রাতের প্রহর যতো বাড়তে থাকে নিস্তব্ধতাও সমান তালে বাড়ে। থেমে যায় মানুষের কলরব। ঘুমন্ত গ্রামটাকে মৃত্যুপুরি মনে হয় তখন। তখন যে জেগে থাকে একমাত্র সেই টের পায় নিরবতা। শীত কমতে থাকাতে এই সময়টাতে গরম লাগছে পরীর। গায়ের কম্বল টা সরিয়ে দিলো। মাথা তুলে শায়ের কে দেখে নিলো। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পরী হাতে আরেকটু জোর দিয়ে জড়িয়ে ধরে শায়ের কে। স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল সে। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেলো পরীর। কোন স্বপ্ন দেখেনি এমনিতেই ঘুম ভেঙেছে। একই ভাবেই সারারাত ঘুমিয়ে থাকলে তো কষ্ট হবে শায়েরের। এপাশ ওপাশ ফিরতে পারবে না। তাই পরী সিদ্ধান্ত নিলো নিজের বালিশে ঘুমানোর। কিন্ত সে উঠতে পারলো না। শায়ের ততক্ষণে জেগে গেছে। চোখ বন্ধ রেখেই সে বলে উঠল,’এমন করছেন কেন পরীজান? আমাকে একটু ঘুমাতে দিন।’
বলতে বলতে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে শায়ের।
-‘আমি আবার কি করলাম? আপনার সুবিধার জন্যই তো সরে যাচ্ছি।’
-‘আমার তো আপনাকে নিয়ে ঘুমাতে সুবিধা হচ্ছে। আপনার হচ্ছে না বুঝি?’
পরী কথা বলল না। ওভাবেই রইল। কিছুক্ষণ পর পরী বলল,’শুনেছি সত্যিকারের ভালোবাসা নাকি কাঁদায়!! ভালোবাসায় চোখের পানি না ঝরলে সেই ভালোালোবাসা পরিপূর্ণ হয় না??’
-‘আপনার কথাটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমার ভালোবাসা আপনাকে প্রতিদিন কাঁদাবে পরীজান। নিত্য নতুন ভালোবাসায় আপনি কাঁদতে প্রস্তুত হন।’
-‘সুখের কান্না সবাই হাসিমুখে বরণ করে। আমিও হাসি মুখে নিলাম। আমার এই কান্না যেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকে মালি সাহেব। সেই দায়িত্ব আপনার।’
-‘যথা আজ্ঞা পরীজান।’
ভালোবাসার পরিপূর্ণ রূপ হলো চোখের জল। ভালোবাসা মানুষকে কাঁদায়। জীবন অনেকগুলো খন্ডে বিভক্ত,কোন খন্ডে জীবনে ভালোবাসা এসে জীবনকে রঙিন করে দেয়। পরে এই রঙিন স্মৃতিগুলো বিষন্নতার পসরা সাজিয়ে মানবহৃদয়কে কাঁদিয়ে দেয়। আবার কিছু খন্ডে সে সুখ পায়। তখন সুখের কান্নায় আবেগপ্লুপাত হয়। হ্যা ভালোবাসা মানুষকে কাঁদায়। কেউ পাওয়ার খুশিতে কাঁদে আর কেউ না পাওয়ার বেদনায়। তবে সবার চাওয়া একটাই থাকে,দিন শেষে যেন প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে চোখের জল ফেলতে পারে।
সকাল সকাল আড়তে চলে গেছে শায়ের। আজকে ওর কাজের প্রথম দিন। পরী উঠোনে দেওয়া দরজা পর্যন্ত শায়ের কে এগিয়ে দিয়ে আসে। ঘরে এসে পরী শূন্যতা অনুভব করে। সেটা যে তার স্বামীর জন্য। এখন থেকে রোজ শায়েরের আসার অপেক্ষা করবে পরী। কিছু অপেক্ষা অত্যন্ত মিষ্টি। যা উপভোগ করার অনুভুতি অসাধারণ।
ফুপুর সাথে কাজে কর্মে আর গল্প করেই সারাদিন কাটাতে হবে পরীকে। নিজের কাজগুলো তাই তাড়াতাড়ি শেষ করলো পরী। দুপুরে গোসলের জন্য কলপাড়ে যেতে উদ্যত হতেই চামেলি এলো। পরীকে দেখে বলে,’নতুন ভাবি নাইতে যাও?’
পরী হেসে বলল,’হ্যা।’
-‘ওহহ। আমার লগে পুকুরে যাইবা?’
