দিনের মধ্যপ্রহরে সূর্য মাথার উপর থেকে খাড়াভাবে কিরণ দেয়। জ্যামের মধ্যে রিকশায় বসে ঘামছে মুসকান। বারবার রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছে সে। অর্ধেক রাস্তা এসে সে জ্যামে আটকে গেছে। অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে ধৈর্যহীন হয়ে পড়ে সে। তাই ভাড়া মিটিয়ে ওখানেই নেমে পড়ে এবং ঠিক করে বাকি রাস্তাটুকু সে হেঁটেই পাড়ি দেবে। হাটতে হাটতে শোভনের স্কুলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। কিন্ত স্কুল এখনও ছুটি হয়নি। ধৈর্যহীনা নারীটি দৌড়ে শোভনের ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ল। তখন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছিল। মুসকান কে অনুমতি ব্যতীত ক্লাসে ঢুকতে দেখে তিনি অবাক হন। কিন্ত মা’কে দেখে ছোট্ট শোভনের ঠোঁটে হাসি দেখা দিলো। মুসকান যেন স্পষ্ট শায়ের কে দেখছে শোভনে মধ্যে। অপলক চোখে শোভনের দিকে এগোতে থাকে সে। তারপর শোভনের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বাইরে চলে আসে সে। শোভন বলে ওঠে,’আম্মু আজকে কি কোন অনুষ্ঠান আছে?’
-‘কেন বলোতো?’
-‘ক্লাস তো শেষ হলো না আর তুমি আমাকে নিয়ে এলে?’
-‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল তাই এসেছি।’
-‘ওহ!!তুমি আমাকে সবসময় মিস করো তাই না?’
-‘হুমম। তোমার বাবা মাও তোমাকে মিস করে!’
-‘কি??’
ধ্যান ভাঙে মুসকানের। সে বলে,’কিছু না,চলো তোমাকে চকলেট কিনে দেব।’
শোভন কে সাথে নিয়ে সোজা নাঈমের চেম্বারে গেল মুসকান। নাঈম তখন রোগী দেখছিল। কিছু সময় অপেক্ষা করতে হলো ওদের। দুপুরের বিরতিতে নাঈম বাইরে আসতেই মুসকান আর শোভন কে দেখতে পেল সে। মুসকান উঠে দাঁড়িয়ে নাঈমের কাছে গেল। জিজ্ঞেস করল,’তুমি আমার থেকে একটা কথা লুকিয়েছো নাঈম। এটা তুমি ঠিক করলে না।’
নাঈম জবাব দিল না কেননা সে জানত মুসকান তাকে এই প্রশ্ন করবেই। মুসকান আবার জিজ্ঞেস করে,’শোভন,পিকুল এই নাম দুটো আলাদা মানুষের। পিকুল রুপালির ছেলে আর শোভন পরী আর শায়েরের সন্তান তাই তো?’
-‘সত্য তো জানোই। আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?’
-‘এই সত্যি টা অন্তত তুমি আমাকে জানাতে পারতে নাঈম!!’
