সন্ধ্যাবেলা কলপাড়ে গিয়ে ইচ্ছামতো ভিজেছে পরী।
মাতৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে সে,এটা কিছুতেই মানতে পারছে না। আর কি কখনো মা হওয়া সম্ভব কি পরীর পক্ষে??বেশি ভেজার কারণে শরীরে জ্বর নেমে এসেছে। তারপর আজকের ঘটনা পরীর মস্তিষ্কে বেশ গভীর ভাবে আঘাত করেছে। যার জন্য উল্টাপাল্টা বকছে। পরীকে পালঙ্কে শুইয়ে দিয়ে কাথা টেনে দিলো শায়ের। সে নিজে উঠতে গেলে পরী হাতটা টেনে ধরে। হারিকেনের টিমটিম আলোতে শায়ের খেয়াল করে অস্থিরচিত্ত নয়নে তাকিয়ে আছে পরী। জ্বরে ফর্সা মুখখানা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। অসম্ভব ভাবে কাঁপছে ঠোঁট দুটো। পরী কম্পিত কন্ঠে বলে,’আপনার সব ভালোবাসা আমাকে দিন না মালি সাহেব যাতে আপনার কাছ থেকে আর কেউ ভালোবাসা না চায়। সবাই যেন খালি হাতে ফিরে যায়। আপনার সব ভালোবাসা শুধু আমার কাছে থাকবে।’
পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো শায়ের বলল, ‘আপনার শরীরে জ্বর এসেছে পরীজান। আপনি একটু চুপ করে শুয়ে থাকুন।’
পরী হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে,’নাহ আমি ঠিক আছি।’
-‘কেন পাগলামি করছেন? আমি কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবো না। একটু শান্ত হন।’

-‘আপনাকে ছেড়ে যেতে কখনো দিলে তো যাবেন।’

শায়ের পরীর থেকে হাত ছাড়িয়ে পরনের ভেজা পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলে। ভেজা পোশাক বদলে আবার পরীর পাশে এসে বসে। পরীর কপালে হাত রেখে দেখে জ্বর ক্রমাগত বেড়ে চলছে। শায়ের জলপট্টি দিতে চাইলে পরী বারণ করলো। পরীর বারণ উপেক্ষা করতে শায়ের পারলো না। পরী জেদ ধরে বসে আছে। শায়ের পড়লো বিপাকে। পরী উঠে বসে জড়িয়ে ধরে শায়ের কে। উত্তাপে কেঁপে উঠল শায়ের,’আপনি ভিজেছেন কেন পরীজান? এখন তো কষ্ট পাচ্ছেন।’
-‘আপনি পাশে থাকলে আমার কোন কষ্ট হবে না। বহু কষ্ট পার করে আপনার কাছে সুখের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। আমার আর কষ্ট হবে না।’

-‘আমার কাছেই তো আপনার সব কষ্ট। আপনার মতো চাঁদের গায়ে আমার মতো কলঙ্ক মানায় না পরীজান।’
-‘আকাশের চাঁদের গায়ে যে কলঙ্ক আছে তা চাঁদের সৌন্দর্য বহন করে। তেমনি আপনিও আমার কলঙ্ক এই কলঙ্ক ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই।’

বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,মেঘের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে শায়ের। পরী ঘুমায়নি,সে শায়ের কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে আর শায়ের উত্তর দিচ্ছে। শায়ের বুঝতে পারছে পরী কেন এরকম করছে। সে মা হতে পারবে না কখনো। কষ্ট তো হবেই। নিজের কাছের মানুষ যে এমন বিশ্বাস ঘাতকতা করবে তা শায়ের ভাবেনি। সে তো ওদের কোন ক্ষতি করেনি তাহলে তারা কেন এরকম করলো। পরীকে অনেক মেহনত করে ঘুম পাড়াতে হলো। পরীর জ্বর নামা না পর্যন্ত শায়ের জেগে ছিলো। জলপট্টি দিয়েছিল।

সকাল হলো,কিন্ত বৃষ্টি কমলো না। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামতেছিল। বৃষ্টি মাথায় শায়ের কোথায় যেন বেড়িয়ে গেলো। ফিরলো ঘন্টা দুয়েক পর। হাতে তার কিছু কাগজপত্র। পরী চুপচাপ শায়েরের কাজ দেখতে লাগলো। সবকিছু ঠিকঠাক করে বের হতে নিলে পরী জিজ্ঞেস করে,’আবার কোথায় যাচ্ছেন? আর ওসব কিসের কাগজ??’
শায়েরের মনে হলো এবার পরীকে সব জানানো উচিত। সে পরীর কাছে এসে বসে বলে,’আমার ভাগের যেটুকু জমি আছে তার দলিল এগুলো। আমি সব ওদের দিয়ে দিবো। বিনিময়ে আমি আপনাকে নিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে চাই।’

