ভালবাসার রাজপ্রাসাদ | পর্ব – ২৩ | বুকভাঙ্গা অশ্রু

জীবন বড় বেদনাদায়ক, ঠিক যেন দাবার ৬৪ ছকে বাঁধা, একটা ছোটো ভুল কত বড় রুপ নিয়ে দাঁড়ায় সেটা কি আর কেউ জানত? অভির আর পরীর জীবনে এই রকম একটা ছোটো ভুল পদক্ষেপ ওদের জীবন তছনছ করে দেয়।
সকাল বেলা, প্রায় দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ, অভি বসার ঘরে বসে চায়ের কাপে আরাম করে চুমুক দিচ্ছিল। পরী রান্না ঘরের কাজে ব্যাস্ত ছিল। আকাশ সকাল থেকে মেঘলা, কোলকাতার বৃষ্টির ঠিক ঠিকানা নেই কখন কি ভাবে এসে পরে। মা সেইদিন আর স্কুলে যাননি, তাঁর আগের দিন, মায়ের শরীর একটু খারাপ ছিল। এমন সময়ে ওপরে নিজের ঘর থেকে মায়ের গলা শুনতে পেল অভি, মনে হয় অভির ঘরে বিছানার চাদর বদল করছিলেন।
মা নিচে নেমে অভির দিকে রক্তাক্ত চোখে তাকিয়ে পরীকে ডাক দিলেন, “পরী এদিকে আয়।”
মায়ের হাতে বালিশের কভার।
পরী ওর ছোটমায়ের গোল এত গম্ভির হতে পারে, ভাবতে পারেনি। হন্তদন্ত হয়ে রান্না ঘর থেকে ছুটে এসে মাকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে ছোটমা?”

মা ওকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই সকাল থেকে তোর মুক্তোর কানের দুল খুজছিলিস, পেয়েছিস সেটা?”
পরী অভির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে, অভি জানেনা যে পরী ওর কানের দুল হারিয়েছে। মাকে উত্তর দেয়, “না ছোটমা, এখন খুঁজে পাইনি।”
মা বালিশের কভার থেকে কানের দুল বের করে পরীর সামনে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি তোর কানের দুল?”
মায়ের হাতে পরীর মুক্তোর কানের দুল দেখে, অভির গলা শুকিয়ে যায়, বুকের মাঝে এক ভয় ঢুকে খাঁ খাঁ করে দেয়, সারা শরীরের রক্ত যেন মুখের ওপরে এসে জমা হয়ে যায়। ওর মাথায় যেন কেউ গরম তেল ঢেলে দিয়েছে। পরীর কান মুখ লাল, ভয়ে মৃদু কাঁপছে পরী। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মায়ের দিকে তাকিয়ে।
মা অভির দিকে তাকিয়ে হিম শিতল কণ্ঠে বলেন, “পরীর কানের দুল, তোর বালিশের কভারে, কেন? এর কি ব্যাখা আছে শুনি?”
বড় নিঃশ্বাস নেয় অভি, “পরী হয়ত আমার ঘরে কোন কাজ করতে গেছিল সেই সময়ে ওর কানের দুল হয়ত পরে গেছে। আমি কি করে জানব, কখন পড়েছে।”
মা দাঁতে দাঁত পিষে অভির দিকে তাকিয়ে বলেন, “কাল রাতে খাওয়ার সময়ে ওর কানে আমি দুল দেখেছিলাম আর আজ সকালে সেই দুলের একটা তোর বিছানায়।”
মা পরীর দিকে দু পা এগিয়ে, ঘাড়ের কাছ থেকে চুল সরিয়ে দেখে যে ঘাড়ে অভির দাঁতের লাল দাগ। মায়ের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, “তোর ঘাড়ে এই লাল দাগ কিসের?”
পরী দুচোখ বন্ধ করে নেয়, দাঁতে দাঁত পিষে বুকের মাঝের ভয় টাকে সংবরণ করতে প্রবল চেষ্টা করে। ভয়ে গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় পরীর। মা পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় গর্জে ওঠেন, “তাহলে ব্যাপার এত সঙ্গিন যে, তোর কাঁধে দাঁতের দাগ। হ্যাঁ?”
