সারারাত বিনা নিদ্রায় পার করে ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল শায়েরের। পরী ঘর থেকে বের হতেই
ঘুম ভেঙে যায় ওর। তাই সে পরীর ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। পরী ফেরামাত্রই সে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকলো পরী। শায়ের বাইরে দাঁড়ানো। পরীর অনুমতি ব্যতীত সে ঘরে প্রবেশ করবে না। পরীর কাছে ঘরে ঢোকার অনুমতি সে চাইলোও না। পরী সেটা খেয়াল করে। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর পরী অধৈর্য হলো। সে ভেবেছিল শায়ের তার সাথে কথা বলবে। কিন্ত তা যখন হলো না পরী নিজেই গেল শায়েরের কাছে। রাতে যেভাবে ওকে বের করে দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই ভেতরে নিয়ে আসে। বলে,’আপনার সমস্যা কি?’

-‘আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরবো?’

কন্ঠে এতোটাই মাদকতা ছিল যে পরীকে ভিশন টানছে। শায়েরের চোখে সে না তাকিয়ে পালঙ্কে বসে পড়ল। শায়ের পরীর পায়ের কাছে বসে পড়ল। হাঁটুর উপর হাত রেখে বলল,’চলুন না আমরা চলে যাই? আমি আপনাকে হারাতে চাই না। নিজেকে নিয়ে আমার ভয় কোন কালেই ছিল না। আমি শুধু আপনাকে চাই। দয়া করে ফিরে চলুন?’

-‘আমিও চেয়েছিলাম আপনার সাথে ছোট্ট সংসার সাজাতে। আপনি আমি একসাথে সুখে থাকতে। আপনার আলিঙ্গনে ঘুমাতে। সকালে আপনার উষ্ণ পরশে ঘুম থেকে উঠতে। আপনার ফেরার অপেক্ষা করতে। একটা মিষ্টি ভালোবাসায় জীবন কাটাতে। কিন্ত তা বোধহয় বাকি জীবনে আর হবে না।’

-‘আমাকে বেঁচে থাকতে একটু ভালোবাসা দিন পরীজান। মরার পর আল্লাহ আপনাকে আমার থেকে আলাদা করে দেবে।’

বিচ্ছেদের কথা শুনে পরী দৃষ্টি মিলায় শায়েরের সাথে। বুকে অদৃশ্য ব্যথা অনুভব করলো সে। এই খারাপ মানুষ টা তার থেকে দূরে থাকবে? পরী বলল,’পাপীরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে ক্ষমা পায়। আপনি কেন পাবেন না? পারবেন না তার কাছ থেকে ক্ষমা এনে আমার সাথে থাকতে?’

-‘আমি তো আপনার ক্ষমা পাচ্ছি না। আল্লাহ কি আদৌ ক্ষমা করবে?’
-‘আমার থেকে হাজার গুন বেশি দয়ালু তিনি। ক্ষমা তিনি অবশ্যই করবেন।’

শায়ের পরবর্তী কথা বলতে পারল না। তার আগেই কুসুমের গলার স্বর ভেসে আসে। আফতাব শায়ের কে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই শায়ের বৈঠকে গেলো। সেখানে শুধু আফতাব নয় আখির,নওশাদ ও আছে। শায়ের ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর নিজের চেয়ারে বসল। নিরবতা ভেঙে আফতাব বলে উঠল,’তুমি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো শায়ের। আমাদের সাথে কাজ করে আমাদেরই বিরুদ্ধে গেছো। এখন তুমি বলো এটা কেন করলে?’

-‘আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আপনারাই নিজেদের মুখোশ খুলে সামনে এসেছেন। কেন আমাকে না জানিয়ে পরীজান কে এখানে নিয়ে এসেছেন আপনারা? কেন সব সত্য জানিয়েছেন? এখানে আমার কোন হাত ছিলো না।’

-‘তার কারণ তুমি খুব ভাল করেই জানো।’
ভারি হয়ে উঠলো শায়েরের কন্ঠস্বর। মৃদু চেঁচিয়ে বলে উঠল,’আমি বলেছিলাম না যে আমার স্ত্রীর থেকে দূরে থাকবেন। তার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না। আমি তো তাকে নিয়ে ভালোই ছিলাম। তাহলে আপনাদের এতো সমস্যা কোথায়?’

