুন করে পেলাম। হারিয়ে যাওয়া আমাদের ছেলেবেলা, আমার পোঁতা আম গাছ, পুকুর পাড় যেখানে আমি আর তুমি মাছ ধরতাম আর তারপরে সেই মাছ গুলো আবার জলে ছেড়ে দিতাম।”
সুব্রত, “কবি কবি ভাব, তুমি কবি না টেকনিকাল?”
ঠিক সেই সময়ে অরুনিমা অভির কাছে এসে বলল, “হুম, দারুন দেখাচ্ছে তোমাকে। অনেক মেয়ের মাথা ঘুরে যাবেত।”
ওর কথা শুনে সুব্রত হেসে ফেলল, অভিকে ওর সাথে যেতে বলল।
অরুনিমা, “তোমাকে খাওয়ার পরে কত খুজলাম কোথাও দেখতে পেলামনা।”
অভি, “কেন খুজছিলে আমাকে?”
অরুনিমা, “এমনি খুজছিলাম। কি করব আমার বয়সের কেউ ছিল না তাই খুব বোর ফিল করছিলাম।”
অভি জিজ্ঞেস করল, “হাটবে নাকি?”
অরুনিমা, “আপত্তি নেই।”
অভি, “ভিড় অনেক সময় বর বোরিং হয়ে যায় তাই না?”
দু’জনে উঠোনের দিকে হাঁটত শুরু করল। ওদেরকে একসাথে হাঁটতে দেখে অনেকের চোখ গেল ওদের দিকে। ইন্দ্রানি মাসির ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে বুঝিয়ে দিল, “ভাল ভাল”
অরুনিমা, “তুমি বড় চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে, তাই না?”
অভি, “হ্যাঁ তা বটে। ব্যাপারটা হচ্ছে ঠিক মতন লোক না পেলে ঠিক কথা বলতে ইচ্ছে করেনা।”
অরুনিমা, “ঠিক বলেছ, মনের মতন মানুষ না পেলে ঠিক কথা বলে আনন্দ হয় না।”
অভি, “তাঁর মানে আমি ত অনার্ড, তুমি আমার সাথে কথা বলছ।”
অভির কথার পরে দুজনেই হেসে ফেলল। কথা বার্তায় ওই জানতে পারল যে, অরুনিমার একটা ছোটো ভাই আছে, স্কুলে পড়ে। ওর বাবা সরকারি চাকুরিরত, রাইটার্স বিল্ডিঙে চাকরি করেন। গল্প করতে করতে ওরা অনেক দূর চলে এসেছিল, অভি পেছনে তাকিয়ে বলল যে ওদের এবারে ফেরা উচিত।
অরুনিমা, “আর একটু হাটলে হত না?”
কিছু দূর আরও এগিয়ে যেতেই অরুনিমা জিজ্ঞেস করল, “আমি তোমাকে একটা পারসনাল কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
অভি, “হ্যাঁ জিজ্ঞেস করতে পার।”
অরুনিমা, “না মানে, তোমার নিশ্চয় কোন গার্লফ্রেন্ড নেই তাই না?”
অভি ঠিক এটাই ভয় পাচ্ছিল।
অভি মনের ভাব লুকিয়ে উত্তর দিল, “না মানে আমার কোন ফুল টাইম গার্লফ্রেন্ড নেই।”
অরুনিমা, “হুম তার মানে খালি ফ্লার্টিং করা হয়।”
অভি, “না না, আমার অত সময় নেই যে ফ্লা+টিং করব। আমার অনেক বন্ধু বান্ধবী আছে তবে বিশিষ্ট কোন বান্ধবী নেই আমার।”
ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অরুনিমা, মনে হল যেন বুকের মাঝে এতক্ষণ কিছু চেপে ধরে ছিল, অভির কথা শুনে সেই পাথরটা বুকের ওপর থেকে সরে গেল। অভি মনে মনে হাসতে থাকে, “পাগলি মেয়ে, আমি আমার ভালবাসা পেয়ে গেছি।”
দুজনেই চুপচাপ বাড়ির দিকে হাটা শুরু করল। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে অরুনিমা বলল, “আমরা দুজনেই কোলকাতায় থাকি, একবার দেখা করা যায় কি?”