অভি মাথা নিচু করে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে জল, কান গরম হয়ে গেছে অভির, গলা শুকিয়ে এসেছে। মা সপাটে এক থাপ্পর কষিয়ে দেন অভির গালে আর রাগে চিৎকার করে ওঠেন, “আমার নাকের নিচে থেকে এই কান্ড?”
রাগে কাঁপতে কাঁপতে মা সোফায় বসে পড়েন। মাথায় হাত দিয়ে বলেন অভিকে বলেন, “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে তুই ওর সাথে এই রকম করবি।”
পরী মায়ের কাছে এসে কিছু বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু মায়ের লাল চোখ দেখে সাহসে কুলায় না পরীর, চুপ করে পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকে মায়ের পাসে।
মা পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “এটা কি পরী, তুই ওর চেয়ে বড়, আর তুই… সম্পর্কে তুই ওর মাসি।”
পরী মায়ের পায়ের কাছে বসে পরে, মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে এক ভাবে। অভি পরীর হাঁটু গেড়ে থাকা দৃশ্য সহ্য করতে পারেনা, বুক ফেটে যায় ওর।
মা অভির দিকে রোষ কষিত নয়নে দেখে বলেন, “তোর একবারের জন্যেও মনে হল না যে পরী তোর মাসি আর তুই পাপ করছিস? এই সব শুধু তোর লালসার কারন, তোর গায়ের গরম রক্তের জন্যে তুই মেয়েটার জীবন অপবিত্র করে দিলি?”
পরীর চোখের জল মায়ের পায়ের কাছে, মেঝেতে টপ টপ করে পরে। কারুর মুখে কোন কথা নেই কিন্তু মনে হল যেন ওই চোখের জলের বুক ফাটা শব্ধ ওদের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিচ্ছে। পরীর বুক কেঁপে ওঠে থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মা অভির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, “কুলাঙ্গার তুই, আমাদের মুখে মুখে কালি দিয়ে দিলি। এই সব কিছু তোর পাপের ফল।”
আর থাকতে না পেরে অভি জোর গলায় উত্তর দেয়, “আমি পরীকে ভালোবাসি।”
মা বিশ্বাস করতে পারেন না, জোর গলায় জিজ্ঞেস করেন, “কি? তুই শেষ পর্যন্ত এই দিলি আমাকে আর ওকে? তুই ভালোভাবে জানিস যে পরী তোর চেয়ে বয়সে বড়, সম্পর্কে তোর মাসি হয়। আমার সম্পর্কে বোন আর তোর দিদার মেয়ে।”
অভি মাকে বুঝানোর চেষ্টা করে, “মা, পরী আমার মাসি নয়, মা। ও তোমার বোন হতে পারে, কিন্তু আমার মাসি নয়। ও তোমার অনেক দূর সম্পর্কের বোন মা সেটা তুমি ভালো করে জানো মা। মা আমাদের মাঝে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই মা। ও আমার মাসি নয়, আমি ওকে ভালোবাসি।”
মা মাথা নাড়ান, “না না না, এ হতে দিতে পারি না আমি।”
মা পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তোর মাথায় কি চলছিল, যখন অভি তোর সাথে এই সব করছিল? তোর একবারের জন্য কিছু মনে হয় নি, পরী? বল, পরী, তুই কি অভিকে ভালবাসিস?”
পরী মাথা দোলায়, হ্যাঁ অভিকে ও ভালবাসে।
ওই কথা জানার পরে মায়ের দুচোখে জল চলে আসে। দুঃখে বা ভালবাসায় নয়, রাগে আর ঘৃণায় চোখে জল আসে মায়ের। পরীর চিবুকে আঙুল দিয়ে পরীর মুখ উঁচু করে নিজের দিকে ফেরায়। পরী দুচোখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখে। মা ওকে জিজ্ঞেস করেন, “একবারের জন্যেও তোর আমার কথা, তোর মায়ের কথা মনে পরেনি? একবারের জন্যেও না? আমি যে তোদের দুজনকে একসাথে বড় করেছি রে।”
পরীর বুক ফাটা আর্তনাদ যেন শুধু একা অভি শুনতে পায়। দুচোখে অবিরাম স্রাবনের ধারা বয়ে চলে। অভির বুকের মাঝে যেন এক বিশাল রেল গাড়ি ঝম ঝম করে দৌড়ে চলে যায়।
মাকে আবার একবার বুঝানোর চেষ্টা করে অভি, “মা, পরী, তোমার মায়ের মামার ছোটো মেয়ের ছোটো মেয়ে, মা। দেখতে গেলে আমাদের মধ্যে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই মা। হ্যাঁ আমার চেয়ে বড় হতে পারে পরী, কিন্তু মা আমি ওকে ভালোবাসি আর বয়সের ব্যাবধান কোন বাধা নয় মা।”
মা ওর দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠেন, “তুই চুপ কর। তুই সত্যি আমাদের জন্য এক কলঙ্ক। সেই ছোটো বেলা থেকে তুই কোন দিন আমাদের কথা শুনিস নি, নিজের কথা মত সবসময়ে কাজ করিস।”
মায়ের কথা আর সহ্য করতে পারেনা অভি, সব সময়ে শুধু একই কথা যে ও কুলের নাম ডুবিয়েছে।
মায়ের দিকে চিৎকার করে ওঠে অভি, “আমি তোমার ছেলে হয়েও কেন তোমার ভালোবাসা পেলাম না মা, কেন?”
