প্রিয়ম আর রোজের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে পরী। প্রিয়ম ইচ্ছে করে ক্ষেপাচ্ছে পরীকে। আর প্রিয়মের পাশে বসে হাসছে রোজ। পরী অভিমানিসুরে রোজকে বলে,
তোমাকে | মুন্নি আক্তার প্রিয়া | পর্ব – ৩৩
“ভাইয়া আমাকে ক্ষেপাচ্ছে আর তুমি হাসতেছ?”
উত্তরে রোজ বলে,
“কী আর করব বলো? ক্ষেপে গেলে যে তোমায় কী দারুণ লাগে!”
“হয়েছে, হয়েছে! আর বলতে হবে না। এখন বলো তোমরা কবে আসবে।”
“পাসপোর্ট, ভিসা করতে একটু তো সময় লাগবে বোন।” বলল প্রিয়ম।
পরী বলে,
“তাও কতদিন?”
“তোর বিয়ের ডেট তো পরীক্ষার শেষ হওয়ার পরের মাসে। বিয়ের তিন থেকে চারদিন আগে আসার চেষ্টা করব।”
পরী ক্ষেপে গিয়ে বলে,
“মানে কী? একমাত্র বোনের বিয়ে আর তুমি আসবে চারদিন আগে? আসা লাগবে না তোমার।”
প্রিয়ম হেসে বলে,
“আচ্ছা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করব। তবুও রাগ করিস না।”
“দেখা যাবে।”
“আচ্ছা এখন বল তোর কী কী লাগবে?”
“লাগবে তো অনেক কিছুই। ভাবিকে নিয়ে শপিং-এ গেলেই ভাবি কিনে নেবে। আর তুমি আমার জন্য বেশি বেশি চকোলেট আনবে। মনে থাকবে?”
“খুব থাকবে।”
“এই নাও এখন মায়ের সাথে কথা বলো।”
.
পরবর্তী পরীক্ষায় পরীর বাবা আর দিয়ে আসেনি কেন্দ্রে। সবার সামনেই তুর্যর বাইকে করে কেন্দ্রে গেছে পরী। প্রতিটা পরীক্ষাতেই তুর্য গিয়ে দিয়ে এসেছে। কখনো কখনো আবার পরীক্ষা শেষে নিয়েও এসেছে। যেদিন তুর্য যেতে না পারত সেদিন কলেজ বাসে করেই আসত। পরীর ক্লাসে মোটামুটি প্রায় সবাই এখন পরী আর তুর্যর বিয়ের কথা জানে। সকলেই ভীষণ খুশি। দুজনকে যে খুব মানিয়েছে এতে তো কোনো সন্দেহই নেই। সেদিন তো পরীর ক্লাস টিচারই জিজ্ঞেস করলেন,
“যে ছেলেটার সাথে বাইকে করে কেন্দ্রে যাও সে কে?”
পরী লজ্জা পেলেও বিনয়ীভাবে উত্তর দেয়,
“ম্যাম আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
তুর্যর সম্পর্কে সব শুনে ম্যাম খুশি হয়ে বলে,
“বাহ্! খুব ভালো। তোমাদের দুজনকে মানিয়েছে ভীষণ। আল্লাহ্ তোমাদের একে অপরের জন্যই বানিয়েছেন। বিয়ের পর সুখী হও অনেক। স্বামী, সংসার নিয়ে সুখে থাকো দোয়া করি।”
উত্তরে পরী সলজ্জিতভাবে মৃদু হেসেছিল।
শেষ পরীক্ষার দিন ট্রিটের আয়োজন করা হয়। পরীক্ষা শেষে পরীর কাছের ফ্রেন্ডস ও তিথির কাছের ফ্রেন্ডসদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যায়। তার কিছুক্ষণ পরই আসে প্রান্ত, তুর্য আর ওদের কাছের কয়েকজন বন্ধু। বলে রাখা ভালো প্রান্ত এখন আর রাজনীতিতে নেই। কোনো মারামারি, রংবাজিতেও নেই। এখন প্রান্ত তুর্যর সাথে একই অফিসে জব করে। সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সবাই। খাবার অর্ডার দিয়ে সবাই গল্পগুজবে মেতে ওঠে। টেবিলের এক কর্ণারে বসেছে মেহনুবা। ফোনে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে তুর্য পরীকে জিজ্ঞেস করে,
“ও তোমার বেষ্টফ্রেন্ড না?”
পরী মেহনুবার দিকে একবার তাকিয়ে তুর্যর দিকে তাকায়। বলে,
“হুম।”
“তাহলে আড্ডা না দিয়ে কার সাথে কথা বলছে?”
“এটা নতুন কিছু না। যেখানেই যাক না কেন বান্দায় সুযোগ পেলেই ফোনে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফুসুরফাসুর শুরু করে দেবে।”
“ওর বয়ফ্রেন্ডের নাম মেবি সাগর?”
