প্রেমালিঙ্গণ | পর্ব – ১

ব্যাকুল রজনির ঈষৎ কৃষ্ণাভ আঁধার কাটিয়ে নীলাভ অম্বরে উঁকি দিচ্ছে অরুণের উজ্জ্বল লালচে হলুদ বর্ণের ছটা। সকালের মিষ্টি রোদ এসে চোখ মুখে উপচে পড়ছে তন্দ্রার। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে এলো মুহুর্তেই। কম্বলের নিচ থেকে কিছু একটা নড়েচড়ে উঠল। নিমিষেই দু’চোখ থেকে ঘুমের রেশ একেবারেই কে’টে গেল তার। চোখ বন্ধ রেখেই চিৎকার দিয়ে উঠল সে। তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে‚ দৌঁড়ে দরজার কাছে এসে চেঁচাতে শুরু করল‚

“বড় মা। ও বড় মা। তোমার গুনধর ছেলের গুনধর বিড়াল কেন আমার ঘরে এসেছে?”

তন্দ্রার ডাকে রান্না ঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে এলেন মিসেস সাহেরা। ফোলা ফোলা চোখ‚ কপালের সামনে ছোট চুলগুলো এলোমেলো‚ একপ্রকার পাগলের মতো অবস্থা তন্দ্রার৷ ফিক করে হেসে উঠলেন মিসেস সাহেরা। এ আর নতুন কী? প্রতিদিন সকালেই অ্যালভিন তার কম্বলের নিচে গাপটি মে’রে শুয়ে থাকে।

“ও তো তোকে খুব পছন্দ করে তাইতো তোর কাছে বারবার যায়।”

“কিন্তু ওকে আমার একটুও ভালো লাগে না। কীভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে‚ আমার ভয় করে।’

“আমার অ্যালভিনকে যখন এতই অপছন্দ তাহলে দরজা লক করে ঘুমোবি।”

চেনা কণ্ঠস্বরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তন্দ্রা। স্বাক্ষরকে দেখতে পেয়ে চুপসে গেল কিছুটা। ড্যাবড্যাব করে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইল স্বাক্ষরের দিকে। পড়নে তার থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর ধূসর রঙা টি-শার্ট। চুল গুলো হালকা ভেজা হয়তো গোসল করেই বের হয়েছে। দূর থেকেই অ্যালভিনকে ডাক দিল৷

“অ্যালভিন কাম হেয়ার!”

ওমনি বিড়ালটা তন্দ্রার পা ঘেঁষে ঢুলতে ঢুলতে স্বাক্ষরের পেছন পেছন তার ঘরে চলে গেল। শিউরে উঠল তন্দ্রা। চোখ মুখ কুঁচকে এলো। সেভাবেই চেয়ে রইল দুষ্টু বিড়ালটার দিকে। সাদা লম্বা সিল্কি পশম গুলোও তার চলার সাথে দুলে উঠছে। কী অবলীলায় স্বাক্ষরের সাথে চলে গেল! তন্দ্রা ফ্যালফ্যাল করে তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। ফোস করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। এই বিড়ালটাকে তার ছোটো মামা দেড় বছর আগে বিদেশ থেকে এনেছিলেন তাকে দেবেন বলে। অ্যালভিনকে দেখা মাত্রই তন্দ্রা ভয়ে তার মায়ের পেছনে গিয়ে লুকায়। সবাই সেদিন তার অবস্থা দেখে খুব হেসেছিল। বিড়ালটাকে দেখে তুলি খুব খুশি হয়েছিল। এতোদিন সেই সবার ছোট ছিল‚ এখন তার থেকে ছোট কেউ চলে এসেছে। তুলি তো সেদিন বিড়ালটাকে একটা কিউট নামও দিয়েছিল “মালাই আইসক্রিম” কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই তন্দ্রা তার ঘরে চলে এলো। বিছানাটা সুন্দর ভাবে ঝাঁট দিয়ে‚ ভার্সিটিতে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিল। একটু পর তুলি তার হেয়ার ব্যান্ড নিয়ে এলো চুল বাঁধার জন্য। তন্দ্রা তার চুলে দুটো বিনুনি গেঁথে দিল। এরপর দু’বোন একসাথেই খাবার টেবিলে এলো। মিসেস তাহেরা আর মিসেস সাহেরা টেবিলে নাস্তা রেডি করে রাখছেন৷ এরই মাঝে ঘর থেকে ডাক এলো মিসেস তাহেরার। তন্দ্রার বাবা মি. ইউসুফ মাহমুদ ডাকছেন।