-‘পরী চায়নি তার সন্তানের পরিচয় কেউ জানুক। তাই আমিই বলিনি। আর তাছাড়া তোমাকে তো বলেছি আমি,আমার কিছু বলা নিষিদ্ধ। শায়ের ই তোমাকে সব বলবে।’
মুসকান নিরাশ হলো নাঈমের গা ছাড়া ভাব দেখে। ছেলেটা যে এখনও তাকে বুঝলো না। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে নাঈমের এমন উদাস ভাবটা। বিয়ের দিনই শোভন কে মুসকানের হাতে তুলে দিয়েছিল নাঈম। একজন আদর্শ মা হতে বলেছিল মুসকান কে। তখন ছোট্ট শোভনের বয়স মাত্র আটমাস। ছোট ছোট হাতে যখন সে মুসকান কে স্পর্শ করতো তখন ভিশন ভাল লাগতো ওর। মাতৃত্বের স্বাদ পেতো সে। কিন্ত আফসোস এই যে এত বছর পর শোভনের আসল পরিচয় জানতে পারে ও। নাঈম শুরুতেই বলেছিল মুসকান যেন তাকে শোভনের বিষয়ে কোন প্রশ্ন না করে। মুসকান তাই করে। কেননা এতো সুন্দর একটা শিশুকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারো নাই। অসম্ভব সৌন্দর্যের অধিকারী এই শিশুটিকে দেখলে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় মুসকানের। তাই তো বাবা মায়ের অমতে এই বিয়েতে সে রাজী হয়। মুসকান নাঈমকে ফিরিয়ে দিলে সে হয়ত অন্য কোন নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো। যদি সেই নারী শোভনের মা না হয়ে উঠতে পারে? ভালোবাসতে না পারে? এই জন্যই মুসকান শোভন কে আপন করে নিয়েছিল। একটা সুখি পরিবার গড়ে তুলেছে।
শোভন কে নিয়ে বাসায় ফেরে মুসকান। দুপুরের খাবার শেষ করে ঘুম পাড়িয়ে দেয় শোভন কে। মুসকান ভাবতে লাগে শায়েরের কথা। শায়ের কি শোভন কে দেখেছে? আর দুদিন পর তার ফাঁ*সি তবুও শায়ের একটাবার শোভনের সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেনি। কেন?? এর মধ্যে কি কোন রহস্য আছে? নাহ ওকে আবার যেতে হবে শায়েরের কাছে। আজকেই যাবে সে। শোভন কে বুয়ার কাছে রেখে বিকেলে আবার সাভারে যায় সে। কিন্ত এবার নুরুজ্জামান তাকে দেখা করতে দিতে চায় না। তিনি বলেন,’দেখুন আপনাকে একবার দেখা করতে দেওয়া হয়েছে কিন্ত বারবার একজন ফাঁ*সি*র আ*সা*মীর সাথে দেখা করতে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
মুসকান তার প্রতিবাদ করে বলে,’আর যদি আ*সামী
সম্পূর্ণ নির্দোষ হয় তাহলে?’
চমকে গেলেন নুরুজ্জামান,’কি বলছেন আপনি? সমস্ত স্বাক্ষী শায়েরের বিরুদ্ধে। শায়ের নিজের মুখে সব সত্য স্বীকার করেছে। আমরা সব তদন্ত করে দেখেছি।’
-‘আমি যেটুকু বুঝেছি তাতে আমার মনে হচ্ছে শায়ের নির্দোষ। একটা খু*নও সে করেনি। সব জানতে হলে আমাকে শায়েরের সাথে কথা বলতে হবে। দয়া করে আমাকে যেতে দিন।’
অতঃপর মুসকান শায়েরের সম্পর্কে যতটুকু শুনেছে তা সব বলে দিল নুরুজ্জামান কে। সব শুনে নুরুজ্জামান বললেন তিনিও সব শুনবেন তবে আড়াল থেকে। কারণ শায়ের নুরুজ্জামানের সামনে একটা কথাও বলবে না। দুজনেই শায়েরের সেলে গেল। মুসকান সামনে এলো নুরুজ্জামান দেওয়ালের ওপাশে রয়ে গেল।
মুসকান কে দেখে এগিয়ে এলো শায়ের। মুচকি হেসে বলল,’কি রহস্য ভেদ করে এলেন সাংবাদিক মেডাম?’
-‘আপনাকে বোঝার সাধ্য পরী ছাড়া কারো নেই। এজন্য আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনাকে।’
-‘আমার বা পাজরের হাড় থেকে সৃষ্টি সে। মনে কথা সে বুঝবে না তো কে বুঝবে?’
শায়ের একটু চুপ থেকে বলে,’পরীজান আমাকে একটা কথা বলেছিল জানেন! বলেছিল,”এটা পৃথিবী বেহেস্ত নয়!!এখানে চক্ষু মুদন করে কাউকে বিশ্বাস করা উচিত না।” কথাটা ঠিকই বলেছে সে। তাই তো পরীজান এই পৃথিবীতে শুধু আমাকে বিশ্বাস করেছে।’
মুসকান বারবার বিষ্মিত হচ্ছে শায়েরের কথায়। পরী ঠিকই বলেছে এই ছেলের প্রতিটা কথায় জাদু আছে।মুসকান বলে,’আপনার কি শোভন কে দেখতে ইচ্ছা করে না?অন্তত ফাঁ*সির আগে ছেলেকে শেষ দেখা দেখতে চান না?’
