অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ৩৯

ঘটনার পেরিয়ে গেছে গোটা দূইদিন।আজ আইরার সাথে কথা বলতে গিয়েও আরহাম যারপরনায়ই আহত হলেন।অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘আইরা তুমি আমার বোন হও।তুমি বুঝবে,একটা মেয়ের সংসার ভাগ করতে কতটুক কষ্ট হয়।মনে আছে তোমার? মাহদিন ভাই শুধু ফান করে বলেছিল,সে মাসনা নিতে চায়।তুমি কি করেছিলে মনে আছে?আমাকে এসব বুঝাতে আসবে না।’

‘বুঝতে পারছি ভাইয়া।কিন্তু তিনি আবার যদি নিজের ক্ষতি করতে চান?কিছু একটা যদি ঘটে?তাহলে?ডোন্ট ফরগেট,তুমার একজন উত্তরাধিকারী আসছে।তার কথাও ভাবো। ‘

আইরাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আম্মুকে ফোন দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কানে তুলে আম্মু বললেন, ‘ওকে আর এসব বলো না।হাফসার সাথে কথা বলে না দুইদিন।মাইমুনার ঘরেও যায় না।’

‘কিন্তু….।’

‘থাক,যা হওয়ার হবে।’

******
সিটে মাথা হেলিয়ে হাতের দূই আঙ্গুল মাথায় চেপে চোখ বুজে আছেন তিনি।মাথার মধ্যে শতেক চিন্তার ভিড়ে মস্তিষ্ক নামক যন্ত্রটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।যার একমাএ উপসম উমায়ের।

কিন্তু উনার সাথে কথা বলতে গিয়ে,ফোনে ম্যাসেজ অথবা টেক্সট লিখতে গিয়েও চাপা একটা অভিমান বাঁধা দিয়ে বসে।উমায়েরের সম্মতিতে মস্তিষ্ক জ্বলেপুড়ে উঠছিল একদম।মাসনা হওয়ার কথা শুনে কি ভীষণ শকড খেয়েছিলেন প্রথম সাক্ষাতে।মাইমুনার করা আঘাতগুলোও সহ্য করেছেন।যেই তিনজনের এিভুজ সম্পর্কটা ঠিক হতে চলল,পুরনো অভিমান,রাগ,অভিযোগের নির্বাসন দিয়ে যখনই স্বস্তি পেলেন ঠিক তখনই ওই মেয়েটার পাগলামি।

******
দোয়াতে হাত তুলে মুখ মাসাহ করতে হাফসা বুঝলো,ওর হাত ভিজে জবজবে।চোখ গড়িয়ে পড়া পানিটুকু ঠোঁট বেয়ে পরতে মুখে নোনতা স্বাদ লাগে।রবের কাছে অভিযোগের কোনো সুযোগ রাখলো না সে।এই পরিবার টা যেমন মায়ায় টানে,তেমনি যত্ন করে কাঁদায়ও।যেই কান্না,আর গভীর রাতের একাকীত্বের বুক চাপা আর্তনাদ,সযত্নে লুকিয়ে রাখতে হয়।বুঝাতে হয়,ভালো আছি বেশ।

কিন্তু সেইদিন ডিনারে বসে আরহামকে আদওয়ার পছন্দসহ,বিয়ের প্রস্তাব শুনে তৈরী হওয়া ভয়টা ক্রমশ দখলদারিত্বের জায়গা করে নিচ্ছে।আদওয়ার নিজেকে আঘাতের বর্ননা চোখে ভাসতেই আরহামকে নিয়ে ভয় হয়।নাহলে কে চাইবে,নিজের একান্ত পৃথিবীটাকে ভাগ করতে!নিজের চোখের সুখ,মনের সুখ কে হারাতে চাইবে!

