অগোচরে তুমি | পর্ব – ১০

রোশনি চমকে গিয়ে চটজলদি উঠে দাঁড়ায়। সামনে এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে পানির মধ্যে কি পড়লো।লেকের ধারে ফুল বিক্রি করছিল ছোট ছোট কয়েকটা ছেলে মেয়ে।মেহেনূর ওদের সাথে খুব খুশমেজাজে গল্প করছিল।কিন্তু হঠাৎ করেই পানিতে এমন ধড়াম করে শব্দ হওয়াতে ওউ চমকে উঠে।তাকিয়ে থেকে রোশনি লেকের একদম কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।তৎক্ষনাৎ হন্নে হয়ে ছুটে আসে মেহেনূর।উতলা কন্ঠে রোশনিকে বললো,
– ভাবী কি হয়েছে?
রোশনি নিজেও আশ্চর্য হয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর সামনেই ঘটনাটা ঘটলো কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সে টের পেলো না।মেহেনূরের প্রশ্নের প্রত্যুত্তর ও কিভাবে দিবে?রোশনির ভাবনার মধ্যেই পানির নিচ থেকে ভেসে উঠে অর্ক আর রাওনাফ।মেহেনূর রোশনি দুজনেই বেশ অবাক হয়।কিন্তু পর মুহূর্তেই রোশনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহেনূরের হাত ধরে ওখান থেকে নিয়ে চলে আসে।
ওখানে কি হলো?রোশনি ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?এইসবের কিছুই মেহেনূরের বোধগম্য হলো না।মেহেনূর বিস্মত কন্ঠে বললো,
– ভাবী ওরা পানিতে কি করছে?আর তুমি ওখান থেকে আমাকে নিয়ে চলে আসলে কেন?
প্রশ্নগুলো মেহেনূরের মনে আসবে এটাই স্বাভাবিক।ওর জায়গায় রোশনি থাকলেও হয়তো ওউ এই প্রশ্নটাই করতো।রোশনি একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বললো,
– অর্কের অগোচরে থাকা পনেরো বছরের পুরোনো কিন্তু সতেজ সত্যিটা আজ জেনে গেছে ও।তাই একটু ঝটকা তো লাগতেই পারে!যত রাগ,যত অভিমান,যত অভিযোগ আর যত দূরত্ব আছে সব গুছে যাক!ওদের নিজেদের মামলা নিজেরাই হ্যান্ডেল করুক না।শুধু শুধু ওদের মাঝখানে আমরা থেকে কি করবো?
মেহেনূর চুপ করে রইলো।অপরাধী না হয়েও দিনের পরে দিন ওর ভাইকে অপরাধের আগুনে ঝলসে যেতে দেখেছে ও।ওর ভাই নিঃসঙ্গতায় কাটিয়েছে অনেকগুলো বছর। তাই বলে ভাইয়ের প্রতি হওয়া অন্যায়ের জন্য অর্ককে প্রবলভাবে ঘৃণা করে নি ও।যতেষ্ট সম্মান আর শ্রদ্ধাই করেছে বরাবর।আজ যদি ভাইয়ের সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটিকে ফিরে পায় তবে ওর তাতে আপত্তি করার প্রশ্নই আসে না।মেহেনূর স্মিত হেসে পা বাড়ালো সামনের দিকে।ওকে অনুসরণ করে রোশনিও চললো পিছু পিছু।
লেক থেকে উঠে একটা বেঞ্চে এসে বসেছে অর্ক আর রাওনাফ।অর্ক রেগে গেলে চোখে অন্ধকার দেখে।কি করবে না করবে কোনো দিশ থাকে না।তখনও অর্ক রেগে গিয়েই রাওনাফকে কলার ধরে টেনে নিয়ে এসে লেকের পানিতে ঝাঁপ দেয়!থমথমে মুখে বসে আছে দুজনই।হুট করেই রাওনাফ শব্দ করে হেসে দেয়।রাওনাফের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায় অর্ক।রাওনাফ অর্ককে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখে হাসি রেখেই গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– মাথা ঠান্ডা হয়েছে?
মুখ ফিরিয়ে নেয় অর্ক।চাপা স্বরে বললো,
– পানিতে ঝাঁপ দিয়েও আগুন নেভাতে পারি নি!
প্রশস্ত কপাল কুচকে আসে রাওনাফের।মুখের হাসি মিলিয়ে যায় নিমিষেই।চাপা কষ্ট আর অদৃশ্য দাবানলে জ্বলে পুড়ে গেছে ওর হৃদয়টাও।চুপ করে রইলো রাওনাফ।অর্ক তেতে গিয়ে রাওনাফের কলার চেপে ধরে রক্তিম চোখে তাকিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
– এতদিন আমাকে বলিস নি কেন?