-‘ওর কথা আমার সামনে বলবেন না।’
-‘আচ্ছা বলব না। তবে এটা বলুন শোভন কে কেন নাঈমের কাছে রেখেছেন? এত বিশ্বাস নাঈমকে কেন করলেন? অন্য কেউ ছিল না?’
-‘ডাক্তারবাবুকে বিশ্বাস করি বলেই নিজ সন্তানকে তার হাতে তুলে দিয়েছি। শুধু তাই নয় দশটা মাস আমার পরীজান তার কাছেই ছিল।’
হাসপাতালে শায়ের নাঈম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। নাঈম এখনও জানে না পরী কে কেন এখানে আনা হয়েছে। সে জিজ্ঞেস ও করেনি পরীর কি অবস্থা। শায়ের চিন্তায় কোন কথাও বলতে পারছে না। এমন সময় ডাক্তার রেবেকা বের হয়ে এলেন। শায়ের কে উদ্দেশ্য করে বললেন,’আপনার স্ত্রীর অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। মুখটা অতোটাও পুড়ে যায়নি তবে শরীরের আঘাত গুলো একটু বেশি। এরকম অ*স্ত্রের
আঘাত সে পেল কীভাবে?’
শায়ের জবাব দিতে পারে না। তবে নাঈম বেশ অবাক হয়। ও রেবেকাকে জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে আপু?
পরীর মুখ পুড়েছে মানে কি?’
শেষ কথাটা শায়ের কে উদ্দেশ্য করেই বলে নাঈম। রেবেকা বললেন,’তুমি চেনো মেয়েটাকে?’
-‘হ্যা চিনি! কিন্ত হয়েছে কি বলুন?’
-‘আসলে নাঈম,মেয়েটার মুখ অর্ধেক পুড়ে গেছে কোনভাবে। চিকিৎসা করলে পুরোপুরি ঠিক না হলেও কিছুটা ঠিক হবে। হাত,পা এবং শরীরে অসংখ্য ধারালো অস্ত্রের দাগ। এর মধ্যে মেয়েটা গর্ভবতী। জানি না এখন আমার কি করা উচিত?’
শায়ের যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। পরী মা হতে চলেছে!! এর আগে তো কত চেষ্টাই না ওরা করেছে তবুও কোন লাভ হয়নি। ভাগ্য ওদের সাথে কোন খেলা খেলছে? এবার শায়ের নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। কথা না বলেই সে ছুটে গেল পরীর কাছে। মুখে তার ব্যান্ডেজ করা। ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে বিধায় ঘুমাচ্ছে পরী। শায়ের প্রিয়তমার ক্ষ*ত বি*ক্ষ*ত হাতটা ধরে। যত্নে চুম্বন করে। হাতটা বুকে চেপে ধরে বলে,’আমি পাথরের ন্যায় হয়ে গেছি পরীজান। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসুক আমি নিশ্চুপ থাকব। কিন্ত আপনি হীনা কেউ যেন না আসে। তাহলে আমি ভেঙে চুরমার হয়ে সমুদ্রে তলিয়ে যাবো। আপনাকে ছাড়া আমি অসহায় ভিশন অসহায়। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আপনি যে মাতৃত্ব চেয়েছিলেন তা আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন কিন্ত এখন এই মাতৃত্ব নিয়েও আপনাকে যু*দ্ধ করতে হবে।’
পরী ঘুমন্ত বিধায় জানতে পারল না তার স্বামী তাকে এখনও কতখানি ভালোবাসে। তার স্বামীর বুকের জমানো ভালোবাসা রত্ন দিয়ে বাঁধানো শুধু তারই জন্য। ভালোবাসার শেষ নেই যদি সেই ভালোবাসা প্রকৃত হয়। সেই ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না শুধু পরিবর্তন হয় নতুন কিছুতে। পৃথিবীতে যেমন ঋতু পরিবর্তন হয় ঠিক তেমনি। গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ,হেমন্ত, শীত ও বসন্তের মতো ভালোবাসার ও ঋতু পরিবর্তন হয়। ভালোবাসা বিয়ে সংসারের মতো পরিবর্তন হয় যুগ যুগ ধরে। শায়ের জানে না তার প্রিয়তমার সাথে কি তার আদৌ এক যুগ থাকতে পারবে কি না?