******
ডিনারে খেতে যেতে মন চাইলো না হাফসার।কাকামণির ফোনটাও তুলতে মন চাইলো না।আম্মু কিছুক্ষণ আগে ডেকে গেলেন।এখন নিচে না নামলে,আরহাম আসবেন।কথা না বললে,দেখা না করলেও ছোট্ট প্রাণটার যত্ন নিতে ভুলেন না।গত দূুইটা দিন,কখনো বা রাতের শেষে,কখনো সুবহ সাদিকের পরক্ষণে,কখনো দূপুরের ঘুৃমানোর সময় এসে তাঁর আবরনে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।ছোট্ট ছোট্ট চুমু খান।মনে মনে দূজনের কথোপকথন শেষ হলে চলে যান।

হাফসার ধারনাই ঠিক।কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, আরহাম আসছেন নিশ্চিত।হাফসা ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইলো একপাশে।

তিনি আসলেন।কয়েকবার ডাকলেন।উত্তর না পেয়ে আবার চলে গেলেন।খানিক পর আবার আসলেন হাতে খাবার নিয়ে।টি টেবিলটায় খাবার ঢেকে সোফায় বসে পড়লেন।

হাফসা আধো চোখ মেলে দেখলো,তিনি ফোনে ব্যস্ত।খাবার দেখে বুঝলো,লোকটা ঠিক ততক্ষণ এভাবেই বসে থাকবেন,যতক্ষণ না ওর ঘুম ভাঙ্গবে।ঘুম ভাঙ্গলে খেতে বলবেন অথবা খাইয়ে দিবেন,তারপর নিজে খেয়ে ঘুমাবেন।

গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে গেলো সে।আরহাম তীক্ষ্ণ নজরে তাকালেন।পানি এগিয়ে দিয়ে খাবার নিয়ে বসলেন ঠিক মুখোমুখি।হাফসা নিরসগলায় বলল,’খাবো না।’
‘কেন?’

‘ইচ্ছে নেই?’

‘তার হয়তো খিদে লেগেছে এতক্ষণে।একটু হলেও খেতে হবে।’

চুপচাপ খেয়ে নিলো হাফসা।উনি চলে যেতে জিজ্ঞেস করলো,’আপনি খেয়েছেন?’

তিনি পিছু ঘুরে মাথা নেড়ে না বুঝালেন।

‘আমার সাথে রাগ করে থাকবেন এখনও?’

‘রেগে নেই।’

‘তাহলে কথা কেন বলেন না?’

‘ঘুমাবে না।আসছি।’

তিনি ফিরলেন হাতে খাবার নিয়ে।হাফসাকে ইশারা করলেন খাইয়ে দিতে।’

খেতে খেতে বললেন, ‘আমি যে আপনার সাথে কম থেকেছি,কথাও হয়নি খুব বেশি।শেষরাতে ব্যথায় ছটফট করেছেন,আমি পাশে থাকি নি।খারাপ লাগেনি?’

হাফসা অকপটে উত্তর দিলো, ‘লেগেছে।’

‘আরো ইগনোর করলে আরও কষ্ট পেতেন?’

হাফসা মাথা নিচু করে নিলো।আরহাম দায়সারাভাবে বললেন, ‘এভাবেই কষ্ট পাবেন।যখন আমার আরেকটা দায়িত্ব যোগ হবে!’

‘কিন্তু সে তো….

‘বুঝানোর বেশি কিই করার আছে আমার?’

‘বিয়ে।’

মুখ ফসকে বেফাস কথা বলেই সাথে সাথে জিভ কেটে শুধরে বলল,’ন্ ন না মানে কিছু করার নেই।’

63★

মুখ ফসকে বেফাস কথা বলেই সাথে সাথে জিভ কেটে শুধরে বলল,’ন্ ন না মানে কিছু করার নেই।’

‘মাথায় যেটা ঘুরপাক খাচ্ছে সেটাই মুখে আসছে।’

আরহাম মন খারাপ করে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।হাফসা পাশে এগিয়ে জড়তা কাটিয়ে আরহামের বক্ষস্থলে মাথা রেখে বলল, ‘আপনাকে ভাগ করা খুব কষ্টের।কিন্তু যেহেতু আল্লাহপ্রদত্ত একটি আইন,আমি বাঁধা দিব না।সে যদি আপনার ভাগ্যে থাকে,তাহলে তো বিয়ে করতেই হবে।’

‘বাদ দিন এসব।এগুলো নিয়ে টেন্সড হওয়ার দরকার নেই।আমি চাই আপনার মন, শরীর সুস্থ থাকুক।’

‘আমিও তো চাই আপনি ভালো থাকুন।’

‘আমি ভালো আছি তো।’

‘মোটেও নেই।সবসময় চিন্তিত থাকেন, আগের মতো প্রাণোচ্ছল নয়।’

আরহাম মুচকি হেসে বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘বুঝেছি, সোনামণি সুস্থ ও খুশি থাকতে হলে সোনামণির আম্মু খুশি থাকতে হবে, আর সোনা মণির আম্মু খুশি থাকতে হলে সোনামণির আব্বুর খুশি থাকা লাগবে!তাইতো?’

