রেহেনা বেগমের চোখ ছলছল করছে। মেয়ের গায়ে এই পর্যন্ত কোনোদিন পরীর বাবা হাত তোলেনি। আজ এই প্রথম মারলেন। বাবা ফের রাগ দেখিয়ে বলেন,
তোমাকে | মুন্নি আক্তার প্রিয়া | পর্ব – ২৯
“তোর ফোন কোথায়?”
রেহেনা বেগম বলেন,
“ওর ফোন দিয়ে তুমি কী করবে?”
“ওর ফোন আমার কাছে থাকবে। তুর্যর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখতে পারবে না।”
“বেশিই বাড়াবাড়ি করছ না তুমি? কাল বাদে পরশু ওর পরীক্ষা। কত সাজেশন দরকার হয়।”
“সেটা আমি দেখব।”
এই বলে তিনি পরীর রুমে যান। পরীর ফোন নিয়ে সুইচড অফ করে নিজের রুমে নিয়ে যান। আলমারির লক খুলে ড্রয়ারে ফোন রেখে লক করে রাখে। পরী তখন থেকে কেঁদেই চলেছে। রেহেনা বেগম পরীকে রুমে নিয়ে যান। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“কান্না করে না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পরী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আব্বু আমায় যত খুশি মারুক আমার আফসোস নেই। কিন্তু কেন তুর্যর থেকে আমায় আলাদা করতে চাইছে বলো?”
রেহেনা বেগম কী উত্তর দেবেন ভেবে পায় না। শুধু চোখের পানিটুকু লুকিয়ে পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বিছানা ঠিক করে পরীকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়েন। পরীর চুলে বিলি কেটে কেটে পরীকে ঘুম পাড়িয়ে দেন।
.
একের পর ফোন দিয়েই চলেছে তুর্য। বারবার ফোন বন্ধ পাচ্ছে। হুট করে কী হলো কে জানে। মনের ভেতর ভয় করছে।রাতটুকু অপেক্ষা করা ছাড়াও আর কোনো উপায় নেই। তাই চিন্তা নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তুর্য।
———————-
ফজরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় পরী। ওজু করে নামাজ আদায় করে পড়ার টেবিলে বসে। বারবার তুর্যর কথা মনে পড়ছে। নামাজ পড়া শেষ করে দুজনে কিছুক্ষণ কথা বলত প্রতিদিন। কিন্তু আজ সময়টা বিপরীত। কী করছে এখন তুর্য? নিশ্চয়ই চিন্তা করছে ফোন বন্ধ পেয়ে। আচ্ছা মায়ের ফোন থেকে একবার কল দিলেই তো হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। পরী রান্নাঘরে চলে যায়। মা তখন রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করছিলেন। পরীকে দেখে বলেন,
“চা খাবি?”
পরী করুণস্বরে বলে,
“তুর্যর সাথে কথা বলব মা। তোমার ফোনটা দাও না।”
রেহেনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
“আমার ফোনটাও কাল রাতে নিয়ে গেছে। তোর বাবা বেশিই বাড়াবাড়ি করছে।”
পরীর মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়। মন খারাপ লুকিয়ে বলে,
“ওহ। থাক তুমি আব্বুর সাথে এসব নিয়ে তর্ক কোরো না।”
পরী চলে আসা ধরলে পেছন থেকে রেহেনা বেগম ডাকেন। পরী থেমে গেলে তিনি এগিয়ে পরীর দুই বাহু ধরে বলেন,
“কখনো মনোবল হারিয়ে ফেলবি না। নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকবি।”
পরী মৃদু হাসে। রেহেনা বেগম পরীর গালে হাত বুলিয়ে বলেন,
“গিয়ে পড়তে বোস। আমি চা নিয়ে আসছি।”