শায়েরের কথায় নওশাদ ও চিৎকার করে,’গলা নামিয়ে শায়ের। তুমি নিজেই পরীকে মা*রার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে করেছিলে। তাহলে তুমি মা*রলে না কেন?’

-‘তুমি আমি কেউই ভাল মানুষ নই। তাই আমার প্রতিশ্রুতি সত্যি ভেবে তুমি ভুল করেছো। আমি নই।’

-‘তাহলে এখন কি হবে? পরী তো আমাদের মা*রতে মরিয়া হয়ে উঠবে।’

শায়ের হাসলো,’একটা মেয়ের ভয়ে এতো কাবু তুমি?’

-‘পরী কতোটা ভয়ানক তা তুমি জানো শায়ের। পরী চাইলে তোমাকেও মা*রতে পারে।’

-‘আমি সেই মৃত্যু হাসিমুখে বরণ করে নেবো।’

এবার আখির মুখ খুলল,’তুমি পারলেও আমরা পারবো না। তুমি যাই বলো না কেন নিজেকে বাঁচাতে যদি পরীকে শেষ করতে হয় তাহলে আমরা তাই করবো।’

-‘আমার পরীজানের গায়ে একটা টোকাও আমি পড়তে দিবো না। প্রয়োজনে শতশত লা*শ পড়বে।’

-‘তাহলে আমরা কি করব? কবিরের মতো জীবন দেব?’
-‘আপনাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমি নিলাম। আপনাদের কোন ক্ষতি আমি হতে দিব না। তারপরও পরীজানের কোন ক্ষতি আপনারা করবেন না।’

নওশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,’বড়ই অদ্ভুত প্রেমিক তুমি শায়ের। তোমার স্ত্রী আমাদের মা*রতে
চায় আর আমারা তোমার স্ত্রীকে। মাঝে তুমি ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। এর পরিণতি কি হতে পারে ভাবতে পারছো? পারবে পরীর সাথে লড়াই করতে?’

শায়ের জবাব দিল না। বের হয়ে গেল সেখান থেকে।
নওশাদ বলল,’দেখছেন কেমন দাম্ভীকতা দেখালো? ইচ্ছা করছে ওকেও শেষ করে দেই।’

-‘নাহ,তা করা যাবে না। শায়েরের কাছে এমন প্রমাণ আছে যা আমাদের পতনের একমাত্র উপায়।’

আফতাবের কথায় বিরক্ত হলো নওশাদ বলল,’ও জীবিত থাকলে তো আমাদের ফাসাবে।’

-‘এমনি এমনি তোমাকে মূর্খ বলি না আমি। তোমার থেকে দ্বিগুণ বুদ্ধি শায়েরের। শায়ের খুব ভাল করেই জানে আমাদের কার্যসিদ্ধি হলেই আমরা লোকদের মে*রে ফেলি। শায়ের ও নিস্তার পেতো না। তাই সব কিছু তৈরি রেখেছে সে। ওর মৃত্যু হলেও সব প্রমাণ প্রকাশ্যে আসবে।’
নওশাদ চুপ করে গেল। আখির বলল,’পরীকে ছাড়লে চলবে না। আমি জানি পরী থেমে থাকবে না। শায়েরের উপর আমার এতটুকুও বিশ্বাস নেই।’

-‘তাহলে আমাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে পরীকে মা*রতে হবে। শায়ের যেন টের না পায়। যদি শায়ের জানতে পারে তাহলে সে আমাদের ছাড়বে না।’

নওশাদ আখির আর আফতাব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল।

শায়ের ঘরে ঢুকতেই পরীকে দেখতে পেলো। হাতে তার একটা ছু*রি। সেটাকেই পরী গভীর ভাবে দেখছে। হাত ঘুরিয়ে পরিচর্যা করছে কীভাবে এটা চালাবে সে। শায়ের কে দেখে হাত থেমে গেল ওর। এগিয়ে এসে শায়েরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,’কি কাজ করে এলেন? আমাকে মা*রার নতুন কোন পরিকল্পনা করেছেন কি?’