লজ্জা পেয়ে এপ্রসঙ্গ এড়িয়ে হাফসা বলল, ‘এখানে ঘুমাবেন না?’

‘উহু।’

‘কার সাথে ঘুমাবেন।’

‘সোনামণির সাথে।’

‘ঠিকাছে ঠিকাছে, কিন্তু আমার পাশে আসা যাবে না।’

আরহাম অযু করে এসে লাইট নিভিয়ে হাফসার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন।হাফসা কিছুসময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দেখলো,আরহাম ঘুমিয়েই পড়েছেন।
সারাদিন ক্লান্তি শেষে,সবাইকে সময় দিয়ে,নিজেকে বিশ্রাম দেওয়ার সময়টুকু পান না তিনি।ওর চোখে ঘুম আসলো না।ভাবলো,তাদের প্রথম কথোপকথন।মানুষটা সেদিন নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছিলেন, কিছু না বলে প্রস্থান করায়!আরহামের শুভ্র মায়ামাখা মুখের আদলে,সেদিন কিছু অপ্রকাশিত দূ:খ চোখে লেগেছিল,আবার হুট কর সম্মতির কথা বলতেই জানালা থেকে লুকিয়ে, সেই দূ:খগুলো মুহুর্তেই কুয়াশার শিশির ফোঁটার মতো ঝরে যেতে দেখেছিলো!আনমনেই হেসে উঠে হাফসা!মাইকের আওয়াজে প্রথম শোনা তাঁর কন্ঠস্বর,হাফসার হৃদয়ে যেনো কেউ করাঘাত করেছিলো!কত পাগলামি,কত ছেলেমানুষী করেই আজ মানুষটা তাঁর।
সেদিন চিঠিটা পড়ে উনার কেমন অভিব্যক্তি হয়েছিল?হেসেছিলেন কী!জিজ্ঞেস করা হয়নি।করে নিবে কোনো এক সময়!

চোখে ঘুম আসতেই পাশ ফিরতে চাইলো,কিন্তু কোনো কিছুর সাথে নিজেকে জড়িয়ে থাকতে দেখে,মুচকি হেসে চোখ বুজে নিলো!

*****
মাইমুনার সকালটা কাটলো সুন্দর একটা ভালোলাগার মুহুর্তে ।নামাজ পড়েই অচেতনের মতো ঘুমিয়েছিলো সে।ঘুম ভাঙ্গতে অনুভব করলো,ওর পুরো মুখাদলে উষ্ণ স্পর্শ পড়ছে।নড়েচড়ে উঠতেই আরহাম উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বললেন, ‘আপনাকে ভীষণ রকম ভালোবাসি হানি।’

‘সকাল সকাল এত খুশি?’

‘আজকে আমার হানিকে প্রথম দেখেছিলাম সাড়ে তিন বছর আগে।চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিলো,ভেবেছি,এর চেয়ে অমায়িক সুন্দর কিছু থাকতে পারে না।আপনার ছবি দেখে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগতো,ভয়ও হতো।কখন জানি,আপনাকে কেউ তুলে নিয়ে যায়।তাই মাকে বলেই আগে আগে আক্বদ করে রাখছিলাম।’

‘এটা আপনার বুদ্ধি ছিল?’

‘হুমম।’

‘আর আর কি কি ভাবতেন আমাকে নিয়ে?’

‘অনেক কিছু।’

‘কিন্তু আমার এক্সিডেন্টে আপনি দূ:খ পেলেন?’

আরহাম মুখ কালো করে বললেন, ‘সাট আপ।কতদিন বলেছি,এই প্রসঙ্গ না তুলতে।’

মাইমুনা মুখ গোমরা করে বলল, ‘সরি।’

‘আমার তো কোনো আফসোস নেই হানি।যখন আপনার এক্সিডেন্টের খবর শুনেছি,খুব করে চেয়েছি,কোনোমতে আপনি লাইফ সাপোর্ট থেকে ফিরে আসুন।আপনি যে- অবস্থাই থাকুন,তবুও আমার আপনাকে চাই।আপনার যদি অসুস্থতা থেকেও থাকে আজীবন,আমার কোনো দূ:খ থাকবে না।কিন্তু আপনি ফিরে আসুন।’

মাইমুনা আবেগপ্রবন হয়ে উঠলো।বলল,’সত্যি?’