পরী গিয়ে পড়তে বসলেও চোখটা বারবার ঘড়ির দিকে যাচ্ছে। মন বলছে তুর্য ফোন বন্ধ পেয়ে মেহনুবাকে কল করেছে বা করবে। মেহনুবা অবশ্যই বাসায় আসবে কী হয়েছে তা জানতে। তখন ওর ফোন থেকেই একটুখানি কথা বলা যাবে তুর্যর সাথে। মনটা অস্থির হয়ে আছে কখন আসবে মেহনুবা! কিছুক্ষণ পড়ে ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ভোরের আলো ফুঁটে সূর্যের মৃদু আলো ঘরের আনাচেকানাচে প্রবেশ করছে। পাখিরা কিচিরমিচির করতে করতে নীল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিনের এই দৃশ্যগুলো দেখে মন খুশিতে নেচে উঠলেও আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই আজ। মনের প্রতিটি কোণে আজ ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর ভয়। আচ্ছা ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয় এত প্রবল হয় কেন? মৃত্যুর যন্ত্রণার মতো হৃদয়বিদায়ক।
অবশেষে সময় গড়িয়ে নয়টা বাজে। পরীর মনের কথাই সত্যি। ঐতো কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মেহনুবা আসছে। আব্বু তো সাতটা বাজেই অফিসে চলে গেছে। তুর্যর সাথে কথা বলতে কোনো সমস্যাই নেই এখন। কলিংবেলের শব্দ বাজতেই পরী দৌঁড়ে যায় দরজা খুলতে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে জড়িয়ে ধরে। মেহনুবা ব্যস্ত হয়ে বলে,
“ঠিক আছিস তুই?”
মুহূর্তেই পরীর চোখে পানি পরিপূর্ণ হয়ে টলমল করছে। মেহুর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে যায়। ধরে আসা গলায় বলে,
“তোর ফোন! তোর ফোন কোথায়?”
“এত অস্থির হচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?”
“তুর্যর সাথে কথা বলিয়ে দে আগে আমায় প্লিজ।”
মেহনুবা আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে পরীর হাতে দেয়। পরী তুর্যর নাম্বারে ডায়াল করে। তুর্য কল কেটে দিয়ে কলব্যাক করে। পরী ফোন রিসিভ করতেই তুর্য বলে,
“হ্যালো।”
তুর্যর কণ্ঠস্বর শোনার পর পরীর চোখ থেকে পানি টপটপ করে গাল বেয়ে পড়ে। কান্নার শব্দ শুনে তুর্য বলে,
“পরী! পরী কাঁদছ কেন তুমি? কী হয়েছে? তোমার ফোন বন্ধ কেন?”
পরী তখনও কেঁদেই চলেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে রাতের সব ঘটনা খুলে বলে তুর্যকে। তুর্য তৎক্ষণাৎ পরীর বাসায় আসতে চাইলে পরী বারণ করে। হুটহাট করে কিছুই করা যাবে না। ভেবেচিন্তে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে যাই হোক না কেন, কেউই পরিবারের বিরুদ্ধে যাবে না। যত কষ্টই হোক, পরিবার রাজি করিয়েই দুজনে বিয়ে করবে। তুর্যও পরীর কথার বাহিরে যায় না। পরীর কথা মেনে নেয়। পরীক্ষা চলাকালীন দুজনের কথা বোধ হয় আর হবে না। আর হলেও সেটা সুযোগ বুঝে। তুর্য অনেককিছু বুঝিয়ে দিল পরীকে। কোনো রকম পাগলামি করতে বারণ করেছে। যেভাবেই হোক তাহমিনা বেগম ও পরীর বাবাকে রাজি করাবে বলে আশ্বস্ত করেছে তুর্য।
.
.
পরেরদিন পরীর প্রথম পরীক্ষা। বাবা-মাকে সালাম করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয় পরী বাবার সাথে। কলেজ পর্যন্ত বাবাই পৌঁছে দেয়। কলেজ থেকে পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য কলেজ বাসের ব্যবস্থা করেছে। পরীকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিলেন। এবং ঠান্ডা মাথায় পরীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বললেন। পরীর দু’চোখ আশেপাশে শুধু তুর্যকেই খুঁজে চলেছে। কিন্তু কোথাও তুর্য নেই। পরীর পাশে বসেছে মেহনুবা। বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। মেহুকে ডেকে পরী জিজ্ঞেস করে,
“তুর্যর সাথে আর কথা হয়েছিল?”
