সকাল থেকে এখনো তন্দ্রা তার ঘর থেকে বের হয়নি। তুলিকে স্কুলের জন্য আজ মিসেস তাহেরা তৈরি করে খাইয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আজ থেকে তন্দ্রার সেমিস্টার শুরু হয়েছে। স্টাডি টেবিলে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে সে। এখন আপাতত পড়া ছাড়া তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছুই নেই। তন্দ্রা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একপলক সময় দেখে নিল। ঘড়িতে এখন দশটা বেজে পনেরো মিনিট। স্বাক্ষর তিনদিনের ক্যাম্প শেষে আজ সকাল সাতটার দিকে বাসায় ফিরেছে। জার্নি করে আসার ফলে টায়ার্ড সে। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় সটানভাবে শুয়ে পড়েছে। তন্দ্রা ঘর থেকে বের না হওয়ায় স্বাক্ষরের সাথে তার দেখা হয়নি। স্বাক্ষর আসার খবরটা তুলিই তাকে দিয়েছে।
ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা বাযে। তাহেরা মাহমুদ তন্দ্রাকে তৈরি হয়ে নিতে বললেন। মি. ইলিয়াস মাহমুদ এবং মি. ইউসুফ মাহমুদ অনেক আগেই নাস্তা করে অফিসে চলে গিয়েছেন। সাথে করে তুলিকে স্কুলে পৌঁছেও দিয়েছেন। তন্দ্রা বই পড়া বন্ধ করে আলমারি থেকে মেরুন রঙের গাউনটা বের করে। কদিন আগেই জামাটা সে উপহার পেয়েছে তবে কে দিয়েছে তার জানা নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জামাটাকে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে দেখছে‚ কেমন লাগবে পড়লে! এরপর সেটা নিয়েই ওয়াশরুমে চলে যায়। তন্দ্রা গোসল করেই বের হয় ওয়াশরুম থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছছে আর নিজেকে দেখছে। মেরুন রঙটা তার গায়ে ভালোই মানিয়েছে। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে লম্বা চুলগুলো তাড়াতাড়ি করে শুকিয়ে নিল তন্দ্রা। এরপর ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। সে ঘর থেকে বের হয়ে দেখল মিসেস তাহেরা তার জন্য প্লেটে খাবার বাড়ছেন। তন্দ্রা গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। তন্দ্রা বসতেই স্বাক্ষর এলো। ধূসর রঙা শার্ট পড়নে‚ চুলগুলো বাতাসে নড়েচড়ে উঠছে। ফর্সা গায়ে ধূসর রঙা শার্টটা যেন ফুটে উঠছে। গোসল করার ফলে দেখতে খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। তন্দ্রা গভীর ভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে স্বাক্ষরের কতবার পলক পড়েছে তাও গুনে ফেলেছে তন্দ্রা।
“এই জামা কবে কিনলি?”
মায়ের প্রশ্নে অবাক হয়ে গেল তন্দ্রা৷ সে তো ভেবেছিল তার বাবা মা হয়তো কিনে এনেছে। আমতা আমতা করে বলল‚
“আমার ঘরের বিছানার উপর ছিল। আমি ভেবেছি তোমরা দিয়েছ।”
স্বাক্ষর খাওয়া বাদ দিয়ে মিসেস সাহেরার দিকে তাকাল। মিসেস সাহেরা পানির গ্লাসটা তন্দ্রার দিকে এগিয়ে দিয়ে মিসেস তাহেরাকে বললেন‚
“আমি এনেছিলাম তন্দ্রার জন্য। জামাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল তাই।”
“ওহ তাই বল।”
এতোক্ষণে স্বাক্ষর যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। তন্দ্রার কেন জানি বিশ্বাস হলো না মিসেস সাহেরার কথা। চোখ ছোটো ছোটো করে একবার তাকাল স্বাক্ষরের দিকে। স্বাক্ষর দিব্যি নিজের মতো করে খেয়ে যাচ্ছে। তন্দ্রা আর কথা বাড়াল না। নাস্তা করেই স্বাক্ষর বাসা থেকে আগেই বের হয়ে এলো। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তন্দ্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। তন্দ্রা তার মা এবং বড়ো মা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এলো। স্বাক্ষর তাকে দেখা মাত্রই সোজা হয়ে দাঁড়াল। অপর পাশে গিয়ে তন্দ্রার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিল। তন্দ্রা বসতেই স্বাক্ষর গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। ক্ষীণ হেসে বলল‚