মাথা নাড়লো অভি, যাবে কোনদিন ওর বাড়িতে। চলে যাবার আগে অভির হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে ইশারা করল যেন ফোন করে। কাগজটা দেখে মাথার চুলে আঙ্গুল দিয়ে আঁচড়াল অভি, মনে মনে হেসে ফেলল, “কি যে হচ্ছে।”
পরী পেছন থেকে এসে ওর কাঁধে একটা টোকা দেয়, “কি ব্যাপার কি চলছে? কিছুর গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে যেন?”
অভি পরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে অবাক হয়ে গেল। পরীর পরনে একটি সুন্দর তুঁতে রঙের লেহেঙ্গা তার ওপরে রুপলি সুতোর ভারী কাজ, ফর্সা গায়ের রঙের সাথে বেশ মানিয়েছে ওর লেহেঙ্গার রঙ। চুল খোঁপা করে বাঁধা, কিছু জুঁই ফুল গোঁজা খোঁপায়। ললাটে একটি বড় তুঁতে রঙের টিপ, কানে লম্বা সোনার দুল, গলায় মায়ের দেওয়া সোনার হার। কবজিতে ছঞ্ছন করছে দু গাছা তুঁতে আর গাড় নীল রঙের কাঁচের চুরি। দু’গালের টোল দেখে মনে হল যেন এখুনি গালে চুমু খায়।
কাচুলি আর কোমরের মাঝে অনাবৃত ছোটো গোল পেট আর তাঁর মাঝে সুগভীর নাভিদেশ। বড় বড় কালো চোখে অভির অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে পরী।
একটু নেচে ঘুরে অভিকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?”
অভি মন্ত্রমুগ্ধের মতন পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে, “আমি যে এখন হার্ট ফেল করব সোনা।”
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল পরী, “অরুনিমার চেয়েও সুন্দরী?”
“হুম, কোথাও কিছু জ্বলছে মনে হচ্ছে?” গালে আলতো করে টোকা মেরে বলে অভি।
একটা ধাক্কা মেরে উত্তর দেয় পরী, “আমি ছাড়া কারুর দিকে তাকালে আমি কিন্তু চোখ গেলে দেব, বুঝলে।”
তর্জনীর ডগায় ছোট্ট চুমু খেয়ে বলে, “পাগল নাকি।”
পরী, “এই কি করছ, ছোটো মা আসছে, দেখতে পাবে যে।”
অভি, “সরি।”
মা কাছেই ছিলেন, পরীকে দেখে ডাক দিলেন। পরী দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল। মা ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু খেল। অভি দূর থেকে মা আর পরীকে দেখতে থাকে। ইন্দ্রানি মাসি ওর কাছে এসে বলে, “আজ পরীকে শান্ত করতে মুশকিল হবে।”
অভি ইন্দ্রানি মাসিকে একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ওর পায়ের কাছে বসে পরে। ইন্দ্রানি মাসির হাত দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, “তুমি ত ওর বড়দি, তোমার চোখে যদি জল আসে তাহলে ওকে কি করে আটকাবে তুমি?”
ফুঁপিয়ে ওঠে ইন্দ্রানি মাসি, “এত বছর শুধু ওকে দোষ দিয়ে গেছি আমরা।” এই বলে কাঁদতে শুরু করে ইন্দ্রানি মাসি।
অভি ইন্দ্রানি মাসির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, “চোখ মোছো মাসি। আজ না তোমার ভাইয়ের বউভাত, এই রকম আনন্দের দিনে কেউ কাঁদে নাকি?”
ঠিক সেই সময়ে মেঘনা ঘরে ঢুকে ওদের কে দেখে বলল, “সারা বাড়িতে হচ্ছে টাকি, এক জায়গায় পরী, মা আর উলুপিদি কাঁদছে আর একদিকে তোমার। আমি ত পাগল হয়ে যাব।”
অভি ইন্দ্রানি মাসিকে শান্ত করে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। অনুরিমা এসে ওকে ডেকে নিয়ে যায় বলে যে ওর জামাইবাবু, সুব্রত ফটো তলার জন্য ওদের ডেকেছে। লোকেরা খেতে বসে গেছে, ধিরে ধিরে রাত গভীর হচ্ছে।
পরীর মুখে হাসি দেখে আসস্থ হল অভি, যাক কান্না কাটির পালা তাহলে শেষ। ওকে দেখতে পেয়ে ডাক দিল পরী। দুই বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। অভি ওকে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক আছো?” কোন উত্তর দিল না, শুধু একটু ম্লান হাসল।
অভি, “দেখি বাবা মা কোথায়, খেতে বসতে হবে।”
পরী, “এত তাড়াতাড়ি? আমার সাথে খেতে বসবে না?”