-‘নাহ পুকুরে যাওয়া মানা আমার। তোমার ভাই যেতে বারণ করেছে।’
-‘আরে নতুন ভাবি পুকুরে কেউ যায়না। আমাগো ঘরের পিছনে পুকুরটা। আমরা বাড়ির মানুষ যাই খালি। আব্বা আর কাকারা তো ক্ষেতে গেছে। আইবো সন্ধ্যার পর। আহো তুমি আর আমি যাই। মজা হইবো।’
চামেলির কথা শুনে হাসলো পরী। তারও ইচ্ছা করে পুকুরে সাঁতার কাটতে। কিন্ত শায়ের মানা করেছে তাই সে যাবে না বলে। খুসিনাও পরীকে একবার পুকুরে যেতে বলে। শ্বশুরবাড়ির কোথায় কি আছে তা দেখতে হবে না?
পরী ভাবলো শায়ের তো এখন বাড়িতে নেই। সে কোথায় গোসল করছে তা তো শায়ের দেখবে না। একদিন পুকুরে গেলে কিছু হবে না। বাড়িতে থাকতে স্বাধীনতা পায়নি। এখানে অন্তত মালার মতো কেউ বকবে না। কাপড় রেখে গামছা নিয়ে পরী চামেলির পিছন পিছন গেলো। বড় ঘোমটা টেনে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গেল পরী। পুকুর ঘাটে গিয়ে ভালো করে চারিদিক দেখে নিলো সে। চারিদিক ঝোপঝাড়। কলাগাছ আর কলাগাছ। তাছাড়া পুকুরে আসতে হলে বাড়ির ভেতর দিয়ে ছাড়া আসার কোন কায়দা নেই।
চম্পা সবে পুকুরে গোসলে নেমেছে। পরী আর চামেলিকে দেখে অবাক হলো সে। রাগন্বিত কন্ঠে চামেলিকে বলে,’তুই নতুন ভাবিরে এইহানে আনছোস ক্যান। সেহরান ভাই মানা করছে না? নতুন ভাবিরে নিয়া বাইরে যাইতে?’
-‘আমাগো পুকুরে তো কেউ আহে না আপা। হের লাইগা নিয়া আইলাম।’
চম্পার ভালো লাগলো না চামেলির জবাব। পরী বেশ বুজতে পারলো যে চম্পা তাকে দেখে রাগ করছে। রাগ করাটাই স্বাভাবিক। তাই পরী কিছু বলে না। চম্পা দ্রতু উঠে চলে গেল। চামেলি পুকুরে নামতে নামতে বলল,’নতুন ভাবি সাবধানে নামেন। ঘাট কিন্ত পিছলা।’
পরী তাই সাবধানে নামলো। দুটো খেজুর গাছ পাশাপাশি রেখে ঘাট বানানো হয়েছে। বহুদিন পানিতে ডুবে থাকার কারণে গাছ দুটোতে শেওলা ধরে গেছে। যার ফলে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। তাই দেখে শুনে পা ফেলছে পরী। পুকুরের পানিতে শরীর ভেজাতে বেশ লাগলো পরীর। বেশিক্ষণ সাঁতার কাটলো না সে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। চামেলি আগে উঠে এলো। কিন্ত পরী উঠতে গিয়ে পড়লো বিপাকে। হাত ফসকে সাবানটা পড়ে গেল পানিতে। পরী চামেলিকে ডেকে বলল,’সাবানটা পানিতে পড়ে গেছে চামেলি। এবার কি হবে?’
-‘ডুব দিয়া খোঁজো। পাইয়া যাইবা। আমার কতবার সাবান হারাইছে। হাতরাইলে পাইয়া যাইবা। ডুব দেও।’
চামেলির কথামত পরী আবার পানিতে নামলো। ডুব দিয়ে সবান খোঁজার চেষ্টা করলো। পানির নিচে কতক্ষণ আর দম আটকে থাকা যায়!!সবান না পেয়ে
পরী পানির উপরে এসে বড় করে দম ছাড়লো। তবে সাথে সাথে দম আটকে আসার উপক্রম হলো। কারণ চামেলির জায়গাতে স্বয়ং শায়ের দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার গেঞ্জি আর লুঙ্গি। হাটু পর্যন্ত উঠিয়ে গিট্টু দেওয়া তার লুঙ্গিটা। মনে হচ্ছে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে শায়ের। সাহসী পরী স্বামীর ভয়ে ঢোক গিললো। শায়ের পরীকে বারবার বাইরে যেতে নিষেধ
করে দিয়েছে। শায়ের বাড়িতে না থাকলে তো একেবারেই পরীর বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। শায়েরের হাতে একটা ছোট লাঠি দেখে পরী আরও ঘাবড়ে গেল। মারবে নাকি?? শায়ের গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘আপনি পুকুরে এসেছেন কেন? আমি যাওয়ার আগে কি বলে গিয়েছিলাম মনে রাখেননি তাই না??’
-‘না মানে!!আসলে আজকেই এসেছি। আর কখনো আসবো না কথা দিচ্ছি।’
-‘আমার কথা না রেখে এখন কথা দেওয়া হচ্ছে!!’
পরী করুন স্বরে বলল,’মাফ চাইছি আর হবে না।’
-‘উঠে আসুন।’
-‘সাবান পড়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছি না তো। আপনি একটু দেখুন না খুঁজে!!’