মৃদু হাসে শায়ের,’আপনি তো সব শুনেছেন তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
কথা বলল না পরী। ভাবলো শায়ের কি কোনভাবে ওকে দেখে ফেলেছিল? পরী ওদের কথা লুকিয়ে শুনছিল। শায়ের দেখলো কীভাবে?

-‘আপনার উপস্থিতি আমি চোখ বন্ধ করে বুঝতে পারি। আপনার শরীরের প্রতিটা লোমের সাথে আমি পরিচিত। কখনোই আমার থেকে নিজেকে লুকাতে পারবেন না।’
-‘আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়,যে মানুষ টা এতো ভালোবাসতে পারে সে কি করে প্রাণ নিতে পারে?’

-‘ভালোবাসা মানুষ কে সব করাতে পারে।’
কথাটার বলে আরেকটু কাছে এলো শায়ের। পরীর যে হাতে ছু*রি সে হাতটা উঁচু করে ধরে বলে,’আপনি ঠিক এই ছুরির মতো ধারালো পরীজান। আমার হৃদয়ে গেঁথে আছেন। সেই ধারালো ছু*রির ফাঁক গলিয়ে চুয়ে পড়ছে আমার ভালোবাসা। যা শুধু আপনার জন্য বরাদ্দ। না পারছি আপনি নামক ছু*রিটা বের করতে আর না পারছি ধরে রাখতে। বুকে থাকলে ব্যথা হয় আর বের করে দিলেই মৃ*ত্যু।
এখন আমার করণীয় কি পরীজান? আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।’

হাত থেকে ছুরিটা আপনাআপনিই পরে গেল। উৎকন্ঠা হয়ে পরী বলে,’আমাকে দূর্বল করার চেষ্টা করবেন না। আমি কঠোর হতে চাই। আমি তাদের শেষ করতে চাই যারা আমার শ*ত্রু। আমি জানি আপনি এর মাঝে আসবেন। তবে একটু সাবধানে থাকবেন।’
-‘আপনি তো বললেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করবেন। আমরা দূরে কোথাও গিয়ে আল্লাহর কাছে আর্জি জানাই?’

-‘বারবার একই কথা বলছেন কেন? আমি তো আপনাকে বলেই দিয়েছি আমি কোথাও যাবো না। প্রতিশোধ না নিয়ে আমি যাবো না।’

শায়ের থামলো। এসব নিয়ে আর কথা বলল না। সে কিছুক্ষণ পর বলে উঠল,’আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরব পরীজান? অনেক তৃষ্ণা পেয়েছে আপনাকে আলিঙ্গন করার।’
পরী শায়েরের বুকে মাথা রাখে। আর শায়ের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নিজের তৃষ্ণা মেটায়। এ যেন বহুক্ষণের পিপাসা।
-‘আমার হাতে যদি ছুরি থাকতো আর সেটা যদি আপনার বুকে গেঁথে দিতাম তাহলে কেমন হতো মালি সাহেব?’

