#প্রেমালিঙ্গণ |১৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সকালের মিষ্টি রোদ জানালা ভেদ করে ঘরে প্রবেশ করছে। জানিয়ে দিচ্ছে নতুন দিনের সূচনার কথা। রাতের অন্ধকারকে দূরে ঠেলে প্রভাতকিরণের আলোয় জেগে উঠেছে প্রকৃতি। সকালে তন্দ্রার আগে স্বাক্ষরের ঘুম ভাঙল। এদিকে তার উষ্ণ বুকে আরাম করে ঘুমোচ্ছে তন্দ্রা। দুজন দুজনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে নিজেদের সাথে। স্বাক্ষর পলকহীন ভাবে তাকিয়ে দেখছে তার তন্দ্রাবতীকে। মানুষ যতই চঞ্চল, গম্ভীর বা রাগী হোক না কেন! ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে সবচেয়ে নিষ্পাপ লাগে। কেমন নীরব হয়ে থাকে তখন। ঘুমন্ত মানুষের মতিগতি বোঝা যায় না। তখন মানুষটাকে দেখে আলাদা মায়া কাজ করে। স্বাক্ষর তন্দ্রার কপালে আলতো চুমু এঁকে দিল৷ ঘুমের মাঝেই‚ তন্দ্রা কিছুটা নড়েচড়ে আবারও আষ্টেপৃষ্টে লেপ্টে রইল স্বাক্ষরের সাথে। সে আলতো হাতে তন্দ্রাকে তার বক্ষস্থল থেকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে দেয়।
বেশ অনেকক্ষণ পর স্বাক্ষর লম্বা শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। তন্দ্রা এখনো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে তন্দ্রার কাছে গেল সে৷ আস্তে করে বার কয়েক ডাক দিল তন্দ্রাকে। কিছুটা নড়েচড়ে চোখ পিটপিট করে তাকাল তন্দ্রা। হঠাৎ করে স্বাক্ষরকে তার ঘরে দেখতে পেয়ে কিছুটা ভড়কে গেল। তাড়াহুড়ো করে শোয়া থেকে উঠে বসল।
“তুমি এই ঘরে কী করছ? কেউ যদি দেখে…”
তন্দ্রাকে বাকি কথা বলতে না দিয়ে স্বাক্ষর তন্দ্রার হাত ধরে।
“আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখ। কোন এঙ্গেলে মনে হচ্ছে এটা তোমার সেই আদি কালের পুরনো ঘরটা? এটা আমাদের ঘর। বাই এনি চান্স‚ তুমি কী আমাদের বিয়ের কথা ভুলে গেছ?”
তন্দ্রা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল। মনে হতেই কপাল চাপড়ে কিছু একটা বিড়বিড় করল। স্বাক্ষর তাকে দেখে হাসি আটকে রাখল। এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করে নেয়। স্বাক্ষর খালি গায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চুল এখনো ভেজা। কপালের সাথে লেপ্টে আছে। আয়নায় তন্দ্রার প্রতিবিম্ব বুঝার চেষ্টা করছে। এদিকে তন্দ্রা তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“এভাবে তাকিয়ে থেক না তন্দ্রাবতী। আমার খুব প্রেম প্রেম পায়।”
ভেংচি কে’টে অন্যদিকে ফিরে তাকাল তন্দ্রা। আর বিড়বিড় করে বলে‚ “অসভ্য।”
“অসভ্য হলেও তোমারই।
শার্ট পড়তে পড়তে কথাটা বলল স্বাক্ষর। তাকে তৈরি হতে দেখে তন্দ্রা জিজ্ঞেস করল‚
“তুমি কী কোথাও যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ! হসপিটালে যাব।”
তন্দ্রা সেভাবেই বসে দেখতে থাকল। স্বাক্ষর মুখে হাসি রেখেই হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। ব্যাগের ভেতর তার যাবতীয় সবকিছু তুলে রাখল। তন্দ্রার কাছে এসে তার কপালে আলতো করে ছুঁয়ে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল‚
“ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিও। আসছি।”
“হুম।”