সুব্রত ওদের কে ফটো তুলতে ডেকে নিয়ে গেল।
বিদায় চুম্বন
ফটো তোলার পরে পরী ওকে বলল, “একটু হাটবে আমার সাথে?”
পরী অভিকে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে এল। দু’জনে হাত ধরাধরি করে আম বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। গভীর কালো অন্ধকার ওদের চারপাশে। পরী অভির বাঁ হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে, বাঁকা চাঁদের আলোয়, পরীকে দেখে মনে হল যেন স্বর্গের অপ্সরা মাটিতে নেমে এসেছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে পরী জিজ্ঞেস করল, “আজকেই তোমাকে চলে যেতে হবে?”
মাথা নাড়ায় অভি, “হ্যাঁ, সোনা।”
পরী, “আর একটা দিন থেকে গেলে হত না?”
অভি, “একটা দিন থাকলেও কোন পরিবর্তন হত না। কালকেও তুমি এই কথাই বলতে।”
রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পরী ওর দিকে ঘুরে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। বুকের ওপরে মাথা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে পরে। অভি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর মাথার ঘ্রান বুকে টেনে নেয়।
পরী, “এতদিন কাছে ছিলে না, অনেক কিছু জানতাম না, ভাল ছিলাম আমি। দু’দিনে এসে আমার জীবন টাকে…”
কথা শেষ করতে পারলনা পরী, অভি ওর মুখখানি আঁজলা করে নিয়ে ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরল। দু’জনের কেউই সেই চুম্বন টিকে খন্ডন করতে নারাজ। বেশ কিছুক্ষণ পরে পরী ওর বড় বড় চোখ খুলে তাকাল অভির মুখের দিকে। অভি ওর ঠোঁট ছেড়ে প্রথমে ওর চোখের পাতায় আলতো করে চুমু খেল, তারপরে ধিরে ধিরে ওর গালে, কানের লতিতে চুমু খেল। দু’হাতে ওর উন্মুক্ত পিঠের ওপরে বিচরন করছে, শিরদাঁড়ার ওপরে নখ দিয়ে আঁচর কেটে দিল অভি। নখের আঁচরে কেঁপে ওঠে পরী। নিঃশ্বাস ঘনিভুত হতে থাকে।
কাধ ছেড়ে পরীর হাত অভির মাথার ওপরে, দশ আঙ্গুল দিয়ে আঁচরে দেয় অভির চুল। গলায়, চিবুকে শত সহস্র চুম্বনের বন্যা বইয়ে দেয় পরী। পীনোন্নত বক্ষ অভির প্রশস্ত বুকের ওপরে পিষ্ট হয়ে যায়। ওর কোমলতা অনুভব করে অভি, সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকে।
দুষ্টু অভি মুখ নামিয়ে আনে পরীর বুকের ওপরে। বুকের ওপরের অনাবৃত অংশে চুম্বনে ভরিয়ে দেয়। পরীর স্বাসে প্রেমের আগুন ঝরতে থাকে, শক্ত করে অভির মাথা চেপে ধরে বুকের ওপরে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বুকে ভরে টেনে নেয় পরীর শরীরে মধুর সুবাস। পরীর পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে দেয়, বুকের মাঝে যেন বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে, উন্নত বক্ষ যুগল থেকে থেকে ওঠা নামা করছে। অভির নচ্ছার হাত পরীর পুষ্ট নিতম্বের কোমল বলয়ের ওপরে, পিষ্ট করতে থাকে। পরী চোখ বন্ধ করে অস্ফুট শীৎকার করে ওঠে।
ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে অভি। পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরে, সুগভীর নাভির ওপরে আলতো করে চুমু খায়। উষ্ণ ত্বকের ওপরে অভির ভেজা ঠোঁটের পরশ পেয়ে কেঁপে ওঠে পরী। অভি তাও থামেনা, ওর পেটের ওপরে নাভির চারদিকে সহস্র চুম্বনে ভরিয়ে তোলে।
পরী প্রেমে ককিয়ে ওঠে, “আমি পাগল হয়ে যাব অভি। আর ওইরকম ভাবে চুমু খেও না সোনা।” অভি ওর কোথায় কোন কান দেয়না। ঠোঁট নাভির নিচে নামতে চায়, পরী বুঝতে পেরে ভীষণ ভাবে কেঁপে ওঠে। আরও জোরে শীৎকার করে ওঠে, “না…… সোনা…”
