মুগ্ধর পরিবারের সবাই যেমন ছিল ওর বাবা ছিল তার পুরোপুরি উলটো। উনি খুব সিরিয়াস টাইপের মানুষ। কিন্তু মুগ্ধ বেশ সাবলীল ছিল ওর বাবার সাথে। তিতির ভাবতেও পারেনি এতবড় একটা ইন্টারভিউ ওকে দিতে হবে ওনার কাছে। সকালবেলা ১০/১১ টার দিকে উনি এসেছিল। তিতির-মুগ্ধ তখন বাগানে ছিল। বাবা ওদের দেখতে পায়নি। কিন্তু ওরা দেখতে পেয়েছিল। ওনার ইউনিফর্ম দেখে তিতির মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করেছিল,
-“তোমার বাবা পুলিশ?”
মুগ্ধ হেসে বলেছিল,
-“হ্যা।”
-“কই কখনো বলোনি তো!”
-“তুমিওতো কখনো জিজ্ঞেস করোনি।”
-“তা বলে তুমি বলবে না?”
-“বাদ দাও, শোনো মায়ের মত ওনাকেও পা ধরে সালাম করতে যেও না যেন। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ ভাববে। এমনি মুখে সালাম দিও।”
তিতির পরে বুঝেছিল মজাটা। ওর বাবা এত এত কোশ্চেন করেছিল যে তিতিরের মনে হচ্ছিল ও কোন আসামী। প্রশ্নপর্ব শেষ হতেই উনি বলেছিল,
-“মুগ্ধ এমন সময় হুট করে তোমাকে নিয়ে আসলো যখন আমি খুবই ব্যস্ত। শুধু তোমার সাথে দেখা করার জন্যই আমি বাসায় এসেছি। আবার লাঞ্চের পরই চলে যাব ৩ দিনের জন্য। তবে এই তাড়াহুড়ো করে আসাটা সার্থক। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”
লাঞ্চ করেই বাবা চলে যায়। যাওয়ার সময় মুগ্ধকে সাথে করে নিয়ে যায়। তিতিরের বিকালটা মা আর পিউএর সাথে সুন্দরভাবে কেটে যায়। ওরা এত আপন করে নিয়েছে যে তিতিরের মনেই হচ্ছে না ও প্রথমবার এসেছে।
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে গেল। মুগ্ধর আসার খবর নেই। তিতির মুগ্ধকে ফোন করল কিন্তু মুগ্ধ ধরলো না। কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ কলব্যাক করলো,
-“আমার তিতিরপাখি টা কি করছে?”
-“তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
-“আমাকে বাবা একটা কাজে পাঠিয়েছিল। কাজ শেষ, আমি ফিরছি ৪০-৪৫ মিনিটের মধ্যেই।”
-“তাড়াতড়ি আসো না। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”
-“সারপ্রাইজ? আমি যদি খুব তাড়াতাড়ি চালাই তাহলেও তো ৩০ মিনিট লাগবে। তার আগে তো পারবো না বাবা।”
-“এই না না। আস্তে চালাও, কোনো সারপ্রাইজ নেই।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,
-“আচ্ছা, বাইকটা তুমি ঢাকা নিয়ে যাওনা কেন? তাহলে এতদূর থেকে অফিসে যেতে কষ্ট হতো না। দেড়ঘন্টা আগেও রওনা দিতে হতো না।”
-“এটাতো বাবার বাইক! মাকে পেছনে নিয়ে ডেটে যায়।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ আরো বলল,
-“আমাদের এদিকটা শহর থেকে কতদূরে দেখেছো? বের হওয়ার সময় রিক্সা,সিএনজি যে কোনটাই পাওয়া মুশকিল তখন এই বাইকটাই কাজে দেয়। পিউ, স্নিগ্ধ সবাই চালাতে পারে।”
-“সিরিয়াসলি?”
-“হুম।”
-“বাহ!”
-“তাহলে তুমিও একটা বাইক কিনে নাও।”
-“নাহ, আমি একটা গাড়ি কিনবো।”
-“ও।”
-“মনে মনে কি ভাবছো গাড়ি কেনার এত টাকা কোথায় পাবো?”
-“না না তা কেন ভাববো?”
-“ভাববে না কেন? আমার বাবার তো অনেক টাকা নেই, আমারও নেই। গাড়ি কেনার টাকা কোথায় পাব ভাবা উচিৎ তোমার!”
-“কোথায় পাবে?”
-“নতুন অফিস আমার কাজে খুবই সন্তুষ্ট! এক বছরের মাথায় একটা প্রমোশন হতে পারে। হয়ে গেলে আমি ইচ্ছে করলে কার লোন অথবা হোম লোন নিতে পারবো। তখন আমি কার লোন নিব।”
-“ওহ।”
-“শোনো তিতির, এরকম হয়ে থাকলে কিন্তু তোমার সংসার ভেসে যাবে।”
-“মানে? বুঝিনি।”
-“মানে এইযে তোমার হাসবেন্ড কি করছে, কেন করছে, কিভাবে করছে তুমি তার খবর রাখবে না? আমি বললাম গাড়ি কিনবো তুমি জিজ্ঞেসও করলে না কিভাবে কিনবো! একটু কৌতূহল থাকা ভাল। তা নাহলে তোমার হাসবেন্ড দুনিয়ার আকাম করে বেড়ালেও তুমি টের পাবে না। হাসবেন্ডের এধরণের সকল কার্যকলাপ সম্পর্কে জানার অধিকার ওয়াইফের আছে। ”
তিতির হেসে বলল,
-“তোমার ব্যাপারে আমার অনেক কৌতূহল। কিন্তু তোমার কাজের ব্যাপারে কোন কৌতূহল নেই। আমি জানি তুমি যাই করবে ঠিকই করবে, তুমি কোনো অন্যায় করতেই পার না।”
-“বিঃশ্বাস ভাল, অন্ধবিশ্বাস ভাল না।”
-“তেমনি ভালবাসা ভাল, অন্ধভালবাসা ভাল না। তুমি আমাকে অন্ধভাবে ভালবাসো, আমি তোমাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করি.. যাও কাটাকাটি।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির বলল,
-“এসব কথা বলে আর সময় নষ্ট করোনা প্লিজ, আসো।”
-“এত তাড়া কিসের? চুমু দিবে?”