‘হুম।আপনার সাথে আমার কথা হয়নি আগে,সামনাসামনি দেখাও হয়নি।তবুও আপনাকে ভালোবাসতাম।’

মাইমুনা আরো গভীর আলিঙ্গন সমেত আরহামের বুকে পড়ে রইলো।

আরহাম ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আমার প্রতি আপনার কোনো ফিলিংস ছিল না তাই না?’

‘ছিল,কম।আর এক্সিডেন্টের পরে তো ভেবেই নিয়েছিলাম,আপনি অন্যকাউকে বিয়ে করে নিবেন।’

‘হ্যাঁ করলাম তো।’

‘সরি শাহ।’

‘খিদে লেগেছে?’

‘উহু।’

‘ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি চা বানিয়ে আনছি।ছাদে যাব।’

খানিক পর আরহামের কোলে চড়ে ছাদে যেতে খুশিতে চকমক করে উঠলো ওর চেহারা।আরহাম তাকে দোলনায় বসিয়ে মুচকি হেসে জিগ্গেস করলেন,’খুশি?’

১০১
তাজা বেলী ফুলের স্নিগ্ধ ঘ্রানে পুরো ছাদ মুখরিত।টি টেবিলটায় কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে।এরকম একটা মুহুর্তে আরহাম একগুচ্ছ গোলাপ এগিয়ে দিলে মাইমুনা খুশিতে খিলখিল করে হেসে উঠে।গোলাপের বুকে’র ভাঁজে ছোট্ট একটা চিরকুট।মাইমুনা হাতে নিয়ে দেখলো,তাতে সরু চেইনের একটা লাভ লকেট চকচক করছে।মাইমুনার হিজাব সরিয়ে আরহাম গলায় পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আপনার জন্য স্পেশাল না হলেও,আজকের দিনটা আমার জন্য স্পেশাল।মনে রাখার মতো।’

আরহাম এগিয়ে মাইমুনার গ্রীবায় ঠোঁট স্পর্শ করতেই সে মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেললো।আরহাম বুকের বা পাশ চেপে ধরে বললেন,

‘ইশ বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে৷’

‘হয়েছে আর বলতে হবে না।’

এককাপেই দূজনে চুমুক দিয়ে চা শেষ করে আরো কিছুক্ষণ সুন্দর সময় কাটালেন।সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশে এই দম্পতি আবারো অনুভব করলো,আজকের পৃথিবীর সেরা সুখী তারা!

******
বিকেল~
হঠাৎ ই রুমে আসলেন আরহাম।মাথার টুপি খুলে অস্থির চিত্তে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়।হাফসা একটা বই পড়ছিলো।আরহামকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি ঠিক আছেন?আপনার কি কিছু লাগবে?’

উনি দ্রুত উত্তর দিলেন। ‘ঠিক আছি। কিছু লাগবে না ‘

উত্তর শুনে শান্ত হলো হাফসা।আবারো বইপড়ায় মনোযোগী হলো।

কিছুক্ষণ পর আরহাম হঠাৎ ই প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার শরীর ভালো আছে?’

আচমকা উনার এহেন প্রশ্নে হাফসা অবাক হলেও উত্তর দিলো, ‘জ্বি।’

‘আপনার মন ভালো আছে? ‘

‘জ্বি।’

‘আমি কি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি?’

হাফসা বুঝলোনা উনি হঠাৎ এমন এমন প্রশ্ন কেন করছেন!তবুও বইয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল, ‘জ্বি না।’

‘আমি কি আপনাকে সন্তুষ্ট রেখেছি?’

