হঠাৎ’ই মাইমুনা কেঁদে দিলেন।আরহাম তাকে আগলে নিয়ে বললেন, ‘হুয়াই আর ইউ ক্রায়িং হানি?’প্লিজ সে।’
‘হা্ হাফসা আমাকে কিচেনে আনিয়ে সব বাসনপাতি ধৌঁত করিয়েছে।চেয়ারে বসে থেকে থেকেই আমি সারা কিচেন ক্লিন করেছি, মুছেছি, ও যাস্ট ডিরেকশন দিয়েছে।’
রাগে আরহামের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
মাইমুনা আবার বলতে লাগলেন, ‘শুধু তাই নয়।দেখুন এতগুলো পেঁয়াজ, আমাকে হাত দিয়ে ব্ল্যান্ড করিয়ে নিয়েছে।সবকিছু আমি করেছি।পেঁয়াজ ব্ল্যান্ড করতেই হাত কেটেছে আমার।আমাকে এখানে একা রেখে ও রুমে চলে গিয়েছে।’
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
আরহাম নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলেন না।মাইমুনাকে কিচেনে রেখে বেরিয়ে যেতেই মাইমুনা পিছন ঘুরে বলে, ‘শাহ বাদ দিন না।কিছু বলবেন না ওকে।ছেড়ে দিন।ছোট মানুষ ভুল করে ফেলেছে।’
মাইমুনার মিথ্যে আকুতিতে আরহাম দমলেন না।এগিয়ে গেলেন হাফসার রুমের দিকে…..
17★
মাইমুনার মিথ্যে আকুতিতে আরহাম দমলেন না।এগিয়ে গেলেন হাফসার রুমের দিকে।
রুমে এসে দেখলেন হাফসা নামাজ পড়ছে। হিজাবের নিচ দিয়ে যখন হাতটা তুলে দোয়া করতে লাগলো তখন দেখা গেলো উনার হাতে সাদা ব্যান্ডেজ পেঁছানো, ব্যান্ডেজ পেরিয়ে ছোপ ছোপ রক্ত ভাসছে।এ চিএ দেখেই আরহাম দমে গেলেন।হাফসা জায়নামাজ থেকে উঠে কাবার্ডে গিয়ে হাতে কিছু একটা করছিলো।আরহাম নক করলেন না, পেছন থেকে এগিয়ে গেলেন।পাশে যেতেই ওর গুঙ্গিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতেই ভেতরটা ধ্বক করে উঠে।
রুমে আলাদা একটা সুগন্ধি যেটা শুধু আরহামের সান্নিধ্যে থাকলে পাওয়া যায়।এমন সুগন্ধির ঘ্রাণ পেয়ে পেছন ঘুরতেই কারো প্রশস্তবুকে মাথা ঠেকলো।হাফসা নিজেকে সামলে চোখ তুলে আরহামকে দেখতেই সরে যায়।হাত লুকিয়ে নেয় পেছনে।
তৎক্ষণাৎ উল্টো ঘুরে হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আবার সামনে ঘুরে বলে, ‘আ্ আ আপনি কখন এলেন?’
‘হাতে কি হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘তাহলে ব্যান্ডেজ কেন?’
‘অল্প একটু কেটেছে।’
‘দেখি সামনে আনুন।’
হাফসা আনলো না।আরহাম হাত এগিয়ে পেছন থেকে সামনে আনলেন হাতটি।কোমল হাতে গাঢ় চোট।
‘কীভাবে কেটেছে?’
হাফসা উত্তর দিতে পারলো না।উনার কন্ঠস্বর এত কঠিন কেন?
‘মাইমুনার সাথে যা করেছেন সেগুলো সত্যি?’
হাফসার বুক কেঁপে উঠলো।আপু কি আবারও এমন কিছু বলেছেন উনাকে?ভয়ে আঁতকে উঠলো সে।
‘মাইমুনার সাথে এমন কেন করেছেন আপনি?সি ইজ ড্যাম ইল। কীভাবে করতে পারলেন এমনটা?’
আরহামের শক্তকন্ঠে এরুপ কথা শুনে হাফসা বাকরুদ্ধ।
ও কি করেছে বুঝতেই পারছে না।
কাঁপা কন্ঠে বলল, ‘ক্ কি করেছি আমি?’