বিস্ফোরিত চোখে অর্কের দিকে রাওনাফ তাকিয়ে আছে।রাওনাফ ভেবেছিল অর্ক তখন মাথা গরম করে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পরেও হয়তো রাগ কমছিল না বলে রাগে ওকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেয়!কারণ এটা অর্কের রাগের বহিঃপ্রকাশ!ছোট বেলা থেকেই অর্ক রাওনাফের উপর রেগে গেলে এই কাজটা করে। আজকেও রেগে গিয়েই করেছে এটা তো শিওর কিন্তু কারণটা ভিন্ন!বুঝতে পারছে রাওনাফ। রাওনাফ একটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
– মানে?
অর্ক বাজখাঁই গলায় বললো,
– তোকে এত মহান হতে কে বলেছিল?আমি বলেছিলাম?
অর্কের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে রাওনাফ নির্বাক।বুঝতে পারছে অর্ক সব জেনে গেছে।তবে ওকে কে জানিয়েছে?মেহেনূর আর রোশনি ছাড়া তো এই সত্য আর কেউ জানে না।তবে কি রোশনি বলেছে?রাওনাফের কলার ছেড়ে দিয়ে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অর্ক।রাওনাফ থমকে গেছে।মস্তিষ্কের নিউরন গুলো বোধহয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।তবে হৃদপিণ্ডটা খুব দ্রুত লাফাচ্ছে।বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা করছে।চোখদুটো নিমিষেই ঘোলাটে হয়ে এসেছে।কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখলো অর্কের পিঠের উপর।অর্কের পরাণটা যেন হুহু করে উঠে।চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে রাওনাফের পিঠের মধ্যে।অর্ক ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,
– আমাকে সবটা বলিস নি কেন?
রাওনাফ অর্ককে সোজা করে দাঁড় করিয়ে চোখ মুছে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
– তখন বললেও কি তুই বিশ্বাস করতি? তুই যেটা দেখেছিস শুনেছিস সেটাই বিশ্বাস করেছিস।অবিশ্বাসের ঘা টা আর বাড়াতে চায় নি।তাই আর বলি নি!
অর্ক তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– অবিশ্বাস!ঠিকই বলেছিস!ওইদিন যদি তোর কথা শুনতাম,তোকে বিশ্বাস করতাম,তাহলে জীবনের পনেরোটা বছর এতটা বেরঙিন হতো না।এত বিষাদের কারণ হতো না!জীবনটা আরো রঙিন আরো প্রানবন্ত হতো!
রাওনাফ একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ধীর কন্ঠে বললো,
– দূরত্বের যে এত জ্বালা আগে জানলে মাটি কামড়ে তোর কাছেই পড়ে থাকতাম।হতাম একটু বেহায়া!তাতে কি,অন্তত চোখের দেখাটা তো দেখতে পারতাম।
রাওনাফ ওই ঘৃণ্য দিনগুলোকে আর মনে রাখতে চায় না।নতুন ভাবে নতুন রূপে আবার ওদের সোনালী দিনগুলোতে ফিরে যেতে চায়।অর্ককে এই টপিক থেকে বের করে আনতে বললো,
– যা হয়েছে হয়ে গেছে।তখন বয়স কম ছিল আবেগ ছিল বেশি।ভুলে যা সব।
ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে অর্কের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বললো,
– এখন বল তো রোশনিকে তোর কেমন লাগলো?
অর্ক একগাল হেঁসে বললো,
– খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে।খুব ভালোবাসে তোকে।তোকে খুব ভালো বুঝেও।আচ্ছা তুই ওকে কোথায় পেলি রে?
অর্কের জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি দেখে রাওনাফ মুখে বিরক্তির ছাপ ফেলে বললো,
– ডাস্টবিনে!
ভ্রু কুচকে আসে অর্কের।রাওনাফ গলার স্বর উঁচু করে কর্কশভাবে বললো,
– মেয়ে মানুষ কি রাস্তায় পড়ে থাকে যে গেলাম আর কুড়িয়ে নিয়ে আসলাম!
কথাটা শেষ করে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রাওনাফ।অর্ক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
– আরে ভাই তুই রাগ করছিস কেন।
– তো কি করবো?তুই এমনভাবে বললি যে মনে হয় আমি বোধহয় ওকে কুড়িয়েই পেয়েছি!
