তোমাকে | মুন্নি আক্তার প্রিয়া | পর্ব – ৩৫

বাইরে পাখিদের কিচিরমিচিরের সাথে বাড়িতে সকলের শোরগোলও শোনা যাচ্ছে। পরী ঘুম থেকে ওঠে গোসল সেরে নিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচরাচ্ছিল তখন তিথি দরজায় নক করে। পরী দরজা খুলে দিতেই তিথি বলে,

“আগেই উঠে পড়েছ?”
“হুম।”
“ভাইয়া ওঠেনি?”
“না। ঘুমাচ্ছে এখনো।”
“ডেকে তোলো। নাস্তা করার জন্য তোমাদের ডাকছে সবাই।”
“আচ্ছা আসছি।”
তিথি চলে যাওয়ার পর পরী দরজা চাপিয়ে দেয়। তুর্যকে বেশ কয়েকবার ডাকে। তুর্যর হুশই নেই। ঘুমে কাতর হয়ে আছে একদম। পরী মেজাজ খারাপ করে কাছে যায়। হাতে একটা চিমটি দিতেই তুর্য “উহ্” বলে শব্দ করে ওঠে। চিমটি দেওয়া জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“আমি এমনিই উঠতাম এখন। চিমটি দিলে কেন?”
“কখন থেকে ডাকছি আমি?”
“আমি শুনেছি তো।”
“তাহলে উঠোনি কেন?”
তুর্য এবার পরীকে কাছে টেনে বলে,
“দূর থেকে ডাকছিলে তাই উঠিনি।”
পরী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“ফাইজলামি বাদ দিয়ে উঠো এখন। বাইরে সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
“অপেক্ষা করতে দাও। সবাই জানে আমরা নতুন বিবাহিত দম্পতি। লেট তো আমাদের হবেই।”
“তুমি এখন উঠবে কী না?” চোখ পাকিয়ে বলল পরী। তুর্য বিড়বিড় করে বলে,
“এই মেয়ে পুরাই আনরোমান্টিক!”
পরী ধমক দিয়ে বলে,
“এখনো উঠোনি! আবার বিড়বিড় করে কী বলো?”
“বললাম তোমায় খুব সুন্দর লাগছে।”
“জানি আমি। এখন উঠো। আমি ড্রয়িংরুমে গেলাম।”
পরী আর অপেক্ষা না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে তুর্য ডাকলেও পরী দাঁড়ায়নি। যতক্ষণ রুমে থাকবে ততক্ষণই জ্বালাবে। উঠবেও না বিছানা থেকে। তাই বাধ্য হয়ে পরী একাই এসেছে। পরী মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়। ড্রয়িংরুমে মুরুব্বি যারা আছে সকলকে সালাম করে। নানী শ্বাশুরী বলেন,
“কীগো সতীন আমার জামাই কই?”
পরী একবার তাকিয়ে লজ্জামিশ্রিত হাসে। মাথা নিচু করে আস্তে বলে,
“আসছে।”
“আইচ্ছা ওয় আসুক। তুমি আমার সাথে রুমে চলো। আমায় পান বানিয়ে দিবা।দেখি কেমন পান বানাতে পারো।”
উত্তরে পরী কিছু বলে না।ঠোঁটের কোণে হাসি। নানী পরীর হাত ধরে নিয়ে যায়। রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে পানের বাঁটা সামনে দেয়। পরী মনোযোগ দিয়ে পান বানাচ্ছে। নানী বলেন,
“আমার তুর্যর পছন্দ আছে। তোমার নামের লগে তোমার একদম মিল আছে। তুমি আসলেই পরী। শুনো নাতবৌ, আমি তিথির কাছে সব শুনছি আগের ঘটনা। আমার মাইয়া তাহমিনা ছোট থেইকাই বদমেজাজি। কিন্তু মন ভালা আছে। একবার মন জয় করতে পারলেই কেল্লাফতে। তোমারে আমার খুব পছন্দ হইছে তাই বলতাছি, শ্বাশুরীর মন জুগাই চলবা। যত দূরে সরাইতে চাইব ততই কাছে ঘেঁষে থাকবা।”
“আপনার সব কথা মেনে চলব নানী।” বলে পান এগিয়ে দেয়। নানী আয়েশ করে পান খায়। তুর্য আসার পর পরীর ডাক পড়ে। খাওয়ার জন্য ডাকতে আসে তিথি।
খাওয়া শেষ করে সবাই বৌভাতের আয়োজনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পরীর দৃষ্টি কখন থেকে একটা বাচ্চার ওপর। কিন্তু লজ্জায় ঐদিকে যেতে পারছে আর বাচ্চাটাকেও কোলে নিতে পারছে না। তুর্যও খেয়াল করেছে বিষয়টা। বাচ্চাটি তুর্যর চাচাতো বোন মেঘলার। তুর্য মেঘলার কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে আসে। পরীর কোলে দিয়ে বলে,
“কখন থেকে দেখছিলাম তাকিয়ে আছো।”
পরী কোলে নিয়েই আগে ইচ্ছে মতো চুমু খায়। কী গুলুমুলু বাবু! তুর্য ফিসফিস করে বলে,
“বাচ্চা এত পছন্দ?”