স্বাক্ষর চলে যায়। তন্দ্রা বিছানা ঘুছিয়ে নেয়৷ আলমারিতে তার সব জামা কাপড় এনে ভাজ করে রাখা হয়েছে আগেই। বেগুনি রঙের লং জামা বের করে নিল। বেশ কিছু সময় পর তন্দ্রা ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুলগুলো শুকিয়ে নিল। চুলগুলোকে হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে উঁচু করে বেঁধে নিল। স্বাক্ষর খুব সকাল সকাল বেরিয়ে গিয়েছে। তার নাকি সকালে একটা অপারেশন করার আছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তন্দ্রা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে নয়টা বাজছে। বিছানার উপর থেকে ওড়নাটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। সবাই ডাইনিং টেবিলে বসেছে। কাজিন মহলের সবাই এখানে উপস্থিত। বড়োরা আপাতত এখানে নেই। রুবি আর শিরিন মিলে বাকিদের খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। ওদের সামনে যেতে কিছুটা লজ্জা পাচ্ছে তন্দ্রা। যাবে কী যাবে না‚ এই সমস্তই ভেবে যাচ্ছে।
“গুড মর্নিং তন্দ্রারানী।”
শুভর কথায় তন্দ্রা জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করল। ডাইনিং টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল। নিজের জায়গায় বসল। সবার দৃষ্টি এখন তন্দ্রার দিকে।
“গুড মর্নিং ভাইয়া।”
রুবি এসে তন্দ্রার প্লেটে রুটি আর মাংসের তরকারি বেড়ে দেয়৷ তন্দ্রা চুপচাপ খেতে শুরু করল। ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছিল তার৷ বাকিরাও আর কোনো কথা বলল না৷ বিনাবাক্য ব্যয়ে খাবার খাওয়া শেষ করল সবাই। নাস্তার পর্ব শেষ হতেই মুহিত ইলোরাকে নিয়ে চলে গেল। বড়োরা মি. ইলিয়াস মাহমুদের ঘরেই আছেন। ড্রইং রুমে সোফায় না বসে মেঝেতে বসে আছে সবাই। তন্দ্রার পুরো কাজিনমহল এখন ড্রইং রুমে বসে আড্ডায় ব্যস্ত৷ শুভ আর সাইফ একে অপরের সাথে হেলান দিয়ে বসেছে। তুলি তার হাতে করে দুটো লুডু নিয়ে আসে। এরই মাঝে সবাই ভাগাভাগি হয়ে যায় কে কোন দলে আছে। শুভ‚ সাইফ‚ হেনা‚ হাসনা একসাথে খেলবে। রুবি‚ শিরিন‚ রবিন আর তুলি একসাথে খেলবে। তন্দ্রাকে অনেকবার জোরাজুরি করা হয়েছে কিন্তু তার খেলতে ইচ্ছে করছে না। তন্দ্রার খুব ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু এখন ঘুমের কথা বললে কাজিনমহলের সবাই খুব হাসি ঠাট্টা করবে।
কালই নাকি ওরা সবাই চলে যাবে। দু’দিনের জন্য আসার ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারছে না তন্দ্রা। কয়েকটা দিন থেকে গেলে‚ কী এমন মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে! দুপুরে খাবার খাওয়ার মাঝেই চলে যাওয়ার কথাটা বললেন তন্দ্রার ছোট মামা। তার উপর শুভ দেরও নাকি সামনে এক্সাম আছে৷ এরা পড়াশোনা “প” ও করে কি-না সন্দেহ আছে। সারাক্ষণ শুধু আড্ডা দেওয়া। এদের দেখে কেউই বলবে না‚ এরাই এক্সামে ভালো রেজাল্ট করে।
দুপুরের খাবার খেয়ে তন্দ্রা ঘরে এসে ঘুমোচ্ছে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় ঘুমটা বেশ ভালোই আসে। সকালের দিকে বেশ ভালোই রোদের প্রখরতা ছিল। হঠাৎ করেই আকাশটা মেঘলা করেছে। বাতাসের সাথে এক দু ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। তন্দ্রার ফোনটা বার বার বেজে উঠছে। ঘুমঘুম চোখে বালিশের পাশে হাতড়াল তন্দ্রা৷ ফোনটাকে রিসিভ করল।
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখ একবার।”
তন্দ্রা ফোন স্ক্রিনে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। জ্বলজ্বল করে স্বাক্ষরের নামটা ভেসে আসছে। তন্দ্রা আবারও ফোনটা কানে নেয়। স্বাক্ষর গম্ভীর স্বরে বলে‚
“তোমার কী বিয়ে হয়েছে?”
স্বাক্ষরের এমন প্রশ্নে তন্দ্রা কিছুটা ভড়কে যায়। এমন প্রশ্নে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তন্দ্রা বিড়বিড় করে বলল‚ “কেন?”
“এখন কয়টা বাজে?”