‘সেটা আপনিই ভালো জানেন।’
আরহাম অসন্তুষ্টি স্বরে বললেন, ‘ইউ নো হুয়াট আসার পর থেকে কী কী করছেন আপনি?আমি কিছু বলে গিয়েছিলাম আপনাকে।আপনি আমার কথা রাখতে পারেননি। হুয়াই?উনার সাথে আপনার জেলাসির কারন কি আমায় বলবেন একটু?এমন তো নয় যে আমি উনাকে বেশী প্রায়োরিটি দেই।আপনি আমাকে রীতিমতো অসন্তুষ্ট করছেন।আমি আপনাকে কীভাবে বুঝাবো?লাস্ট ওয়ার্নিং প্লিজ আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করবেন না উমায়ের।আমার এসব ভালো লাগে না।’
আরহাম একদমে কথাগুলো বলে ব্রেক নিলেন।উনার চোখে হাফসা নিজের জন্য বিতৃষ্ণা দেখতে পাচ্ছে। উনি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন।দরজা পর্যন্ত গিয়ে পেছন না ঘুরেই বললেন, ‘গো নাউ।আপনি গিয়ে এখন ক্ষমা চাইবেন উনার কাছে সমস্তকিছুর জন্য। উনার হাতে মেডিসিন লাগিয়ে আসবেন।’
বলেই আরহাম প্রস্থান করলেন।
হাফসা বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো।বুঝতে বাকি রইলো না মাইমুনা আরহামকে আমার প্রতি উষ্কিয়ে দিয়েছেন।বাট কেন?আপনি কেন আমার সাথে এমন করেন আপু?আমি এতিম বলে?আমি দূর্বল এজন্য আপনার বিরুদ্ধে যেতে পারি না তাই?আমি তো পারবও না আপনার বিরুদ্ধে যেতে।উনাকে কথা দিয়েছি।আম্মুকে কথা দিয়েছি।আপনি সুযোগগুলো লুফে নিচ্ছেন।উনার চোখে আমাকে খারাপ বানানোর জন্য এত মিথ্যা?
মাইমুনার কাছে গিয়ে আরহাম অনুতপ্ত সুরে বললেন, ‘আ’ম সরি ফর অল হার মিস্টেকস মাইমুনা।উনাকে নিয়ে আমার সিদ্ধান্ত কি ভুল হলো?আপনাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট পেতে হচ্ছে।এবারের মতো মাফ করে দিন উনাকে।আমি অনেক কঠিন কথা বলেছি।’
কথাগুলো বলা শেষ হতেই হাফসা দরজার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখলে আরহাম চলে যান।
মাইমুনা মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। হাফসা চুপচাপ গিয়ে উনার হাতটা ক্লিন করলো।দেখলো অল্প একটু কাটা তাও পুরনো। তাহলে এত রক্ত ঝরলো কোথা থেকে।তবুও চুপচাপ ব্যান্ডেজ করে নিচুস্বরে বলল, ‘আইএম সরি।আমাকে ক্ষমা করে দিন।একটা অনুরোধ আপু,আমি যদি ভুল করি একটু ধরিয়ে দিয়েন আমি শুধরে নিবো তবুও উনাকে…..
পুরো কথা না বলে থেমে গেলো।প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে আমার। ক্ষমা করে দিবেন প্লিজ। আপনার কিছু লাগবে?’
‘না, যাও তুমি।’
চলে আসার সময় মাইমুনা পেছন থেকে ধীরকন্ঠে বললেন, ‘শাহ এর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে।’
হাফসা বেরিয়ে এলো কোনো উত্তর না দিয়েই।এটা কেমন কথা।তাহলে আপনি কি উনার থেকে আমাকে দূরে রাখতেই এসব করছেন!
__________
বেশ কিছুক্ষণ পর….