রাওনাফ মুখ ফুলিয়ে বলে কথাটা।অর্ক ফিক করে হেসে দেয়।রাওনাফ রাগী চোখে তাকাতেই হাসি থামিয়ে একটু সিরিয়াস মুখ করে বললো,
– ভাবীর সাথে তোর পরিচয় হয় কিভাবে?
এবার সন্তুষ্ট রাওনাফ।অর্কের কথার ভঙ্গি দেখে মুচকি হাসি দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– কানাডায় রোশনিদের বাড়ির অপজিটের বাড়িটাতেই আমরা থাকতাম।ওর বাবা মা অনেক আগেই কানাডায় সিটিজেনশীপ পেয়েছে।আমার হবু শ্বশুর ওইখানকার একটা টুরিজম ম্যানেজমেন্ট রিসোর্টের মালিক আর শাশুড়ি হাউজওয়াইফ।তাদের দুই সন্তানের মধ্যে রোশনিই বড় আর ওর ছোট এক ভাই আছে।ও মেহেনূরের সাথে পড়ে।দুজনের বাসা সামনা-সামনি হওয়া সত্ত্বেও আমি রোশনিকে কখনো দেখি নি।ইনফ্যাক্ট জানতামও না আমার বাসার সামনে কোনো অপ্সরা বাস করে।পড়াশোনা শেষ করে আমি যে কোম্পানিতে জয়েন করি রোশনিও ওই কোম্পানিতেই জব করতো।তখনই প্রথম পরিচয় হয়, কিন্তু কলিগ হিসেবেই।কথায় কথায় জানতে পারি আমাদের দুজনেরই বাসা একই এরিয়াতে।একদিন ওকে ড্রপ করতে গিয়ে আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম।খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় দুজনের। আস্তে আস্তে ওর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।অফিসে একসাথে যেতাম আসতাম।মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যেতাম দূরে কোথাও।আমার মনে হতে থাকে আমি ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছি ওর প্রতি।কিন্তু যার অতীতে ঘৃণ্য একটা ইতিহাস রয়েছে, মনের গহীনে লুক্কায়িত ঘা রয়েছে সে নিশ্চয় চাইবে না নতুন করে আর কোনো ঘা বাড়াতে।প্রেমের স্রোতের আবার গা ভাসাতে ভয় করতো।তাই নিজেকে ওর থেকে দূরে দূরেই রাখতাম।ইগ্নোর করতাম প্রতি পদে।হাল ছাড়ার মেয়ে রোশনি না।মেহেনূরের কাছ থেকে জেনে গিয়েছিল ওকে ইগ্নোর করার কারণ।আমাকে অবাক করে দিয়ে একদিন রোশনিই আমাকে প্রপোজ করে বসে।আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারি নি।কারণ ততদিনে আমিও ওকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম!কিন্তু তার থেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম এটা জেনে যে,রোশনি আমাকে আগে থেকেই চিনতো।অনেক আগে থেকেই আমাকে ভালোবাসতো।আমার বাহিরের গম্ভীরতা কঠোরতা দেখে ভয়ে কখনো সামনে আসে নি আর নিজের মনের কথা বলেও নি!পরিশেষে ভয়কে জয় করে তাহাতে আমাকে আসক্ত করে তবেই ছেড়েছে।
একনাগাড়ে বিরামহীন কথাগুলো বলে শেষ করেছে রাওনাফ।অর্ক শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রাওনাফের কথাই শুনছিল।দুজনের হুশ ফিরে মাগরিবের আজানের ধ্বনিতে।অর্ক স্মিত হেসে রাওনাফকে আবার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।রাওনাফও তাই করলো।শান্তি লাগছে খুব।পনেরোটা বছর পর একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে দুজনে।
পরনে থাকা ভেজা কাপড় নিয়েই দুই বন্ধু এতক্ষণ বসেছিল।ফলে ইতিমধ্যেই তার ইফেক্ট দুজনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।রাওনাফ অর্ক দুজনই হাঁচি দিতে দিতে চোখ মুখের বেহাল অবস্থা বানিয়ে ফেলেছে।মেহেনূর আর রোশনি ওদের অবস্থা দেখে শুধু মুখ টিপে হাসছে।ড্রাইভিং সিটে বসে আছে মেহেনূর।বাড়ি ফেরার পথে মেহেনূরই ড্রাইভ করছে।কারণ রাওনাফ আর অর্কের যে অবস্থা এই মুহূর্তে ওদের ড্রাইভ করতে দেওয়াটা একটু রিস্কই হয়ে যাবে। মেহেনূরও অনেক ভালো ড্রাইভ করে।মেহেনূরের বা পাশে বসে আছে রোশনি।পিছনের সিটে অর্ক আর রাওনাফ একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।