-“এই আমি রাখি।”
তিতির ফোন রেখে দিল। তিতির মনে মনে বলল, ‘আমি তো নিজে থেকে দিতে পারব না। কিন্তু তুমি যদি চাও আজ আর বাধা দেবনা আমি।’
মুগ্ধ ফিরলো প্রায় ৩৫ মিনিট পর। রাত প্রায় ১০ টা বাজে। বাড়িতে ঢুকেই দেখলো ড্রইংরুমে পিউ টিভি দেখছে। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“সবাই কোথায় রে?”
-“সবাই নাকি ভাবী?”
-“মারবো এক চড়। বাসায় ঢুকে সবসময়ই তো আমি সবার খোঁজ নেই। এটা কি নতুন নাকি?”
-“আচ্ছা সরি, স্নিগ্ধ পড়তে বসেছে। মা আর ভাবী রান্নাঘরে। ভাবী যেন কি বানাচ্ছে।”
-“ও।”
মুগ্ধ নিজের ঘরে চলে গেল ফ্রেশ হতে। তিতির টের পেয়েছে মুগ্ধ এসেছে। ও এখন মাছের কাবাব বানাচ্ছে যেটা মুগ্ধ খুব পছন্দ করেছিল। তাই এখনো ওর সামনে যেতে পারেনি। বুকটা ঢিপঢিপ করছে যেন প্রেম হওয়ার পর ওদের প্রথম দেখা হতে যাচ্ছে। মুগ্ধ এসেছে শুনে মা ওর জন্য চা বানাচ্ছিল। শেষ হতেই বলল,
-“এই নাও, চা টা মুগ্ধকে গিয়ে দাও।”
-“এত রাতে চা?”
-“ও খায়। বাসায় ফিরেই চা খায়। তাতে নাকি ও এনার্জি পায়।”
-“ওহ, আচ্ছা।”
-” আর তোমাকে দেখে কি বলল আমাকে বলতে হবে কিন্তু। লজ্জা পেলে চলবে না।”
একথা শুনেই তিতির লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। মা ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আচ্ছা লজ্জা পেও। লজ্জাতেই তোমাকে মানায়, তাছাড়া এই যুগে লাজুক বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবে কে জানে পরে কেমন হয়ে যাবে।”
তিতির কিছু বলল না। মুচকি হাসলো। মানুষটা কত সরল নাহলে ভবিষ্যতের চিন্তার কথা এভাবে কেউ মুখের উপর বলে! মা আবার বলল,
-“যাও যাও, নাহলে চা এখানেই ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
তিতির চা নিয়ে মুগ্ধর ঘরে ঢুকলো। মুগ্ধ পিছন ফিরে হাতমুখ মুছছিল। দরজা খোলার শব্দ পেতেই ও পিছনে তাকিয়ে ওর চোখ আটকে গেল তিতিরকে দেখে। গাঢ় নীল পাড়ের নীল রঙের তাতের শাড়ি পড়ে আছে তিতির। শাড়ি পড়া এই প্রথম দেখছে। হাতে চায়ের কাপ। কানে গলায় গয়না পড়েছে, ওগুলো চেনে মুগ্ধ ওর মা ওর বউয়ের জন্য বানিয়ে রেখেছে আর হাতে দুটো চুরিও দেখা যাচ্ছে, ওগুলো ওর মায়ের। আর কোনো সাজগোজ নেই। চুলগুলো খোলা। তিতির জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুগ্ধর দিকে তাকাচ্ছে না। লজ্জা লাগছে। মুগ্ধর তো চোখে পলকই পড়ছে না, কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তিতিরকে একদম অন্যরকম লাগছে। কতক্ষণ যে তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই। তারপর খেয়াল হতেই হাতের টাওয়াল টা ফেলে দিয়ে মুগ্ধ তিতিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তিতির চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“তোমার চা।”
মুগ্ধ কাপটা ধরে টেবিলে রাখলো। তারপর তিতিরের আরো কাছে এসে তিতিরের মুখটা দুহাতে ধরে চোখে চোখ রেখে নিচু গলায় বলল,
-“একটা কথা রাখবে?”
মুগ্ধর গলা হালকা কাঁপছিল। তিতিরেরও একই অবস্থা। চোখ সরালো না। বলল,
-“হুম রাখবো, বলো।”
-“বিয়ের দিন থেকে প্রতিদিন তুমি শাড়ি পড়বে? আজীবন?”
-“হুম, তুমি বললে পড়বো।”
-“বউ হলে তোমাকে মারাত্মক লাগবে।”
তিতির এবার মাথা নিচু করে হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের চোখের উপর এসে পড়া চুলগুলোকে সরিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“এতবড় একটা সারপ্রাইজ পাব সত্যিই ভাবিনি।”