হাফসার রুমে বসে বিরক্ত সময় পার করছিলো।তাই ছাদে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে।অমন সময় দেখলো আরহাম শার্টের হাত জড়াতে জড়াতে নিচে নামছেন।হাফসা তৎক্ষনাৎ ঘুরে নেমে যেতে শুরু করে।
উনি ওপরের সিঁড়ি থেকে ওকে দেখতে পেলেন।মাইমুনা করিডোরে একুরিয়াম দেখছিলেন।উনি শার্টের স্লিভ গোটাতে গোটাতে ড্রয়িংরুমে এসে বললেন, ‘ আমি বাইরে যাচ্ছি।ফিরতে লেট হবে।টেক কেয়ার।’
বলে চলে গেলেন।হাফসা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো অথচ ওর দিকে কেনো জানি ফিরেও তাকালেন না।
আরহাম যেতেই মাইমুনা হাফসাকে রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন।প্রায় ঘন্টাখানিক মাইমুনার সব কাপর ইস্ত্রী করিয়ে নিলেন হাফসার কাছ থেকে।আয়রন করতে গিয়ে হাতের কোণে আয়রন মেশিন লেগে বেশখানিক জায়গা পুড়ে গিয়েছে।রুমে এসে পোড়া জায়গায় মেডিসিন দিয়ে চোখ খিঁচে রইলো।না চাইতেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।আল্লাহ কি আমার পরিক্ষা নিচ্ছেন?আপনি তো জানেন রব আমি অধৈর্যশীল।আমাকে এমন কোনো পরিক্ষায় ফেলবেন না যেটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।আমি যে আপনার সবচেয়ে দূর্বল বান্দা।আমার ঠুনকে ঈমান আপনার পরিক্ষা নেওয়ার জন্য এখনো উপযুক্ত নয়।
পোড়া জায়গাটা অসম্ভব রকমের জ্বলছে।তবুও হেয়ালি না করে অযু করতে চলে গেলো।
ঘড়িতে যখন ১০ টার কাটা পেরোলো তখন মাএ কুরআন শেষ করে উঠলো হাফসা।মনটা ভীষণ খারাপ।বিকেলের বলা আরহামের কথাগুলো অবিরত কানে বাজছে।আর নেওয়া যাচ্ছে না।এ সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
ঘড়িতে চোখ পড়তে দেখলো ডিনারের টাইম হয়ে গিয়েছে। উনি এখনও ফিরেননি।কি জানি কোথায় ইফতার করেছেন।ভয়ের কারনে চেয়েও টেক্সট করতে পারে নি।ফোনটা এখনো হাতে নিয়ে বসে আছে কল দিবে বলে।তখনই শব্দ করে কল টিউন বেজে ওঠলো।হাফসার চোখমুখ চকচক করে উঠে।
(৩১)
কাকামণি ফোন করেছেন।
সালাম বিনিময় করে কিছুক্ষণ কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর কাকামণি জিজ্ঞেস করলেন,
‘কবে আসবে মামণি।অনেকদিন তো হয়ে গেলো।’
‘জানিনা।’
‘আরহাম কিছু বলেনি?’
‘সময় করে নিয়ে যাবেন বলেছেন।’
‘আমি কাল একবার আসবো।নিজে এসে দাওয়াত দিয়ে যাবো।’
‘ঠিক আছে আসুন।মামুণীকে নিয়ে আসবেন প্লিজ।’
কাকামণি হেসে বললেন, ‘তুমি আসো।সে তো আছেই।’
হাফসা আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় নিচ থেকে মাইমুনার উঁচু আওয়াজ শোনা গেলো,
‘হাফসা কোথায় তুমি?ডিনার রেডি করবে না?শাহ ওয়েট করছেন কখন থেকেই।’
হাফসা পরে কথা বলবে বলে ফোন কেটে নিচে গেলো।উনি আর মাইমুনা পাশাপাশি বসে আছেন সোফায়।হাফসা চুপচাপ কিচেনে চলে গিয়ে ওভেনে তাড়াতাড়ি তরকারি গরম করে সার্ভ করলো কাটা হাত দিয়েই।ডানহাত ব্যথাসহ জ্বলছে খুব।নরম আঙ্গুলের মাথাগুলো পেঁয়াজের মেশিন লেগে ছিলে গিয়েছে।হাতটা ওরনার নিচে লুকিয়ে রাখছে দৃষ্টিতে না পড়ার জন্য।আরহাম উঠে এলেন কিঁচেনে।তাকে রাখা তরকারি গুলো সার্ভ করতে তিনিও সাহায্য করলেন।