পরী কথা বলল না। শুধু শায়েরের দিকে তাকিয়ে রইল। শায়ের পরীর গালে হাত রেখে বলল,’নিজের সাধ্যের মধ্যে রাণীর মতো করে রাখবো আপনাকে। রাজা হতে পারবো না কখনো তবে কোন রাজার সাধ্য নেই আমার মতো হওয়ার। আমার মতো করে আপনাকে কেউ আগলে রাখতে পারবে না পরীজান।’
শায়েরের হাতে হাত রাখে পরী। স্মিত হেসে বলে, ‘আপনার মনের রাজ্যের রাণী হতে পারলেই হবে। আপনি সব দিয়ে দিন ওদের। আপনার ভালোবাসাতেই বেঁচে থাকতে পারবো।’

পরীর সম্মতি পেয়ে শায়ের ছুটলো হেরোনার ঘরের দিকে। চম্পা তখন মন খারাপ করে বসেছিল। শায়ের কে আসতে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল। শায়ের বলল, ‘তোর মা কোথায়??’

চম্পার গলা দিয়ে কথা বেরোলো না। গলাতেই সব কথা আটকে গেল। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে হেরোনা এলো। শায়ের দলিলটা হেরোনার হাতে দিয়ে বলে,’এই নিন আপনাদের জমি। এটুকু সম্পদের জন্য আমার সবকিছু তো কেড়ে নিলেন। এবার আশা করি শান্তিতে থাকবেন। আপনাদের কারো ছায়া যেন আমার পরীজানের উপর না পড়ে। আমার ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গার সময় কিন্ত এসে পড়েছে। তাই সাবধান।’

ঘর থেকে বের হওয়ার আগে শায়ের চম্পাকে উদ্দেশ্য করে বলে,’যে মানুষ টা তোকে এতো কাছে টানলো তার এতোবড় ক্ষতি করতে তোর বুক কাঁপলো না? তোর মুখ যেন দ্বিতীয়বার আমি না দেখি।’

শায়ের চলে গেল। চম্পা কাঁদতে লাগল মাটিতে বসে। হেরোনার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,’তোমার সম্পদ তো তুমি পাইছো মা। আমি ক্যান আমার সম্পদ খোয়াইলাম? তুমি পারলা না আমার সম্পদ আইনা দিতে।’

হেরোনার মুখ গম্ভীর দেখলেও সে মনে মনে ভিশন খুশি। শায়ের যে ওকে সব দিয়ে গেছে। তিনি এও ভাবলেন এবার চম্পাকে বড় ঘরে বিয়ে দেবেন। তাহলেই ওনার ষোলকলা পূর্ণ হবে।

দিন মাস পেরিয়ে বছর ঘোরে। পরী মন খারাপ করে বসে থাকে বাড়ির জন্য। কিন্ত সময়ের অভাবে শায়ের পারে না পরীকে নিয়ে যেতে। কিন্ত তার ভালোবাসার কোন কমতি রাখেনি শায়ের। পরী কখনো প্রশ্ন করতে পারেনি শায়ের কে। জিজ্ঞেস করতে পারেনি শায়ের তাকে ঠিক কতখানি ভালোবাসে। তার প্রমাণ সে পদে পদে পেয়েছে। শায়েরের ছোট ঘরটাকে রাজপ্রাসাদ মনে হয় পরীর। সারাদিন রাত ঘরে বসে কাটে ওর। সেদিনের পর থেকে পরী সম্পূর্ণ একা থাকে। চম্পা তো আসেনা, এমনকি চামেলিকেও আসতে মানা করেছে। কেননা চামেলি সহজ সরল মানুষ। কখন কি বুঝিয়ে পাঠাবে কে জানে? তবে মাঝেমধ্যে চামেলি উঠোনের দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দুয়েক কথা বলে। আবার চলে যায়।
এমনই একদিন চামেলি এসে বলল,’ভাবি আপার বিয়া ঠিক হইছে।’

-‘তাই নাকি? কোথায়?’
-‘পাশের গেরামের সুজনের লগে। মায় কইলো এই শুক্রবার বিয়া।’
পরী কথা বলল না। একটু চুপ থেকে চামেলি আবার বলে,’আমার ভালো লাগে না ভাবি। তুমি তো আইবা না বিয়াতে। আমি একলা একলা কি যে করমু?’