“হ্যাঁ। ভাইয়ার বিয়েতে এসেছিল।”
“হু, মনে আছে।”
তুর্য উঠে গিয়ে মেহনুবার পাশে থাকা ফাঁকা চেয়ারটিতে বসে। তুর্যকে দেখে মেহনুবা হেসে বলে,
“কিছু বলবেন ভাইয়া?”
তুর্য ডান হাতের তর্জনী দ্বারা কপাল চুলকে বলে,
“কার সাথে ফোনালাপ চলছে শালীকা?”
মেহনুবা লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে,
“সাগরের সাথে।”
“ও’কে আসতে বলো এখানে।”
“বলেছিলাম। আসবে না। কী কাজ নাকি আছে!”
“দেখি আমি কথা বলি।”
মেহনুবা ফোনটা তুর্যর কাছে দেয়। সাগর তখনও লাইনে। ফোন নিয়ে তুর্য একটু দূরে চলে যায়।
প্রান্ত তিথি ও পরীর সব বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে বলে,
“ডিয়ার শালীকারা যত খুশি খেয়ে নাও আজ। সব বিল আজ তোমাদের দুই দুলাভাইয়ের।”
প্রান্তর এক বন্ধু বলে,
“বন্ধু খাওয়া-দাওয়া না হয় তোরা করালি। বলছিলাম যে, শালী দিবি না আমাদের? না মানে আমরা তো ভাই-ব্রাদার লাগি আমাদেরও তো একটা হক আছে বল?”
উত্তরে পরীর বান্ধবী বলে,
“যদি এই দুই দুলাভাইর মতো প্রেমিক পুরুষ হতে পারেন তাহলে আমরা ভেবে দেখতে পারি।”
কথায় কথায় সকলের হাসির ধুম পড়ে যায়। পরীও সবার সাথে হাসিতে যোগ দেয়। হাসতে হাসতেই হুট করে সামনে চোখ যায়। সবার থেকে কিছুটা দূরে তুর্য দেয়ালের সাথে এক পা তুলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্যান্টের পকেটে দু’হাত রেখে গভীর মনোযোগে পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। তুর্যকে এমন মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরীর হাসি থেমে যায়। চোখেমুখে এখন লজ্জার আভাস। হুট করেই তুর্য ঠোঁট দুটো চোখা করে চুমু দেখায় পরীকে। এতে পরী থতমত খেয়ে যায়। একটু নড়েচড়ে বসে আশেপাশে তাকায়। কেউ আবার দেখল নাকি! আশেপাশে তাকিয়ে দেখে যে যার মতো ব্যস্ত। তার মানে কেউ খেয়াল করেনি। এরপর তুর্যর পাশ থেকে সাগরকে আসতে দেখা যায়। দুজনে একসাথেই আসে। তুর্য এসে পরীর পাশে বসে। সাগর বসে মেহনুবার পাশে। মেহনুবা এখনো জানে না সাগর যে আসবে। সকলের সাথে ফাইজলামি করায় ব্যস্ত ছিল। তখন সাগর কেঁশে বলে,
“ফাইজলামি অনেক করছেন ম্যাম, এখন এইদিকে তাকান।”
মেহনুবা পাশে তাকিয়ে চমকে যায়। পরমুহূ্তে তাকায় তুর্যর দিকে। তুর্য হেসে বলে,
“ফোনে প্রেম করার চেয়ে পাশাপাশি বসেই না হয় প্রেম করো এখন শালীকা।”
মেহনুবা খুশি হয়ে বলে,
“ইউ আর আ গ্রেট ব্রাদার-ইন-লো।”
কথার বলার মাঝে টেবিলের নিচ থেকে পরীর এক হাত শক্ত করে ধরে তুর্য। পরী ফিসফিস করে বলে,
“কী করছ?”
উত্তরে তুর্যও ফিসফিস করে বলে,
“এখনো তো কিছু করিনি। বিয়ের পর করব!”
পরী রাগ দেখিয়ে বলে,
“মুখে কিছু আটকায় না নাকি?”
“বউকে বলব মুখে কেন আটকাবে?”
পরী চোখ পিটপিট করে বলে,
“ওয়ে মিষ্টার, এখনো বউ হইনি ওকে?”
“বেশি বকবক কোরো না। তাহলে এখনই কাজি অফিসে নিয়ে বিয়ে করে রেখে দেবো।”
“এত সাহস?”