দু’পা জবাব দিয়ে দেয়, ধপ করে অভির কোলে বসে পরে পরী। বুকের ওপরে মাথা গুঁজে বলে, “আর পারছিনা সোনা, আর পাগল করোনা প্লিস…”
দু’জনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ বসে রইল আম বাগানের ভেতরে। চারদিকে ঝিঝি পকার আওয়াজ আর রাতের ঘন অন্ধকার। আকাশে বাঁকা চাঁদ যেন ওদের দেখে মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। এই প্রথম পরীর মনে হল যে নিস্তব্ধতাও কত মধুর প্রেমময় হতে পারে।
কতক্ষণ ওরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল জানা নেই, পরী অভিকে বলল, “আমাদের হয়ত কেউ খুঁজতে পারে এবারে বাড়ি যেতে হয়।”
অভি, “হুম… কিন্তু আর একটি চুমু…”
পরী, “না একদম দুষ্টুমি নয়, তুমি আমাকে পাগল করে ছেড়ে দিয়েছিলে।”
হাতে হাত রেখে বাড়ির দিকে রওনা দিল দুজনে। পেছন দরজা দিয়ে চুপচুপ বাড়ি ঢুকে পরী আগে দেখে নিল কেউ আছে কিনা, কাউকে না দেখতে পেয়ে অভিকে ভেতরে আসতে বলল। তারপরে ওর দিকে চোখ টিপে পরী ওর বান্ধবীদের কাছে চলে গেল।
অশ্রুভরা বিদায়
সময় খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলেছে। বাবা অভির কাছে এসে খেতে ডেকে নিয়ে গেলেন। দিদা ওদের জন্য আলাদা করে খাবার ঘরে খাবারের ব্যাবস্থা করেছিলেন। ওদের খাবার সময়ে সবাই ওদের চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ইন্দ্রানি মাসি এসে মাকে একবার অনুরধ করল আর এক রাত কাটিয়ে যেতে। মা জানালেন যে কাল মায়ের স্কুল আছে, বাবাকে অফিস যেতে হবে।
খাবার পরে দিদা মাকে ডেকে নিয়ে গেল ঘরের মধ্যে। অভি বুঝতে পারল যে কান্নার পালা শুরু। বাবা ওকে ডেকে নিয়ে গেল বারান্দার দিকে।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ে কেমন কাটল?”
অভি মাথা নাড়ল শুধু।
বাবা, “তুই ওপরের রুমে শিফট হয়ে যাস কাল থেকে, পরী আমাদের পাশের রুমে থাকবে।”
অভি আবার মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে।”
ধিরে ধিরে রাত বাড়ছে, আত্মীয় সজ্জন অনেকে চলে গেছেন। বাবা জানালেন যে উঠানে ওদের জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকালেন বাবা, রাত প্রায় এগারোটা বাজে। ওকে বললেন ভেতর থেকে ওদের মালপত্র নিয়ে এসে গাড়িতে রাখতে। মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকাল অভি, পরীকে ছেড়ে যেতে হবে এবারে ভেবে বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল। কিছু পরে ভেতর দিকে পা বাড়াল।
খাবার ঘরে দিদা মায়ের হাত দুটি ধরে বসে আছে, দু’জনার চোখে জল। ইন্দ্রানি মাসি আর মেঘনা পাশে দাঁড়িয়ে, ওদের চোখেও জল। সুব্রত ওদের মালপত্র কাজের লোককে দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিল। মৈথিলী চুপ করে দিদার পাশে দাঁড়িয়ে দিদার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এর মাঝে পরীর কোথাও দেখা নেই। এমন সময়ে চন্দ্রানি এসে অভিকে জানাল যে পরী ওপরের রুমে নিজেকে বন্ধ করে দিয়েছে, দরজা খুলছে না। দিদা ওর কথা শুনে আবার মাকে থেকে যেতে বলল।
মা বললেন, “আজ না হয় কাল আমাকে যেতে তো হবেই। কাল গেলেও তুমি কাঁদবে ত আজ কেন নয়।”