পরী তুর্যর দিকে তাকায়। ওর চোখেমুখে দুষ্টুমি। নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা বলবে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“খুব বেশিই পছন্দ। কিন্তু খবরদার! বাজে কিছু বলবে না এখন।”
পরীর কথায় শব্দ করে হাসে তুর্য। পরী বাবুকে রুমে নিয়ে যায়। যা দেখে তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এতা তি?(এটা কী?)”
বোঝা যায় নতুন কথা শিখতেছে। কী আদুরে করে কথা বলে। পরীর ইচ্ছে করে আদর করতে করতে খেয়েই ফেলতে। দাঁত কিড়মিড় করে শুধু। রুমে নিয়ে দুজনের খুনসুটি চলে। পরীর কথা শুনে খিলখিল করে হাসে শুধু। কী বোঝে এইটুকুন বাচ্চা কে জানে! বাবু হাপুড় দিয়ে যাওয়ার সময় খাটের সাথে মাথায় বারি লেগে ব্যথা পায়। চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। পরী তাড়াতাড়ি বাবকেু কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। কান্না শুনে মেঘলা ছুটে আসে। কোলে নিয়ে বলে,
“কী হয়েছে?”
“খাটের সাথে ব্যথা পেয়েছে।” বলে পরী।
মেঘলা আদর করে করে কথা বলছে। একটা সময়ে ওর কান্না থামে। ও’কে খাইয়ে দিয়ে পরীর রুমেই ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে রাখে। পরী তিথির সঙ্গেই রান্নাঘরে যায়। তাহমিনা বেগমও সেখানে ছিলেন। এই বাড়িতে আসা পর্যন্ত এখনো একটা কথাও তিনি পরীর সাথে বলেননি। নানীর কথা অনুযায়ী পরী বলে,
“আমি সাহায্য করি আম্মু?”
তিনি একবার পরীর দিকে তাকান। গম্ভীর মুখে বলেন,
“না। তুমি রুমে যাও।”
“করি না একটু সাহায্য!”
“বললাম তো লাগবে না। তুমি যাও। মানুষজন আসবে তোমায় দেখতে।”
“সমস্যা কী?  এসে দেখুক শ্বাশুরী-বৌমা হাতে হাতে কাজ করছে।”
ড্রয়িংরুম থেকে মানুষজনের কথা শোনা যাচ্ছে।
“রান্নাঘরে বউ-শ্বাশুরীর মান-অভিমান, খুনসুটি চলছে নাকি?”
উত্তরে নানী বলে,
“হ। বউ-শ্বাশুরীর সম্পর্ক হইব মা আর মাইয়ার মতো।”
.
.
পরীকে কেউ কোনো কাজ করতে দেয়নি। তুর্য ওর বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত। মেহনুবা ফোন করেছিল। বলেছে ওরা আসছে। কী করবে এইটুকু সময় ভেবে পাচ্ছে না। বাড়ির পাশ থেকে অনেকেই আসছে দেখতে। কী করবে ভেবে না পেয়ে রুমে চলে যায় আবার। বাবু তখনো পরীর রুমেই। ঘুমন্ত বাচ্চাকেই চুমু খায়। আদর করে। ঘুম ভেঙে যায় ওর। পরী পড়ে যায় বিপাকে। এবার কান্না থামাবে কীভাবে? পরী দেখেছে মেঘলা কাজ করছে। মেঘলা আসে আবার এঁটো হাতে। পরীকে বলে,
“ছাদ এখন ফাঁকা আছে। ও’কে নিয়ে একটু ছাদ থেকে ঘুরে এসো। আমার হাতে এখন কাজ আছে।”
মেঘলার কথামতো পরী বাবুকে নিয়ে ছাদে যায়। হাঁটাহাঁটি করে এটা ওটা দেখিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। বাবু কান্না থামিয়ে বলে,
“কুতু! কুতু!”