অভির কানে সেই প্রথম অকাঠ সত্য কথা প্রবেশ করে। মা ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন, “আমি আর তোর বাবা, কোনদিন ছেলে চাই নি, কিন্তু ভগবান বিরূপ। সেই আমাকে ছেলেই দিল। আমাদের শারীরিক কিছু কারনে আর আমার কোন সন্তান হল না। আমি ছেলে চাই নি।”
হাতের মুঠি শক্ত করে নেয় অভি, একি শুনছে, “আমার জন্মে আমার কি দোষ মা। আমি সারা জীবন শুধু দুঃখ পেয়ে গেলাম তোমাদের কাছে। আমার যা কিছু ভালো লাগে তাই তোমরা কেড়ে নিয়েছ। আমার মনের শান্তি, আমার পেন্টিং আরও অনেক কিছু। মা দয়া করে পরীকে আমার কাছে থেকে কেড়ে নিও না মা। আমি মরে যাবো, পরী বাঁচবে না মা।”
সারা ঘর নিস্তব্ধতায় ডুবে যায়। বাইরের আকাশ যেন আরও কালো হয়ে আসে। থেকে থেকে মেঘ গর্জন করে ওঠে। ঘরের পরিবেশ মেঘের সাথে সাথে, কালো হয়ে আসে। পরী বুকের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে মায়ের হাতে হাত রেখে ম্যের দিকে তাকায়।
মা পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর কি বলার আছে?”
পরী কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “ছোটমা, অভিকে আমার কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দিও না ছোটমা, আমি বাঁচবও না ছোটমা।”
মা দাঁতে দাঁত পিষে মাথা নাড়ান, “না না, আমি বেঁচে থাকতে এ পাপ হতে দিতে পারিনা। সমাজ কি বলবে? আমাদের আত্মীয় সজ্জন কি বলবে?”
অভি চিৎকার করে ওঠে, “কোথায় ছিল তোমার সমাজ যখন দাদু মারা যান? কোথায় ছিল তোমার আত্মীয় যখন পরীর মুখে দুধ জটেনি? কেউ আসে নি ওকে দেখতে। তুমি ওকে দুধ খাইয়েছিলে মা, তুমি ওকে বড় করেছিলে। আমি সমাজের কথা জানিনা মা, আমি আত্মীয় সজ্জনদের কথাও শুনি না। তুমি কি ভাব সেটা বল, মা।”
মা খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেন, “আমি আর তোর বাবা এই সমাজের এক সনামধন্য ব্যাক্তি। আত্মীয় সজ্জন, পরিবার পরিজন মিলে সমাজ তৈরি। আমি বেঁচে থাকতে এই পাপ হতে দিতে পারিনা। অভি, তুই পরীর ধারে কাছে থাকতে পারবি না। তোরা দুজনে একসাথে থাকতে পারিস না। আমি চাই না তুই পরীর হাজার মাইলের মধ্যে আয়। আজই তোকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।” মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অভি, মা কি বলছেন?