মাকে চন্দ্রানি বলল যে, পরী দরজা খুলছে না। মা ইন্দ্রানি মাসি কে নিয়ে দৌড়ে গেল ওপরে। সাথে সাথে সুব্রত আর অভিও দৌড়ে গেল। মা দরজায় টোকা দিয়ে পরীকে দরজা খুলতে বললেন, কিন্তু ভেতর থেকে কোন সারা শব্দ নেই।
মা আবার ডাক দিলেন, “পরী, সোনা মা আমার দরজা খোল।”
তাও দরজা খোলে না পরী। দু’জনেই ভয়ে অভি আর সুব্রতর দিকে তাকাল।
ওদিকে দিদা এসে গেছেন, দিদাও দরজায় ধাক্কা দিয়ে পরীকে দরজা খুলতে বলে, কিন্তু ভেতর থেকে কোন সারা না পেয়ে সবাই উদ্ভিগ্ন হয়ে ওঠে।
দিদা কেঁদে অথেন, “পরী, দোহাই মা আমার, দরজা খোল।”
সুব্রত আর অভি একে ওপরের মুখ চাওয়াচায়ি করে। দরজার পেছনে পরী না কিছু অঘটন ঘটায়। সুব্রত দউর দিল ছাদের দিকে, পেছন পেছন অভি। অভি কে জিজ্ঞেস করল সুব্রত যে পাইপ বেয়ে নিচে নামতে পারবে কিনা। অভির মাথায় তখন রক্ত চরে গেছে, কিছু আর ভাবতে পারছে না। মাথা নেড়ে বলল ও সব কিছু করতে রাজি। পাইপ বেয়ে দু’জনে জানালার কার্নিশে নেমে গেল। জানাল দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে যা দেখল তাতে অভির রক্ত জল হয়ে গেল। বিছানার ওপরে সংজ্ঞাহীন লুটিয়ে পরী।
অভি দৌড়ে গিয়ে পরীর মাথা কোলে তুলে নিল, পরী নড়ছে না। থমকে গেল অভি, বুকের কাছে কান নিয়ে এসে দেখল যে বুকটা ধুকপুক করছে। অভি হাতের কাছে একটা গ্লাসে জল ছিল, সেটা পরীর মুখের ওপরে ছিটিয়ে দিল। সুব্রত তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। মা দিদা সবাই ঘরের মধ্যে ঢুকে পরলেন। দু’জনের মধ্যে কারুর কান্না আর থামে না।
কিছু পরে পরী চোখ খুলে চারপাশে তাকায়। ওকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে। মা ওকে কোলে নিয়ে চোখের বাঁধ ভেঙ্গে দিলেন।
মা, “পাগলি মেয়ে, এইরকম কেউ করে। কোনদিন আমার সামনে দরজা বন্ধ করবি না।”
মাকে জড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ল পরী, “প্লিস যেও না…”
মা ওর মুখ আঁজলা করে নিয়ে সান্তনা দিলেন, “তুই আমার সোনা মা না? বোকা মেয়ের মতন কেউ এই রকম করে কাঁদে নাকি? একটু হাস মা, আজ আমাকে ছেড়ে দে।”
কান্না কাটির পালা আরেক প্রস্থ শুরু হবে দেখে অভি আর সুব্রত ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। নিচে নেমে দেখে যে মৈথিলী আর অরুনিমা বসে আছে। কিছু পরে মায়ের সাথে পরী নিচে নেমে আসে। পরী তখন মায়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
অভি সুব্রত আর মৈথিলী কে জড়িয়ে ধরে বলল, “মামা চুর্নি কে দেখ। আর বেস্ট উইসেস ফর হানিমুন। পরে গল্প শুনব।”
মায়ের কান্না দেখে মনে হল যেন কেউ অনার বুকের একটুকরো কেটে রেখে দিয়েছে। বাবা মাকে ধরে গাড়িতে উঠে গেলেন। অভি ইন্দ্রানি মাসি কে প্রনাম করতে গেল, ইন্দ্রানি মাসি ওকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, “ভাল থাকিস।”
অভি একবার পরীর দিকে তাকাল, ওর চোখ দুটি লালা হয়ে গেছে, মৈথিলী ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে। অভি বুক ভরা শূন্যতায় একবার সবার দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে গেল।
গাড়ি ছেড়ে দিল। ঠাণ্ডার রাত কেটে গাড়ি এগিয়ে চলল। পেছনের সিটে মা চুপ করে বাবার হাত ধরে বসে। অভি চুপ করে সামনের সিটে বসে। কিছু পরে চোখ বন্ধ করে নিল অভি। বন্ধ চোখের সামনে পরীর অশ্রুভরা লাল দু’নয়ন ভেসে উঠল। ওই দু’চোখ যেন ওকে বলছে, “আমি আজ থেকে প্রত্যেক মুহূর্তে তোমার কথা মনে করব।”
কাঁদতে পারল না অভি।