“আমার সাহস সম্পর্কে কোনো আইডিয়াই নেই তোমার। শুধু বিয়ে কী! ফুল নিয়ে গিয়ে ফুলসজ্জাও করে ফেলব।”
পরী তুর্যর মুখে হাত রেখে দাঁত কটমট করে বলে,
“বাজার থেকে একটা স্কচটেপ নিয়ে মুখে লাগিয়ে নিও প্লিজ।”
পায়ের সাথে কারো পায়ের স্পর্শ পেয়ে তিথি টেবিলের নিচে তাকায়। প্রান্ত জুতো খুলে তিথির পায়ের সাথে পা ঘষছে আর বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। তিথি ভ্রু কুঁচকে প্রান্তর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রান্ত যে তিথির অভিমূর্তি খেয়াল করেনি এমনটা নয়। আড়ালে ঠিকই দেখছে তিথি যে ফুলছে। বেশিক্ষণ আর না তাকিয়ে থাকতে পারে না। তিথির পানে তাকিয়ে বলে,
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
তিথি প্রান্তর কলার ধরে টেনে কিছুটা কাছে এনে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“কী হচ্ছে এটা?”
প্রান্ত অসহায়ের মতো করে বলে,
“কী হয়েছে?”
“এখন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারো না তাই না?”
প্রান্ত এবার তিথির কানে কানে বলে,
“পুরো মাছটাই গিলে খেতে পারি। দেখবে?”
তিথি ধাক্কা দিয়ে প্রান্তকে সরিয়ে দেয়। বিড়বিড় করে বলে,
“বেশরম!”
উত্তরে প্রান্ত খিলখিল করে হাসে। ঐদিকে তুর্যও হাসছে। শুধু দু’জনের সঙ্গীর মুখটাই রাগান্বিত। সবাই সেটা খেয়াল করে বলে,
“হলো কী তোদের?”
“সিক্রেট।”
একসাথেই বলল তুর্য আর প্রান্ত। এরপর দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে খিলখিল করে হেসে উঠল। বাকিরা কিছু না বুঝেও দুজনের হাসির সঙ্গে হেসে ফেলে।
.
.
সময়গুলো দুই জুটির এভাবেই আনন্দে কাটছিল। বিয়ের আর বেশিদিন নেই। কাল রাতের ফ্লাইটে দেশে ফিরছে প্রিয়ম আর রোজ। আত্মীয়-স্বজন সকলকেই দাওয়াত করা হয়ে গেছে।
বিকেলের দিকে তুর্য আর পরী হাঁটতে বের হয়েছে। সেই লেকে যেখানে প্রথম রাগ হয়েছিল পরীর তুর্যর ওপর। দুজনের হাঁটার মুহূর্তে তুর্য বলে,
“একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“কলেজে যেদিন তুমি গান গেয়েছিলে সেদিন আমি তোমায় মিথ্যা বলেছিলাম। তুমি ভালো গান গাওনি এটা বলেছিলাম একান্তই তোমায় রাগানোর জন্য। কিন্তু আজ সত্যিটা বলছি সেদিনই আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম তোমার প্রতি। কিন্তু আমার একটা পিছুটান ছিল। আমার আগের গার্লফ্রেন্ড রিনি। ও যতই এড়িয়ে চলত আমি তো সিরিয়াস ছিলাম। যদি তখন আমি সিঙ্গেল থাকতাম তাহলে নির্ঘাত সেদিনই আমি তোমার প্রেমে পরে যেতাম। সেদিন বাসে যে হিজরাদের বলেছিলাম ‘তুমি আমার বউ হও’। আসলে এটা আমি আদৌ বলতে চাইনি। আমার মুখ দিয়ে কেন যেন এই শব্দটাই বের হয়েছিল। এরপর ডাকাতদের কবলে পরে যখন গ্রামের একজনের বাসায় উঠি। সে রাতে তুমি গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে ছিলে। হারিকেনের মৃদু আলোয় তোমার মুখটা দেখে আমার বুকে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছিল। বারবার না চাইতেও তোমার মায়ায় আটকে যাচ্ছিলাম।”
পরী হাঁটা থামিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সঙ্গে তুর্যও দাঁড়িয়ে পড়ে। পরী বলে,
“এসব আগে বলোনি কেন?”
“আগে কখনো বলতে ইচ্ছে হয়নি। অনুভূতিগুলোকে নিজের মনেই রাখতে চেয়েছিলাম। আজ কেন জানি মন সায় দিল অনুভূতিগুলো তোমাকে জানানোর জন্য।”
এরপর পরীর দু’হাত ধরে বলে,
“পরী! আগের ক্ষতগুলো তুমি আমার জীবনে এসে সারিয়ে তুলেছ। তোমায় আমি কতটা ভালোবেসে ফেলেছি তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। যতবার বলি ভালোবাসি ততই কম মনে হয়। ইচ্ছে হয় সারাক্ষণ বলি ভালোবাসি, ভালোবাসি। পরী,যেমন সিচুয়েশনই আসুক না কেন কথা দাও কখনো আলাদা হওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেবে না? দোষ আমার হলে যা শাস্তি দেবে মেনে নেব কিন্তু তোমায় ছাড়া আমি থাকতে পারব না।”
“আর আমি তোমায় ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারি না তুর্য।