মা ওকে বাড়ি ছাড়া হতে বলছেন? মা বলে চলেন, “আমি মাসিমা কে, পরীর মাকে কথা দিয়েছি যে আমি ওকে দেখব। যত দুঃখ কষ্ট হোক, আমি আমার কথা রাখব। আজ থেকে তেইশ বছর আগে, আমি এই বুক কেটে দু ভাগ করে পরীকে বড় করেছিলাম যাতে ও বেঁচে থাকে। আজ আবার আমি সেই বুক কাটতে রাজি, যাতে ওর স্বপ্ন পূরণ হয় আর ও বড় হতে পারে।”
বুকভাঙ্গা অশ্রু (#02)
পরী দুঃখে ককিয়ে ওঠে, বেদনায় চিৎকার করে ওঠে গলা ফাটিয়ে, “ছোটমা, আমি মাস্টার্স করতে চাই না, আমি কিছু চাই না, শুধু অভিকে আমার কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দিও না ছোটমা। কে কি বলে আমি তার ধার ধারিনা ছোটমা, শুধু ওকে আমার কাছ থেকে দুরে করে দিও না, ছোটমা, আমি বাঁচবও না।”
মায়ের কানে পরীর কান্না ভেজা আর্তনাদ প্রবেশ করে না, চুপ করে বসে থাকেন।
অভি মায়ের দিকে তাকিয়ে রেগে যায়, চিৎকার করে ওঠে, “তুমি তোমার আত্মসন্মান আর স্বভিমান নিয়ে সারা জীবন বেঁচে থাকলে। আমি যদি এই বাড়ি থেকে চলে যাই তাহলে আমি পরীকে সাথে নিয়ে যাবো।”
মা, “না, কারুর ক্ষমতা নেই, ওকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে নেওয়ার। পরীর মাথায় হাত রেখে তোকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে তুই কোনদিন কোলকাতা আসবি না, তুই কোনদিন ওর সামনে আসবি না।”
মায়ের আদেশ শুনে অভি পাথরের মূর্তির মতন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মা ওর হাত টেনে ধরে পরীর মাথায় রাখে, অভির বুক ফেটে যায় হাতের ওপরে পরীর চুলের পরশ পেয়ে। এক ভীষণ ভুমিকম্প এসে যেন ওদের জীবন টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে দিয়ে চলে যায়। পরী ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ কয়রে ফেলে, মাথায় অভির হাত। মরমে যেন মরে যায় পরী।
চাপা ককিয়ে ওঠে, “না……”
মায়ের কোলে মাথা গুঁজে কেঁদে ফেলে। মা ওর দিকে তাকায় না।
মা পরীকে বলেন, “তোর মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, যে তোকে আমি আগলে রাখবো। আমার মান সন্মান আজ সমাজের কাঠগোরায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর সেই জন্যেই অভিকে বাড়ি ছাড়তে হবে, এমনকি কোলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে ওকে। আমি চাই না ওর ছায়া পর্যন্ত তোর কাছে আসুক।”
মা অভির দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন, নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নে। আমি তোর বাবা কে এখুনি ফোন করে কাল সকালের দিল্লীর জন্যে প্লেনের টিকিট কাটতে বলে দিচ্ছি। আর এক দিনের জন্যেও তুই এই ছাদের তলায় থাকতে পারবি না। কথা দে, আমি যত দিন না বলব, তত দিন তুই কোলকাতা আসবিনা আর আমাদের বাড়িতে ফোন করবি না। যদি আমার কথা না রাখিস তাহলে তুই পরীর মরা মুখ দেখবি।”
মায়ের কথা শুনে অভির যেন দুই পা কেউ মেঝের সাথে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে, নড়ার শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলে অভি। পরী মুখ নিচু করে কাঁদে, বুকের মাঝে এক বিশাল আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়েছে ওর। শক্ত করে হাত চেপে ধরে পরী, হাতের সরু সোনার চুড়ি বেঁকে গিয়ে কবজিতে ফুটে যায় আর রক্ত বের হতে শুরু করে, কিন্তু সেই বেদনা যে মনের বেদনার কাছে খুব কম। অভির চোখের সামনে সারা পৃথিবী বন বন করে ঘুরতে শুরু করে দেয়।
অভিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মা চিৎকার করে ওঠেন, “দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে, আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।”
কোনোরকমে টলতে টলতে অভি নিজের ঘরে ঢোকে। জানেনা, পরীর কি হবে বা বাবাকে মা কি বলবেন। বাকি সারাদিন নিজেকে নিজের ঘরে বন্ধ করে রাখে। শেষ পর্যন্ত মৈথিলীর অভিশাপের কথা মনে পরে যায়, মৈথিলী যেন ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে, “জীবন যুদ্ধে তুমি শেষ পর্যন্ত হেরে গেলে, অভিমন্যু।”
বিকেলে বাবা ওর ঘরে আসেন। হাতে একটা খাম আর দিল্লীর টিকিট দিয়ে বলেন, “আমরা তোর বাবা মা, আমরা তোর ভালোই চাইব। যতদিন তুই চাকরি না পাস, তত দিনের জন্য আমি সুপ্রতিমের আকাউন্টে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেব।”
বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়, আকাশ যেন সেদিন জলের বদলে রক্তের বৃষ্টি করে। পরীর আর অভির বুকের রক্ত যেন আকাশ কেঁদে কেঁদে জল করে সারা জায়গায় ছড়িয়ে দেয়, কিন্তু কেউ সেই কান্না শুনতে পায় না।
রাত একটা নাগাদ, জামা কাপড় পরে, ব্যাগ হাতে নিচে নেমে আসে অভি। আসার আগে নিজের ঘরে সেই ডায়রি খোঁজে, কিন্তু পায় না, ভাবে হয়ত পরীর কাছে থাকবে।
শেষ বারের মতন বাড়ি থেকে অরুনাকে ফোন করে। অরুনা অত রাতে ফোন ধরে জিজ্ঞেস করে, “কিরে, কি হয়েছে? এত রাতে ফোন করেছিস কেন?”
অভি, “আমি কোলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, সকালের ফ্লাইট। আমার সাথে পারলে এয়ারপোর্টে দেখা করিস।”
চাপা চিৎকার করে ওঠে অরুনা, “কি হয়েছে?”
অভি, “ফোনে বলতে পারছিনা, সকালে এয়ারপোর্টে বলব।”
শেষ বারের মতন বাড়ির ফোনে কথা বলে রিসিভার রেখে দেয়।
সারা রাত বসার ঘরে চুপ করে বসে থাকে অভি। মায়ের ঘরে মা জেগে, পরীর ঘরে পরী দরজা বন্ধ করে কাঁদে। শেষ বারের মতন পরীর সাথে দেখা করার অবকাশ টুকু পায় না অভি, বুকের মাঝে হুহু করে কেঁদে ওঠে যখন পরীর বন্ধ দরজার দিকে চোখ যায়।
সকাল চারটে নাগাদ মায়ের দরজায় টোকা মারে অভি, জানায় যে এবারে ও চলে যাবে। মা কোন উত্তর দেন না। বাবা বেড়িয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, “প্লেন তো সাত টায়, এখুনি বের হবি কেন?”
বুকের পাঁজর ভেঙ্গে যায় অভির তাও উত্তর দেয় বাবাকে, “এই বাড়িতে আমার থাকার সময় শেষ হয়ে এসেছে।”
মাথা নিচু করে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে অভি, শেষ বারের জন্য মেঝে ছুঁয়ে মাকে শেষ প্রনাম জানায়। ব্যাগ হাতে নিয়ে বেড়িয়ে যায় দরজা দিয়ে। বাবা বাইরের গেট পর্যন্ত ওর সাথে আসেন। গেট থেকে বেড়িয়ে যাবার আগে, শেষ বারের জন্য বাড়ির দিকে তাকায় অভি। দুতলার বসার ঘরের জানালার পর্দা হালকা নড়ে ওঠে। তাকিয়ে দেখে যে পরী জল ভরা চোখে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। কাজল কালো চোখ দুটি রক্ত জবার মতন লাল হয়ে উঠেছে। বুক ফেটে কান্নার সুর অভির কানে এসে বাজে। পরীর বুকের পাঁজর ওর কাছ থেকে দুরে চলে যাচ্ছে, পরী বাঁচবে কি নিয়ে।