পরীর অসহায় মুখ দেখে শায়ের পানিতে নামলো। ডুব দিয়ে মুহূর্তেই সাবানটা খুঁজে আনলো। সাবান দেখে পরীর মুখে হাসি ফুটল। শায়েরের থেকে সাবানটা নিয়ে বলল,’যাক অবশেষে পাওয়া গেল।’
-‘এখন আর খুশি হওয়া লাগবে না। আমাকে কথা দিন আর কখনোই পুকুরে আসবেন না। আর আমি ছাড়া কারো সাথে বাড়ির বাইরে যাবেন না।’
-‘আমাকে নিয়ে এতো ভয়ের কি আছে মালি সাহেব?’
শায়ের পরীর হাতটা ধরে কাছে টেনে নিলো বলল, ‘আমার একটি মাত্র পরীজান। আমি চাই না যে আমি ছাড়া পরীজানের দর্শন অন্য পুরুষ করুক। আপনাকে আমার কাছে খুব যত্ন করে আগলে রাখবো।’
-‘আপনার হাতে লাঠি দেখে ভাবলাম মারবেন বুঝি আমাকে!’
-‘ভালোবেসে কাঁদতে চেয়েছেন না? লাঠি দিয়ে মেরে কাঁদাবো।’
পরী মৃদু রাগ নিয়ে বলে,’কি???’
শায়ের হাসলো অতঃপর পরীকে নিজ আলিঙ্গনে নিয়ে বলে,’ভালোবেসে কুল পাইনা আবার মারবো?’
পাড় থেকে চামেলির গলা শোনা গেল,’আরে সেহরান ভাই তোমরা অহনও উঠো নাই। ঠান্ডা লাগবো যে।’
থতমত খেয়ে পরীকে ছেড়ে দিলো শায়ের। কিন্ত চামেলির ভাবান্তর নেই। বোকা মেয়েটা অতো কিছুই বুঝলো না। শায়ের ধমকে চামেলিকে বলল,’তোর মার খেয়ে হয়নি না? দাঁড়া আবার আসছি।’
দৌড়ে চলে গেল চামেলি। একটু আগে শায়ের পুকুর পাড়ে এসে চামেলিকে দু’ঘা লাগিয়েছিল পরীকে ঘাটে আনার জন্য। বাড়ি ফিরে এসে সে যখন দেখলো ঘরে পরী নেই তখন ফুপুকে জিজ্ঞেস করে। শায়ের কে রাগ করতে দেখে সমস্ত দোষ তিনি চামেলির উপর দিয়ে দেন। যার ফলস্বরূপ লাঠির বাড়ি চামেলির উপর পড়ে।
পরীকে নিয়েই বাড়ি ফিরে এলো শায়ের। আজকে ভালোয় ভালোয় বেঁচে গেছে। আর এই ভূল করা যাবে না। মালার কথা মনে পড়ল পরীর। মালা শায়ের কে বলেছিল পরীকে আগলে রাখতে। শায়ের সেই চেষ্টাই করছে।
ভেজা কাপড় বদলে ঘরে এলো পরী। সে শায়ের কে জিজ্ঞেস করল,’আপনি আজ চলে এলেন যে? বলে গেলেন তো ফিরতে সন্ধ্যা হবে।’
-‘আপনাকে দেখার আকাঙ্খা আমাকে টেনে নিয়ে এলো পরীজান। পারলাম না থাকতে। আপনি কি আমাকে একটুও মনে করেননি?’
-‘আপনাকে তো ভুলিনি তাহলে মনে পড়বে কি? একটা মানুষ কে তখনই মনে পড়ে যখন তাকে ভুলে যায়।’
শায়ের পরীর কাছের আসার চেষ্টা করতেই খুসিনা এসে ঢুকলো। মুখটা বিকৃত করে শায়ের সরে গেল।
তাকে আবার আড়তে যেতে হবে। প্রতিদিন দুপুরে সে খাওয়ার জন্য আসবে। এই চুক্তিতে সে কাজে ঢুকেছে। এখন যাবে আবার আসবে সন্ধ্যার পর। বেশিক্ষণ থাকলো না শায়ের। দুপুরের খাবার শেষ করেই সে চলে গেল।
পরী পরবর্তী সময়টুকু শায়েরের জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষা করতে করতেই সন্ধ্যা নেমে এলো। ফুপু বাড়িতে নেই। অভ্যাস মতো সে পাশের বাড়িতে গেছে। দরজায় টোকা পড়তেই খুশি হলো পরী। দ্রুত দরজা খুলতে গিয়েও থেমে গেলো। শায়ের বলেছিল রাতে সে যদি না ফেরে তাহলে দরজায় আওয়াজ পেলেই যাতে সে দরজা না খোলে। তাই পরী থেমে গেলো। আগে জানা দরকার কে এসেছে?? তাই সে জিজ্ঞেস করলো,’কে??’