খাবার সার্ভ করে আম্মুকে ডাকলো।উনারা বসেছে পাশাপাশি। হাফসা ওদের খাবার সার্ভ করে বসেছে মুখোমুখি।
আরহাম উনার পাশের চেয়ার দেখিয়ে হাফসাকে বললেন, ‘এখানে আসুন।’
মাইমুনা সন্তোর্পণে বাধা দিয়ে বললেন, ‘থাক না।ও ওখানেই কম্ফোর্টএবল ফিল করছে।’
খেতে খেতে মাইমুনা বললেন, ‘আগের ওয়াক্তের আইটেম রয়ে গেলো।কত করে বললাম নতুন আইটেম রান্না করতে।সারাদিন রোযা রেখে আপনি ভালো কিছু খাবেন।বাট সে হাত কেটে বসে আছে।’
কথাগুলো মাইমুনা স্বাভাবিক ভাবে বললেও হাফসাকে আঘাত করলো ভীষণ।চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ।ঘনঘন পাপড়ি ফেলে আরহামের দিকে চোখ পড়তেই দেখে উনি তাকিয়ে আছেন।ও তাকাতেই চোখ সরিয়ে বললেন, ‘কাটা হাত নিয়ে রান্না করার দরকার নেই।পরেরবার ম্যাডকে বলবেন রান্না করতে।আর আমার এগুলো দিয়ে খেতে ভালো লাগছে।’
খাওয়া শেষ হতেই মাইমুনা বললেন, ‘শাহ।আপনি রুমে যান আমি একটু আসছি।
আরহাম কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে হাফসার দিকে তাকালেন। তারপর মাইমুনার রুমের দিকে চলে গেলেন।
উনি যেতেই মাইমুনা হাফসাকে বললেন, ‘শোনো বাসনগুলো কিচেনে নিয়ে যাও।এঁটো বাসনগুলো ক্লিন করে কিচেন পরিষ্কার করে ঘুমাতে যেও।নাহলে সকালে বেশী হয়ে যাবে।তুমি তো জানো বিনু আর কাজল আজকাল কাজে কত ফাঁকি দেয়।তাদের আশা করে লাভ নেই।’
হাফসা নীরবে সহ্য করে নিলো।ওর গলা পর্যন্ত কান্নাগুলো ভারী হয়ে আটকে আছে।আপু কি একটাবার চিন্তা করলেন না আমি কাটা হাত দিয়ে কীভাবে বাসনগুলো ক্লিন করবো?
মাইমুনা চলে গেলেন।হাফসা সবগুলো বাসন নিয়ে কিচেনে রাখলো।
প্রায় পনেরো মিনিট হলো কিচেনে মাথায় হাত চেপে আছে হাফসা।মাথার একপাশ ভীষণ ব্যথা করছে।পেঁয়াজ কাটার পর থেকেই ব্যাথাটা উঠেছিলো বেশী চোখ জ্বলার কারণে।ক্রমশ সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে যন্ত্রণায়।ছলছল চোখে সামনে থাকা বাসনগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কীভাবে ক্লিন করবে এগুলো।পোড়া হাতে পানি লাগলে যন্ত্রণা টা কলিজায় গিয়ে লাগে।
হাফসা উঠে পড়লো।হাত দিয়ে গালের পানিগুলো মুছে নিলো।আমাকেই তো ক্লিন করতে হবে।নাহলে উনাকে দিয়ে আবারো আমাকে হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করা কথা শোনাবেন।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে ভিমবার লাগাতে যাবে অমনি কেউ এসে বাঁধা দিয়ে বসলেন।ওর হাত থেকে গ্লাসটা রেখে দিয়ে সামনে দাঁড়ালেন আরহাম।ওর চোখ দেখেই উনি বুঝে গেলেন ও কান্না করেছে।
হাফসা হাত ছাড়িয়ে নিলো।স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘কোনো দরকার?কিছু লাগবে?’
‘নাহ।রুমে যান আপনি।এসব করতে হবে না।’
‘করব।আমি পারবো।আপনি যান।’
‘আমার কথার অবাধ্য হওয়া শিখে গেছেন?’