হাফসা আবারো বইয়েই সব মনোযোগ রেখে বলল,’জ্বি না।’

পাঁচ মিনিট পর পৃষ্ঠা মার্ক করে বই রেখে উঠতে গেলেই দেখে আরহাম ছলছল চোখে ব্যাথিতদৃষ্টিতে ওর দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছেন।

হাফসা কাছে এসে দেখলো ও কি ভুল দেখেছে!আরহাম কে ভালোভাবে পরখ করে অস্থিরতা নিয়ে বলল, ‘শুনছেন!কি হয়েছে আপনার?চোখে পানি কেন?’

আরহাম বারবার পলক ফেলে চোখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন।হাফসার একটার পর একটা প্রশ্ন উপেক্ষা করে নিজেকে সামলে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন কি ভুল আমার!কেন অসন্তুষ্ট?ভুলগুলো ধরিয়ে দিন।আমি শুধরে নিবো।’

হাফসার ছোট্ট মস্তিষ্কে আরহামের কোনো কথাই বোধগম্য হলো না।ব্যস্তচিত্তে প্রশ্ন করলো,’কে অসন্তুষ্ট? কিসের ভুল?’

আরহাম দূর্বল কন্ঠে বললেন, ‘আপনিই তো আমার ওপর অসন্তুষ্ট।’

হাফসা অবাক হয়ে শুধালো, ‘কেন কেন?’

‘আমি জানি না।’

‘আমি আপনার প্রতি কেনো অসন্তুষ্ট হবো?’

‘আপনিই তো বললেন।’

‘আমি বলেছি??কখন?’

‘এইতো একটু আগে’

হাফসা মনে করার চেষ্টা করলো তবে ব্যর্থ হলো।আরহামের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে অনুতপ্ত হলো।মানুষটাকে শুধু শুধু কাঁদালো।মায়ামাখা কন্ঠে বলল, ‘আমি দূঃখিত।আমার বলার ভুল হবে নিশ্চয়ই।এর জন্যে আপনি কাঁদবেন?’

‘সত্যি টা বলুন।’

হাফসা মুচকি হেসে বলল, ‘এত সফট হার্টেড কেনো?আমি আপনার প্রতি সবদিকে সন্তুষ্ট।অসন্তুষ্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

আরহাম হাসিমুখে বললেন, ‘সত্যি তো?’

‘জ্বি সত্যি।’

আরহাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘একদম ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আমায়!বুকের ওপর যেনো পাথর চেপে বসেছিলো।’

‘আল্লাহর বিধানে এত ভয়?’

আরহাম উত্তর দিলেন না। উনার চেহারায় বোঝা গেল উনি কতটা দূর্বল হয়ে গিয়েছিলেন একটু আগে!

*****
বিকেলে দূইজনকে নিয়ে বাগানে বের হলেন আরহাম।অনেকদিন পর এমন মুহুর্ত।চারিপাশের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে করতে একসময় মাইমুনা বললেন,’আব্বুকে সারা সকাল এখানে বসে থাকতে দেখলাম।খুব দুশ্চিন্তায় দেখাচ্ছিলো।’

আরহাম চুপ হয়ে গেলেন।মাইমুনা আবারও বললেন, ‘এ সমস্যার সমাধান হোক শাহ।ভালো লাগছে না আর।’

‘কি সল্যুশন খুঁজবো?’

‘এমন কিছু যাতে ও শান্ত হয়,আমরাও শান্তিতে থাকি।’

মাইমুনার কথায় আরহাম খানিক ভেবে বললেন, ‘সি নীডস টু গো এ্যানি সাইক্রিয়াটিস্ট।’

আরহামের এমন উত্তরে হাফসা বলে, ‘তিনি অসুস্থ না।সুস্থ মাথায়ই এগুলো করছেন।’

‘সিওর?’

দূজনে সমস্বরে সম্মতি দিতেই আরহাম বললেন, ‘ওহ।তাহলে আমার যাওয়া দরকার?’