অভি নিচু হয়ে বাগানের একটু মাটি তুলে নিয়ে পরীর সেই সিল্কের রুমালে বেঁধে নেয়। ট্যাক্সি তে ওঠার আগে জানালার দিকে শেষ বারের মতন তাকায় অভি। ওর দিকে তর্জনী উঠিয়ে ইশারায় জানায় “আই”, ইশারা দেখে পরী নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তারপরে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল মেলে ধরে ইশারা করে, “এল”, পরীর বুকে কেঁপে ওঠে, প্রানপন নিজেকে থামাতে চেষ্টা করে। তারাপরে অভি, মধ্যমা আর অনামিকে মেলে ধরে ওর দিকে ইশারা করে, “ইউ”
পরী জানালার গ্রিল শক্ত করে ধরে থাকে, প্রানপন চেষ্টা করে সেই লোহার গ্রিল ভেঙ্গে অভির কাছে ঝাঁপিয়ে চলে যাওয়ার, কিন্তু লোহার গ্রিল আর সমাজের কঠিন বন্ধন পরীকে ঝাঁপ দিতে দেয় না। পরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা, সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। এক বার আগেও পরী সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল, তখন অভিকে সবাই ডেকে ছিল, কিন্তু সেই সময় আর আজকের সময় অনেক ভিন্ন। সেদিন চেয়েও অভি দৌড়ে পরীর কাছে গিয়ে ওর মাথা নিজের কোলে তুলে নিতে পারে না।
জল ভরা চোখ, ভাঙ্গা বুক নিয়ে অভি ট্যাক্সি চাপে। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায় যে, পরীকে যেন শান্তি দেয় ওকে যেন সুখে রাখে, নিজের জীবনে ত কিছুই পেলনা শেষ পর্যন্ত। পরীর কাছে হয়ত ওর একমাত্র চিনহ স্বরুপ পর ডায়রি থেকে যাবে আর অভির কাছে ওর রুমাল, তার সাথে পরীর এক বিন্দু রক্ত ওর শিরা উপশিরায় মিশে।
21শে জুলাই, 2001, শনিবার। সকাল চারটে নাগাদ এয়ারপোর্টে পৌঁছে লক্ষ্য করে যে অরুনা আর সমুদ্রনীল উপস্থিত। অরুনা অভির কাছে দৌড়ে এসে কলার ধরে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে তোর বাড়িতে? তুই কেন কোলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছিস? শুচিদির কি হবে?”
অভি, “আমি চিরদিনের জন্য কোলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
চাপা চিৎকার করে ওঠে অরুনা, “কেন?”
অভি পুরো ঘটনা জানায় অরুনাকে।
সব শুনে অরুনা কেঁদে ফেলে, “আমাকে আগে কেন জানাস নি তুই?”
অভি, “কি করে জানাতাম রে। সবকিছু কেমন ঝড়ের বেগে এসে আমাদের জীবন তছনছ করে দিয়ে চলে গেল। মা জেগে বসে আমি কি করে তোকে জানাই এই সব কথা।”
অরুনা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলনা যে অভিমন্যু কোলকাতা ছেড়ে চলে যাবে। অভির দিকে তাকিয়ে সমানে কেঁদে চলে অরুনা, পেছনে সমুদ্রনীল দাঁড়িয়ে, যেন কিছু বলার ভাষা খুঁজতে চেষ্টা করে।
অরুনা, “আমি কাকিমার সাথে কথা বলব, তুই যাস না।”
অভি, “সেই পথ বন্ধ অরুনা। মা এত খনে ভালভাবে বুঝতে পেরে গেছেন যে তুই আগে থেকে আমার আর পরীর ভালবাসার কথা জানতিস, তাই আমার মা হয়ত তোকে আমাদের বাড়ি ঢুকতে পর্যন্ত দেবে না। পরীর মাথায় হাত রেখে আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছে যে আমি কোনদিন পরীর সাথে দেখা করতে পারবোনা বা কোনদিন কোলকাতা ফিরতে পারবোনা। আমি মরে যাবো কিন্তু পরীর গায়ে কোন আঁচড় আসুক আমি চাই না, অরুনা।”
অরুনা অভিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বুকের জামা ভিজে যায় অরুনার চোখের জলে। অভির বুক ফেটে যায় পরীর দুঃখে আর অরুনার কান্না দেখে। দুহাতে শেষ বারের মতন অরুনাকে জড়িয়ে ধরে অভি, মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে সমুদ্রনীলের দিকে ঝাপসা চোখ নিয়ে তাকায়।
কাঁপা গলায় বলে সমুদ্রনীলকে, “আমি চেক ইন করার আগে অরুনাকে নিয়ে চলে যা।”