হাফসা কান্নারত সুরে বলল, ‘এগুলো না করলে যে আমাকে কথা শুনতে হবে।’
উনি থমকালেন ওর কান্নারত স্বর শুনে।চোখ থেকে পানি পড়তেই হাফসা মুছে নিলো দ্রুত।
আরহাম অবাক হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছেন?কে আপনাকে কথা শুনাবে?’
‘কিছু না।আপনি রুমে যান।আমি গ্লাভস পরে ধুয়ে নিতে পারব।’
উনি এবার বেশ জোর দিয়ে বললেন,’আপনি কেন এসব কাজ করবেন?এসব করার জন্য লোক আছে।প্রয়োজন ছাড়া কিচেনে আসবেন না।মাইন্ড ইট।এখন রুমে যান।’
হাফসা বুঝলো অবাধ্য হওয়া যাবে না।তাই চুপচাপ চলে গেলো।আরহাম ব্যথিত হচ্ছেন রীতিমতো ওর কান্নামাখা চেহারা দেখে।সামনে স্বাভাবিক হলেও ভেতরটা যে ছিড়ে ফেড়ে যাচ্ছে সেটা উনাকে বাইরে থেকে দেখে বুঝা দায়।আরহামের ভেতরে ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসছে।না পারছেন প্রকাশ করতে,না পারছেন হজম করতে।ওকে একবার স্পর্শ করতে গিয়েও পারলেন না।কপালে একটা স্পর্শ দিতে চেয়ে হঠাৎ’ই ডাকলেন, ‘উমায়ের!’
হাফসা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।ওর লাল লাল ফোলা চোখগুলোতে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট।আর কষ্ট তো আমিই দিয়েছি উনাকে।আরহাম চেয়েও পারলেন না অনেক কিছু!
কথা ঘুরিয়ে বললেন, ‘রুম চেক করবেন।বিড়াল থাকলে বের করে ঘুমাবেন।’
‘আচ্ছা।’
ক্ষীণসুরে উত্তরটা দিয়েই রুমের দিকে পা বাড়ালো।যাওয়ার সময় কিছু শব্দ শুনলো মাইমুনার রুম থেকে।ভেতর থেকে কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে।উনি তাহলে রুম বাইরে থেকে লক করে আসছেন?
18★
(৩২)
সময়টা বসন্তের শেষ দিক।বৈশাখ মাসের আগমন ঘটছে ধীরে ধীরে।সন্ধ্যার পরপরই বাতাস শুরু হয়েছিল।রাত প্রায় বারোটার দিকে হঠাৎ কোনোকিছুর তীব্র শব্দে ঘুম ভাঙ্গে হাফসার।জানালার পর্দা জোরে জোরে নড়ে ওঠছে।ভয়ে হাফসা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।আচানক শুরু হয় মেঘের তীব্র গর্জন,সাথে অঝরে বৃষ্টি।।হাফসা গুটিসুটি মেরে বিছানার এক কোণায় বসে পড়ে জড়োসড়ো হয়ে।মেঘের গর্জনে এর আগেও ওর প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে।প্যানিক রোগীরা মেঘের গর্জনে সবচেয়ে বেশী ভয় পায়।হঠাৎ আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে জোরে বিজলী দিতেই হাফসা থরথর কাঁপতে থাকে।বজ্রধ্বনি তার বেগে ক্রমাগত বাড়ছেই। হাফসা ভয়ে বিছানার কোণায় মাথা চেপে বসে আছে।এভাবে ঘড়ির কাটা পেরোলো ১২ টা থেকে ৩ টা। শেষরাতের ভয়ংকর বজ্রধ্বনিতে হাফসার প্যানিক এ্যাটাক হয়েছে।ফলে রাতেই অচেতন হয়ে পড়ে।
আরহাম রাতে কয়েকবার কল করেছেন ওকে ২ টার দিকে।হাফসা বুঝতে পারে নি।কারণ প্যানিক এ্যাটাক হলে রোগীর মাথা হালকা হওয়া বা অচেতন হওয়ার অনুভূতি হয়।স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী ঘাম হয়।হার্টবিট দ্রুত হয়,বুকে চাপ অনুভব করে।এ অবস্থায় স্বাভাবিক কোনোকিছুই তারা বুঝে উঠতে পারে না।হাফসা অধিকবেগে কাঁপছিলো।প্রচুর ঘামছিলো।গাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু হয়ে ঘাম ঝরেছে ঘামফোঁটা।অবশেষে বেশি ভয় পেয়ে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।
________
সকালে অবিরত করা দরজায় কড়াঘাতে পিটপিট করে চোখ তুলে তাকালো হাফসা।একটু নড়াচড়া করতেই সারা গায়ে জ্বর অনুভূত হলো।প্রতিটা পেশীতে পেশীতে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে।
হাফসা বুকে হাত দিয়ে দেখলো ওর গলা এখনো ভিজে রয়েছে। এতটাই ঘেমেছে ও!তবুও কষ্ট করে উঠে দরজা খুললো।
ওকে প্রায় বিধ্বস্ত, ভেজা মুখে চুল বসে গিয়েছে, ভীতি চেহারা,আর চোখমুখ লাল দেখে বিনু’ ধড়ফড়িয়ে রুমে ডুকলো।
‘আফা আমনে ঠিক আছেন তো?’