“তন্দ্রাবতী ইউ লুকিং বিউটিফুল।”
কথাটা বলেই স্বাক্ষর গাড়ি স্টার্ট দিল। এক্সামের জন্য কিছুটা টেনশন হতে শুরু করেছে তন্দ্রার। সে বসে থেকেই বাইরের দিকে তাকিয়ে দু’হাত কচলাতে শুরু করল। স্বাক্ষর তন্দ্রার অবস্থা বুঝতে পেরে গান ছেড়ে দিল।
এই মন কিছুই চায় না শুধু তুই হলেই চলে
নাম লিখিয়েছি বুঝি আমি তোর ঐ কপালে
ধরে মন শুধু বায়না তোকে দেখবে যে বলে
মন আর কিছুই চায় না শুধু তুই হলেই চলে
দুজনে ডুবে আছি…
দুজনে ডুবে আছি দুজনেরই মন গভীরে
যে বাধন বেধেছি তা কখনো যাবে না ছিড়ে
এদিকে তন্দ্রার এক্সামের জন্য কিছুটা টেনশন হচ্ছে তারওপর গম্ভীর মহারাজ মনের সুখে গান শুনছেন। তন্দ্রা চোখ ছোট ছোট করে বার কয়েক আড়চোখে স্বাক্ষরের দিকে তাকাল। এতে করে তার কোনো হেলদোল নেই বললেই চলে। সে নিজের মতো করেই ড্রাইভ করছে। তন্দ্রা ভেবে পায় না হঠাৎ করে স্বাক্ষরের রোমান্টিক গান শোনার মানে টা কী! রোমান্টিকতা যে তার বৈশিষ্ট্যের সাথে বড্ড বেমানান লাগছে। তন্দ্রার ঠিক হজম হচ্ছে না ব্যাপারটা। বিরক্ত হয়ে নিজের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গানটাকে অনুভব করতে থাকে। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। মুহূর্তটা ভালোই লাগছে তন্দ্রার‚ সাথে গানটাও।
তোকে ছুঁয়ে আমি বলে দিয়ে গেলাম
আমার আমি’টাকে তোকে লিখে দিলাম
আজ থেকে আমি যতটা না নিজের
তারও বেশি হলাম তোর ঐ হৃদয়ের
তোকে খুব ভালোবাসি…
তোকে খুব ভালোবাসি, ছুটে তাই কাছে আসি
দুজনের রবো দুজন, এভাবেই বারোমাসই
দুজনে ডুবে আছি, দুজনেরই মন গভীরে
যে বাধন বেধেছি তা কখনো যাবে না ছিড়ে
গান শোনার এক পর্যায়ে তন্দ্রা ঘুমিয়েই পরেছে। স্বাক্ষর নিজের কাঁধ থেকে তন্দ্রার মাথা সন্তপর্ণে সরিয়ে দিয়ে তাকে ডাকল। ঘুমের মাঝেই তন্দ্রার মাথা বার বার জানালার সাথে ধাক্কা লাগছিল তাই স্বাক্ষর নিজের কাঁধে তার মাথা রাখল। ভার্সিটি সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে পাঁচ মিনিট হতে চলল। স্বাক্ষর একবার হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে আবারও তন্দ্রাকে ডাকতে শুরু করল।
“তন্দ্রাবতী! আমরা এসে পড়েছি। উঠ!”
চোখ পিটপিট করে তন্দ্রা তাকিয়ে দেখে স্বাক্ষর তারই দিকে তাকিয়ে আছে। সে সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ব্যাগ হাতে নিয়ে স্বাক্ষরকে বলেল‚
“আসছি।”
“হুম! অল দ্য বেস্ট।”
তন্দ্রা মুচকি হেসে গাড়ি থেকে নেমে গেল। স্বাক্ষর তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তন্দ্রা ভার্সিটির ভেতর প্রবেশ করার বেশ কিছু সময় পর স্বাক্ষর গাড়ি নিয়ে চলে গেল। অফিস রুমের সামনে ইলোরা আর মুহিত তন্দ্রার জন্য অপেক্ষা করছিল৷ তিনজনের সিট এক সিরিয়ালেই পরেছে।
গোধুলি বিকেল। আকাশটা বেশ পরিস্কার। নীলাভ আকাশে পাখিরা নিজের খেয়াল খুশি উড়ে বেড়াচ্ছে। তন্দ্রা‚ ইলোরা আর মুহিত মাত্রই এক্সাম দিয়ে বের হয়েছে। গেইটের বাইরেই ফুচকা ভেলপুরি দোকান বসেছে। সাথে ঝালমুড়ি তো আছেই। তন্দ্রা দু প্লেট ফুচকা অর্ডার দেয়। মুহিত খাবে না‚ আগেই বলে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে দোকানদার মামা দু প্লেট ফুচকা দিয়ে যান। দেখতেও বেশ ঝাল ঝাল। মুহিত ফোন ঘাটতে ঘাটতে প্রশ্ন করে।
“এত ঝাল তোরা খাস কী করে?”