“তাহু আমার টাই খুঁজে পাচ্ছি না।”

“আপা তুই একটু এখানটা দেখ আমি আসছি।”

বলেই তিনি চলে যান স্বামীর টাই খুঁজে দেওয়ার জন্য। এমনটা হরহামেশাই হয়। স্বাক্ষর আর মি. ইলিয়াস মাহমুদ একসাথে এসে দুজনেই চেয়ার টেনে বসলেন। তার কিছুক্ষণ পরেই রেডি হয়ে আসলেন মি. ইউসুফ মাহমুদ। সবাই একত্রে বসে নাস্তা করে নেন। স্বাক্ষর প্রতিদিন তন্দ্রা আর তুলিকে পৌঁছে দিয়ে এরপর হসপিটালে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্বাক্ষর খাবার খেয়েই নিজের ব্যাগ নিয়ে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে থাকল ওদের দু’বোনের জন্য। এদিকে তন্দ্রা এখনো আস্তে আস্তে করে খেয়েই যাচ্ছে। প্রতিদিন এমনটাই হয়। তার নাস্তা শেষ হয় সবার দেরিতে। এক কথায় লেট লতিফা। এই নিয়ে সবসময়ই মায়ের কাছে কথা শুনোতে হয় তার। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তন্দ্রা আর তুলি তাদের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সকালের সময়টা খুব বোরিং কাটে মিসেস সাহেরা এবং মিসেস তাহেরার। দুপুরের পর অবশ্য তন্দ্রা আর তুলি এসে পুরো বাসাটাকে মাতিয়ে রাখে। মিসেস সাহেরা এবং মিসেস তাহেরা দুজন যমজ বোন। যমজ হওয়ায় দুবোনকে একই বাড়িতে বিয়ে দিয়েছিলেন মিজান তালুকদার। যাতে করে দুজন কখনো আলাদা না হয়।

স্বাক্ষর গাড়ি ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে বসে আছে তন্দ্রা। দৃষ্টি তার বাহিরের দিকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তার পাশের বড় গাছ গুলোর দিকে৷ গাড়ি নিজ গতিতে যতটা এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই গতিতে গাছগুলোও পিছিয়ে যাচ্ছে। তুলি পেছনে বসে আমতা আমতা করে স্বাক্ষরকে ডাক দেয়।

“ভাইয়া!”

“হুম বল! শুনছি।”

“আমার খাতা শেষ হয়ে গিয়েছে। কালকে আব্বুকে বলতে ভুলে গেছি।”

“আচ্ছা সামনের দোকান থেকে কিনে দেব।”

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই কথা বলছিল স্বাক্ষর। তন্দ্রা এখনো সেই বাইরের দিকেই তাকিয়ে আসে। এই মেয়েটা তার খোয়াবে এতটাই মেতে থাকে যে অন্য কোনো কিছুরই খেয়াল থাকে না৷ কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে স্বাক্ষর বলল‚

“এভাবে তাকিয়ে থাকলে গাছগুলোও লজ্জা পাবে।”

এমন কথায় জোরে হেসে দিল তুলি। তন্দ্রা বড়ো বড়ো চোখের শাসানো দৃষ্টিতে তাকালেও থামল না তুলি। সে তো দিব্যি হেসে যাচ্ছে। সে জানে স্বাক্ষরের সামনে তন্দ্রা তাকে কিছু বলবে না। এরই মাঝে তুলির স্কুলের সামনে চলে এসেছে স্বাক্ষর। গাড়ি সাইডে দাঁড় করিয়ে তুলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আবার গাড়িতে এসে বসল স্বাক্ষর। পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিল। তন্দ্রা তখন ফোনে ওদের ফ্রেন্ড সার্কেলের গ্রুপে চ্যাট করছিল। হুট করে গাড়ি আবার থেমে গেল। ফোনে মগ্ন তন্দ্রা তা টেরই পেল না। স্বাক্ষর তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল। গম্ভীর স্বরে বলল‚

“গিলে ফেল ফোনটাকে। আজই ছোটো আব্বুকে বলব আর যেন তোর হাতে ফোন না দেয়। দিন দিন অধঃপতনের দিকে যাচ্ছিস।”

“গেলে গেলাম। তুমি যাবে নাকি ভাইয়া?”