হাফসা বুঝলো না উনি কি বললেন।শুধু বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।
বিনু কিছু একটা গেস করে মাথায় হাত দিয়ে দেখেন তীব্র জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
‘আল্লাহ গো!আফা আমনের কি হইছে।আফনেরে তো আমার কাছে স্বাভাবিক লাগতাছে না।জ্বর আইছে কেমনে?চোখমুখের এ অবস্থা কেন?’
হাফসা তখনো কোনোকিছু পারলো না।বলা বাহুল্য ওর মস্তিষ্কে কাজ করছে না।সবকিছু শুনছে,কিন্তু বুঝতে পারছে না।
হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই হাফসা ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি এখানে কেন?আ্ আ্ আপনি?দেখেছি আপনাকে।ফযর আযান কখন হয়েছে? আমি নামাজ পড়িনি?’
বিনু হাফসার ব্যবহারে ব্যতিক্রমী বুঝে প্রশ্ন করে বসলো, ‘আফা হইছে টা কি আপনার?দাঁড়ান আমি ভাইসাব রে ডাইকা আনি।’
বিনু যখন হন্তদন্ত হয়ে সিড়ি নামতে থাকলো তখনই হাফসার মস্তিষ্ক নড়ে উঠলো।দ্রুতবেগে রুম থেকে বেরিয়ে ডাকলো, ‘শুনে যান না একটু!প্লিজ।’
বিনু আবার হন্তদন্ত হয়ে হাফসার কাছে গেলো।হাফসা নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলল, ‘না না।আপনি উনাকে কিছু বলবেন না।আমি একদম ঠিক আছি।’
‘কিন্তু……’
‘কিছু না।বেশী ঘুমিয়ে পড়েছি তাই আর কি।কেন আসছিলেন আপনি?’
‘মাইমুনা আফায় তো রাগ করবার লাগছে।ভাইসাব এহনো উঠেন নাই।মাইমুনা আফার লাগি নাস্তা রেডি করতে কইছে।’
‘আচ্ছা আমি ছাড়া কি কেউ নেই রান্নাঘরে কাজ করার?’ হাফসা ব্যথিতকন্ঠে কথাটা বলে উঠলো।
বিনু অসহায় মুখে বলল, ‘কি কমু আফা।আমি বুঝি কিন্তু কিছুই করার নাই।আমরা তো কামের মানুষ।মাইমুনা আফায় আমনেরে খুব কষ্ট দেয়,খুব খাটায়।’
হাফসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আপনি যান।আমি নামাজ পড়েই বেরোবো।’
‘আমনে খুব বালা আফা।কিন্তু এতো অত্যাছার সহ্য করতেছেন কীভাবে?’