“এভাবে!”
বলেই একটা ফুচকা মুখে পুরে নেয় তন্দ্রা। ইলোরা তো আগেই খেতে শুরু করে দিয়েছে। অনেকদিন পরেই আজ দুজন একসাথে ফুচকা খাচ্ছে। ইলোরা ফুচকা চিবোতে চিবোতে বলল‚
“আমরা কীভাবে খাই তা তুমি খেলেই বুঝতে পারবে।”
“কেন?”
“এটা বলে বুঝানো যায় না রে পাগলা। খেয়েই দেখ।”
ইলোরা জোর করে একটা ঝাল দেওয়া ফুচকা মুহিতের মুখে পুরে দেয়৷ মুহিতও তা খেয়ে নেয়।
“পানিইইইইইই।”
মুহিতের চেচামেচিতে তন্দ্রা আর ইলোরা নিজেদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। তন্দ্রা উঠে গিয়ে পনেরো টাকা দিয়ে এক বোতল পানি কিনে নিয়ে এলো। মুহিত এক মুহুর্তেই পুরো পানি সাবাড় করে ফেলল। তন্দ্রা আর ইলোরার ফুচকা খাওয়া শেষ হতেই মুহিত বিল মিটেয়ে দিল। এরপর তন্দ্রা আর ইলোরা রিকশায় চড়ে বসল।
রাতে তন্দ্রা সবে মাত্র খাবার খেয়ে তার ঘরে এসেছে। তুলি তার হেয়ার ব্যান্ড আর চিরুনি নিয়ে আসে চুলে বেনী গাঁথার জন্য। তন্দ্রা তুলিকে দুই বেনী গেঁথে দেয়৷ তুলি ওয়াশরুম থেকে ব্রাশ করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। এতোক্ষণে তন্দ্রাও তার চুলে বেনী করে ফেলেছে। তন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে তুলি এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে। পরবর্তী এক্সাম আবার তিনদিন পর। তন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে শুতে নিবে এমন সময় কেউ দরজায় নক করে। অনুমতি পেয়ে স্বাক্ষর ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।
“কিছু কী দরকার ভাইয়া?”
“তোকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে।”
একটা জিনিস দেওয়ার কথা শুনেই তন্দ্রা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। চারদিন আগের ঘটনা মনে পড়ে যায়। সেদিন তো স্বাক্ষর একটা অসম্ভব কাজ করে ফেলেছিল। আজ না জানি কী দেবে। ভাবতেই কেমন একটা হচ্ছে তন্দ্রার। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড় করাল। অজানা কারণেই তন্দ্রার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। স্বাক্ষর তার অনেকটা কাছাকাছিই। আয়নায় তন্দ্রা স্বাক্ষরের মুখটা দেখতে পারছে। মুখে অমলিন হাসি লেগে আছে। তন্দ্রা কিছুটা লজ্জা গেল স্বাক্ষরের সেই অমায়িক হাসিতে। পকেট থেকে একটা তাজা বেলীফুলের মালা বের করে তন্দ্রা বেনীতে লাগিয়ে দিল স্বাক্ষর। এরপর নিজের দিকে ফেরায়। স্বাক্ষরের শরীর থেকে এক তীব্র ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকল তন্দ্রার।
“ডিয়ার বেনীওয়ালি তন্দ্রাবতী। তোমার লম্বা চুলে বেলীফুল ছাড়া বড্ড বেমানান লাগে।”
কথাটা বলে এক মুহুর্ত স্বাক্ষর সেখানে থাকল না। দ্রুত তন্দ্রার ঘর থেকে প্রস্থান করল।