“কুতু? কুতু কী বাবা?”
“ঐতে কুতু।”
পরী এদিক-ওদিক তাকিয়েও বুঝতে পারছে না কুতু কাকে বলছে।”
একটু পর দিশানও ছাদে আসে। দিশান বলে,
“তুমি এখানে ভাবি। ভাইয়া তোমায় খুঁজছে।”
“কেন?”
“জানি না তো!”
“ওহ! গিয়ে বলো পরে আসছি।”
“আচ্ছা।” বলে দিশান চলে যাওয়া ধরে তখন পরী আবার ডাকে। জিজ্ঞেস করে,
“দিশান কুতু কী? ও বারবার কুতু কুতু বলছে।”
দিশান খিলখিল করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
“ও কুকুরকে কুতু বলে।”
“অ্যা? এখানে আবার কু্কুর নেই তো?”
“না, কুকুর নেই। টাইগার আছে।” বলে তুর্য। ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
“আমি তোমায় খুঁজছিলাম।”
পরী উত্তর দেওয়ার আগে বাবু নিচে নামার জন্য কান্নাকাটি করে। নিচের দিকে তাকিয়ে পরীর বুক কেঁপে ওঠে।।দিশান টাইগারকে নিয়ে এসেছে। পরী রাগ দেখিয়ে বলে,
“তুমি এই কুত্তাকে নিয়ে আসছ কেন?”
সঙ্গে সঙ্গে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে। পরী দু’পা পিছিয়ে যায়। তুর্য বলে,
“তোমায় কতবার বলেছি ওর নাম টাইগার। কুত্তা বলবে না।”
“আজব! একটা কুত্তার এত আত্মসম্মান কীসের?”
টাইগার আবার ঘেউ ঘেউ করে। পরী ভয়ে থতমত খেয়ে যায়। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে,
“কত কিউট টাইগার!”
পরীর কথা শুনে দিশান আর তুর্য হাসে। বাবু টাইগারের গায়ে হাত বুলাচ্ছে। আর বলছে, ‘কুতু’। পরী বিড়বিড় করে বলে,
“আমি শালা এই কুত্তার ভয়ে বাঁচি না। আর এইটুকু বাচ্চা কুত্তার গায়ে হাত বুলাচ্ছে! আমি কুত্তা বললেই দোষ। আর ও যে কুতু বলছে তাতে কিছু না। বদ কুত্তা!”
শেষের কথাটা জোরেই বলে পরী। টাইগার আজও পরীর আঁচল কামড় দিয়ে ধরে।
“মানে ভালো টাইগার!” ভয়ে চুপসে গিয়ে বলে পরী।
তুর্য জোরে জোরে শব্দ করে হাসে। পরীর হাত ধরে বলে,
“ও কিছু বলবে না পাগলী বউ। দাও ওর গায়ে হাত রাখো।”
পরী চিৎকার দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। তুর্য জোর করে হাত নিয়ে টাইগারের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য পরীকে সাজানো হয়েছে। সবাই রুম থেকে চলে যাওয়ার পর পরী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাজ দেখছিল। তখন রুমে আসে তাহমিনা বেগম। পরীর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যভাবে হাসেন। ভালোমতো পরীকে দেখে বলেন,
“সুন্দর লাগছে তোমায়।”
পরী মৃদু হাসে। তবে কথা বলার ভঙ্গি ভালো লাগছে না। তিনি আবার বলেন,
“এইযে আজ তুমি এই বাড়ির বউ। সেটা শুধুমাত্র আমার ছেলের জন্যই। তুমি হয়তো বুঝেছ এই বিয়ে আমি মন থেকে মেনে নেইনি। আবার হয়তো জানোও না। তবে এখন জেনে রাখো, তোমায় আমি মন থেকে মেনে নেইনি। আর কখনো মেনে নেবও না।”

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।