তন্দ্রা আবারও ফোনের দিকে তাকায়। ফোন স্ক্রিনে সাড়ে তিনটা বাজে। স্বাক্ষর ঠিক কী বুঝাতে চাইছে তা তন্দ্রার বোধগম্য হচ্ছে না। ঘুমের রেশ এখনো পুরোপুরি কা’টেনি। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে এলো। বিরক্ত হয়ে বলল‚
“সাড়ে তিনটা বাজে।”
“সাড়ে তিনটা বাজে আর তুমি আমাকে একটা বার কলও করলে না! বউ বউ ওয়েদার স্যরি রোমান্টিক ওয়েদারে আমার খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে বউ।”
স্বাক্ষরের কথায় তন্দ্রা কিছুটা তাজ্জব বনে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তাকে চুপ থাকতে দেখে স্বাক্ষর আবারও বলল‚
“আবার ঘুমিয়ে পড়েছ তুমি? আনরোমান্টিক একটা।”
“তুমি এটা বলার জন্য কল করেছ? রাতেও ঘুমোতে দাও নি। এখন অন্তত ঘুমোতে দাও।”
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলে তন্দ্রা। ঘুম পুরোপুরি না হলে তার মাইগ্রেনের ব্যথা হয়৷ তখন মেজাজও খুব খিটখিটে হয়ে থাকে। স্বাক্ষর মেকি হেসে বলল‚
“এই রে বউ ক্ষেপেছে। আচ্ছা বউ এখন রাখি পরে কথা হবে।”
স্বাক্ষর কল কে’টে দেয়৷ তন্দ্রা ফোনটাকে বালিশের পাশে আবারও রেখে দিল। অন্যপাশে মুখ করে শুয়ে পড়ল আবারও।
“আল্লাহ বাঁচাও আমাকে৷ এ আমি কার পাল্লায় পড়লাম!”
কথাটা সে মনে মনে ভাবল। আর আনমনেই হেসে দিল৷ কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল৷
বিকেল হয়ে এসেছে কিন্তু কালো মেঘে ঢেকে থাকা আকাশ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখন বিকেল। দেখে বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আড়মোড়া ভেঙে তন্দ্রা ঘুম থেকে ওঠে। বেশ অনেকটা সময় ঘুমিয়েছে৷ এখন অনেকটা ফ্রেশ লাগছে৷ পাশে তাকাতেই দেখতে পায় স্বাক্ষর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সে কখন এলো সেটাই ভাবতে থাকল তন্দ্রা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ঘুমোচ্ছে। ওদের দুজনের মাঝে অ্যালভিন বসে আছে৷ অ্যালভিনকে দেখে তন্দ্রা আজ আর ভয় গেল না। ড্যাবড্যাব করে তন্দ্রার দিকেই তাকিয়ে আছে। তন্দ্রা কাঁপা কাঁপা হাতে অ্যালভিনের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল।
“মিয়াও।”
তন্দ্রার স্পর্শ হয়তো অ্যালভিনের ভালো লেগেছে। সে উঠে গিয়ে তন্দ্রা কোলে বসে পড়ল। অ্যালভিনে এমন কান্ডে তন্দ্রা কিছুটা ভড়কে গেল। আগে কখনো সে অ্যালভিনকে কোলে নেয়নি। বরাবরই তার খুব ভয় করতো অ্যালভিনকে। এত্ত কিউট বিড়ালকে সে কেন ভয় পায়‚ সেটার কোনো উত্তর তার কাছে নেই! আজ একটু আদর করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। যদি খিমচি দেয়।
“আল্লাহ বাঁচাও আমাকে। এই দুটোর জ্বালায় আমার শান্তি নেই।”
“কথাটা কী তুমি আমাকেও বললে তন্দ্রাবতী?”
তন্দ্রা তাকিয়ে দেখে স্বাক্ষর তার দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে। হয়তো উত্তরের অপেক্ষা করছে। তন্দ্রা ভেংচি কে’টে বলল‚
“কেন কানে কী ইদানীং কম শুনছ?”
“আমি কানে ঠিকই শুনেছি৷ এখন তো একটু আধটু জ্বালাতেই হচ্ছে তন্দ্রাবতীকে।”
“এই না না।”
“আমি তোমার নানা হলাম কবে?”
“আমি নানা কখন বললাম আজিব।”
তন্দ্রাকে কপট রাগ দেখাতে দেখে স্বাক্ষর তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। শুয়ে থেকে স্বাক্ষরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তন্দ্রা। স্বাক্ষর তন্দ্রার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকাল। তন্দ্রার হৃদস্পন্দন স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে সে৷ নিজের সবটা ভর তন্দ্রার উপর ছেড়ে দিল স্বাক্ষর৷
“তোমার ওজনে আমি তো চ্যাপ্টা হয়ে যাব ভাইয়া।”
তন্দ্রার কথায় স্বাক্ষর চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। তন্দ্রা বুঝতে পারে সে কী বলে ফেলেছে। অ্যালভিন বিছানার একপাশে বসে থেকে বুঝার চেষ্টা করছে। তন্দ্রা তার বলা কথাটা এড়ানোর জন্য বলে‚
“দেখ অ্যালভিন কীভাবে তাকিয়ে আছে। ওর মনে হয় ক্ষিধে পেয়েছে।”
স্বাক্ষর তন্দ্রার গালে শব্দ করে একখানা চুমু খেয়ে বলল‚
“অ্যালভিন মনে মন ভাবছে‚ এবার অন্তত অফ যা। তোদের রোমান্স দেখে আমার মতো সিঙ্গেলদের বুকটা তো ফে’টে যায়।”