-‘সেটা আমার পরম সৌভাগ্য হতো পরীজান। আপনাকে বুকে নিয়েই দুনিয়া ত্যাগ করতে চাই আমি।’
-‘আর আমি আপনাকে এই দুনিয়া আরও দেখাতে চাই।’

আর কেউ কোন কথা বলল না। অনুভূতির সাথে মিশে গেল দুজনে। একদিকে ভালোবাসা আরেক দিকে প্রতিশোধ! কীভাবে সামলাবে পরী? আর শায়ের!! খারাপ মানুষ গুলোকে বাঁচাতে গিয়ে ওর কি হবে? পরী যদি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে? যদি সে শায়ের কে আঘাত করে? যতোই সে শায়ের কে দূরে সরিয়ে দিক না কেন,শায়ের ছাড়া পরী অচল।
নিষ্ঠুর এই নিয়তি ওদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। আলাদা করে দিলো দুজনকে। সময় কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা কেউই জানে না। কার ভাগ্যে কি আছে তাও জানে না। তবে শুধুমাত্র প্রার্থনার মাধ্যমেই মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।

রুপালি পিকুলকে কোলে নিয়ে উঠোনের এক কোণে বসে আছে। খুশি গ্রাস করে নিয়েছে এক অজানা কালো মেঘ। যার দরুন হাসি নেই কারো মুখে। তখনই অন্দরের দরজা পেরিয়ে একজন যুবক প্রবেশ করল। তাকে দেখেই কেঁপে উঠল রুপালির সর্বাঙ্গ। পিকুলকে শক্ত করে ধরে সেই পুরুষের দিকে তাকিয়ে রইল সে। পুরুষটি রুপালির নিকটে এসে বলল,’কেমন আছো রুপালি?’

ঈষৎ কেঁপে উঠল রুপালি। কতদিন পর এই কন্ঠস্বর সে শুনতে পেলো! সিরাজের চোখে চোখ রেখে দাঁড়াল রুপালি। কম্পিত কন্ঠে বলল,’ভাল। আপনি কেমন আছেন?’
সিরাজ হেসে বলে,’ভাল। তোমার ছেলে?’

পিকুলের দিকে তাকিয়ে রুপালি বলে,’হুম।’

-‘দেখতে তোমার মতোই হয়েছে। গায়ের রঙ ও তোমার মতোই সুন্দর।’
-‘এতোদিন পর কি মনে করে এলেন? সেই যে গেলেন তারপর আর তো দেখা দিলেন না।’

-‘জীবনের সবকিছু চলে যাওয়া মানেই তো জীবন যাওয়া। তাহলে দেখা দেই কীভাবে বলো?’

-‘তাহলে আজ দেখা দিলেন যে?’

-‘জানি না কেন এসেছি!! তবুও এসেছি।’

দোতলায় দাঁড়িয়ে পরী রুপালি আর সিরাজকে দেখছে। ভাবছে ওদের মিল হলে কত না সুন্দর হতো।
কবির নামক খারাপ মানুষের সাথে জীবন জড়াতো না রুপালির। এখন রুপালি সম্পূর্ণ একা। সবাই থেকেও নেই।
সেই মুহূর্তে শায়ের ওর পেছনে এসে দাঁড়াল। সিরাজ কে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে বলে উঠল,’সিরাজ!
এখানে কেন?’

পরী পেছন ফিরে তাকালো বলল,’মনে হয় আপার সাথে দেখা করতে এসেছে।’
-‘ভুল ভাবছেন আপনি পরীজান।’
ভ্রু কুঁচকালো পরী,’ভুল ভাবছি মানে?’
-‘সব যখন জেনেছেন তাহলে এটুকু অজানা থাকবে কেন? সিরাজের থেকে আপনার বোনকে দূরে রাখুন।
এখন আপনার সাথে বিপদ অন্দরের সবার। তাই যথাসম্ভব অন্দরে থাকার চেষ্টা করুন সবাই।’

-‘কি বলতে চাইছেন আপনি? সিরাজ ভাইও!!’

-‘সেও আমার মতোই আপনার বাবার সাথে কাজ করত। বাকিটা আপনি বুঝে নিন।’

পরী ঘাড় ঘুরিয়ে সিরাজের দিকে তাকালো। বিশ্বাস হলো না ওর। কিন্ত শায়ের তাকে মিথ্যা বলেনি। সিরাজ ও ছলনার আশ্রয় নিলো! পরী এতে খুব বেশি অবাক হলো না। তবে ওর ভয় হলো রুপালিকে নিয়ে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।