“ঠাট্টা করছিস আমার সাথে? দিন দিন বড্ড বেয়াদব হচ্ছিস।”

“এতো বড় কলিজা কার শুনি!”

“যা। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ ছুটির পর রিকশা নিয়ে সোজা বাসায় চলে যাবি। আমি কিন্তু খোঁজ রাখব।”

“তুমি কী আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছ নাকি ভাইয়া?”

সন্দেহজনক দৃষ্টিতে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল তন্দ্রা। তার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে গেল স্বাক্ষর। মেয়েটা বড্ড বকবক করে৷ শাসানো স্বরে বলল‚

“বেশি কথা আমি পছন্দ করি না।”

এরপর আর বেশি কথা না বলে তন্দ্রা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। গেইটের কাছে ইলোরা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখা মাত্রই হাত নাড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকল। তন্দ্রাও সেখানে এগিয়ে গেল। দু’জনে একসাথে ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করল। স্বাক্ষর তার গাড়ি নিয়ে চলল হসপিটালে দিকে। চেম্বারে এসে প্রথমে কিছু রোগীর চেকআপ করল। আজ বিকেলে একজন পেসেন্টের সার্জারী আছে। সার্জারীটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে তন্দ্রা ক্লাসে মনোনিবেশ করার চেষ্টায়। এখন ইকোনমিকস ক্লাস চলছে। ইলোরা মনোযোগ সহকারে নাজিম উদ্দীন স্যারের পড়া বুঝতে চেষ্টা করছে। হুট করেই তন্দ্রার হাতের কাছে একটা কাগজ ছিটকে এলো। কাগজটা হাতে নিয়ে সে এদিক সেদিক তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল, কোথা থেকে এসেছে কাগজটা! তন্দ্রা দৃষ্টি গেল অপর সাড়ির চার বেঞ্চ পেছনে মুহিত বসে আছে। সে ইশারায় বুঝানোর চেষ্টা করছে‚ ‘কাগজটা তোর জন্য নহে।’ তন্দ্রাও ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বুঝাল‚ ‘মুহিইত্তা আব তো তু গেয়ি!’ মুহিত হাত জোর করল। পরবর্তীতে কানও ধরল। তন্দ্রা মুহিতের কাণ্ড দেখে হেসে দিল।

মধ্যাহ্ন গড়িয়ে অপরাহ্ণের প্রহর শুরু। সূর্য কোমল ও মোলায়েম হয়ে আসছে। ভার্সিটি ছুটির হয়েছে মাত্রই। তন্দ্রা আর ইলোরা একই রিকশায় উঠল। দুজনের বাসা একই রাস্তায়। ইলোরা বাসা সামনে হওয়ায় সে আগেই নেমে গেল। তুলির স্কুল দেড়টার দিকেই ছুটি হয়ে যায়। তন্দ্রা একাই বাড়ি ফিরে এলো। কলিং বেল চাপতেই তুলি দরজা খুলে দিল। দেখে মনে হচ্ছে বেশ খুশি খুশিই আছে। বিষয়টা ঘেটে দেখা দরকার! তন্দ্রা ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল। ক্ষিধেও পেয়েছে ভীষণ। ক্লান্তও লাগছে কিছুটা। আগে কিছু খেয়ে তারপর যা জিজ্ঞেস করার করবে। তন্দ্রা খাওয়া দাওয়া করেই তুলির হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলো।

“কিরে পিচ্চি এত খুশি কেন?”

তুলি ভনিতা ছাড়াই চকলেট খেতে খেতে বলল‚ “আমরা সবাই নানু বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। রুবি আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

“ওহ এই ব্যাপার। আমি ভাবছি কী না কী হয়েছে! ওয়েট কী বললি?”

“যা শুনেছ তাই বলেছি।”

“রুবি আপুর বিয়ে? কবে? কার সাথে?”

“উফ! আমি এত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। তুমি মা’কে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।”

কথাটা বলেই তুলি দৌঁড়ে পালায়। তন্দ্রা তো খুব খুশি হয়ে গেছে‚ গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে বলে কথা। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া ওদের খুব একটা গ্রামে যাওয়া হয় না। বিয়ে উপলক্ষে কিছুদিন তো থাকতে পারবে‚ সেই ভেবেই খুশিতে তার নাচতে ইচ্ছে করছে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।