“না রে।”
কেন্দ্রের সামনে গিয়ে বাস থামে। বাস থেকে নেমেই রাস্তার ওপাশে তুর্যকে চোখে পড়ে। কিন্তু এত মানুষের ভীড়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। পরী রাস্তা পার হতে গেলে স্যার ডেকে বলেন,
“কোথায় যাচ্ছ?”
পরী একবার পিছনে তাকিয়ে বলে,
“আসছি স্যার। দু’মিনিট।”
পরী রাস্তার ঐ পাড়ে যেতেই দেখতে পায় প্রান্তকে। সাথে তিথিও আছে। আশেপাশে তাকিয়ে তুর্যকে খুঁজতে দেখে প্রান্ত বলে,
“কাউকে খুঁজছ?”
পরী না তাকিয়েই উত্তর দেয়,
“ও কোথায়?”
“কে? তুর্য? ও তো আসেনি।”
“ও এসেছে। আমি দেখেছি।”
“ভুল দেখেছ।”
“কখনোই না। আমি শিওর ঐটা তুর্যই ছিল। কোথায় গেল!”
“এইতো ম্যাম, আপনার পাশেই।”
পরী চকিতে পাশে ফিরে তাকায়। তুর্য দাঁড়িয়ে আছে। খুশি আর উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরতে গেলে তুর্য থামিয়ে দিয়ে বলে,
“এই কী করছ? এটা পাবলিক প্লেস। কত মানুষ দেখেছ?”
পরী আশেপাশে তাকিয়ে ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে ফেলে। তুর্য হাত ধরে টেনে পাশে থাকা দোকানের আড়ালে টেনে নিয়ে যায় পরীকে। শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। এতে পরীর কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। তুর্য চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“কান্না থামাও প্লিজ। তোমার চোখের পানি সহ্য হয় না আমার। কষ্ট হয়।”
ক্রন্দনরত অবস্থায় পরী বলে,
“আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না তুর্য। একটাদিন তোমায় দেখিনি। অথচ আমার কাছে মনে হচ্ছে এক যুগ হয়ে গেছে। এই দূরত্ব আমি সহ্য করতে পারব না।”
“তুমি তো আমার কাছে বলতে পারছ। আমি কার কাছে বলি বলো তো? আমার যে কতটা কষ্ট হয় সেটা কীভাবে বোঝাব?”
“আমি কী করব বলো?”
“এখন কিছুই করতে হবে না। এখন শুধু মনোযোগ দিয়ে পড়ো আর পরীক্ষা দাও। আমি মেহনুবার কাছে একটা ফোন দেবো। প্রাইভেট পড়তে যাবে যখন তখন ওর থেকে নিয়ে নেবে। আর বাসায় ঐটা লুকিয়ে রাখবে। যখন আব্বু থাকবে না বাসায় তখন ফোন দেবে। মনে থাকবে?”
“হু।”
“এখন কান্না থামাও আমার পরীবানু।”
কান্নার মধ্যেই পরী হেসে ফেলে। বলে,
“মাঝে মাঝে মা’ও বলে পরীবানু।”
তুর্যও হেসে বলে,
“এখন তো সব ঝামেলা মিটে গেছে? তুমি শুধু বাড়িতে বিয়ে আটকানোর দায়িত্ব নাও। দুই পরিবার রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।”
তিথি এসে বলে,
“ভাইয়া এখন যেতে হবে। সীট খুঁজতে হবে তো। মেহনুবা পরীকে ডাকতে এসেছে।”
তুর্য পরীর হাত চেপে ধরে বলে,
“সব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দেবে। ভালো রেজাল্ট করা চাই। নয়তো বাচ্চাকাচ্চাকে পড়াবে কীভাবে?”
পরী তুর্যর পিঠে কিল দিয়ে বলে,
“ফাজিল।”
তুর্য হাসে। সাথে পরীও।