হাফসা মলিন হেসে বলল, ‘আপনি আমার দূঃখ বুঝলেন বোন।অথচ যারা বুঝার তারা বুঝে না।’
বলে হাফসা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ডুকে পড়ে।
বিনু দাঁড়িয়ে ভাবছে আফায় কান্না আটকাইয়া কথাগুলো কইলেন?বাথরুমে গিয়া এহন কানবেন নিশ্চয়ই।আফা আমনে বালা দেইখাই আমনেরে এত কষ্ট দেয়।
*****
নামাজ শেষ করে দ্রুত এসে নাস্তা রেডি করে হাফসা।মাইমুনা কটাক্ষ মুখে এসে বসছেন নাস্তার টেবিলে।কেন এত লেট হলো এটাই উনার অভিযোগ।সব রেডি করে রাখতেই মাইমুনা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘এসব কি?এগুলো দিয়ে আমি নাস্তা করব?তুমি পারো টা কি হ্যাঁ?বাপের বাড়ি থেকে কাজ শিখে আসো নি?আমি এগুলো খাবো না।নাও খাও তুমি।’
বলেই স্যান্ডউইচের প্লেটটি ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলেন মাইমুনা।হাফসা চোখ খিঁচে নেয়।এ জায়গা থেকে রাস্তায় থাকলেও হয়তো সে শান্তি পাবে।কত তাড়াহুড়ো করে নাস্তা বানিয়েছে?উনি তো জিজ্ঞেস করলেন না আমি খেয়েছি কি না?কষ্টে আর রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেলো।ধনুকের চাইতেও ধারালো উনার কথাগুলো হজম করে নিয়েও পারলো না।
ধীরসুরে বলল, ‘সরি আপু।আমার লেট হয়ে গিয়েছে আজকে তাই আর কিছু মেইক করতে পারিনি।’
‘সাট আপ।হু আর ইউ টু আরগু উইথ মি?এ বাসায় কেউ আমার সাথে তর্ক করে না।তুমি এখানে আসার যোগ্যতা রাখো না।মা-বাবা তো নেই।তাই সঠিক শিক্ষা নিতে পারো নি।অবাধ্য আর হিংসুটে রয়ে গেছো।’
হাফসার চোখ ছলছল হয়ে উঠলো।ওর সবচেয়ে দূর্বল জায়গায়ই আঘাত করলেন মাইমুনা।রাগে, দূঃখে,কষ্টে মনে হলো আল্লাহ আপনি আমাকে এসব থেকে মুক্তি দিন।কোনো অভিযোগ থাকবে না আমার।এত তো ধৈর্যশক্তি নেই আমার যে এই কথাগুলো আমি সহ্য করব।কখনো অভিযোগ করিনি।কিন্তু আজ করছি, আপনি কেন?কেন আমার মা-বাবাকে কেড়ে নিয়েছেন?কেন আমাকে এতিম করেছেন?মানুষ কত নিচ ভাবে দেখে আমাকে?আপনি কি কিছুই দেখতে পাও না।আল্লাহ অনুগ্রহ করে আমাকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দিন আর উনাকেও হিদায়াত দিন।
কথাগুলো একমনে আওড়েই কান্না আটকানোর চেষ্টায় চুপচাপ রুমে ফিরে গেলো।
আরহাম বেরিয়ে এলেন।উনার মুখ কুঁচকে রয়েছে। এমনিই রাতে ঘুম হয়নি।এখন আবার চিল্লাপাল্লা!
বিছানা থেকে উঠে চোখ কুঁচকে এসে মাইমুনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?সকাল সকাল চেঁচামেচি কেন?এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।মেয়েদের স্বর এতো উঁচু কেন?’
মাইমুনা নরম সুরে কন্ঠ খাদে নামিয়ে কান্নারত সুরে বললেন, ‘চেঁচামেচি কে করেছে শুনেন নি আপনি?’
‘চেঁচামেচি শুনেছি কিন্তু কে করেছে?’
এবার মাইমুনা মিথ্যে চোখের পানি ঝরিয়ে বললেন…
নোট📌
(রাগের মাথায় আল্লাহর কাছে মৃত্যু চাওয়ার গুনাহ কারো আমলনামায় না হোক।এটা অনেক বড়ো গুনাহ।আর কখনো পূর্বের কোনো কিছু নিয়ে আফসোস বা প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত নয় আল্লাহকে।গল্পে আমি এমনটাই দিয়েছি হাফসার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গা বুঝাতে।অনুগ্রহ করে কেউ গল্প থেকে ভুল শিক্ষা নিবেন না।)
(📌গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।এটাকে বাস্তবের সাথে মিলাবেন না কেউ)