‘ফাইজলামি করছেন?একটুও সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না বিষয়টা।’

‘আমি কি করব।আপনারাই বলুন।’

‘বুঝিয়ে তো লাভ হয়নি।কপালে থাকলে বিয়ে করে নিন।’

দূজনের একই সমাধানে আরহাম রাগ করে চুপচাপ ঘরে চলে আসলেন।ড্রয়িংরুম পার হতেই আব্বুর আচানক ডাক শুনে আরহাম চমকে উঠেন।বাকি দূজনের দিকে স্থির চাহনি রেখে আব্বু আরহামকে ইশারায় কাছে ডাকলেন।ফোন কানে এগিয়ে দিলে আরহাম চুপচাপ কানে তুললেন।ওপাশ থেকে উৎকন্ঠিত কান্নামাখা আকুতি ভেসে আসলো, ‘আদওয়া দরজা বন্ধ করে আছে গতকাল রাত থেকে।অনেক ডেকেছি,খুলছে না।নিজের কোনো ক্ষতি করেনি তো আহনাফ।প্লিজ আমাকে কিছু বল।’

মাইমুনা আর হাফসার চোখের জোরাজুরি ইশারায় ফোন স্পিকারে দিলে,ওপাশ থেকে এমন কথা শুনে দূজনে ভয়ে জড়ো হয়ে পড়ে।

আরহাম খানিক চুপ থেকে বললেন, ‘ডাকুন উনাকে আবার?’

আরহামের কন্ঠশুনে লোকটির কান্নার বাকি ছিলো।পাশ থেকে আদওয়ার মা ফোন কানে তুলে বললেন, ‘বাবা তোমার কাছে হাতজোড় অনুরোধ,আমাদের মেয়েকে হারাতে চাই না।মেয়ের জীবনটা ভিক্ষা চাইছি তোমার কাছে।’

আরহাম চুপ হয়ে রইলেন।আম্মু একপাশে হা হুতাশ করতে করতে সোফায় বসে রইলেন।হাফসা কাছে এসে খুব করে অনুরোধ করলো,মেনে নিতে।তাদের হাতজোড় আগ্রাহ্য না করতে।

আম্মু কোনোসময় এ বিষয় নিয়ে মন্তব্য না করলেও এবার তিনিও অনুরোধ করলেন।আব্বুও দূর্বল চোখে অনুরোধ রাখলেন।আরহাম কিছু বলতে গিয়েও কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো উনার।

হাফসা খুব কাছ থেকে দেখলো,হাতে থাকা আরহামের ফোনটা কেমন তিরতির করে কাঁপছে।অসহায় চোখে চেয়ে আছেন হাফসার দিকে।তখুনি আচানক পুনরায় কান্নামাখা আওয়াজ শুনে হাফসা ফোন কানে নিয়ে বলল, ‘তাকে বের হতে বলুন।উনি মেনে নিয়েছেন আদওয়াকে।প্লিজ কোনো ক্ষতি যেনো না করেন উনার।’

******
পা থেমে যায় হাফসার।কান্নারা দলা পাকিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অন্তঃস্থলে উত্তাল ঝড়। লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে সব।সত্যই কি এই মানুষটাকে নিজমুখে ভাগ করে দিলো সে।

মাইমুনা চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গিয়েছেন।আব্বু-আম্মুও পাশে নেই।আরহাম এলোমেলো দৃষ্টি রেখে হাফসার পাশে এসে দাঁড়ালেন।সোফায় বসিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছেন?’

‘হুমম।’

‘খুশি এখন?’

আরহাম কাঠখোট্টা স্বরে প্রশ্নটি করে উত্তরের আশা করলেন না।চুপচাপ বসে রইলেন অন্যদিকে তাকিয়ে।হাফসা কিছু বলতে যাচ্ছিলো আব্বু ফোন এগিয়ে দিলেন।আরহাম আব্বুর দিকে জিগ্গাসাদৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোন তুলে রুক্ষস্বরে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে উৎকন্ঠিত কন্ঠে ভেসে আসে, ‘আপনি সত্যি আমায় মেনে নিয়েছেন?নিজের মুখে বলুন।বাবার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না।’

আরহাম নিরুত্তর চেয়ে রইলেন হাফসার দিকে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে কল কাটতে গেলে হাফসা বাঁধা দিয়ে বসে।অনুরোধ করে স্বীকার করতে।তিনি করলেন না বরং ফোন কেটে দিলেন।

কল কাটতেই পুনরায় লাগাতার রিং হতে শুরু করলো।সাথে টেক্সটও আসলো, ‘আপনি না বললে আমি দরজা খুলবো না।পয়জন আছে আমার রুমে।’

আরহাম এবার কিছুটা দমে গেলেন।হাফসার অনুরোধে লিখতে বাধ্য হলেন, ‘আমি আপনাকে বিয়ে করব।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।