নাঈম রেবেকার সাথে কথা বলছিল পরীর বিষয়ে। বাচ্চাটা কি পরী জন্ম দিতে পারবে কি না? নাকি পরীর জীবনের ঝুঁকি থাকবে? রেবেকা বললেন, ‘দেখো নাঈম পরীর শরীর এখন ঠিক না। তিন মাস লাগবে ওর মুখ ঠিক হতে। তবে তার বেশিও লাগতে পারে আমি নিশ্চিত নই। ওর শরীরের ক্ষ*ত গুলো সারতে মাসখানেক তো লাগবেই। তখন ওর শরীরের কতটা উন্নতি হবে তা আমি এখন বলতে পারব না। যদি ওর শরীর খারাপ থাকে তাহলে তখন এবরেশন
করা যাবে। পরীর অনুমতিও তো নিতে হবে। আগে পরী সুস্থ হোক তারপর দেখা যাবে। তার আগে পরী সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন যেখানে সে ভালোভাবে থাকতেন পারবে।’
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনল শায়ের। এই মুহূর্তে পরীকে কিছুতেই নূরনগর নেওয়া যাবে না। একটু সুস্থ হলেই পরী আবার হ*ত্যা খেলায় মেতে উঠবে। এতে পরীর জীবনের আশঙ্কা আছে। সেজন্য শায়ের নাঈমের কাছে গিয়ে বলে,’আপনি পারবেন আমার পরীজানকে আপনার কাছে রাখতে? বেশিদিন নয় পরীজান একটু সুস্থ হলেই আমি তাকে নিয়ে যাব।’
-‘কেন বলুন তো? পরীকে বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে ওর পরিবার আছে। পরী সেখানে থাকলে আরও তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে।’
-‘আপনাকে আমি এখন কিছু বলতে পারছি না। তবে এটুকু বলছি যে নূরনগর এখন পরীজানের জন্য নিরাপদ নয়। সেখানে তার জন্য মৃ*ত্যু অপেক্ষা করছে। আপনি কি আমার কথা রাখবেন?’
নাঈম বুঝতে পারে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। নাহলে পরীর এই অবস্থা কীভাবে হলো? তাই সে কথা বাড়ায় না। পরীকে নিজের কাছে রাখতে রাজী হয়।
এক সপ্তাহ পর পরীকে হাসপাতাল থেকে নাঈমের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরী থাকবে বলে নাঈম বাসা পরিবর্তন করেছে। দুটো রুম আর রান্না ঘর।
পরী নাঈমের বাসায় গিয়ে বিব্রতবোধ করে। সে চায় নূরনগর ফিরে যেতে। এখন সে একটুও আধটু কথা বলতে সক্ষম। তাই সে শায়ের কে বলে,’আমি ফিরে যাব মালি সাহেব। আমাকে গ্রামে নিয়ে চলুন।’
শায়ের পরীর হাত দুটো চেপে ধরে বলে,’আপনি সেখানেই থাকবেন যেখানে আমি বলব। স্বামী হয়ে কখনোই কোন আদেশ করিনি আপনাকে। তবে আজ করছি। আপনি এখানেই থাকবেন। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না। তাই আপনার কিছু আমি হতে দিব না।’
পরী আহত গলায় বলে,’তাহলে ওরা যে আমার আপা আর আম্মাকে মেরে ফেলবে। আর জুম্মান কে তো আমি নবীনগর পাঠিয়েছি পিকুল কে দিয়ে। ওর কি হবে?’
-‘আপনার সব কাজ আমি করে দেব। আমি যাব জমিদার বাড়িতে। আপনার পরিবার রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। আপনি চিন্তা করবেন না।’
পরীর কাঁদতে খুব ইচ্ছা করছে কিন্ত এখন কাঁদা যাবে না। তাহলে ওর যন্ত্রণা বাড়বে। শায়ের চলে যাবে ভেবে পরীর ভেতরটা চুরমার হচ্ছে। কিন্ত স্বামীকে এখন তার বিদায় দিতে হবে। শায়ের নিজেও আর দেরি করে না। আবার সে পরীর কাছে ফিরে আসবে বলে গভীর স্পর্শ এঁকে দিয়ে চলে যায় সে। নাঈমের কাছে তার সবচেয়ে প্রিয় আমানত রেখে সে দূরে পাড়ি জমায়।