সমুদ্রনীল উত্তর দেয়, “তুই ওকে ভালো ভাবে চিনিস, অভি। ওই বোর্ডে যতক্ষণ না লেখা ফুটবে যে আই সি 264 Departed. ততক্ষণ অরুনা এখান থেকে নড়বে না। আমি জানি না রে অভি, তুই যাবার পরে অরুনার কি হবে। ও শুচিদিকে খুব ভালবাসত রে।”
অভি, “আমাকে কথা দে, তুই ওকে দেখবি, দয়া করে ওর চোখে জল আনিস না রে। আমার হয়ে, পরীর হয়ে ওকে ভালবাসিস তুই, আমি পুবালিকে কথা দিয়েছিলাম, সেই কথা আমি ত আর রাখতে পারলাম না, তুই রাখিস।”
কোনোরকমে জোর করে অরুনাকে ছাড়িয়ে ওর হাত সমুদ্রনীলের হাতে তুলে দেয়। অরুনা কিছুতেই অভিকে ছাড়তে চায় না, প্রাণপণে জামার কলার আঁকড়ে ধরে থাকে। শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টে বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দিয়ে অভি পেছনে সরে আসে আর জামার একটা বোতাম ছিঁড়ে অরুনার হাতে থেকে যায়। অভি পেছনে না তাকিয়ে সোজা, চেক ইন করার দিকে হাতা দেয়।
পেছন থেকে অরুনা ডুকরে কেঁদে ওঠে, “আজ আমি আমার জীবনের সব কিছু হারিয়ে ফেলেছি অভি।”
সিকুরিটি চেক করার আগে শেষবারের মতন অরুনার জল ভরা চোখের দিকে তাকায়। চোখের মণি, প্রিয় বান্ধবী অরুন্ধতি ব্যানারজির জল ভরা চোখ ওর দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে।
প্লেন রানওয়ে দিয়ে দৌড়তে শুরু করে। অভি দাঁতে দাঁত পিষে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। প্লেনের ঝন ঝন আওয়াজ যেন ওর বুকের পাঁজরের ভাঙ্গা আওয়াজ মনে হয়। একটা একটা করে ভাঙ্গে ওর শরীরের হাড়। বারে বারে মাথা পেটায় সিটের পেছনে। আগে এক বার এই প্লেন অভিকে নিয়ে উড়েছিল পরীর সাথে অজানার পানে ভ্রমনে। সেই একই প্লেনে করে উড়ে ও ফিরে পেয়েছিল প্রানের বান্ধবীকে। কিন্তু সেইদিনের উড়ান বাকি দিনের উড়ানের চেয়ে অনেক অনেক আলাদা, এবারে ওকে সবকিছু ছেড়ে যেতে হবে, সাধের প্রান প্রেয়সী আর চোখের মনি দেবী অরুন্ধুতি।
শেষ পর্যন্ত প্লেনের চাকা উঠে গেল প্লেনের দেহে। অভির শরীর যেন এক বিশাল ধাক্কা খেল, যেন এক লোহার শেকল ছিঁড়ে গেছে অবশেষে। মাথার মধ্যে সেই লোহার শেকলের শত সহস্র টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে। এতদিন যা যা প্রতিজ্ঞা করেছিল অভি, সব যেন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেল প্লেনের ওড়ার সাথে সাথে।
অভি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে ওর প্রেয়সীর জন্য একটা কুঠির বানিয়ে দেবে।
অভির সুটকেসে ভাঁজ করে রাখা প্রেয়সীর ছবি যেটা শেষ করতে পারেনি।
অভি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে বুড়ো হলে ওরা দুজনে মিলে একসাথে বসে ওর ডায়রি পড়বে।
অভি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে প্রেয়সীর সাথে দোলনায় বসে বিকেলের চা খাবে সেই পাহাড়ের কুঠিরের সামনে।
অভি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে বয়স কালে ওরা কি বৃদ্ধাশ্রমে একসাথে থাকবে।
অভির সব প্রতিজ্ঞা সেইদিন ভেঙ্গে যায়।
ঝাপসা চোখের সামনে তিন খানি চেহারা ভেসে ওঠে।
পরীর জল ভরা লাল চোখ, দু গাল বেয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে, হৃদয় ভেঙ্গে সহস্র টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে পরীর।
অরুন্ধুতির হৃদয় বিদারক কান্নার আর সেই ডাক।
মায়ের ক্রোধিত নয়ন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।