-‘কিছু করার নেই চামেলি। তোমার ভাই চায় না আর আমিও চাই না।’
-‘আপা আর মা একটুও ভালা না ভাবি।’
শায়ের আসার সময় হয়ে গেছে। তাই পরী বলল, ‘তুমি এখন যাও চামেলি। তোমার ভাই এখুনি চলে আসবে। তোমাকে দেখলে বকবে।’

চামেলি মন খারাপ করে প্রস্থান করলো। পরীও নিজের কাজে চলে গেল। সবকিছু জানার পর খুসিনাও তার ভাইয়ের বউদের সাথে কথা বলে না। তিনি পরীকে নিয়ে ছোটেন নানা ফকিরের কাছে। মাতৃত্বের স্বাদের জন্য পরী নিজেও যায়। কিন্ত কোন লাভ হয় না। কত ওষুধ খেয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। দিন শেষে পরী হতাশই হয়েছে। তবুও আল্লাহর উপর ভরসা রাখছে।
শায়ের ফিরলে ওর মন খারাপ কখনোই তাকে বুঝতে দেয়নি। পরী জানে ওর হাসি মুখ দেখলে শায়েরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

চম্পার বিয়েতে শায়ের কে দাওয়াত করে যায় আকবর। কিন্ত সাথেই সাথেই তা প্রত্যাখ্যান করে শায়ের। আকবর কিছু বলার সুযোগ ও পেলো না। শায়ের সে সুযোগ কখনো দেবে না। পরী নিজেই শায়ের কে বলে,’ফিরিয়ে না দিলেই পারতেন। নিজের লোকই তো। অন্তত বিয়েতে নাহয় থাকুন।’

-‘আমি শুধু আপনার সাথে বাকি জীবনটুকু কাটাতে চাই। এছাড়া অন্য কাউকে আমাদের মাঝে আনতে চাই না। ওদের ক্ষমা করলেও আমার ক্ষোভ কিন্ত যায়নি। আপনি ওদের হয়ে কিছু বলতে আসবেন না।’

আর কোন বাক্য পরী উচ্চারণ করে না। সে শায়ের কে যতটা চায় তার চেয়েও গভীর ভাবে শায়ের পরীকে চায়। এভাবেই দুজনের ছোট্ট সংসারে সময় কেটে যাচ্ছে খুব।
চম্পার বিয়ের আগের দিন খুসিনাকে ধরেবেধে সবাই নিয়ে গেল। যতই হোক তার তো যাওয়া উচিত। একমাত্র ফুপু বলে কথা। শায়ের নিজেই খুসিনাকে যেতে বলেছে।
শায়ের তাই সন্ধ্যা হতেই বাড়িতে এসে পড়েছে। নাহলে পরী একা হয়ে যাবে। হঠাৎই চম্পা ছুটে আসে এবং ঝাপটে ধরে শায়ের কে। আকস্মিক ঘটনাতে শায়ের নিজেকে ছাড়ানোর বদলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চম্পা কাঁদতে কাঁদতে বলে,’মাফ করো সেহরান ভাই। আমি মা’র কথায় সব করছি। আমি তো ইচ্ছা কইরা কিছু করি নাই। আমিতো তোমারে চাই। এমনে ছাইড়া দিও না। আমি বিয়া করতে চাই না। মইরা যামু আমি।’

হাতে টান লাগতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সে। পরী এক ঝটকায় চম্পাকে শায়েরের থেকে ছাড়িয়ে আনে। ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে বলে,’তোমার মুখটা আমি দেখতে চাই না চম্পা। আমার স্বামীকে ছোঁয়ার সাহস দ্বিতীয়বার দেখিও না। আমি কিন্ত অতো ভালো মেয়ে না। যে বারবার তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবো।’

চম্পাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পরী ওকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলো। শায়ের চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সে চম্পাকে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্ত তার কথাটা পরীই বলে দিয়েছে। পরী যে একা কতো লড়াই করছে তা ধারণার বাইরে।
চম্পার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত শায়ের আর বাড়িতে আসলো না।
তবে বিকেলে একটা চিঠি এসেছে শায়েরের নামে। চামেলি খামটা এসে পরীকে দিয়ে যায়। চিঠিটা ওলট পালট করে দেখে পরী। চিঠির উপরে দেওয়া ঠিকানা দেখে সে। নূরনগর থেকে এসেছে চিঠিটা। পরী একবার ভাবল খুলে দেখবে। যেহেতু চিঠিটা শায়েরের নামে তাই অন্যের চিঠি খোলা ঠিক নয় ভেবে পরী খুলল না।
রাতে শায়ের ফিরতেই চিঠিটা দিলো পরী এবং বলল,’নূরনগর থেকে আপনাকে কে চিঠি পাঠিয়েছে? নামটা লেখেনি। খুলে দেখুন তো?’

শায়ের চিঠিটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলো বলল,’এখন পড়তে ইচ্ছা করছে না। পড়ে পড়বো।’

পরী ভাবলো শায়ের ক্লান্ত। তাই চিঠিটা আগের স্থানে রেখে দিলো। তবে শায়ের কে বিচলিত দেখাচ্ছে খুব। কোন ঝামেলা হয়েছে? রাতে তেমন ঘুম হলো না পরীর। ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠল সে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।